অফিসে বসে তিয়াশের সবসময়ই কাজের ফাঁকে ফাঁকে সিসি টিভির দিকে নজর রাখে। তিয়াশের বাসায় প্রায় সর্বত্রই আনাচে কানাচে তিয়াশ সিসি ক্যামেরা লাগিয়েছে মূলত তার স্ত্রী রেহানার গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করার জন্য। বিকেলে ঠিক কিছুক্ষণ আগে রেহানার কল আসে। তিয়াশ ফোন রিসিভ করে সিসি টিভির দিকে তাকায়। সিসি টিভিতে তিয়াশ দেখলো রেহানা বারান্দায় ইজি চেয়ারে ফোন কানে দিয়ে বসে আছে।
ফোনে ওপাশ থেকে রেহানার মিষ্টি কন্ঠ ভেসে আসলো।
– তুমি বলেছিলে আজ দুপুরে বাসায় খেতে আসবে। কেন আসলে না? আমি তোমার জন্য কতক্ষণ অপেক্ষা করেছি!
– দেখ রেহানা আজকের অফিসে ভয়াবহ কাজের চাপ আমার পক্ষে সেজন্য আসা সম্ভব হয়নি।মন খারাপ করো না প্লিজ।
– আচ্ছা ঠিক আছে। সমস্যা নেই।
– আমি আজকে তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরবো কথা দিলাম।
– বেশি রাত করবেনা কিন্তু…
– আচ্ছা । তোমার কি কিছু লাগবে? কিছু কেনা লাগবে?
– আপাতত লাগছে না। তুমি এক বোতল টমেটো কেচাপ আনতে পারো।
– আচ্ছা ঠিক আছে।
ফোনটা কেটে তিয়াশ তার ল্যাপটপের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে দেখল। বারান্দার চেয়ারে রেহানা চুপচাপ উদাস হয়ে বসে আছে। তিয়াশ গত এক সপ্তাহ আগে সিসি ক্যামেরা লাগিয়েছে। কিন্তু রেহানার আচরণের মধ্যে সন্দেহজনক কিছু পায়নি। বরং রেহানার মন খারাপ চুপচাপ চেহারাই সবসময় তার চোখে পড়ে। রেহানার কি কোনো সমস্যা হয়েছে? সবসময় এমন মন খারাপ করে বসে থাকে কেন সে?
পাশের বাসার আন্টি একবার তিয়াশকে বলেছিল.. তোমার ওয়াইফ এর মানসিক সমস্যা আছে। ওকে ডাক্তার দেখিও। কেন তিনি এমন কথা বলেছিল তিয়াশ জানে না ।
রেহানার মাঝে অস্বাভাবিক কিছু ব্যাপার আছে সেটা তিয়াশ বিয়ের প্রথম রাতেই বুঝতে পেরেছিল তবে ব্যাপারটা কি ছিল সেটা তিয়াশ এখনো বুঝতে পারছে না।
রেহানার বিয়ের আগে একটা সম্পর্ক ছিল। সেটা সে তিয়াশকে বিয়ের পরের দিনই বলেছিল।
তিয়াশ রেহানাকে ভয়াবহ ভালোবাসে । যতটা তার ভালোবাসার প্রয়োজন তার চেয়ে হয়তোবা একটু বেশিই ভালোবাসে।
তবে ইদানিং সে রেহানাকে সন্দেহ করছে রেহানা আবার তার প্রাক্তন প্রেমিকের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েনি তো ! তবে এমন কোন ব্যাপার তিয়াশ রেহানার মধ্যে দেখেনি যেটা দিয়ে তিয়াশ রেহানাকে সন্দেহ করতে পারে।
এসব ভাবতে ভাবতে তিয়াশ বাসায় সামনে চলে আসলো। কলিং বেল চাপতেই রেহানার দরজা খুলে দিলো।
তিয়াশ রেহানাকে বলল – দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে ছিলে নাকি? সাথে সাথে দরজা খুললে!!
এই প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে রেহানা মৃদু হাসলো।
রাতের খাওয়া দাওয়া সেরে তিয়াশ কিছু কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেল। এমন সময় রেহানা তিয়াশের কাছে এসে আবদারের সুরে বলল- তিয়াশ কালকে প্লিজ ছুটি নাও না।
রেহানার কথা শেষ হওয়ার আগেই তিয়াশ বেশ চমকে উঠলো এই প্রথম রেহানা তার কাছে এমন করে কিছু চাইলো।
রেহানা বলল- কি হলো কি এত ভাবছো?
– নাহ তেমন কিছু না।
– ছুটি নিতে পারবে না?
– আচ্ছা নিব।
তিয়াশ তার ছুটি কনফার্ম করার পর রাতে ঘুমুতে যাবার আগে নিজের ভেতরে বেশ অপরাধবোধ অনুভব করলো।
তার কাছে মনে হলো রেহানা তাদের সম্পর্কটা স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছে। কিন্তু তিয়াশ খামোখাই তাকে সন্দেহ করছে।
মাঝরাতে তিয়াশের ঘুম ভেঙ্গে যেতেই সে লক্ষ্যে করলো রেহানার তার পাশে নেই । তিয়াশের একবার ঘুম ভাঙ্গলে সহজে ঘুম আসতে চায় না তাই সে বিছানায় কি শুয়ে থাকলো। অনেক সময় পার হয়ে যাবার পর ও রেহানাকে না দেখে বেশ অবাক হলো
তিয়াশ বিছানা থেকে উঠে পড়লো। রেহানাকে তন্ন তন্ন করে সারা বাসা খুঁজে পেলো না। এত রাতে কোথায় গেল মেয়েটা??
হঠাৎই তার মনে হলো বাসায় সিসি ক্যামেরা আছে তাই তিয়াশ দ্রুত তার ল্যাপটপে ফুটেজ চেক করে দেখতে যা দেখতে পেলো তা দেখে বেশ প্রচন্ড অবাক হলো রেহানা এত রাতে বাসা থেকে খালি হাতে বাসা থেকে বের হয়ে গেছে।
এত রাতে কোথায় গেল রেহানার? এত রাতে রেহানার কি এমন কাজ থাকতে পারে?
