ফ্রিজ পর্ব ১৫ ও শেষ
আনোয়ার চাচার মেয়েটা আর বেঁচে নাই! আমার খুব খারাপ লাগছে! চিঠিটা রেখে ডায়রির পৃষ্ঠা উল্টাতে লাগলাম। এক পৃষ্ঠায় কিছু একটা লেখা। মনে হয় আনোয়ার চাচার লেখা।
কোনো বাবা একমাত্র মেয়ের এমন চিঠি পড়ে ঠিক থাকতে পারে না। আমার ইচ্ছে হয়েছিল পৃথিবী ছেড়ে চলে যাই।
আমার নতুন ব্যবসার জন্য বেশ ব্যস্তছিলাম। বাবা বাড়িটা রেখে গেছে। তাই থাকার জন্য চিন্তা করতে হয়নি। একটা পরিমান টাকা আমি আয়শার হাতে তুলে দিয়েই ভাবতাম আমার দায়িত্ব শেষ! আয়শা কে সময় দিতে পারিনি। আয়শা ঘর-সংসার দেখেছে আমি বাইরে ছুটে বেড়িয়েছি। হয়ত আরেকটু সময় ওদের দিতে পারতম। কেন যে দেয়নি!
মেয়েটা আসল সেও তো আয়াশার একারেই অবদান বলা যায়। কী বা করেছিলাম আমি মেয়েটার জন্য। নার্সিংহোমের বিল মিটানো আর মাঝেসাঝে এক নজর দেখে আসা ছাড়া।
অভিমান করে আয়শা চলে গেল! ওর এমন রোগছিল কোনোদিন বলেনি! আমিও কি কখনো আয়শা কে অভাবে খেয়াল করেছি? করিনি।
আয়শা মারা গেল একা বাড়িতে। মেয়েটার বয়স তখন কত দশ বার বছর হবে হয়ত। মেয়েটাও আমার সময় পায়নি। মায়ের থেকে পাওয়া অভিমানটা মেয়েও লালিত করে রাখল।
আয়শা মরার পরে তো আমি নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলাম। চেয়েছিলাম মেয়েটা কে আকড়ে ধরতে। পারিনি! সময় পেরিয়ে গেলে বোধহয় আর কিছুই করা যায় না!
মেয়েটা আর আমার কাছে এলো না! কত চেষ্টা করলাম কিন্তু আসল না। মামা বাড়িতে বড়ো হলো। মাঝে মাঝে দেখা করতে যেতাম। ও আমার সামনেই আসত না!
তবুও তো ভালো লাগত। মেয়েটা ভালো আছে। একদিন শুনলাম ও বিদেশে চলে যাবে। যাবার আগে একমুহূর্তের জন্য দেখা হয়েছিল। তেমন কথাই বলল না আমার সাথে। যাবার সময় বলল,” ভালো থেকো।”
এটাই যে ওর মুখে শেষ কথা হবে। কে জানত? ভেবেছিলাম বিদেশে গেলে পরিবর্তন হবে। না, আমার সাথে কোনো ধরনের যোগাযোগ করল না। ওর মামার কাছ থেকেই যা খবর টবর পেতাম।
হুট করে বছরখানিক এ চিঠি এলো। ছুটে গিয়েছিলাম সেই দেশে মেয়ের খোঁজে। মেয়ে আমার অনেক আগেই চলে গেছে ওর মায়ের কাছে না ফেরার দেশে! মেয়ের মুখখানা আর দেখা হলো না! সব কিছু শেষ হয়ে গেছে! কেন যে এমন করল জানি না!
জীবনটা শেষ করে দেয়ার একটা চিন্তা তো মাথায় এসেছিল। কী নিয়ে বেঁচে থাকব আমি? ওরা মা মেয়ে আমাকে যে শাস্তিটা দিলো। আমি কি এত বড়ো অপরাধ করেছি?
জানি না কেন মরার সাহসটা হলো না। ভাগ্যিস হয়নি। জানি প্রকৃতি মানুষ কে দ্বিতীয় সুযোগ দেয় না। কিন্তু আমাকে দিলো।
আমার চোখের পর্দায় মেয়ে দুটি ভেসে ওঠল। মনে হলো এই দুটি মেয়ে নিয়ে তো আমি ভালো থাকতে পারি।
ছোটো মেয়েটা প্রায়ই সময় আমার বাসায় আসে। বেশিরভাগ সময় আসে ফ্রিজে এটা-সেটা রাখতে। টুকটাক কথা বলে । আমার কী যে ভালো লাগে! আর মিলিটা তো চাচা বলতে পাগল।
আসলেই সুন্দর করে এক কাপ চা বানায়। খেতে কী ভালো লাগে! ওদের আমি বুঝতে দিই না। ওদের জন্য খুব বেশি কিছু করতে পারি না। ওর মা এ সব পছন্দ করেন না। কোনো কিছু নিতে চায় না!
