- গরিবের কষ্টের গল্প।
- গরিবের কষ্টের স্ট্যাটাস।
- আবেগি কষ্টের স্ট্যাটাস।
- চাপা কষ্টের স্ট্যাটাস।
১. গরিবের কষ্টের গল্প
সেইবার কুরবানী ইদে আব্বু কুরবানী দিতে পারেন
নাই । তখন আমরা থাকতাম নানাবাড়ির কাছাকাছি একটা ভাড়া বাসায় । নানীজানকে সালাম করতে যেয়ে দেখি টেবিল ভর্তি খাবার । আমার খুব কাছেই ছিল কাবাবের প্লেটটা ।
– ঐ কাবাবে হাত দিস না তো মমোতা , তোর খালুজির জন্য তুলে রেখেছি ।
নানিজানের কথায় আমি টেবিলের ওপর বাড়িয়ে দেওয়া কাবাবের ওপর থেকে হাতটা সরিয়ে নিয়ে চোখ নিচু করে লাজুক দাঁড়িয়ে রইলাম ।
সময়ে কত কিছুই না পরিবর্তন হয় । একটা সময় ছিল যখন আমরা ঢাকায় থাকতাম । বাবা ছিলেন সরকারি চাকুরে , সাভার ব্রাঞ্চের অফিসার ইনচার্জ ।
যেকোন আত্মীয়স্বজন কি নানাবাড়ি কি দাদাবাড়ি , ঢাকায় আসলে , কি ডাক্তার দেখানো কি বেড়ানো অথবা অন্য যেকোন কাজে তখন একটাই ঘাটি আমাদের বাসা । বড় খালার বিয়ের পর হানিমুনে যাবেন বিদেশে , এসে উঠলেন আমাদের বাসায় ।
মামাদের বিয়ের অনুষ্ঠানের সমস্ত আয়োজন , তাদের শ্বশুরবাড়ির মানুষদের আদোর আপ্যায়ন সব কিছুতেই আমার আম্মু । নানা নানির প্রথম সন্তান হওয়াতে আম্মু তার বাপের বাড়ির সব দায় দায়িত্বকে নিজের কর্তব্য মনে করতেন । তাই ছোট বেলা থেকে আমাদেরও একটা অন্যরকম আন্তরিকতা গড়ে উঠেছিল নানাবাড়ির সবার সাথে ।
আব্বু একটা সময় সরকারি চাকুরী করতেন । অতিমাত্রায় সততার খেতাব স্বরুপ টিকে থাকতে না পেরে সেচ্ছায় অবসর নিলেন । এরপর ঢাকার অফিস কোয়ার্টার ছেড়ে দিয়ে আমাদের ঠাঁই হলো মফোস্বল শহরে । আমরা অল্প ভাড়ায় ছোট্ট একটা বাসাভাড়া নিলাম , নানাবাড়ির খুব কাছেই । যা টাকা পেয়েছিলেন অফিস থেকে তাই দিয়ে আব্বু একটা হোটেল ব্যাবসা শুরু করলেন । আমার এক দূরসম্পর্কের মামার সাথে । দুতিন মাস যেতে না যেতেই সেই মামা একদিন বাসায় এসে বললেন আমাদের বাবা নাকি ওনার হোটেলের কর্মচারী ছিলেন ! এই কথায় আম্মু ভিষন রেগে গেলেন ।
– কি বলিস এই সব রাসেল ? তোর দুলাভাই না তোর সাথে ফিফটি পার্সেন্ট পার্টনার ?
– হ্যা আপা পার্টনার তো ছিলেন , তবে সেই টাকা তো আমি গতমাসেই শোধ করে দিয়েছি ।
– কই আমরা তো কিছুই জানি না !
– ঠিক আছে বিশ্বাস না হলে কাগজ দেখেন , এই যে দুলাভাইয়ের সাইন ।
ততোক্ষনে সবকিছু আমাদের কাছে জলের মতো পরিষ্কার । আমাদের যে মামার ক্ষমতা ছিল না একটা মুদি দোকান দেয়ার সে কিভাবে একটা হোটেলের মালিক বনে গেলেন সেটা বুঝতে আমাদের তেমন একটা কষ্ট হলো না ।
আমি তখন মাত্র এইচ এসসি পাশ করেছি । আমার ছোট মিতু আর অভিক পড়ে এইট ও সেভেনে । আব্বু প্রচন্ড শক পেলেন সংসার চলবে কিভাবে ?
