আমার মাকে দেখি সবসময় ভাবির সাথে রাগারাগি চিল্লাচিল্লি করতে। প্রচন্ড খুঁতখুঁতে স্বভাবের আমার মার চোখে শুধু ভাবির দোষটাই ধরা পড়ে, মেয়ের কিছুই দেখতে পায়না। ভাবির কোনো কাজই উনার পছন্দ হয়না। ছোটখাটো বিষয় নিয়েও চিল্লাচিল্লি করবে, এই এখনই ঘর ঝাড়ু দিয়েছে তবুও ওই কোনায় ময়লা রয়ে গেছে। আজকে ভাত নরম হইছে তো কালকে তরকারিতে লবণ বেশি হইছে, তেল বেশি হইছে। সারাদিন কি কাজ করে না করে, একটা কাজও ঠিকমতো করতে পারেনা। বাপের বাড়ি থেকে কিছুই শিখে আসেনি।
আমি যখন ফোনে কথা বলি,কথার ফাঁকে ফাঁকে ও শুনি ভাবিকে মা এটা সেটা বলছে। একদিন আমি মাকে বললাম, তুমি যে সারাদিন ভাবিকে এভাবে গালমন্দ করো, তার কি খারাপ লাগে না? সে কি মানুষ না?
মা আমাকে বলছে,
ও আচ্ছা তোর কাছেও বুঝি নালিশ করেছে তাই না? এভাবে ও ফাহিমের মাথাটাও খেয়েছে। আজকাল দেখি বউয়ের হয়ে উকালতি করে। আমার চাইতে ভাইয়ের বউ আপন হয়ে গেছে তাইনা!
আমি বুঝতে পারলাম উনাকে ফোনে বলে কিছু হবে না। সামনাসামনি বলতে হবে।
ভাইয়া ফাহিম আমার তিন বছরের বড়। ভাবিকে ভাইয়া ভালোবেসে পছন্দ করে একাই বিয়ে করে এনেছিল। ভাইয়া একটা কোম্পানিতে চাকরি করে, বেতন তুলনামূলক কম। তবুও ইচ্ছে করলে সে বউকে নিজের কাছে নিয়ে রাখতে পারে কিন্তু মায়ের মন রক্ষার্থে নেয় না, আর ভাবিও যেতে চায়না। কারণ ভাবি ছোটবেলায় মা হাঁরিয়েছে সৎ মায়ের কাছে অনাদরে অবহেলায় বড় হয়েছে। শাশুড়িকে সে নিজের মা বানাতে চায়, কিন্তু আমার মা সেরকমটা হবে বলে আশা করা যায় না।
ঈদের সময় বাচ্চাদের নিয়ে গেলাম বাড়িতে। আমি গেলে অবশ্য ভাবি খুব খুশি হয়। আমার বাচ্চাদেরও অনেক আদর করে। ভাইয়েরও সাত বছর বয়সী একটা ছেলে আছে রতন”। ভাবি আবার কনসিভ করেছে প্রায় সাত মাস চলছে।
অন্য সব বার গেলে ভাবি বিভিন্ন রকমের খাবার তৈরি করে দেয় বাচ্চাদের, বাচ্চারা তাতে খুব খুশি হয় কিন্তু এবার ভাবির শরীর দেখছি একবারে কঙ্কালের মতো হয়ে গেছে। বিছানা থেকেই উঠতে পারেনা। আর হবেই না বা কেন, কোন যত্নআত্তি নাই, খাওয়া-দাওয়া করলো কি না তা দেখার ইচ্ছে নাই কারো। এখন তো আবার কাজকর্ম ঠিক মতো করতে পারে না আরো গালমন্দ শুনতে হয়।
পরেরদিন সকাল এগারোটা বাঁজে। আমি ভাবির কাছে গিয়ে বসলাম, জিজ্ঞেস করছি শরীরের কি হাল বানিয়েছো তুমি? ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করো না নাকি? এর মধ্যেই মার হাকডাক শুরু হয়ে গেলো। এত্তো বেলা হইছে এখনো রান্নাবান্না যোগাড় শুরু করলোনা, কি এক পেটের ওসিলায় দিন-রাত চিত হয়ে থাকে। মনে হয় আমাগো তো আর পেট মেট হয়নাই!
