#ঘেউলের সংসার
পর্ব ২
তার ঠিক এক মাস পর আমাদের বাড়িতে আরেকটা কাজের মেয়ে এলো। মেয়েটার বয়সও আগের মেয়েগুলোর সমান। নাম জুঁই। মা মেয়েটাকে বুঝিয়ে দিলেন তারা বাড়িতে না থাকলে কিভাবে আমার খেয়াল রাখতে হবে। আমি যে কথা বলতে পারি না এটা শুনে মেয়েটার মুখে মায়া ভর করলো দেখলাম। মেয়েটা বেশ হাসি-খুশি , আমাকে ভাইয়া বলে ডাকতে লাগলো। দিনের বেশির ভাগ সময় বাবা-মা বাড়ির বাইরে থাকতেন। ফিরতেন রাতে। মেয়েটা সারাদিন আমার সঙ্গে কথা বলে যায় । কথাগুলো আমার এত ভালো লাগে! ইচ্ছা করে তার সঙ্গে হেসে হেসে কথা বলি। কিন্তু অদৃশ্য কন্ঠস্বরটার সতর্কবাণী আমাকে বাধা দেয়। কিছুতেই কাউকে জানানো যাবে না যে আমি বোবা নই! একই ঘরে আমরা ঘুমাই।
একরাতে জুঁই নীচে বিছানা করে ঘুমিয়ে আছে। আমি অপলক দৃষ্টিতে তার ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। এমন সময় ঘরের দরজা ঠেলে ঢুকল কেউ। বাবা! আমি জড়সড় হয়ে উঠে বসলাম। বাবার মুখে মুচকি হাসি লেগে রয়েছে। এমনটা এর আগে আমি দেখিনি। তিনি আমার কাছে এসে বসলেন। আলতো করে ডান হাতটা ধরে বললেন, ‘ভয় পেও না খোকা! কেমন আছ তুমি?’
আমি ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তার মুখের দিকে চেয়ে রইলাম, এমনটা তিনি কখনো করেন না। দরজার দিকে তাকাতে দেখলাম মাও সেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তার মুখে চিরো চেনা সেই মায়াবী হাসি। তারা কী চায় এত রাতে! বাবা আমার মাথায় আলতো করে হাত বোলালেন, ‘খোকা, তোমাকে এতদিন এই পৃথিবীর সৌন্দর্য্য আর বীভৎসতা থেকে আমরা বাঁচিয়ে রেখেছি। ৯ বছর পূর্ণ হলো তোমার বয়স আজ রাতে, অথচ এই বাড়ির বাইরের দুনিয়া সম্পর্কে তুমি কিছুই জানো না। আমাদের ইচ্ছা তোমাকে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দেব এখন থেকে আমরা। শীঘ্রই আমরা এই বাড়ি বদল করে নতুন বাড়িতে উঠব। সেখানে দেখবে আমরা তোমার কেমন ভালো বাবা আর মা হই! তুমি স্কুলে যাবে, তোমার বন্ধু হবে, সবার সাথে মিশবে তুমি। তুমি কী আমাদের সাথে যেতে রাজি আছ?’
আনন্দে আমার চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বাবা এত সুন্দর করে কথা বলছে আমার সাথে! ইচ্ছা করছে চেঁচিয়ে বলি, ‘আমি যাব বাবা!’ কিন্তু সেই অদৃশ্য নারী কন্ঠস্বরটা আমার কানের কাছে এসে বলল, ‘ না করে দাও খোকা, এই বাড়ি থেকে তুমি বের হলে ওরা তোমাকে মেরে ফেলবে। কেউ তোমাকে সাহায্য করতে পারবে না!’ মুহূর্তে মুখ আমার শুকিয়ে গেল। আমি ডানে-বামে মাথা ঘুরিয়ে জানালাম আমি অন্য কোথাও যাব না। বাবার মুখের হাসি মুহূর্তেই উবে গেল। সেখানে স্থান নিল চিরচেনা ক্রুদ্ধ রুপ, রাগে কাঁপছেন তিনি। মায়ের দিকে ঘুরে চেঁচিয়ে বললেন, ‘আমি তোমায় আগেই বলেছিলাম ও এখনো এই বাড়ি ছেড়ে যায়নি! তোমার ছেলের সাথেই আছে ও। ওকে নানান বদ মতলব দিয়ে যাচ্ছে এতদিন ধরে। ওই ওকে শিখিয়ে দিচ্ছে বাড়ি ছেড়ে না যেতে। ও কী করে এখনো এই বাড়িতে থেকে গেল! বোকা মেয়ে!’