আম্মু ততোটা ভেঙে পড়লেন না কারণ তার বাবার বাড়ি কাছেই । একটা সময় নানাবাড়ির সবাই প্রচন্ড অর্থ কষ্টের মধ্যে দিনযাপন করেছিল । নানাভাই যখন সড়ক দূর্ঘটনায় পঙ্গু হয়ে চাকরি হারালেন তখন আমার আব্বু নানারকম সহায়তা দিয়েছিলন । মামাদের স্কুল , কলেজ এমনকি মেজোমামার বিদেশ যাওয়ার টাকাটাও আব্বু যোগাড় করে দিয়েছিলেন ।
তাই আম্মুর সবসময়ই একটা ভরসা ছিল আমাদের দুঃসময়ে আমাদের আত্মীয়পরিজনরাও ঠিক সেভাবেই আমাদের সহায়তা দেবে যেভাবে আমরা সকলের পাশে দাঁড়িয়েছিলাম ।
একটু একটু করে বুঝতে শুরু করলাম এখন আর নানাবাড়িতে আমরা রবাহূত নই বরং অনাহূত । বড় খালার শ্বশুরবাড়ির আর্থিক অবস্থা ভালো । মেজ মামা সপরিবারে আমেরিকায় আছেন । ডলার পাঠান মাসে মাসে । এখন ও বাড়ি গেলেই ছোট দুই খালা নাক শিটকান আর ছোট মামার কপালে বিরোক্তির ভাঁজ ফুটে ওঠে ।
রোজার ইদের দুদিন আগেই দুইখালা বাসায়
এলেন । খালারা না কি ইদের জামা এনেছেন আমাদের জন্য । আমার হাতে মেজোখালা একটা থ্রিপিস দিয়ে বললেন এইটা নে মাত্র দুদিন পরেছি । খুবই দামি। বুঝলাম খালা আমাকে পুরোন জামা দিয়েছেন । ছোট খালা তার হাতের জামাটা আমার ছোটবোন মিতুর হাতে দিয়ে বলল আমার খুব পছন্দের এই জামাটা বুঝলি মিতু কিন্তু খেয়ে দেয়ে এমন মোটা হয়েছি এখন আর গায়ে ঢোকে না । তুই খুব যত্ন করে রাখবি। সাইডে একটু খাপিয়ে নিলেই তোর চমৎকার ফিটিং হবে ।
ওরা বেশি সময় বসল না। কি না কি কেনা কাটা বাকি আছে । নানাভাইয়ের মৃত্যুর পর বড় মামা আলাদা বাসা নিলেন বউ সহ । তারপর আমাদের অবস্থা যখন পড়ে গেল ধীরে ধীরে চিনতে পারলাম কাছের মানুষগুলোকে । নানিজানও ততোদিনে মনের দিক থেকে বেশ দূর্বল । চেষ্টা করেন আমার অবিবাহিত দুই খালা আর ছোট মামা’র মন মর্জি মতো চলতে ।
আম্মু যখন দেখলেন পুরোন জামা দেওয়া হয়েছে তখন শুধু ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন ,
– জানিস মমো , তুই তখন ছোট , তোর নানা বাড়িতে সেবার গিয়েছিলাম ইদ করতে । অনেক খোঁজাখুঁজি করেও লাগেজে রাখা একটা শাড়ি খুঁজে পাচ্ছিলাম না । শাড়িটা দিয়েছিল তোর দাদীমা । আমার খুবই শখের ছিল হালকা গোলাপী রংয়ের সেই তান্চুই কাতান শাড়িটা ।
এর পরের বছর যখন আবার বেড়াতে গেলাম তখন দেখি তোর মেজো আর ছোট খালার পরনে গোলাপী কামিজ সাথে ম্যাচিং সেলোয়ার আর ওড়না পরে ঘুর ঘুর করছে । আমার খুব চেনা চেনা লাগছিল । মেজো তখন একগাল হেসে বলল আপা তোমাকে না জানিয়ে তোমার শাড়িটা কেটে দুটো কামিজ বানিয়েছি । তুমি আবার কিছু মনে করোনি তো ?