আমরা পেট নিয়েই দুনিয়ার কাজকর্ম করছি।
তো জমিদারের বেটি কাজকর্ম করতে না পারলে তোমার বাপ রে খবর দাও আইসা তোমারে নিয়ে যাক। দেখলাম ভাবির চোখটা পানিতে টলমল করছে।
হঠাৎ করেই মেজাজটা খারাপ হয়ে গেলো আমার, অন্যায় যেই করুক সেটা তো আর মেনে নেয়া যায়না।
হোক সে নিজের মা। তাছাড়া মা যে আমাকে খুব একটা পছন্দ করে তাও না, পছন্দ করে আমার টাকাকে।
কারণ কাপড়চোপড় আর মাসের বাজারের খরচটা আমারই দিতে হয়,না হলে ওনাদের টানাপোড়ন লেগে যায়। সেজন্য উপরে উপরে হলেও মোটামুটিভাবে আমাকে একটু মানে।
রুমের থেকে বেরিয়ে এসে বললাম তুমি কি বললে মা? ভাবি বাপের বাড়ি যাবে, কেন? সারাবছর সে তোমাদের করে খাইয়েছে আর এখন তার যে শরীরের অবস্থা এই অবস্থায় সে বাপের বাড়ি যাবে! কেন তোমার বাড়িতে কি রান্না করার আর মানুষ নাই? তোমার মেয়েকে বলো রান্না করতে। নিজের মেয়ে নাতি খাইয়ে খাইয়ে হাতি বানাইতেছো আর পরের মেয়েকে সারাদিন গালমন্দ করো!
আমার বোন শীলা দুই ছেলে নিয়ে এই বাড়িতেই পড়ে থাকে। স্বামীর বাড়ি যায় না, কাজ করে খেতে হবে তাই। স্বামীর বাড়ি ভরা সংসার। তারা আবাদি জমিতে ফসল ফলিয়ে বাড়িতে আনে সেই ফসল বাড়ির মহিলারা কঠোর পরিশ্রম করে ঘরে তোলে। সেই কাজের ভয়ে শীলা এই বাড়িতে এসে পড়ে থাকে আর মায়ের সাথে সাথে ছড়ি ঘুরায়।
আমি শীলা কে রান্নার কথা বলাতে আমার উপরে মা-বোন ক্ষেপে গেল, কেন আমি ভাবির পক্ষপাতিত্ব করলাম!
ভাইয়া ফোন করেছে আগামীকাল বাড়িতে আসছে সে।
রাত দুইটা পর্যন্ত বসে থেকে মাকে বোঝালাম। ভাইয়া আসলে তুমি তার সামনে ভাবির সাথে অন্তত খারাপ ব্যবহারটা করোনা। তাতে সে মনে কষ্ট পায়।
তাছাড়া ভাবি তো খারাপ না। এই যে দেখ সারাদিন তুমি তাকে কতোকিছু বলো, সে কি কখনো কোনো কথার প্রতিউত্তর করেছে? করে না তো।
তাহলে তুমি তাকে তোমার মেয়েদের জায়গায় কেন বসাতে পারো না! ধরো আজকে যদি সেইম কষ্টটা আমার শশুর বাড়ি থেকে আমি পেতাম, তোমার কি ভালো লাগতো?