রেহানা কি তার প্রাক্তন প্রেমিকের সাথে দেখা করতে গিয়েছে?
রেহানার তো তার কাছে বলেছিলো তার প্রেমিক তার ছেড়ে পাঁচ বছর আগে বিদেশ চলে গিয়েছে। এর পর তাদের সম্পর্কটি সেখানেই শেষ হয়ে গিয়েছে।
তবে কি সে ফিরে এসেছে?
এরকম হাজারো প্রশ্নের ঘিরে ধরছে তিয়াশকে । প্রচন্ড চিন্তায় যখন তিয়াশ কোন কূলকিনারা করতে পারছেনা ; তখন সদর দরজায় খুট করে শব্দ হলো। তিয়াশ দেখলো রেহানা বাসায় ঢুকছে।
রেহানা ঘরে ঢুকে তিয়াশে জাগ্রত অবস্থায় দেখে মনে হয় চমকে গেল।
রেহানা কাঁপা গলায় বলে উঠলো- তিয়াশ তুমি ঘুম থেকে উঠে পড়লে কখন?
– তুমি কোথায় গিয়েছিলে রেহানা?
– আমি ইয়ে ….মনে ছাদে গিয়েছিলাম।
– এত রাতে ছাদে কি করছিলে?
– আমার ঘুম আসছিল না । তাই হাঁটতে গিয়েছিলাম।
রেহানার এহেন অদ্ভুত জবাবে তিয়াশ প্রচন্ড রেগে উঠলো।
চেঁচিয়ে রেহানা কে বলল – তোমাকে আমি এর আগে ও হাজার বার ছাদে যেতে নিষেধ করেছি তুমি জানো না ছাদে কার্নিশ ভেঙ্গে গিয়েছে কিছু দিন আগে ছাদে যাওয়াটা নিরাপদ না। তারপর ও তুমি কেন গিয়েছো ?
কেন?
বিয়ের পর থেকে তিয়াশ কখনো রেহানার উপরে চেঁচামেচি করা তো দূরে থাক কখনো গলা উঁচু করে কথা পর্যন্ত বলেনি আজকে তিয়াশ তার ওপর চেঁচাচ্ছে!!
রেহানা বুঝতে পারলো তিয়াশ তার ওপরে ভয়াবহ রেগে উঠেছে।
তিয়াশ অনেক রাগের সাথে বলল – তুমি জানো তোমাকে না দেখে আমার কত চিন্তা হয়েছিল।
যখন দেখলাম তুমি বাসা থেকে বের হচ্ছো আমি তখন কত চিন্তায় মধ্যে পড়েছিলাম জানো?
তিয়াশের শেষের কথাটা শুনে রেহানা মনে হলো বেশ অবাক হলো ।
রেহানা বলল – আচ্ছা আমি যখন বাসা থেকে বের হয়েছিলাম তুমি কিভাবে দেখলে?
তুমি তো ঘুমিয়ে ছিলে …..।
রেহানার হঠাৎ এমন প্রশ্নে তিয়াশ কিছুটা ধাক্কা খায়। আরে তাইতো রেহানা বাসা থেকে বের হবার সময় তার তো দেখার কথা নয় ।
রেহানা আবার কিছু ধরে ফেলল না তো!! রাগের মাথায় এসব কি বলল সে?
রেহানার প্রশ্নটা এড়িয়ে যাবার জন্য , তিয়াশ এবার কন্ঠ নরম করে বলল – দেখ আমি আসলে অনেক দুঃখিত । আমার এমনভাবে তোমার সাথে কথা বলা উচিত হয়নি। আসলে আমি রাগের মাথায় কি বলতে কি বলেছি আমি নিজেও জানি না।
রেহানা এবার তিয়াশের হাত দুটো বলল – আমি সত্যিই অনেক সরি। আমার তোমার কথা শোনা উচিত ছিল। আমি তোমাকে প্রমিস করছি আর কখনো আমি এভাবে তোমাকে না জানিয়ে বাইরে যাব না।
তিয়াশের রাগ কমে যায়। সে বলল – আচ্ছা ঠিক আছে। কোনো সমস্যা নেই। চলো আমরা ঘুমুতে যাই।
পরদিন যেহেতু তিয়াশের ছুটি ছিল তাই সে বেশ দেরি করে ঘুম থেকে ওঠে। ঘুম ওঠার পর তিয়াশ দেখল প্রায় একটা বাজে। মধ্যদুপুর হয়ে গেছে।
রেহানার দুপুরের রান্না শেষ। সে বারান্দায় বসে ল্যাপটপে কাজ করছে।
রেহানা একজন ফ্রিল্যান্সার। সে বাসায় থেকেই অফিসের কাজ করে। তার স্যালরি ও বেশ ভালোই। আজকে অনেকক্ষণ ধরে একটানা কাজ করে যাচ্ছে রেহানা । অনেক কাজ জমে আছে সেগুলো শেষ করতে হবে।
রেহানা একটানা বিরতিহীন ভাবে কাজ করে যাচ্ছিলো…. এমন সময় তিয়াশ পেছন থেকে ওকে চমকে দিলো। রেহানাকে চমকে উঠতে দেখেই তিয়াশ অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো।
– এত অল্পতেই ভয় পেয়ে গেলে?
-উফ। তুমি আর আমার সাথে কথা বলবে না। এত ভয় কেউ কাউকে পাওয়ায়?
– কেন ? আমাকে ছুটি নিতে বলে তুমি কাজ করছো কেন?
– তো কি করব?
-আমার সাথে…….
তিয়াশের কথা শেষ হওয়ার আগেই বাসায় টেলিফোনটা বেজে উঠল। বাসার টেলিফোনে সচরাচর কেউ ফোন করে না। এমন সময় কে ফোন করতে পারে?
তিয়াশ টেলিফোনটি ধরলো। অপরপাশ থেকে একটা উদ্বিগ্ন গলার স্বর শুনা গেল।
– তিয়াশ ভাই বলেছেন?
-জ্বি বলছি। আপনি কে বলছেন?
– আমি আপনার কলিগ বাশার বলছি।ভাই আপনার ফোন কতবার ফোন দিছি জানেন? আপনার ফোন বন্ধ কেন? শেষে আপনার টিএন্ডটি নাম্বারে কল দিলাম।
– কেন ভাই কি হয়েছে? কোনো সমস্যা হয়েছে?