বিশ্বাস কর্ আমি তখন একটুও কষ্ট পাইনি অথচ আজ কষ্ট লাগছে ।
অল্প কিছুদিনের মধ্যেই আম্মু সব ভুলে গেলেন । নানীজানের কথামতো ঘটক লাগিয়ে । একমাসের মধ্যেই মেজো খালার বিয়ে ঠিক করে ফেললেন । আমাদের সংসার তখন চলছিল কোন রকমে । আব্বুর পেনশনের কটা টাকা আর আমার টিউসনি তখন একমাত্র সম্বল । বাকিটা চলছিল তখন এর ওর কাছ থেকে ধার দেনা করে । এরই মধ্যে আম্মু একদিন আমাকে নিয়ে গেলেন নানীজানের সাথে দেখা করতে । যেয়ে দেখেন বাড়ি ভর্তি মেহমান গিজ গিজ করছে । আর নানীজানের ঘরভর্তি অনেক শাড়ি, গয়না আর কসমেটিকস্ ।
– কি রে তোরা বিয়ের মার্কেটিং করে ফেলেছিস ? আমাকে একটাবার কোন কিছু জানালি না ?
– আমার বড় খালা বললেন দেখ্ বড় আপা , মেজো বিদেশ থেকে আমার কাছে টাকা পাঠাতেই…………
আম্মু বললেন ,
– মেজো আমাকে বাদ দিয়ে তোর কাছে কেন টাকা পাঠালো তাই তো বুঝলাম না ।
নানীজান তখন আম্মুকে বললেন ,
– মন খারাপ করিস না মা আতসী , এমনিতেই তোর টানাটানির সংসার এখন কি আর তোর ভালো লাগতো বিয়ের মার্কেটিং করতে বল ?
– ও আচ্ছা তাহলে তোমরা এটাই ভেবেছিলে যে আমি হাতে টাকা পেলে সব খরচ করে ফেলব আমার সংসারের পেছনে এই তো ? এই চল্ তো মমো । এই বলে আম্মা বেরিয়ে এলেন নানাবাড়ি থেকে । সেদিন আম্মুর মুখটা শুকিয়ে এতোটুকু হয়ে গিয়েছিল । রাগে, দুঃখে, কষ্টে না কি যন্ত্রণায় বলতে পারব না ।
এর কয়েকদিন পর হঠাৎ একদিন আম্মুর কমদামী ফোনসেটটা বেজে উঠলো । ওপাশ থেকে নানীজানের কান্নার আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল । আম্মু আবার ফোন স্পিকারে দিয়ে রাখে সবসময় ।
– মা রে তুই না বাড়ির বড়ো সন্তান । তুই এভাবে মুখ ঘুরিয়ে রাগ করে থাকলে কি চলে বল ?
-কেন তোমার আর ছেলে মেয়েরা আছে না ? অভিমানের সুরে বললেন আম্মু ।
যাই হোক নানিজানের ফোন পেয়েই দশ মিনিটের মধ্যে আম্মুর রাগ অভিমান তখন সব ঠান্ডা গলা আইস্ক্রিমের মতো গলে গেল । আমার আম্মাজান আবার কাজে নেমে পড়লেন ।
আসল ঘটনা জানা গেল পাত্রি মানে মেজো খালার যেহেতু বাবা নেই তাই আমার মা অর্থাৎ বড় সন্তান ছাড়া তারা কোন কথা বা আলোচনায় বসবে না । পাত্রেরও বড় বোন আছে , যাকে সবাই খুব মানে আর তাই আমার মায়ের জরুরী তলব পড়েছে ।
আমি অনার্স তৃতীয় বর্ষে ওঠার আগেই আমার বিয়ে হয়ে গেল । তারপর অনেক চড়াই – উৎরাই পেরিয়ে আজ আমি প্রতিষ্ঠিত , উপার্জনক্ষম । আমার মায়ের শিক্ষাটা পেয়েছি । ভালোবাসি বাবামায়ের পরিবারকে । খালা মামাদের মতো একটুও হতে চাই না । কারণ ফলাফল চোখের সামনেই তারা কেউ ভালো নেই । তাদের সংসারে পারিবারিক কলহ , শারীরিক অসুস্থতা দানা বেঁধে উঠেছে । আর্থিক সচ্ছলতার পিছু ধাওয়া করতে যেয়ে সুন্দর সময় , সম্পর্ক ও আন্তরিকতাকে হারিয়ে ফেললে তার মতো নিঃস্ব , রিক্ত আর কেউ হয় না ।
তারা যে আত্মার আত্মীয় কি করে ভোলা যায় তাদের !
#আত্মীয় ।
#রেজওয়ানা_ফেরদৌস।
২. গরিবের কষ্টের স্ট্যাটাস
“আম্মা, আজ আমি যদি রোজা রাখি তাহলে কি রাতে গরুর গোশত দিয়ে ভাত দিবে?”