আমি ভয়ে কুঁচকে গেলাম। মা অসহায় দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন। বাবা আমাকে উঁচু করে তুলে ঘরের এক দিকে ছুড়ে মারলেন। আমি উউউ করে গুঙিয়ে উঠলাম। একটা হাত আমার শরীরের নীচে চাপা পড়ে মচকে গেল আর মাথাটা মেঝেতে ঠুকে রক্ত ঝরতে লাগলো। প্রচণ্ড যন্ত্রনায় চারপাশে শুধু অন্ধকার দেখলাম। এরপর আর কিছু মনে নেই।
যখন চোখ খুললাম তখন আমার হাত ব্যান্ডেজ করে বাধা, হাতটা আড়াআড়িভাবে সেটে আছে বুকের সাথে। মচকে গেছে। মাথায়ও ব্যান্ডেজ বাধা। একটু নড়তে গিয়েই ব্যাথায় গুঙিয়ে উঠলাম। কাজের মেয়েটিকে দেখলাম আমার পাশে বসে আছে। কাঁদো কাঁদো মুখ। চোখ মেলেছি দেখেই আমার কপালে মুখে আলতো করে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে বলল, ‘কিছু হয় নাই ভাইয়া সব ঠিক হয়ে যাবে, বাবার কথা সব সময় শুনে চলবে!’ আমি আবার চোখ বন্ধ করে ফেললাম।
পুরোপুরি সেরে উঠতে আমার মাস খানিক সময় লাগলো। এতদিনে একটুও খারাপ লাগা কাজ করেনি শুধু জুঁই এর জন্য। সে এক মুহূর্ত আমাকে ছেড়ে কোথাও যায় না। যাওয়ার জায়গাও অবশ্য নেই! তবুও বাড়িটা বেশ বড়। সারাদিন নিজের সম্পর্কে গল্প করে যায় সে। সে তার বাবা-মা কে অনেক ছোটবেলায় হারায় । এরপর অন্যের বাড়িতে বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে শৈশব কাটে। কৈশোরে পা পড়তেই এক লোক ওকে চাকরি খুঁজে দেয়ার কথা বলে। কাউকে না জানিয়েই সে লোকটার সাথে এই শহরে চলে আসে। লোকটার কাছ থেকে আমার বাবা-মা ওকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে আসে এরপর। এখানে সে আনন্দেই আছে। পুরো বাড়িতে ওকে যা ইচ্ছা করার স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে, যা খুশি সে রান্না করতে পারবে, যা ইচ্ছা খেতে পারবে।
প্রায়ই নতুন পোশাক পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে যায়। শুধু একটাই শর্ত এই বাড়ি থেকে বের হওয়া যাবে না। জুঁইয়ের তেমন ইচ্ছা আছে বলেও মনে হয় না। ওর বয়স কত হবে! ১৩-১৪!
আমি নিজের বাবা-মাকে বুদ্ধি হওয়ার পর থেকেই ভয় করে চলি। অদৃশ্য সেই কণ্ঠস্বরের কথাগুলো বিশ্বাস করে বাবা-মাকে ভয় করার অন্যতম কারণ হচ্ছে আমি লুকিয়ে অনেকবার তাদের দুজনের কথা শুনেছি। প্রথম প্রথম তাদের কথার অর্থ না বুঝলেও যখন বুঝতে শুরু করেছি তখন শিউরে উঠতাম। মায়ের কোমল চেহারার পেছনে যে এক পিশাচি আছে তা আমার বিশ্বাস হয়ে যায়। আর বাবার চেহারাটাই আমার কাছে আতঙ্কের আরেক রুপ ছিল।
মাঝেমধ্যে সন্ধ্যা বেলায় বাবা বাড়িতে ঢুকেন হাঁপাতে হাঁপাতে। উত্তেজনায় তার শরীর কেঁপে কেঁপে উঠে। চোখ-মুখ উজ্জ্বল। আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমাকে আর জুঁইকে টেনে এনে। আমাদের শোবার ঘরের ভেতর রেখে দরজা বাইরে থেকে বন্ধ করে দেন। আমরা দুজনেই প্রতিবাদহীন ভাবে চুপিসারে বসে থাকি।
ঘরের সব আলো তখন বন্ধ হয়ে যায়। দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালে শোনা যায় বাবা আর মায়ের চিৎকার চেঁচামেচির শব্দ। একবার মনে হয় তারা ঝগড়া করছেন, আবার মনে হয় দুজনেই আনন্দে চিৎকার করে হাসাহাসি করছে, হঠাৎ মনে হয় কোনো একজনের গোঙানির শব্দ কানে আসছে, ওরা যেন কিছু খাচ্ছে। হাড় চিবানোর শব্দ। ভয়ে ভয়ে আমি জুঁইয়ের পাশে গিয়ে বসি। শক্ত করে ওর শরীর চেপে বসে থাকি। অন্ধকারে ওর মুখ দেখা যায় না। সেও আমার মতো ভয় পাচ্ছে কিনা বুঝতে পারি না। এরপর এক সময় দুজনেই ঘুমিয়ে যাই।