– ভাই আমাদের অফিসে বস খুন হয়েছেন।
-কিহহহ!! কি বলছেন এসব?
– হ্যাঁ ভাই সত্যি। পুলিশ এসেছে এখন ইনভেস্টিগেশন শুরু হয়েছে। ভাই খুব ভয়ে আছি। পুলিশ অফিসের ভেতর থেকে কাউকে অফিসের বাইরে বের হতে দিচ্ছে না।
তিয়াশ তার কলিগ বাশার সাহেবের সাথে কথা বলে ফোন রেখে দিতেই রেহানাকে তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল ।
– জানো রেহানা!! আমাদের বস খুন হয়েছেন!!
– ওহ্ আচ্ছা।
তিয়াশ বিস্মিত হয়ে দেখল রেহানা স্বাভাবিক ভাবেই তার কথা শুনলো। যেন সে খুবই সাধারণ কথা শুনছে।
তার ঠোঁটের কোনে মৃদু হাসি মেখে আছে। এই মুহূর্তে তিয়াশের কাছে রেহানা নামের ব্যাক্তিটি যেন অচেনা থেকে অচেনা হয়ে উঠছে।
গল্প অন্ধকারের হাতছানি পর্ব ১
লেখাঃ নাজিফা তাবাসসুম
অন্ধকারের_হাতছানি পর্ব ২
নাজিফা_তাবাসসুম
তিয়াশের বাসায় পুলিশ এসেছে। মূলত রেজাউল করিম এর খুনের বিষয়ে তিয়াশকে জিজ্ঞেসাবাদ করার জন্যই । বসার ঘরে দুজন পুলিশ অফিসার বসে আছেন। তাদের সামনে এই মুহূর্তে তিয়াশ ও রেহানা বসে আছে। রেহানা খুবই নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বসে আছে। কিন্তু তিয়াশ প্রচন্ড নার্ভাস হয়ে আছে। সিনিয়র পুলিশ ইন্সপেক্টর রায়হান আহমেদ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে এই দম্পতির দিকে তাকিয়ে আছেন। তিয়াশকে দেখে তার সন্দেহ লাগছে। রায়হান আহমেদ সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি তিয়াশকে প্রশ্ন করবেন।
জুনিয়র পুলিশ অফিসার রোহিত চাকমা তাকে সেই সুযোগটি না দিয়ে তিয়াশকে প্রশ্ন করতে শুরু করলো। এতে করে ইন্সপেক্টর রায়হান বিরক্ত হলেও মুখে কিছু বললেন না। শক্ত মুখ করে বসে রইলেন।
রোহিত প্রথমে তিয়াশকে প্রশ্ন করলেন – আপনি তো ইউনাইটেড কোম্পানির সিইও? অ্যাম আই রাইট?
– ইয়ে… মানে..জ ..জ ..জ্বি।
– অদ্ভুত তো ! সিইও কথাটা বলতে এতটা তোতলাতে হয়। মূল প্রশ্ন শুরু করলে কি করবেন?
তিয়াশের প্রচন্ড ভয়ে গলা দিয়ে শব্দ বের হচ্ছে না ছোটবেলা থেকে পুলিশ দেখলে সে ভীষণ ভয় পায়।
– ইয়ে মানে যে আসলে আমি একটু নার্ভাস তো, সেজন্য আরকি একটু ও তোতলানো..আর কি
– আচ্ছা ঠিক আছে , তিয়াশ সাহেব তাহলে আমরা মূল প্রসঙ্গে আসি আপনি তো গত কালকে আপনার অফিস থেকে ছুটি নিয়ে ছিলেন। ঠিক ?
-জ্বি ।
– আচ্ছা আপনি কি কারনে ছুটিটা নিলেন ? আপনার অফিস অ্যাটেনডেন্স চেক করে দেখলাম আপনি গত এক বছরে বেশি ছুটি নেননি ।বলতে গেলে প্রায় দুই দিন ছুটি নিয়েছেন ।
আপনি হঠাৎ করে কালকে কি মনে করে ছুটি নিলেন এবং কালকেই আপনার বস মারা গেল এটার অর্থ কি দাঁড়াচ্ছে?
– মানে আপনি কি বলতে চাচ্ছেন আমি খুন করেছি!
– অদ্ভুত তো । তিয়াস সাহেব আমিতো একবার ও উচ্চারণ করিনি যে আপনি খুন করেছেন।
আপনি নিজেই হঠাৎ এভাবে বলছেন এর মানে কি ধরবো আপনার ভিতরে কোন ঘাপলা আছে?
তিয়াশ আর কিছু বলার আগেই রেহানা বলে উঠলো-
– ওয়ান সেকেন্ড মিস্টার রোহিত চাকমা আপনি আমার হাসবেন্ড কে এভাবে করে বলতে পারেন না!
আপনার কাছে কি এমন এভিডেন্স আছে যে আমার হাজব্যান্ড এই খুনের সাথে জড়িত?
– দেখুন ম্যাম আমি কিন্তু একবারও বলিনি জড়িত। আপনারাই বারবার টেনে কথা নিয়ে বলছেন।
– আচ্ছা আপনি একবার বলুন তো আমার হাজবেন্ডের বস রেজাউল করিমের ফরেনসিক রিপোর্ট কি এসেছে? সেটা যে আদৌ খুন সেটা কি আপনারা জানেন?