৬বছরের ছেলে আরিফের মুখ থেকে এমন কথা শুনে আমিনা আঁচল দিয়ে চোখের জলটা মুছে বললো,
-“হ্যাঁ বাবা, আজ তুই রোজা রাখলে তোকে রাতে গরুর গোশত দিয়ে ভাত খাওয়াবো।”
মায়ের মুখ থেকে এমন কথা শুনে আরিফ চোখে মুখে আনন্দের ছাপ এনে বললো,
-“তাহালে আমি আজ রোজা ভাঙবো না। আমার যত খিদেই লাগুক না কেন। তুমি কিন্তু বাবাকে বলবে আজ আমি রোজা রেখেছি বাবা যেন বাজার থেকে গরুর গোশত আনে।”
কথাটা বলে আরিফ বাহিরে চলে গেলো। আমিনা আঁচলে মুখ লুকিয়ে ঢুকরে কাঁদতে লাগলো। ছেলেটা পেটের খিদে একদম সহ্য করতে পারে না। একটু পর ঠিকিই খেতে আসবে কিন্তু হাড়িতে তো এক মুঠো চাল নেই। ছেলেকে যে কচু ভর্তা দিয়ে অল্প ভাত খেতে দিবে সেই উপায়ও তো নেই…
মা ছেলের কথা গুলো ঘরের পিছন থেকে শুনছিলো ইউনূস মিয়া। বেড়ার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে দেখেন উনার স্ত্রী আমিনা কাঁদছে। বিয়ে পর থেকে মেয়েটা কেঁদেই গেলো। ইউনূস মিয়া নিজের কপালে নিজে থাপ্পড় মেরে নিজেকে বললেন, কি কপাল নিয়ে জন্মালাম, আজ পর্যন্ত নিজের বউ বাচ্চাকে একবেলা পেট ভরে খাওয়াতে পারলাম না।
উঠানে দাঁড়িয়ে ইউনূস মিয়া চিৎকার করে বললেন,
-“কই গো আরিফের মা? বাজারের ব্যাগটা একটু নিয়ে আসো তো?”
স্বামীর ডাক শুনে আমিনা বাজারের ব্যাগ নিয়ে ছুটে এলেন। স্ত্রীর হাত থেকে বাজারের ব্যাগটা নিয়ে ইউনূস মিয়া হেসে স্ত্রীকে বললো,
-“আজ বাজার থেকে গরুর গোশত কিনে আনবো। রমজান মাস চলে একদিন তো ভালো মন্দ খাওয়া উচিত।”
আমিনা কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,
-“গরুর গোশত আনবেন টাকা কই পাবেন?”
ইউনূস মিয়া স্ত্রীকে ধমক দিয়ে বললেন,
-” তুমি মেয়ে মানুষ তুমি চিন্তা করবে ডালে লবণ বেশি হলো কিনা, ভাত বেশি নরম হলো কিনা এইসব। তুমি টাকার চিন্তা করতে যাও কেন?”
কথাটা বলে ইউনূস মিয়া চলে যেতে লাগলো। তখন পিছন থেকে উনার স্ত্রী আমিনা ডাক দিলো। ইউনূস মিয়া পিছন ফিরে তাকাতেই উনার স্ত্রী মাথা নিচু করে রইলেন। ইউনূস মিয়া তখন বললো,
-“বুঝেছি ঘরে চালও নেই। আমি কিনে নিয়ে আসবো”—
ইউনূস মিয়া মেম্বার সাহেবের বাড়ির ভিতরে এসে দেখে মেম্বার সাহেব বারান্দায় মাদুর বিছিয়ে ভাত খাচ্ছে আর একটা ছেলে মেম্বার সাহেবের পিট চুলকে দিচ্ছে। ইউনূসকে দেখে মেম্বার সাহেব হেসে বললো,
-“আরে ইউনূস মিয়া যে। তা কি মনে করে।”
মেম্বার সাহেব খেয়াল করলেন ইউনুস মিয়া তার খাবারের দিকে তাকিয়ে আছে। মেম্বার সাহেব তখন হেসে বললো,
-” রোজা রাখলে গ্যাস্টিকের ব্যথাটা বেড়ে যায়। তাই আর রোজা রাখি না। আগে ৩০টা করেই রোজা রাখতাম। তা তুমি কি মনে করে?”