ওদের নিয়ে আমার বড়ো পরিকল্পনা আছে। মেয়ে দুটির পাশে আমি থাকতে চাই। ওদের ভবিষ্যতটা ভালো করে দিতে চাই।
কয়েকটা পেজে কিছু লেখা নাই। এরপরে আবার লিখেছে। রুনুরা একটা ফ্রিজ কিনবে। অনেকদিন ধরে নাকি ওরা টাকা জমাচ্ছে। এ খবরটা শুনে আমার ভালো লাগার কথা। কেন জানি আমার ভালো লাগছে না! ভালো লাগছে না ঠিক না বরং খারাপ লাগছে বলা যায়!
আমার কী হয়েছে বুঝতে পারছি না। ওরা ফ্রিজ কিনলে আমার কী সমস্যা? কেন আমার এমন লাগছে! আমি ছোটো বাচ্চাদের মতো হয়ে গেছি? কেমন একটা শুন্যতা আমায় ঘীরে ধরছে। মনে হচ্ছে একটা গভীর তলায় আমি ডুবে যাচ্ছি।
আমি বুঝতে পারছি আমার মানসিক কোনো সমস্যা হয়েছে। একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সাথে পরামর্শ করা দরকার। কিন্তু আমার চিকিৎসা করাতে ইচ্ছে হচ্ছে না।
জানি তোমরা মা-মেয়ে হাসছ! আমার কিছু করার ছিল না। ভাবছ আমি তো এমনই করব? টাকা ছাড়া আমি কিছু চিনি না। তোমাদের ধারণা ঠিক না। আমি টাকার জন্য করিনি। কেন করেছি? আমি জানি না।
কী বিশ্বাস হচ্ছে আমার কথা? তোমরা জান? আমি আমার বাড়িটা মিলির নামে লিখে দিয়েছি। না, ওদের কিছু বলিনি। হয়ত বলব বা বলবোই না। কোনো একদিন ওরা জানবে। ওদের চোখের সামনেই আমি থাকব।
ছোটো মেয়েটার কী হবে? ওকে আমি ভালোবাসি না। কে বলল ওকে ভালোবাসি না। রুনুটা লেখাপড়ায় ভালো না। পড়াশোনা করতেও চায় না। কিন্তু রুনাটা খুব ভালো গান গায়। মাঝে মাঝে ছাদে একা একা গুন গুন করে গায়। কী মিঠা গলা মেয়েটার! আমি মেয়েটাকে গান শিখাব।
আমার বিশ্বাস ও একদিন অনেক বড়ো শিল্পী হবে। ওকে শিল্পী বানানোর জন্য যা করতে হয় সব আমি করব। আমার যা কিছু সব দিয়ে চেষ্টা করব।
অনেক সময় কেটে গেছে। চাচা যে কোনো সময় বেরিয়ে আসতে পারে। আমি ঘর থেকে বেরিয়ে আসলাম। আমার কেমন জানি লাগছে! ঠিক বুঝতে পারছি না। আপা কে কী বলব এ সব? না থাক কাউকে কিছু বলার দরকার নাই।
আপা কলেজ থেকে ফিরেছে। সারা দেগ ঘামে ভিজে গেছে। আমাকে দেখেই বলল, “কোথায় ছিলি!”
আমি আপার দিকে তাকিয়ে আছি। সাদা রংয়ের একটা শাড়ি পরেছে। কী সুন্দর লাগছে! তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে।
“কী হয়েছে রে রুনু?”
“কিছু হয়নি তো আপা। কী হবে বলো তো?”
“তোকে কেমন মনমরা লাগছে! মা বকা টকা দিয়েছে নাকি?”
“না তো।” আপা কে কী সব কিছু বলব? বলতে ইচ্ছে করছে না। থাক কী দরকার বলার। চলুক না যেমন চলছে।
“মা কী করে রুনু?”
“জানি না আপা।”
“আচ্ছা থাক। আমি একটু আনোয়ার চাচার বাসা থেকে ঘুরে আসি। এক কাপ কফি খেতে ইচ্ছে করছে। তুই যাবি?”
আমি কিছু বললাম না। আপা ঘরে থেকে বের হয়ে যাচ্ছে। আমার কোথায় যেতে ইচ্ছে করছে না। দুনিয়ার কিছু জিনিস জানতে হয় না। কিছু কথা গোপন থাকাই ভালো। জেনে যাওয়ার কারনে আমার সময়গুলো কেমন থমকে গেছে! না জানলেই বোধহয় ভালো হতো।
————-
শেষ
জীবনের গল্প কখনো শেষ হয় না। জীবন শেষ হলেও গল্প থেকে যায়। রুনুদের পরের জীবনটা কেমন হয়েছিল? রুনু কী সত্যি বড়ো শিল্পী হতে পেরেছিল। এমন কত-শত প্রশ্ন থেকেই যায়। এ সব প্রশ্ন থেকে আবার নতুন কোনো গল্প শুরু হবে।
® নাবিল মাহমুদ