রেহানার এহেন প্রশ্নে জুনিয়র অফিসার রোহিত চাকমা এবং ইন্সপেক্টর রায়হান আহমেদ পরস্পর মুখ চাওয়াচাওয়ি করলেন…
কারণ আসলেই তো ফরেনসিক রিপোর্টে আরো একদিন আসবে।কিন্তু তারা বিষয়টিকে খুন হিসেবে বিবেচনা করছে। কারণ লাশটা যেমন বিভৎস অবস্থায় পাওয়া গেছে সেটা খুন ব্যাতীত আত্মহত্যা হতে পারে না। সেটা অবশ্যই খুন।
ইন্সপেক্টর রায়হান আহমেদ রোহিতকে আর কোন প্রশ্ন করার সুযোগ না দিয়ে নিজেই কথা বলা শুরু করলেন রেহানাকে বললেন – দেখুন ম্যাম আমি আমার দীর্ঘ ২১ বছরের ক্যারিয়ারে অনেক খুন দেখেছি। তাই আমরা কোন লাশকে দেখলেই আইডেন্টিফাই করতে পারি সেটা খুন নাকি আত্মহত্যা।
ইন্সপেক্টর এর কথা শুনে রেহানা মৃদু হেসে বলল , আপনার এইবারের অভিজ্ঞতাটা ভিন্ন হতেও পারে
সব সময় আমরা যেটা ভাবি সেটা তো আর হয় না। আশা করি বুঝতে পেরেছেন।
রায়হান আহমেদ বলে উঠলেন- আপনি এতটা কনফিডেন্ট কিভাবে?যে এটা খুন নয় ?
– আমি মোটেও কনফিডেন্ট না । আমি জাস্ট আপনাদেরকে বলছি ফরেনসিক রিপোর্ট হাতে না আসতেই এতটা গভীরে না যাওয়াই ভালো।
ইন্সপেক্টর রায়হান আহমেদ বললেন – সেটা আমাদের ব্যাপার ; আপনাকে সেটা নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে না।
রেহানা তার কথা শুনে বলে উঠলো – মাথা ঘামাতে অবশ্যই হবে কারণ আমার হাজব্যান্ড এই ব্যাপারটার মধ্যে জড়িয়ে পড়েছে ।
ইন্সপেক্টর রায়হান আহমেদ বললেন, আমরা কিন্তু আপনার হাজবেন্ডের সাথে কথা বলতে এসেছি আপনি মাঝখান থেকে এত কথা বলছেন কেন?
রেহানা বলল ,আপনাদের কনফিউশন দূর করার জন্য আমি মূলত কথা বলছি; আমার হাজব্যান্ড যে খুনের সাথে জড়িত নয় ; সেটা আপনারা আজকে আমার বাসা থেকে বের হওয়ার পরই বুঝতে পারবেন।
রোহিত বলল , কিভাবে?
তিয়াশ বিস্মিত হয়ে রেহানার দিকে তাকিয়ে আছে। রেহানা এত যুক্তি দিয়ে তাদের সাথে কথা বলছে তা দেখে সে অবাক হয়ে যাচ্ছে।
রেহানার কথা বলার ভঙ্গি তার কাছে অচেনা লাগছে। রেহানা বরাবরই চুপচাপ মেয়ে। হঠাৎ করে সে তিয়াশকে ডিফেন্ড করে এত কথা বলছে বিষয়টা তিয়াশের কাছে অনেক ভালো লাগলো।
রেহানা বলল, শুনুন তাহলে আমার হাজব্যান্ড বাসার নিরাপত্তার জন্য কিছু সিসি ক্যামেরা লাগিয়েছে। আপনারা চাইলে সিসি টিভি ফুটেজ গুলো আমি আপনাকে দিতে পারি সেখানে আপনি দেখতে পারেন। আমার হাজব্যান্ড গত পরশু সারারাত বাসায় ছিল। সে বাসা থেকে বের হয়নি এবং সে রাতে ছুটি নেওয়ার পর সকালে অফিসে ও যায়নি।
রেহানার মুখে সিসি ক্যামেরার কথা শুনে তিয়াস ভয়ানক বিস্মিত হলো ।
রেহানা কিভাবে জানে সে সিসি ক্যামেরা লাগিয়েছে। তার মানে রেহানাকে অনেক আগে থেকেই জানতো কিন্তু কখনো প্রকাশ করেনি। কিন্তু কেন ?
অনেক কিছুই তিয়াশ ভাবতে যাচ্ছিল। তার আগেই রেহানা উঠে গেল।
ইন্সপেক্টর রায়হান তিয়াশের দিকে তাকিয়ে বললেন অদ্ভুত। আপনি পুলিশ দেখে ভয় পেলেও আপনার বুদ্ধি আছে মশাই। তিয়াশ বিব্রতবোধ করল।
রেহানা পাশের ঘর থেকে তার ল্যাপটপটা নিয়ে এলো এবং তার কাছে থাকা কিছু ফুটেজ ইন্সপেক্টর হাতে দিয়ে বললো, আপনি চাইলে ফুটেজ গুলো নিয়ে যেতে পারেন এমনকি এখানে বসে ও দেখতে পারেন।
ইন্সপেক্টর বললো, আচ্ছা ঠিক আছে ।তাহলে চালু করুন । রেহানা ল্যাপটপে ফুটেজগুলো চালু করতেই ইন্সপেক্টর গভীর মনোযোগে দেখতে শুরু করলেন। সিসি ক্যামেরা ফুটেজে সেদিন রাতে তিয়াশের বাসায় ঢোকার পর থেকে, তাদের রাতের খাওয়া-দাওয়া, ঘুমানোর প্রস্তুতি ,এমনকি ঘুম, সব কিছুই আছে ।
কিন্তু অদ্ভুত বিষয় এটাই যে; সেদিন রাতে যখন রেহানা বাসার বাইরে গিয়েছিল সেই দৃশ্য গুলো ফুটেজের কোথাও নেই।
তিয়াশ ফুটেজে এত বড় ধরনের পরিবর্তন দেখে অনেক অবাক হলো। এটা কিভাবে সম্ভব? সে ভেবে পাচ্ছেনা। এক রাতের মধ্যে এতটা পরিবর্তন কিভাবে হতে পারে ফুটেজে?