ইউনূস মিয়া মাথা নিচু করে বললো,
-“মেম্বার সাব, কয়েকদিন আগে আপনার এইখানে তিনদিন কাজ করেছিলাম। টাকা যদি আজকে দিতেন তাহলে ঘরে দুইকেজি চাল কিনে নিয়ে যেতাম তাছাড়া ছেলেটা আজ রোজা রাখছে। ও ওর মা’র কাছে বায়না করছে রাতে গরুর গোশত দিয়ে ভাত খাওয়ানোর জন্য”
মেম্বার সাহেব বিরক্ত হয়ে বললো,
-“তোর টাকা নিয়ে কি আমি পালিয়ে যাচ্ছি যে দুইদিন পর পর টাকার জন্য আসিস। বলছি তো টাকা দিবো পরে। তোর ঘরে চাল নাই আর তোর ছেলে কোন আক্কেলে গরুর গোশত খেতে চায়? ছেলের জিব্বা কেটে ফেলতে পারিস না? এখন বিরক্ত করিস না সামনে থেকে যা।”
কথাটা বলে মেম্বার সাহেব পিট চুলকাতে থাকা ছেলেটাকে বললেন,
-“অই যা তো ওজুর জন্য পানি দে। আমি খাওয়ার পর যোহুরের নামাজটা পড়বো”
ইউনূস মিয়া মাটিতে কতখানি থুথু ফেলে মেম্বর সাহবের বাড়ি থেকে চলে গেলেন।
দোকানদার কাশেম ইউনূস মিয়াকে দেখেই বললো, আজ কোন বাকি হবে না বলে দিলাম। তোমার এমনিতেই অনেক টাকা বাকি জমছে। সব টাকা শোধ করে তারপর বাকি নিও।
ইউনূস মিয়া মুখটা মলিন করে বললো,
-“ভাই আমি সব টাকা শোধ করে দিবো। সারাদিন রোজা রাখার পর লবণ মেখে যে ভাত খাবো সেই চালটাও ঘরে নেই। তুমি এককেজি আজ অন্তত দাও”
দোকানদার কাশেম চিৎকার করে বললো,
-“বিদায় হও তো। রোজা রেখে এমনিতেই মাথা নষ্ট। তুমি আর মাথা নষ্ট করো না”
দিন মজুর ইউনূস মিয়া সারাদিন একটা কাজের জন্য এদিক ওদিক ছুটাছুটি করলেন কেউ কোন কাজ দিলো না। কেউ এককেজি চাল কিনার মতো টাকা দিয়ে সাহায্য করলো না। ভরা ক্লান্ত শরীর নিয়ে ইউনূস মিয়া মাটিতে বসে পড়লো। এমন সময় উনার কানে আছরের আযানের শব্দ এলো। ইউনূস মিয়া ওযু করা মসজিদে ঢুকলেন। নামাজ শেষে দুই হাত তুলে কাঁদতে কাঁদতে আল্লাহ কাছে বললেন,
-” আল্লাহ গরীবরে পেট সহ কেন দুনিয়ায় পাঠাইলা? আজ গরীরের যদি এই পেট না থাকতো তাহলে গরীব বড়লোকের দ্বারে দ্বারে গিয়ে লাথি খেতো না। আমি এমন এক অসহায় স্বামী যে কিনা নিজের স্ত্রীকে চোখের জল ফেলা বাদে আর কিছুই দিতে পারি নি। আমি এমন এক অসহায় বাবা যে নিজের রোজাদার সন্তানের মুখে একটুকরো গোশত তুলে দিতে পারি নি। হয় আল্লাহ তুমি আমার অভাব দূর করে দাও নয়তো আমার স্ত্রী সন্তান সহ আমারে উঠায় নাও।”…
রাতের অন্ধকারে উঠানের এক কোণে ইউনূস মিয়া নিজেকে লুকিয়ে বসে আছে। কিছুক্ষণ পর উনার স্ত্রী আমিনা আসলে ইউনূস মিয়া বললো,
-আরিফ ঘুমাইছে?
-“হুম ঘুমাইছে”
–ছেলেটা সারাদিন খুব আশায় ছিলো আমি গোশত কিনে আনবো তাই না?
কথাটা বলে ইউনূস মিয়া নিজের হাত কামড়ে ধরে কাঁদতে লাগলেন।
উনার স্ত্রী তখন উনার হাত ধরে বললেন,
-কান্না করেন না যেন। ইনশাআল্লাহ একদিন আমাদের অভাব দূর হয়ে যাবে।
এমন সময় একটা প্রাইভেট কার ইউনূস সাহেবের বাড়ির সামনে এসে দাড়ালো। প্রাইভেট কার থেকে একজন মুরব্বি লোক বের হয়ে উনাদের সামনে এসে দাড়ালো। লোকটার হাতে দুইটা বক্স। ইউনূস মিয়া অবাক হয়ে বললেন,
–আপনি কে?