দিন, সপ্তাহ, মাস যত কাটতে থাকে তত জুঁইয়ের চঞ্চলতা কমতে থাকে। তাকে কেমন উদাস দেখায়। কম কথা বলে। আমি অনুমান করতাম বন্ধি জীবন আর তার ভালো লাগছে না। তার জন্য আমার খুব মায়া হতো। এর আগে যতগুলো মেয়ে এই বাসায় থাকতো সবাইকেই আমি পছন্দ করতাম। তাদের হঠাৎ চলে যাওয়ায় কষ্ট পেয়েছিলাম। এবং শেষে তাদের কী পরিণতি হয়েছে জানতে পেরে বড় একটা মানসিক ধাক্কা পেয়েছি। জুঁইয়ের সাথেও তাই ঘটবে!কেন যেন মনে হচ্ছে এই মেয়েটাকে হারালে আমি আমার নিঃসঙ্গ জীবনে আর কোনো বন্ধু পাবো না।
অদৃশ্য সেই নারী কণ্ঠস্বরটা একরাতে আমাকে বলল, মেয়েটার প্রতি এতটা মায়া অনুভব করো না। বিপদ হবে। যা ঘটে তা ঘটতে দাও।
আমি বিরক্ত হলাম। মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে, তার কথা শুনতে, তার সঙ্গে বসে থাকতে, তার স্পর্শ আমাকে এতটা আনন্দ দেয়। আমি তার ক্ষতি কী করে হতে দেই!
আমি সারাবাড়ি খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছি এই বাড়ি থেকে মেয়েটির পালিয়ে যাওয়ার কোনো পথ আছে কিনা! কিন্তু কোনো ফাক রাখেননি বাবা-মা।
একদিন। বাড়িতে বাবা-মা কেউ নেই। আমাদের শোবার ঘরের সাথে লাগোয়া যে বাথরুম আছে জুঁইকে ইশারা করে ওখানে নিয়ে গেলাম। দরজাটা বন্ধ করতেই চমকে উঠে সে আমার দিকে তাকালো। ভয়ে আমার গলা শুকিয়ে রয়েছে। আমি তার হাত চেপে ধরে বললাম, ‘চিৎকার দিও না, আমি বোবা নই! কথা বলতে পারি!’
এক মুহূর্তে শিউরে উঠে পিছিয়ে গেল মেয়েটা। যেন জোরে কেউ তাকে ধাক্কা দিয়েছে । বিস্ময়ে হা হয়ে গেল তার মুখ। ঠোঁট কাঁপছে। আমি তাকে বললাম , ‘তুমি পালিয়ে যাও জুঁই, আমার বাবা-মা তোমাকে এখানে এনেছে হত্যা করার জন্য।’ এরপর বলতে শুরু করলাম কেন আমি বোবার মতো সেজে থাকি। আর বাড়িতে রাখা আগের কাজের মেয়েগুলোর কী পরিণতি হয়েছে।
জুঁই কোনো কথাই বলল না। শুধু হা করে আমার দিকে চেয়ে রইলো। নিজেকে যেন সে বিশ্বাস করতে পারছে না। আমি নিজেও কাঁপতে লাগলাম। আমার এই ৯ বছরের জীবনে এই প্রথম কোনো মানুষের সঙ্গে কথা বললাম আমি। নিজের কন্ঠই নিজের কাছে অপরিচিত লাগলো। মেয়েটা আমার দিকে একটু এগিয়ে এলো, আলতো করে আমার চিবুক স্পর্শ করেই উল্টো ঘুরে বাথরুমের দরজা খুলে বেরিয়ে গেল। কাঁদছে সে! আমি বুঝতে পারছি না আমি কী ঠিক কিছু করলাম নাকি ভুল! অদৃশ্য নারীটা কথা বলতে কেন আমায় বাধা দিল না এখন।
সেদিন সন্ধ্যা পর্যন্ত আর আমার সঙ্গে দেখা করলো না। সন্ধ্যার পর সে যখন দেখা করতে এলো তখন সে একা নয়। বাবা-মাও তার সঙ্গে সঙ্গে ঘরে ঢুকলো। তাদের দুজনের দৃষ্টিতেই রাগ ঝরছে। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে জুঁই। বাবা শক্ত করে আমার হাত চেপে ধরে বলল, ‘ তুই এতদিন কথা বলতে পারতিস! শুধু শুধু আমাদের সঙ্গে নাটক করেছিস! তোর জন্য আমাদের কত কষ্ট করতে হয়েছে, কত সময় অপেক্ষা করতে হয়েছে জানিস! ‘ মাও রাগের স্বরে বললেন, ‘আমরা তোমাকে জন্ম দিয়েছি, বড় করেছি এভাবে ছল করে ধোকা দেয়া তোমার উচিত হয়নি! তুমি কথা বলতে পারও এটা কিনা আমাদের শুনতে হলো কাজের মেয়েটার মুখ থেকে!’