ফুটেজ টা দেখার পর ইন্সপেক্টর রায়হান এবং পুলিশ অফিসার নিশ্চিন্ত হয়ে গেলেন যে সেদিন রাতে তিয়াশ বাসা থেকে বের হয়নি।
তারা তিয়াশের বাসা থেকে বের হবে এমন সময়
পুলিশ অফিসার রোহিত থমকে দাঁড়ালেন । সে রেহানাকে বলল, আপনার হাতের অনামিকার আংটিটা তো বেশ সুন্দর।
কথাটা শুনে ইনস্পেক্টর রায়হান বিরক্ত হলেন। তবে রেহানার চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছিল সে চমকে গেছে।
পুলিশ অফিসাররা বাসা থেকে চলে যাওয়ার পর তিয়াশ বিমর্ষ হয়ে বসে থাকলো।তার নিজেকে নিজের কাছে ছোট মনে হচ্ছে , তার মনে হাজারো প্রশ্ন জমে থাকলে ও লজ্জায় সে রেহানার সাথে কথা বলতে পারছেনা ।
অনেক সময় ধরে তিয়াশকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে রেহানা তার পাশে এসে বসলো।
তিয়াশ রেহানার দিকে লজ্জায় তাকাতে পারছে না। রেহানা তাকে হয়তোবা কত না অনেক খারাপ মানুষ ভাবছে।
দুজনে বেশ কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর রেহানা নীরবতা ভেঙে বলল , তিয়াশ আমি তোমাকে একটা মিথ্যা কথা বলছিলাম। তিয়াশ জিজ্ঞেসাসূচক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকায়।
– আমার প্রেমিক সিয়াম পাঁচ বছর আগেই মারা গিয়েছে। খামোখা তাকে নিয়ে সন্দেহ করে কোন লাভ নেই।
– আমাকে ক্ষমা করে দাও রেহানা। আমার ভুল হয়ে গেছে।
রেহানা তিয়াশের কথার জবাব দেয় না। অপলক মায়াময় দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। তিয়াশের কাছে মনে হলো রেহানার চোখের ভাষায় গভীর কোন কষ্ট লুকিয়ে আছে।
বাসা থেকে বের হওয়ার পর ইন্সপেক্টর রায়হান রোহিতের উদ্দেশ্যে বলল, তুমি এমন ভাবে মিসেস রেহানার প্রশংসা করলে কেন?
আমি প্রথম থেকে খেয়াল করেছিলাম তুমি তার হাতের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলে।
স্যার আমি মিসেস রেহানার হাতের যে আংটিটা দেখে প্রশংসা করেছিলাম ; সেটা আর কিছু না পেন্টাকলের ডায়াগ্রাম ছিল।
– কি?
– সেটা একটা পেন্টাকলের ডায়াগ্রাম ছিল।
– পেন্টাকল?
– জি স্যার।
– এটা আবার কি?
-স্যার মিসেস রেহানা আর কেউ নয় একজন শয়তানের পূজারী।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: (পাঠকের অনেকেই হয়ত জানেন না পেন্টাকল কি? পেন্টাকল নিয়ে ছোটখাটো ভাবে কিছু যদি বলতে হয় তবে বলব এটা ইলুমিনাতি অর্থাৎ শয়তানের উপাসনা যারা করে ; তারা সব সময় একটা বিশেষ চিহ্ন ব্যবহার করে সেটাকে পেন্টাকল বলা হয়। শয়তানের উপাসকরা এই চিহ্ন দ্বারা শয়তানের উপাসনা করে থাকে।)
এই পর্বে রেহানার আসল পর্দা ফাঁস হলেও তাকে ঘিরে থাকা রহস্যের সমাধান হয়নি । তবে এখন পর্যন্ত অনেক প্রশ্নের সমাধান না হতে পারে। সেগুলো আগামী পর্বে অর্থাৎ শেষ পর্বে পেয়ে যাবেন ।
আজকের পর্ব পড়ে কেমন লাগলো মন্তব্য করে জানাবেন। যদি কোন ভুল ত্রুটি হয় তবে আমি ক্ষমাপ্রার্থী। ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। ধন্যবাদ।
চলবে…………
অন্ধকারের_হাতছানি (অন্তিম_পর্ব)
নাজিফা_তাবাসসুম
বারান্দার ইজি চেয়ারে রেহানা আধশোয়া হয়ে বসে আছে। তার দুচোখ বন্ধ।বাইরে থেকে তাকে যে কেউ দেখলেই ভাববে সে খুব শান্ত হয়ে বসে আছে , কিন্তু রেহানা আজ ভেতরে ভেতরে ভয়ানক অস্থির এবং চিন্তিত। তিয়াশ অফিসে যাওয়ার আগে রেহানাকে একবার খুঁজছিল। তিয়াশ দেখতে পেল, রেহানা বারান্দায় বসে আছে , তিয়াশ রেহানার কাছে এসে বলল , রেহানা আমি অফিসে যাচ্ছি।
রেহানা চোখ না খুলেই বললো – আচ্ছা ঠিক আছে।যাও। সাবধানে যেও।
তিয়াশ বাসা থেকে চলে যাওয়ার পর রেহানা নিজ মনে ভাবল, তিয়াশকে সে আজ সাবধানে যেতে বলল; কিন্তু আজকে রাতে তিয়াশের ভাগ্যে কি অপেক্ষা করছে তা কি তিয়াশ জানে?
