বন্ধু পর্ব ২
অরুনের বউ তৃষ্ণার ইচ্ছে হচ্ছে ড্রইং রুমে যেয়ে শাহিন নামের মহিলাটার সাথে একটু কথা বলতে,উনি এত রাতে, কিভাবে, কি?ভেবে অন্য কারো বাসায় চলে এসেছে তা জানতে? ওনার যদি কোন সমস্যা হয়েই থাকে তা হলে তিনি তার নিকট আত্মীয়র বা পরিবারের কাছে যাবে এখানে আসবে কেন? আর অরুণের কাছে এই মহিলার নামও সে কখনো শোনে নাই, কোথা থেকে উদয় হলো এই মহিলা? আর এই মহিলাকে নিয়ে অরুনের বাড়াবাড়ি তার একদম ভালো লাগছে না। মনে হচ্ছে বিশাল ভিআইপি কেউ চলে এসেছে। মনে হচ্ছে হাসবেন্ডর সাথে মারামারি করে নাক ফাটিয়ে চলে এসেছে।
তৃষ্ণা মনে মনে বলল,এই মহিলাকে নিয়ে যদি কোন ঝামেলায় পড়ে অরুন, তবে সে অরুনকে তো কোন সাহায্য করবেই না উল্টো ওকে লটকাবে।
কিন্তু কোন একটা বিশেষ কারণে অরুণ, শাহিন নামের মহিলাটাকে আড়াল করতে চাইছে এবং কোন ভাবেই তৃষ্ণাকে শাহিনের সাথে কথা বলার কোন সুযোগ দিচ্ছেনা না। না বলে, এটা বলা ভালো তাঁকে আশেপাশে থাকতেও দিচ্ছে না। বারবার বেহায়ার মতো তো যাওয়া যায় না, একটু আগে অরুন ওদের বেডরুমে উঁকি দিয়ে বলে গেলো,
– তৃষ্ণা তুমি টি ভি দেখো, আর কিছু লাগলে আমাকে বলো।
তৃষ্ণা, ইচ্ছে করেই ওর রুমের দরজা খুলে রেখেছে, ওর রুম থেকে ডাইনিং দেখা যায়, অরুন কফি বানাচ্ছ। তৃষার মনে হলো একবার, তার রুম থেকে বের হয়, কিন্তু এভাবে বারবার বের হতে লজ্জা লাগছে। এমন সময় অরুন এসে তাঁকে বলল,
– তৃষ্ণা আমার বন্ধুরা আসবে, তোমাকে বের হতে হবে না, ওদের জন্য আমি কফি রেডি করে রেখেছি তুমি ঘুমিয়ে যাও।
– তুমি যাও আমি আসতেছি কফি খেতে। ভদ্রমহিলা কি মনে করবে এভাবে আমি রুমে বসে থাকলে?
– না, না শাহিন কিছু মনে করবে না, বরং তোমার সামনে ওর অসোয়াস্তি লাগতে পারে, দেখছো না ও একটু আপসেট হয়ে আছে। আমি তোমার জন্য রুমে কফি দিয়ে যাচ্ছি।
আবারও তৃষ্ণা আগুন চোখে অরুনের দিকে তাকালো।
অরুন দেখেও না দেখার ভান করলো, আর ভাবলো আচ্ছা তৃষার এত কৌতুল কেন? অরুন কোন ভাবেই চাচ্ছে না শাহিনের বিষয়টা সে জানার আগে তৃষ্ণা শাহিনের সাথে কথা বলুক। আসলে তার মনে একটা ভয় ঢুকে গেছে, মনে হচ্ছে শাহিন হয়তো ভয়ংকর কোন বিপদে পড়েছে অথবা বিপদ ঘটিয়েছে। এমনকি অরুন এখন পর্যন্ত এটাও শাহিনকে জিজ্ঞেস করতে পারে নাই, শাহিন ওর মোবাইল নম্বর ও বাসায় ঠিকানা কি ভাবে পেলো? শাহিন যতোই স্বাভাবিক আচরণ করার চেষ্টা করুক না কেন, ও যে প্রচন্ড রকমের টেনশনে আছে এটা অরুন বুঝতে পারছে। বন্ধুরা সবাই চলে আসলেও একটু ভরসা পেতো অরুন।
অরুণ যখন তাদের বেডরুমে এসে তার অন্য বন্ধুদের কল দিচ্ছিলো, তখন তৃষ্ণা মনে মনে বলছিলো, সবাই তো তার হাসবেন্ডর মতো নির্বোধ না যে এত রাতে একটা মহিলার কথা শুনে দৌড় দিবে বন্ধুর বাসায়! এখন তো আসলেই তার অবাক হওয়ার পালা, অরুনের সব বন্ধুরা এত রাতে ওর বাসায় চলে আসতেছে, তারমানে এই শাহিন তো আসলেই বিশাল গুরুত্বপূর্ণ তার হাসবেন্ড এবং তাদের সব বন্ধুদের জন্য। এই মহিলা আসার পর থেকে অরুণের আচরণ দেখে তো মনে হচ্ছে তৃষ্ণা এই বাড়ির মেহমান।
এখন দেখতে হবে রিফাত ভাইও এদের মতো ছুটে আসে কিনা, কারণ রিফাত ভাই ওদের বন্ধুদের মধ্যে যথেষ্ট পরিমানে বোধবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ। আর নেহা রিফাত ভাইকে কাঁচা খেয়ে ফেলবে এত রাতে বাসা থেকে বের হলে তাও আবার কোন এক মহিলার জন্য!