লোকটা মুচকি হেসে বললো,
-“আমায় তুমি চিনবে না। আমি এইগ্রামে মাছের ফিশারি করবো। তুমি কি আমার সাথে কাজ করবে? মাস শেষে তুমি ১০ হাজার করে টাকা পাবে।”
ইউনূস মিয়া এতোটাই অবাক হয়েছিলো যে মুখ দিয়ে কোন কথা বের হচ্ছিলো না। লোকটা তখন ইউনূস মিয়ার হাতে কিছু টাকা আর বক্স দুইটা দিয়ে বললো,
-” এই নাও তোমার অগ্রীম টাকা আর এইখানে গরুর গোশতের তরকারি আর ভাত আছে। স্ত্রী সন্তানকে নিয়ে খেয়ে নাও।”
কথাগুলো বলে লোকটা যখন চলে যাবে তখন ইউনূস মিয়া বললো,
-“আপনি জানেন কি করে আমার সন্তান গরুর গোশত দিয়ে ভাত খেতে চেয়েছিলো?”
লোকটা পিছন ফিরে হেসে বললো,
-“তোমার নামাজের পিছনের কাতারে আমি ছিলাম। একটা কথা মনে রেখো যার সাহায্য করার মতো কেউ নেই তার আল্লাহ আছে। আল্লাহ চেয়েছিলো বলেই আমি আজ তোমার দোয়ারের সামনে এসে দাড়িয়েছি।”
লোকটা চলে গেলো। ইউনূস মিয়া তখন ভাবতে লাগলেন, আমি যদি এতোদিন মানুষের কাছে হাত না পেতে আল্লাহর কাছে হাত তুলতাম তাহলে হয়তো আমার ঘরের অভাব অনেক আগেই দূর হয়ে যেতো…
(সমাপ্ত)
সৃষ্টিকর্তার_কাছে_চাওয়া
আবুল_বাশার_পিয়াস
৩. আবেগি কষ্টের স্ট্যাটাস
৬ বছর প্রবাস জীবন পার করার পর যখন দেশে ফিরলাম তখন বাবা মা খুব করে চাইলেন আমি যেন বিয়ে করি। আমিও ভেবে দেখলাম বয়স তো কম হলো না। তাই বিয়ে করার জন্য রাজি হলাম।
আমার খালাতো ভাই সুজনকে সাথে নিয়ে এক জায়গায় মেয়ে দেখতে গেলাম। মেয়ে দেখার আগেই মেয়ের বাবা আমায় বললো,
-” ডুবাইতে তো তোমার রেস্টুরেন্টের ব্যবসা আছে তাই না?”
আমি মুচকি হেসে বললাম,
–বিদেশে রেস্টুরেন্টের ব্যবসা করা অনেক ব্যয়বহুল। নিজে ব্যবসা করার মত এতো টাকা আমার এখনো হয় নি।
মেয়ের বাবা অবাক হয়ে বললো,
-”ঘটক যে বললো তোমার সেখানে নিজের রেস্টুরেন্ট আছে?”
আমি তখন বললাম,
–উনি মিথ্যা বলেছেন।বিদেশে আমার নিজের কোন রেস্টুরেন্ট নেই বরং আমি একটা রেস্টুরেন্টে কাজ করি।
মেয়ের বাবা রাগী চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
-”আমি আমার মেয়েকে কোন কামলার কাছে বিয়ে দিবো না।সাহস কত বড়! বিদেশ গিয়ে কামলাগিরি করে দুইটাকা ইনকাম করেছে বলে আমার মেয়েকে বিয়ে করতে আসছে। তোমরা এখন আসতে পারো।”
আমি চুপচাপ মাথা নিচু করে চলে গেলাম।
বাসায় আসার পর মা আর খালা যখন জিজ্ঞেস করলো মেয়ে কেমন দেখেছি তখন পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আমার খালাতো ভাই মুচকি হেসে বললো,
-” মেয়ে দেখার আগেই মেয়ের বাবা পাত্রকে কামলা উপাধি দিয়ে বাসা থেকে বের করে দিয়েছে”
আমি মন মরা হয়ে মাকে বললাম,
–মা, নেক্সট টাইম এত বড়লোক ঘরের মেয়ে না দেখে আমাদের মত নিন্মমধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে দেখো।তাহলে হয়তো এতোটা অপমান করবে না।
খালা তখন আমায় বললো,