রেহানা নিজ মনে বলল , লুসিফার আজকে আমি তোমার আনুগত্য প্রকাশ করব। তুমি বলেছিলে তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা প্রকাশ করার জন্য আমাকে তোমার উদ্দেশ্যে কাউকে উৎসর্গ করতে, আমি তিয়াশকে বেছে নিয়েছি।
লুসিফার আমি তোমার আনুগত্য প্রকাশ করছি।
এই কথাগুলো ভাবতে ভাবতে রেহানা তার হাতের আংটিতে আরেক হাত দিয়ে স্পর্শ করে শক্ত মুখে বসে থাকল।
বেশ কিছু দিন পার হয়ে গেছে রেজাউল করিম এর খুনের কেসটি অমীমাংসিতই থেকে গেছে।ইন্সপেক্টর রায়হান এবং রোহিত দুজন অনেক চেষ্টা করেছিল; কিন্তু কেসটি সলভ করতে কিন্তু পারেননি। শেষ পর্যন্ত যে ফরেনসিক রিপোর্ট এসেছিল… তাতে করে কেস নিয়ে আগানোর মতই অবস্থায় তারা ছিল না। খুবই বিচিত্র ভাবে ফরেনসিক রিপোর্টে এসেছিল, কোন অচেনা বিষধর সাপের দাঁতের আঘাতে রেজাউল করিমের মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু অদ্ভুত বিষয় এই যে , সেই বিষধর সাপ কোন প্রজাতির তা কেউ জানে না? পৃথিবীর কোথাও সেই বিষের অস্তিত্ব নেই।
কেসটি সেখানেই বন্ধ হয়ে গেছে । কেস সংক্রান্ত ফাইলে হয়তো এতদিনে ধুলো জমে গেছে।
যেহেতু রেজাউল করিমের কেস নিয়ে আগানোর মতই কোন ক্লু নেই।
তাই কেসটি আর রিওপেন করা হয়নি।
এ কিছুদিনের ব্যবধানে সবার জীবনে একটি পরিবর্তন চলে এসেছে, ইন্সপেক্টর রায়হান তার অন্যান্য কেস নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন।
রোহিত চাকমা ট্রান্সফার নিয়ে তার জন্মভূমি খাগড়াছড়িতে চলে এসেছে। ঢাকায় রোহিত পড়াশোনা এবং চাকরির সুবাদে থাকলেও জন্মভূমি টানে নিজ জেলায় ফিরে এসেছে। তবে সে ফিরে আসার আগে রেহানার কথা অনেকবার ভেবেছিল। তিয়াশের কথাও ভেবেছিল। কিন্তু অদ্ভুত বিষয় এই দম্পতির সাথে তার আর কখনোই দেখা হয়নি।
তার আজও মনে পড়ে রেজাউল করিমের খুনের কেস নিয়ে সে এবং ইন্সপেক্টর রায়হান যখন কাজ করছিলেন। রেহানার বাস্তব সত্যটা সে রায়হান আহমেদকে বললে , রায়হান হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। এসব বিষয় আসলে অনেক মানুষের কাছে হাসিঠাট্টার বিষয়। সেজন্য রোহিত আর কারো কাছে হাসিঠাট্টার পাত্র হতে চায়নি; তাই রেহানার অমোঘ সত্যটা সে নিজের মধ্যে রেখেছে।আর কারো কাছে প্রকাশ করেনি।
রোহিতের মনে পড়ে গেল, তার এক বন্ধুর বাবা একজন শয়তানের উপাসক ছিলেন, তাঁর শেষ পরিণতি খুবই ভয়াবহ হয়েছিল। রোহিতের শরীর শিউরে উঠলো। আজ তার বন্ধু বেঁচে নেই তার বন্ধুর বাবা নিজ হাতে নিজ সন্তানকে শয়তানের উদ্দেশ্যে বলি দিয়ে উৎসর্গ করেছিল।
রেহানার থেকে কি শেষ পর্যন্ত তিয়াশের ও একই পরিণতি হবে!! রোহিত এসব নিয়ে ভাবতে চায় না। এসব অন্ধকার জগতের ভাবনা বাদ থাকুক না। রেহানা থাক তার অন্ধকার জগত নিয়ে । রেহানার অন্ধকার জগতে অনাধিকার প্রবেশ করে নিজের কোনো বিপদ ডেকে আনতে চায় না রোহিত।
মাঝরাতে তিয়াশের ঘুম ভেঙ্গে গেলে সে একটা চাপা কান্নার শব্দ শুনতে পায় ; সাথে একটা ভরাট কন্ঠ থেকে চেঁচানোর শব্দ… এমন কিছু তার মনে হলো। তিয়াশের ঘুম ভাবটা কেটে যেতেই তিয়াশ বিছানায় উঠে বসলো।
তার পাশে রেহানাকে দেখতে পেল না।
এত রাত্রে রেহানা কোথায় গেল? রেহানা
আবার ছাদে যায়নি তো! এসব ভাবতে ভাবতে তিয়াস বাসায় রেহানাকে খুঁজে না পেয়ে ছাদের উদ্দেশ্যে রওনা হল ।
ছাদে যেতেই তিয়াশ বিস্ময় বোধ করল সে দেখতে পেলো রেহানা ছাদের একেবারে শেষ প্রান্তে ভাঙ্গা কার্ণিশের উপর পা ঝুলিয়ে বসে আছে। রেহানা বলে তিয়াশ ডাক দিতেই রেহানা তার দিকে মাথা ঘুরিয়ে তাকাল; রেহানার চোখের দৃষ্টি দেখে তিয়াশ কেঁপে উঠলো; ‘কি ভয়াবহ দৃষ্টি রেহানার চোখে!
তার চোখ দুটো রক্তবর্ণ ধারণ করে আছে’।
তিয়াশ কাঁপাকাঁপা স্বরে করে বলে উঠলো, ‘রেহানা তুমি কি করছো’? ‘এখন থেকে পড়ে যাবে তো’!! ছাদের কার্নিশে ভাঙ্গা।প্লিজ রেহানা তুমি চলে আসো।
রেহানা ভয়ঙ্কর শক্ত গলায় বলে উঠলো, ‘তিয়াশ আমি এখান থেকে সরবো না’।
তুমি যদি নিজের ভাল চাও এখান থেকে চলে যাও।
– ‘রেহানা প্লিজ চলে আসো’। কি পাগলামি করছ রাতের বেলায়?
রেহানা প্লিজ কিছু করো না। এখান থেকে চলে আসো তুমি পড়ে যাবে তো!!
রেহেনা এবার বললো- ‘আমি বললাম না তুমি চলে যাও!’ আর কিছুক্ষণ যদি তুমি এখানে থাকো, আমি কিন্তু; ছাদ থেকে লাফ দিব!
– রেহানা কেন এই পাগলামি করছ? আচ্ছা রেহানা তুমি আমাকে বলো, আমি কি কোন ভুল করেছি? আমার কোন ভুল হয়েছে ?তোমার কি কোন সমস্যা আছে? তুমি প্লিজ আমার সাথে শেয়ার করো।
সেটার সমাধান আমরা বের করতে পারবো। সমস্যা থেকে বের হতে পারব। প্লিজ রেহানা তুমি চলে আসো।
রেহেনা এবার চেঁচিয়ে বলল , আমার সমস্যা তুমি! তুমি আমার সমস্যা! তুমি যতক্ষণ আমার সামনে থাকবে আমার সমস্যা । তুমি তুমি চলে যাও।আমি বললাম তুমি চলে যাও।
তিয়াশ এবার চেঁচিয়ে বলে উঠলো – রেহানা, আমি তোমাকে ভালোবাসি। অনেক ভালোবাসি। প্লিজ রেহানা এমন কিছু করো না। যদি তুমি আমার সাথে থাকতে না চাও। তবে তুমি আমাকে ছেড়ে দাও। তারপরও প্লিজ…. রেহানা, তুমি নিজের ক্ষতি করবে না। প্লিজ!