★★★
এদিকে জিয়া , বাবুকে কল দিয়ে যখন শাহিনের কথা বলছিলো, তখন মনে হয় বাবুর বউ সোহানা পাশে ছিলো, বাবু কেমন মিনমিন করে কথা বলছিলো, আর বারবার বলছিলো,
– অরুনের এত বড় বিপদ, তোরা সবাই যাচ্ছিস আর আমি আসবো না এটা কি করে ভাবলি? আমি নামতেছি, তুই আমাকে তুলে নিবি।
গাড়িতে উঠেই বাবু জিয়াকে বলল,
-দোস্ত একটা সিগারেট থাকলে দে, টেনশনে আমার মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে।
– কিসের টেনশন? সিগারেট দিবো মানে কি? তুই না গতমাসে সিগারেট ছেড়ে দিলি।
– ছেড়ে দিয়েছিলাম কিন্তু শাহিনের কথা শুনে মাথাটা কাজ করছে না, মাথা ঠান্ডা করার জন্য একটা সিগারেট লাগবেরে দোস্ত।
– গাড়ির ভেতরে সিগারেট খাওয়া যাবে না, অহনা মেরে ফেলবে।
– আরে স্প্রে করে ফেলবি, তোর বউ টের পাবে না।
– না, তারপরও টের পায় সেদিন আমাকে আঠারো মিনিট দরজার বাহিরে দাড় করিয়ে রেখেছিলো।
– শালা, আমাদের বউ গুলো যে কি ভাবে আমাদের জোগাড় করলো বুঝতে পারছি না।
– ভুল বললি,আমরা কোথা থেকে যে, এই অসন্ভব রকমের খন্ডানী মেয়ে গুলোকে খুঁজে খুঁজে বের করলাম আমরা হবে, এখন জীবন শেষ! দেখ আমাদের শাহিনও মেয়ে ছিলো! বাদ দে,তুই, সোহানার সামনে একবারও শাহিনের নাম না নিয়ে, কেন বারবার বলছিলি অরুনের বিপদের কথা?
– বেশি কথা বলবি না, আর শাহিনের কথা বললি কেন? শাহিনের সাথে পৃথীবির কোন মেয়েকে মিলাবি না। পৃথীর সব মেয়ে এক রকম, আর আমাদের শাহিন অন্য রকম! বাবুর গলা ধরে এলো তারপর নিজেকে সামলিয়ে বলল,
আমি যদি সোহানাকে হুট করে বলতাম, আমি এখন এত রাতে অরুনের বাসায় যাব শুধু মাত্র, আমাদের এক সময়ের জানি দোস্ত, না, মেয়ে বন্ধু শাহিন এসেছে, তার সাথে দেখা করতে । তা হলে ও কি বলতো? যাও, যাও মেয়ে বন্ধু বলে কথা, দেখা করে আসো?
-তা অবশ্য ঠিক
– তুই চিনিস না সোহানাকে, তখন সোহানা শুরু করতো,
তোমাকে কেন যেতে হবে অরুন ভাইয়ের বাসায়?উনি নিশ্চয়ই কোন প্রয়োজনে এসেছে। আর এত রাতে একটা ছেলের বাসায় হুট করে যে মেয়ে চলে আসে, তাকে তো সুবিধার মনে হচ্ছে না!
তখন কি হতো? আমার উকিল বউয়ের সাথে তুমুল তর্ক- বিতর্ক তার পর যুক্তি আমি হেরে যেতাম।
তখন আর তোর এক ডাকে,বাবু বের হ, আমি তোর বাসার নীচে আসতেছি, বললেও বের হতে পারতাম না।
আচ্ছা বাদ দে, এই সব ফালতু কথা এখন বলতো,
শাহিনের ঘটনা কি?অরুন কিছু বলেছে।
– না, ও কিছু জানে না, আর শাহিন নিজে আমাদের কল দিতে বলেছে অরুনকে, আমরা সবাই গেলে সবার সামনে শাহিন বলবে, ঘটনা কি?