-” কামলাকে তো কামলায় বলবে। আমার ছেলের মতো ভালো করে পড়াশোনা করলে আজ বিদেশ গিয়ে কামলা খাটতে হতো না। তুই পরেরবার মেয়ে দেখতে গেলে আর আমার ছেলেকে সাথে নিয়ে যাস না যে। তোর জন্য আমার ভার্সিটিতে পড়ুয়া ছেলে অপমানিত হোক সেটা আমি চাই না”
আমি কিছু না বলে মাথা নিচু করে চুপচাপ নিজের রুমে চলে গেলাম।
কয়েকদিন পর অর্পা নামের একটা মেয়েকে দেখতে যাই। মেয়ে আমার খুব পছন্দ হলে মেয়ের সাথে আমাকে একা কথা বলতে বলে। আমি আর মেয়ে যখন আলাদা রুমে যায় তখন মেয়ে সাথে সাথে দরজা লাগিয়ে আমার দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে বললো,
-” আপনাদের মত প্রবাসীদের এই এক সমস্যা। বিদেশে গিয়ে সুইপারের কাজ করবে আর দেশে এসে টাকার ফুটানি দেখিয়ে মধ্যবিত্ত পরিবারের সুন্দরী আর শিক্ষিতা মেয়েকে বিয়ে করতে চাইবে। আপনার টাকা পয়সা দেখে আমার বাবা মা গলে গেলেও আমি গলবো না। আপনি আমায় বিয়ে করলে আমি আমার পছন্দের ছেলের সাথে বিয়ের পরের দিন পালাবো বলে দিলাম।তাছাড়া আপনার সাহস কতবড় নিজে ইন্টার ফেল করা ছেলে হয়ে অনার্সে পড়া মেয়েকে বিয়ে করতে চাইছেন?”
আমি মাথা নিচু করে মেয়ের কাছে হাত জোর করে বললাম,
–আমি জানতাম না আপনি অনার্সে পড়েন। জানলে আমি আসতাম না।দয়া করে আমায় আর অপমান করেন না যে।
এই কথা বলে মেয়ের বাসা থেকে বের হয়ে আসলাম।
রাতে নিজের বাসায় ফিরে এসে দেখি মা, খালা আর খালাতো ভাই সোফাই বসে আছে। মা আমায় দেখে বললো,
-”কিরে, মেয়ে পছন্দ হয়েছে?”
আমি তখন মাকে বললাম,
–শুধু আমার একা পছন্দ হলে তো হবে না। আমাকেও তো মেয়ের পছন্দ হতে হবে। মেয়ে আমার মত ইন্টার ফেল করা প্রবাসী ছেলেকে বিয়ে করতে পারবে না।
এই কথা শুনে মায়ের পাশে বসে থাকা খালা আর খালাতো ভাই হেসে দিলো।হাসতে হাসতে খালাতো ভাই আমায় বললো,
-”তোমার কপালে আর বউ জুটবে না।”
খালা তখন মুখ বাঁকিয়ে বললো,
-”বউ জুটবে কি করে, বিদেশ গিয়ে রেস্টুরেন্টের থালা বাসন ধুলে কি আর বউ পাওয়া যাবে”
আমি সচরাচর বড়দের মুখের উপর কথা বলি না। কিন্ত খালার বারবার অপমান করে কথা বলা আমার সহ্য হচ্ছিলো না। তাই একটু রেগে গিয়েই খালাকে বললাম,
–হার্ট ব্লক হয়ে যখন হাসপাতালে পড়ে ছিলেন তখন এই কামলায় কামলাগিরি করে আপনাদেরকে দুইলাখ টাকা পাঠিয়েছিলো অপারেশনের জন্য। আপনার ছেলের আইফোনের শখ পূরণ করেছিলো এই কামলায় কামলাগিরি করে। আমি জানি এই দেশের মানুষের চোখে আমরা সকল প্রবাসীরা কমলা। তাই দয়া করে বারবার কামলা কামলা বলে সেটা মনে করিয়ে দিতে হবে না
আমার কথা শুনে খালাতো ভাইটা রেগে গিয়ে বললো,
-” দুইলাখ টাকা আর একটা আইফোন দিয়েছো বলে আমার মাকে যা তা বলে অপমান করতে পারো না। সময় হলে তোমার টাকা আর ফোন তোমার মুখে ছুড়ে মারবো।”
আমি আমার খালাতো ভাইকে কিছু না বলে শুধু একটু হাসলাম। পরদিন সকালে মাকে ডেকে বললাম,
–মা, আমি এখন বিয়ে করবো না। আরো কয়েকবছর প্রবাসে কামলাগিরি করে আসি তারপর একেবারে দেশে এসে বিয়ে করবো।