তিয়াশের কথা শেষ হতেই রেহানার চোখের দৃষ্টি আগের চাইতে অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে এলো,
রেহানা নরম গলায় তিয়াশকে বলল, “প্লিজ তুমি চলে যাও”। তোমার কোন ক্ষতি হোক আমি চাইনা। তুমি এখানে বেশিক্ষণ থেকো না। তোমার বিপদ হতে পারে।
– না রেহানা । তোমাকে না নিয়ে আমি এখান থেকে যাব না।
– তিয়াশ জেদ করো না। তুমি এখান থেকে চলে যাও।
রেহানার কথা শেষ হতেই তিয়াশের মাথায় প্রচন্ড চাপ অনুভব হল। হঠাৎই সে মূর্ছা গেল ।
তিয়াশের যখন জ্ঞান ফিরলো তখন সে নিজেকে হসপিটালের বেডে আবিষ্কার করল। সে বিস্মিত হয়ে হসপিটালের একজন নার্সকে ডেকে বললো, ‘আমার কি হয়েছে’? আমাকে এখানে কে এনেছে?
নার্স অবাক হয়ে বলল, সেটা বলতে পারবো না। তবে ‘আপনাকে একজন মেয়ে এডমিট করিয়ে দিয়ে গিয়েছে’; তার পরিচয় আমরা জানি না।
– ‘আমি কত দিন অজ্ঞান ছিলাম’?
– আপনি তিন দিন অজ্ঞান ছিলেন।
তিয়াশ প্রচন্ড অবাক হয়, তার কি হয়েছিল? সে বুঝতে পারছে না ; আস্তে আস্তে যখন তিয়াশের শরীর কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে আসে, তখন সে হসপিটাল থেকে বাসায় ফিরল । বাসায় ফিরে রেহানাকে খুঁজে পেল না। ‘রেহানার কি হয়েছে’? ‘সে এখান কোথায়’? কেউ জানে না।
তিয়াশ অনেক খোঁজার চেষ্টা করে শেষ পর্যন্ত রেহানাকে কোথাও না পেয়ে; সে রেহানার বাড়িতে যায়। কিন্তু সেখানে গিয়েও রেহানার বাড়ির কাউকে খুঁজে পায় না । তালাবদ্ধ ভাবে রেহানার বাড়ি দেখতে পায় ।
তিয়াশের হঠাৎ মনে পড়ে যায়, রেহানা আর তার বিয়ের সময় , রেহানা একজন চাচা ছিলেন তিনি মূলত রেহেনার সাথে তিয়াশের বিয়ে দিয়েছিলেন।
সে কোথায়? তার খোঁজ করে তিয়াশ জানতে পারে তিনি গত দুই দিন আগে মারা গিয়েছেন। কেন মারা গিয়েছেন কেউ জানে না। ডক্টর বলেছেন, হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যু হয়েছে। সে এতোসব কিছুর পর আর কিছুতেই কিছু না করতে পেরে ফিরে এসেছে।
বেশ কিছু দিন পার হয়ে যাওয়ার পর, রেহানাকে ছাড়া তিয়াশের জীবন পার হয়ে যাচ্ছিল।
হঠাৎই তার মোবাইলে একটা মেসেজ আসে। সেদিন অফিসে তিয়াশ অনেক ব্যস্ত ছিল। কি কারনে যেনো তার মেসেজটা চেক করা হয়নি। রাতে সে বাসায় ফিরে মেসেজটা চেক করে দেখে , সেই মেসেজটা আর কারোর না রেহানার নাম্বার থেকে এসেছে। কল ব্যাক করতে গিয়ে তিয়াশ দেখল নাম্বারটি বন্ধ।
তিয়াশ বিস্ময়বোধ করে কারণ সেই মেসেজে লেখা ছিল,
“শুভ জন্মদিন” তিয়াশ ।তোমার জন্মদিনের উপহার হিসেবে আমাকে ঘিরে থাকা রহস্যগুলো তুমি আজ উন্মোচন করতে পারবে । আমাদের আলমারির পিছনে একটা “সিক্রেট চেম্বার” আছে। সেখানে একটা ডায়েরী আছে; সেটা বের করে নিও।
মেসেজটা পাওয়ার পর , তিয়াস দ্রুত আলমারি খুঁজতে থাকে। আলমারির পেছনে সত্যিই একটা সিক্রেট চেম্বার পেয়ে যায় সে।
সেখান থেকে একটা অদ্ভুত কালো রংয়ের ডায়েরী বেরিয়ে আসে। ডায়েরীটা হাতে নিতেই তিয়াশের অন্য রকম একটা অনুভূতি হয়। অনূভুতিটি যেন বড্ড বেশি অচেনা।
তার কাছে মনে হলো; রেহানা যেন তার পাশেই আছে। ডায়েরীর প্রত্যেকটা পাতা খালি শুধুমাত্র একটা পাতাতে কিছু লেখা আছে। তিয়াশ পরম উৎসাহের সাথে লেখাগুলো পড়তে শুরু করে।
“প্রিয় তিয়াশ”
যখন তুমি লেখাগুলো পড়ছো, তখন আমি হয়তোবা তোমার পাশে নেই। ‘ততক্ষণে আমার অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে নাকি’ ; ‘আমি জানিনা’। তবে আমাকে ঘিরে কিছু অপ্রিয় সত্য, ‘তোমাকে আমি জানিয়ে যেতে চাই’। “তিয়াশ” তুমি হয়তো বা জানো না। আমি একজন অন্ধকারের বাসিন্দা। আমি অন্ধকার জগতের মানুষ। আমাদের সম্পর্ক কখনো সম্ভব না, কারণ আমাদের জগত ভিন্ন।আমাদের ভেতরের সবকিছু ভিন্ন।