– দূর, এত রাতেও রাস্তায় গাড়ির জ্যাম লাগছে কেন?
– চুপ করতো, আর পাঁচ মিনিট লাগবে তরুনের বাসায় পৌঁছাতে।
★★★
রিফাত, অরুনের মুখে, শাহিনের নাম শোনার পর থেকে যথেষ্ট পরিমানে চেষ্টা করছে স্বভাবিক থাকতে কিন্তু পারছে না। অরুনের কল কেটে দিয়ে, তাড়াতাড়ি করে বাসা থেকে বের হওয়ার জন্য রেডি হচ্ছে , রিফাত তার ভেতরে এক ধরনের কাঁপন অনুভব করছে, সে একটু নার্ভাস হয়ে গেছে। সত্যি শাহিন এসেছে অরুনের বাসায়? বুকের ভেতরটা এমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে কেন? সে তো কবেই ভুলে গেছে শাহিনকে। বুঝতে পারছে না নেহাকে কি বলে বের হবে?
রিফাত ওর বউ নেহা, রিফাতকে তার মেডিক্যাল ব্যাগ নিয়ে বের হতে দেখে জিজ্ঞেস করলো,
– আমি বুঝতে পারছি না, অরুণ ভাইয়ের বাসায় তোমাদের একজন বন্ধু এসেছে, সে কোন ভাবে হয়তো ব্যাথা পেয়েছে, তার জন্য তোমাকে এত রাতে অরুণ ভাইয়ের বাসায় যেতে হবে কেন? পাড়ার মোড়ের কোন ফর্মেসীতে নিয়ে গেলেই তো হয়। আর তোমাকে এত অস্হীর লাগছে কেন?
– নেহা, প্লীজ আমাকে এত প্রশ্ন করো না তো, এমন কোন রাত হয় নাই, মাত্র এগারোটা বাজে। আমাদের পুরাতন বন্ধু বিপদে পড়ে তরুনের বসায় এসেছে,আমি প্রথমে যেতে চাই নাই,, কিন্তু তরুন যখন বলল,শাহিনের নাক দিয়ে অঝোরে রক্ত পড়ছে বন্ধ হচ্ছে না, আমাকে অন্তত ডাক্তার হিসেবে যেতে, তখন তো যেতেই হয়।
– আমি তো ভাবতাম তরুন ভাইয়ের বোধ বুদ্ধি তোমার চাইতে ভালো, এখন তো দেখছি ওনার কান্ডজ্ঞান অনেক কম।
রিফাত গাড়ি ড্রাইভ করছে আর ভাবছে, শাহিনের বিয়ের আগের দিন রাতের কথা, সে দিন রাতে সে মরিয়া হয়ে গিয়েছিল শাহিনের সাথে দেখা করতে, এর পেছনে একটা-ই কারণ ছিলো, শাহিনের বাবা, শাহিনের বিয়ে এত গোপন ভাবে ঠিক করে ফেলেছিলো যে ওরা কেউ জানতেও পারে নাই, আর আংকেল যখন ওদের বাসায় দাওয়াত দিতে আসে তখন পরিস্কার ভাবে বলে যান, শাহিনের বিয়েতে বাড়ির মুরব্বিরা শুধু আমন্ত্রিত। তার মানে কোন ভাবে রিফাতরা যেন বিয়েতে না যায়। ঠিক একই ভাবে, জিয়া,অরুন,আর বাবুদের বাসায়ও দাওয়াত দেওয়া হয়েছিল। পরে জেনেছিল, শুধু মাত্র শাহিনের বন্ধুদের পরিবার গুলোতে এভাবে তিনি দাওয়াত দিয়েছিলেন।
শাহিনের বাবার ভয় ছিলো, শাহিন বিয়েতে যেহেতু রাজি ছিলো না, শাহিনকে হয়তো ওর বন্ধুরা ভেগে যেতে সাহায্য করবে। তাই কঠিন পাহাড়ায় শাহিনের বিয়ে হয়েছিল। হ্যা শেষ সময়ে রিফাত শাহিনদের বসার কাজের মহিলাকে হাত করে, শাহিনের সাথে রাত তিন টার সময় দেখা করতে পেরেছিলো, তখন ও কি করে নাই? শাহিনের পা ধরতেও বাকি রাখে নাই,রিফাত তো শাহিনকে বলেছিলো,
শাহিন তুই রেডি হয়ে থাকবি, আমি, জিয়া,অরুণ আর বাবু তোদের বাসার পেছনে অপেক্ষা করবো, তারপর তোকে নিয়ে চলে যাবো চিটাগং, কেউ আমাদের খুঁজে পাবে না, তারপর এক সময় সব কিছু ঠান্ডা হলে পনেরো বিশ দিন পরে ঢাকা চলে আসবো, ততদিনে তোর জন্য ঠিক করা ঐ পটকা মাছ নিশ্চয়ই দুবাই চলে যাবে,