লাগতো না, কারণ আমি তোমার পেটের সন্তান।
ঈদের আগের দিন ভাইয়া আসলো। ভাবির শারীরিক অবস্থা দেখে তার মনটা খারাপ হয়ে গেলো। সেইটা ও কাউকে বুঝতে দিলো না।
ঈদের আগের দিন কুরবানীর গরু কিনে এনেছে। বাচ্চারা গরু নিয়ে আনন্দ করতেছে। একজন গরুর শিং ধরে টানছে তো আরেকজন লেজ নিয়ে নাচানাচি করছে।
এরমধ্যেই বোনের ছোট ছেলেটি কে গরু শিং দিয়ে গুঁতা মারে তখন রতন গরুর লেজ ধরে ছিল।
ওমনি শীলা যেয়ে রতনকে জোরে জোরে চার-পাঁচটা থাপ্পর মারলো, পোয়াতির বাচ্চা তুই লেজ ধরেছিস দেখে গরু আমার ছেলেকে গুঁতা মারছে।
পুকুর ঘাটে বসে ভাইয়া ওইটা খেয়াল করেছে তারপর এসে জিজ্ঞেস করলো তুই রতনকে মারলি কেন শীলা ও কি করেছে?
ওই পোয়াতির বাচ্চা লেজ ধরে টানাটানি করেছে বলে আমার ছেলেকে গরু গুতা দিয়েছে,তাই মেরেছি।
এই বেয়াদব পোয়াতির বাচ্চা কারে কয় রে?
তোর বউরে জিজ্ঞেস কর যা।
বলেছিস তুই বউকে কেন জিজ্ঞেস করবো বলেই ভাইয়াও ওকে এক থাপ্পর মেরে দেয়।
ব্যাস বাড়িতে লেগে গেলো তুলকালাম কাণ্ড।
সব ঝামেলাই মিটে যায়, যদি মা নিজের মেয়ের সাথে তাল না মিলিয়ে সমাধানের চেষ্টা করে। সেইটা না করে ওনি আরো উল্টো একই কথা বলে যাচ্ছে তার মেয়েকে কেন মারা হলো তার নাতি কেন পড়ে গেল!
একপর্যায়ে তুমুল ঝগড়া লেগে গেল।
ভাইয়া বললো যেখানে আমার স্ত্রী সন্তানের কোন মূল্য নাই, আমি তাদেরকে আর এক মুহূর্তও এখানে রাখবো না। ভাবিকে হুকুম করলো,এখনই তৈরী হয়ে নাও এই বাড়ি থেকে চলে যাব আমরা। ভাবে আসতে চাইছে না, কান্নাকাটি করছে। কিন্তু মা পুরোই নীরব ভূমিকা পালন করলো।
কিসের গরু কুরবানী আর কিসের ঈদ?
মা যখন বাঁধা দিচ্ছে না, তখন আমি আর বাঁধা দিয়ে কি করবো। বললাম ঠিকআছে আমার বাসায় চল তারপরে বাসা ঠিক করে ওদেরকে নিয়ে যাস। একটা প্রাইভেট কার ভাড়া করে আনলো ভাইয়া। তাদের সঙ্গে আমিও বাচ্চাদের নিয়ে রওনা হলাম।
আসার আগে মাকে কিছু কথা বললাম, যে
মা কখনো একতরফা বিচারক হয় না। আর আজকে যাকে অন্যায় ভাবে বাড়ি ছাড়তে বাধ্য করলে একদিন তার উপরই তোমার নির্ভরশীল হতে হবে,হতেই হবে। টাকা পয়সা খরচ করে, কষ্ট এসেছিলাম মার সাথে ঈদ করার জন্য। সেই ঈদ এভাবে মাটি হয়ে যাবে যানলে কোনদিনই আসতাম না।
মনে হলো মা আমার কথায় গুরুত্ব দিলো না। আসলেই যে জনম বাঁকা সে কোনদিন শোধরাবে না। শুধু শুধু বৃথা চেষ্টা করে কোন লাভ নেই।
দুই পর্বের গল্প আগামী পর্বে শেষ করবো।
#গল্প___ফিরতি উপহার পর্ব ১
#Rozina Rose