আমি ডেভিল লুসিফারের একজন উপাসক। আমি আমার স্রষ্টা লুসিফারের আনুগত্য প্রকাশ করার জন্য সুউচ্চ স্তরে প্রবেশ করতে চেয়েছিলাম। তার কারণে আমাকে আমার নিজের ভালোবাসাকে স্যাক্রিফাইস করতে হবে। এটা অদ্ভুত হলেও সত্য আমার জীবনের সবচেয়ে ভালোবাসার মানুষ হলে “তুমি”। তোমাকে আমি কখনো স্যাক্রিফাইস করতে পারবোনা। তার জন্য যদি আমাকে ডেভিল লুসিফারের হাতে মৃত্যুবরণ করতে হয়। আমি করব ।
আমি আমার নিজেকে স্যাক্রিফাইস করলাম। আমি খুবই খারাপ একটা মানুষ। খুবই খারাপ। আমি আমার নিজের হাতে আমার প্রেমিক সিয়াম কে খুন করেছিলাম । শুধুমাত্র লুসিফারের কাছ থেকে অসামান্য ক্ষমতা পাওয়ার জন্য । সেই শক্তি অর্জন করার জন্য।পৃথিবীতে অকল্পনীয় শক্তির অধিকারিণী হয়ে বাঁচার জন্য।
কিন্তু ; আমি শেষ পর্যন্ত হেরে গিয়েছি। আমি তোমার ভালোবাসার কাছে মৃত্যু বরণ করেছি। তিয়াশ আমি জানি, তুমি আমাকে অনেক ভালোবাসো।
কিন্তু ; প্লিজ। তুমি যদি আমাকে এক মূহুর্তের জন্য ও ভালোবেসে থাকো… তবে তুমি আমাকে এখন এই মুহূর্ত থেকে ঘৃণা করো… আমি তোমার ঘৃণা পাওয়ার যোগ্য। আমার ভালোবাসা পাওয়ার কোনো অধিকার নেই। আমি একজন নিকৃষ্ট মানুষ।
আর হ্যাঁ তিয়াশ, তোমার কি মনে আছে তোমার বস রেজাউল করিমের কথা? তার মৃত্যু কিভাবে হয়েছিল? সেটা নিয়ে এখনো হয়তোবা এখনো তোমার মনে প্রশ্ন জমে আছে । ফুটেজে কিভাবে এতো পরিবর্তন হলো সেটাও জানতে চাও?
‘তুমি কোনো বিপদে পড়ো তা আমি চাইনি ‘ তাই আমি নিজ হাতেই ফুটেজটি অনেকাংশে পরিবর্তন করেছিলাম। কিভাবে করেছি তা নাহয় তোমার অজানা থাক…।
তবে শোনো… রেজাউল করিমকে স্বয়ং লুসিফার মেরে মেরেছিল । শুধুমাত্র এই কারণে… কারণ সে তার সন্তানকে ডেভিল লুসিফারের উদ্দেশ্যে স্যাক্রিফাইস করতে চায়নি।
শুনে হয়তো অবাক হলে!! এত চমৎকার একজন মানুষ! সেও লুসিফারের উপাসক! হ্যাঁ তিয়াশ। আমি আর করিম পূর্বপরিচিত ছিলাম।
আমরা পাঁচ জন ছিলাম… পেন্টাকলের পাঁচ প্রান্তে… তবে পাঁচজনের মধ্যে আমি আর করিম দুজনই শেষ হয়ে গেলাম …..শুধুমাত্র ভালোবাসার জন্য।
ভালোবাসা একটি বিরাট ব্যাপার। সত্যি আমি আমার জীবনের সমস্ত পাপের প্রায়শ্চিত্ত না করতে পারলেও….আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি। অনেক।
‘কখনো হয়তো তোমার কাছে প্রকাশ করিনি’। সব সময় গোপন রেখেছি । তবে তোমার কাছে আমি একটা জিনিস চাইছি।
তুমি যদি সত্যিই আমাকে ভালোবেসে থাকো তাহলে তুমি আমাকে ভুলে যাও। ‘একেবারের জন্য ভুলে যাও’। আমি পাপী। ঘোর পাপী। ‘আমাকে ঘৃণা করো’। ‘ঘৃণা করো’। ‘আমি তোমার ঘৃণা পাবার যোগ্য’।
লেখাটি এখানেই শেষ । তিয়াশ সম্পূর্ণ ডায়েরীতে আর কোন লেখা পেল না ।
তিয়াশের চোখে জল জমছে । বুকের ভেতরটা কেমন যেন শূন্য লাগছে । সব কিছু ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। তার প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে।
‘তবে কি রেহানার গল্পটি এখানেই শেষ’?
রেহানাকে হারিয়ে গেলো তিয়াশের জীবন থেকে। সত্যিকারের অর্থে ।
রেহানাকে তিয়াশ কি কোনদিন ঘৃণা করতে পারবে? নাকি ঘৃণা করতে গিয়ে বারবার তাকে… ভালোবেসে ফেলবে! “ততটা ভালোবাসা যতটা ভালোবাসার জন্য রেহানা তার নিজের জীবন স্যাক্রিফাইস করে তাকে বাঁচিয়ে দিয়ে গেল”।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: (এই গল্পটি মূলত একজন অন্ধকার জগতের বাসিন্দাকে নিয়ে ছিল। ইলুমিনাতি অর্থাৎ শয়তান বা লুসিফারের উপাসনায় আচ্ছন্ন রেহানাকে নিয়ে ছিলো। যে তার অন্ধকার জগত ছেড়ে বের হতে না পেরে গাঢ় অন্ধকারের হাতছানিতে ডুবে গেছে।
রেহানাকে সবার কাছে কেমন লাগেছে? গত দুই পর্বে অনেক প্রশ্ন জমেছিল তা আজকে অন্তিম পর্বে দেওয়ার চেষ্টা করছি। )
আশা করি আমি ব্যর্থ হইনি। গল্পের শুরু থেকে যারা গল্পের সাথে ছিলেন সবাইকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
যদি কোন ভুল ত্রুটি হয় তবে আমি ক্ষমাপ্রার্থী। ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। ধন্যবাদ।
গল্পঃ #অন্ধকারের_হাতছানি_(অন্তিম_পর্ব)
লেখাঃ #নাজিফা_তাবাসসুম