কি আশ্চর্য, এই কথা শুনে শাহিন হঠাৎ করে ওকে জড়িয়ে ধরে সে কি কন্না, কান্নার ধমকে কথা বলতে পারছে না, এখনো, রিফাতের কানে শাহিনের বলা কথাটা বাজে তা হলো,
‘আমি, তোকে অনেক ভালোবাসি রিফাত’
সেদিনও রিফাতের পুরো শরীর কাঁপছিলো, কারণ শাহিনের বিয়ে ঠিক হওয়ার কথা শোনার পর থেকে ওর বুকে অসম্ভব ব্যথা অনুভব করছিলো, তারপর সে এক সময় আবিষ্কার করে, সে তাদের বন্ধু শাহিনকে বন্ধু হিসাবে না, অন্য রকম ভালোবাসে, যদিও তারা চার বন্ধু একবার প্রমিজ করেছিলো, ওরা কখনো ভুলেও কেউ, শাহিনের প্রেমে পড়বে না। তা হলে ওরা হেরে যাবে, ওরা সব সময় একটা কথা বলতো, ওরা পাঁচজন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বন্ধু, আর শাহিন ওদের কোন মেয়ে বন্ধু না ওরা শুধু বন্ধু, ।শাহিনের জন্য ওরা জীবন দিতে পারবে।
না তারা সেদিন তাদের বন্ধু শাহিনেরকে নিয়ে ভাগতে পারে নাই, কারণ শাহিনের বাবা কিভাবে জানি টের পেয়ে গিয়েছিল, তারপর শাহিনকে কঠিন পাহাড়ায় রাখা হয়েছিল। হিন্দি সিনেমায় বিয়ের দিন কত পাত্রি অন্য কাউকে বউয়ের জায়গায় বসিয়ে ভেগে যায়, বাস্তবে তা সম্ভব হয় না। তারা-ও পারে নাই শাহিনকে নিয়ে ভাগতে, তবে শাহিনের বিয়ের দাওয়াত তাদের জোর করে খাওয়ানো হয়েছিল এবং তাদের চোখে চোখেও রাখাও হয়েছিল সেদিন।
রিফাতের ভাবনার মধ্যে কখন যে অরুনের বাড়ির সামনে চলে এসেছে তা ও টেরও পায় নাই। বাবু আর জিয়া অরুনের বাসার সামনে দাড়িয়ে সিগারেট টানছে ওরা ওকে দেখে ডাক দেয়। আর বলে,
-রিফাত তোর জন্য অপেক্ষা করছিলাম। চল উপরে যাই।
ডোর বেল মনে হয় বাজলো কি বাজলো না, সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে দিলো অরুন। ও মনে হয় শুধু ওদের অপেক্ষাতেই ছিলো।
জিয়া প্রথমে বলল,
– শাহিন কোথায়?
অরুন ড্রইং রুমের দিকে ইশারা করলো
শাহিন একটা সোফায় পা তুলে গুটিশুটি হয়ে বসে আছে হাতে কফির মগ।
সব বন্ধুদের একসাথে দেখে শাহিনের চোখে পানি চলে এসেছে।
সব বন্ধু একসাথে শাহিনের সামনে গিয়ে দাড়ালো।শাহিন ওর হাতটা বন্ধুদের দিকে বাড়িয়ে দিয়েছে, সবাই একে একে শাহিনের হাতটা আলতো করে ছুঁয়ে দিচ্ছে সবার মনের মধ্যে একধরনের কাঁপন অনুভব করছে, আর মনে হচ্ছে শাহিনকে জড়িয়ে ধরতে, কিন্তু সেটা তো সন্ভব না।
শাহিন এতক্ষন ওর আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করে রেখেছিলো, কিন্তু এখন ওর চোখের পানি ধরে রাখা কঠিন হয়ে গেছে, এত রাতে শুধু মাত্র ওর খবর শোনার সঙ্গে সঙ্গে ওর বন্ধুরা সবাই ছুটে এসেছে, যাদের সাথে গত পনেরো বছরে তার একবারের জন্যও কোন রকম যোগাযোগ হয় নাই।
শাহিনের মনের মধ্যে এখন একটা আলাদা ভয় কাজ করছে, কেন ও আসলো এত বছর পরে বন্ধুদের শান্তির জীবন নষ্ট করতে।
#চলবে
#লেখাঃসুরাইয়া_শারমিন