আমি যেন কাঠ হয়ে গেলাম! যাকে কিনা আমি বাঁচাতে চেয়েছি সেই কিনা আমাকে ধোকা দিল! ফুঁপিয়ে উঠল জুঁই, ‘আমাকে মাফ করে দিও ভাই। তোমার বাবা বলেছিল তুমি কথা বলতে পারো নাকি সত্যিই বোবা, এটা যদি আমি তাকে জানাতে পারি তাহলেই আমাকে মুক্তি দেবে এই বাড়ি থেকে। এই বাড়ি আর আমার ভালো লাগছে না!’
আমার চোখ ফেটে শুধু পানি গড়িয়ে পড়লো। একজন অদৃশ্য নারী যে আমার সঙ্গে সঙ্গে থেকে আমাকে এতদিন রক্ষা করে এসেছে তাকে আমি অনুভব করতে পারতাম। কিন্তু নারীটির কোনো উপস্থিতি এই মুহূর্তে আশেপাশে অনুভব না করে ঘাবড়ে গেলাম। অসহায় মনে হলো নিজেকে।
বাবা ধাক্কা দিয়ে আমাকে মেঝেতে ফেলে দিলেন। বললেন, ‘কথা বলো খোকা! না হলে আমাদের আসল রূপ দেখবে এবার।’ আমি চুপ করে একবার বাবার আরেকবার মায়ের দিকে তাকালাম। তাদের কারও চেহারাতেই আমার জন্য মায়া নেই। বাবা এক মুহূর্তে নিজের পকেট থেকে একটা ধারালো ছুরি বের করলেন। ছুটে গিয়ে চেপে ধরলেন ওটা জুঁইয়ের গলায়। ‘কথা বল খোকা, নইলে ওর গলা কেটে এখানেই ফেলে রেখে যাব!’
দিশেহারা বোধ করলাম আমি। চেঁচিয়ে বললাম, ‘মেরো না ওকে, থামো!’
মায়ের মুখ হা হয়ে গেল। তিনি ছুটে এলেন আমার কাছে, জড়িয়ে ধরলেন আমাকে, ‘এইদিনের জন্যই অপেক্ষায় ছিলাম আমরা খোকা! অবশেষে এই অভিশপ্ত মানুষের দুনিয়া থেকে মুক্তি পাবো আমরা!’
খিলখিল করে হেসে উঠলেন বাবা। ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলেন জুঁইকে সামনে থেকে। ‘আজ রাতেই তোমার মাধ্যমে আমি আর তোমার মা ফিরে যাব আমাদের দুনিয়ায়! অপেক্ষা করো তুমি!’
তাদের দুনিয়া মানে! তারা কারা!
মা আমাকে কোলে তুলে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে কপালে চুমু খেয়ে ঘর থেকে বের হয়ে চলে গেলেন। বাবার মুখ ভরে আছে পৈশাচিক হাসিতে। জুঁই হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। বাবা ওকে তুলে টানতে টানতে ঘরের বাইরে নিয়ে গেলেন। বন্ধ দরজার ভেতরে পুরো ঘরে আমি শুধু একা। এতটা অসহায় বোধ আমি আমার জীবনে আর করিনি কোনোদিন! …………………………………………………
……………………………..
.
.
. . . . চলবে . . . .
.
.
লেখা: #Masud_Rana
.