—
—–
৪বছর পরের ঘটনাঃ-
আমি দেশে এসেছি শুনে আমার খালা আর খালাতো ভাই আমার সাথে দেখা করতে এসেছে। খালা আমার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
-” তুই যেখানে জব করিস সেখানে সুজনের একটা কাজের ব্যবস্থাব করে দিতে পারবি। পাস করার পর তিন বছর ধরে বেকার ঘুরছে কোথাও কোন চাকরি পাচ্ছে না।”
আমি হেসে খালাকে বললাম,
–তোমার শিক্ষিত ছেলে বিদেশ গিয়ে কামলাগিরি করবে তোমার খারাপ লাগবে না? পরে তো নিজের ছেলের জন্য বউ খুঁজে পাবে না।
খালা আমার কথা শুনে চুপ হয়ে আছে।আমি তখন খালাতো ভাইটাকে বললাম,
–নিজে যখন কষ্ট করে টাকা ইনকাম করবি তখন অন্য কারো মুখে টাকা ছুড়ে ফেলবার ইচ্ছে হবে না। খালা আর খালাতো ভাইটা আমার কথা শুনে মাথা নিচু করে আছে। আমি আর কিছু না বলে বাসা থেকে বের হয়ে গেলাম।
একটা বিষয়ে পরামর্শের জন্য এক পরিচিত উকিলের কাছে গেলাম। গিয়ে দেখি ঐ আংকেল যার মেয়েকে আমি বিয়ে করতে গিয়ে ছিলাম বলে আমাকে অপমান করে বের করে দিয়েছিলো উনি উকিলের সাথে কথা বলছে।
আংকেল চলে গেলে আমি উকিলকে জিজ্ঞেস করলাম,
–উনি এইখানে এসেছিলো কেন?
উকিল তখন বললো,
-“উনার মেয়ের ডিভোর্সের বিষয় কথা বলতে। অনেক বড় ঘরে মেয়েকে বিয়ে দিয়েছিলো কিন্তু জামাইটা নেশাখোর।মেয়েকে অত্যাচার করে বলে মেয়ে সংসার করতে চাইছে না”
তার কয়েকদিন পর বাসায় বসে খবরের কাগজ পরছি। হঠাৎ একটা লেখা দেখে চোখটা আটকে গেলো।
“স্বামীর পরকীয়ার জের ধরে স্ত্রীর আত্মহত্যা” ফ্যানে ঝুলন্ত লাশটার দিকে তাকিয়ে দেখি মেয়েটা অর্পা। আমি প্রাবাসী দেখে যে মেয়েটা আমায় অপমান করেছিলো।
আমি পত্রিকা বন্ধ করে ভাবতে লাগলাম, দ্য ডেইলি স্টারের একটা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ২০২০ সালে করোনা মহামারীতেও বাংলাদেশের প্রবাসীরা ২২বিলিয়ন ডলার অর্জন করেছে। অথচ তবুও বাংলাদেশের বেশিভাগ মানুষ প্রবাসীদের কামলার চোখে দেখে। নিজের মেয়েকে নেশাখোর ছেলেদের সাথে বিয়ে দিবে তবুও প্রবাসীদের কাছে বিয়ে দিবে না। বদ চরিত্রের প্রেমিককে বিয়ে করবে তবুও প্রবাসীদের বিয়ে করতে চাইবে না….
বিঃদ্রঃ- আমার এই লেখাটা ফেসবুকে পোস্ট করার আগে ভিডিও আকারে প্রকাশ করা হয়েছে
প্রবাসীর বিয়ে বিড়ম্বনা
আবুল বাশার পিয়াস
৪. চাপা কষ্টের স্ট্যাটাস
বাবা যখন ফোন করে বললো আমার ছোট ভাইয়ের বিয়ে ঠিক হয়েছে এই মাসের ১৫তারিখ বিয়ে তখন আমার একটু কষ্ট লাগছিলো। আমি বড় ভাই অথচ আমায় রেখে বাবা মা আমার ছোট ভাইয়ের বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে। পরক্ষণেই মনে হলো আমি দেশের বাহিরে যেহেতু তাই বাবা মা আমার বিয়ের কথা ভাবে নি। আমি যখন দেশে চলে যাবো তখন আমার বিয়ের কথা ঠিকিই ভাববে। ছোট ভাইকে ফোন দিয়ে বললাম,
–তোর আর তোর হবু বউয়ের বিয়েতে যা যা লাগে আমায় বলিস আমি টাকা পাঠিয়ে দিবো।
ছোট ভাইয়ের বিয়েতে আমি মেয়ের গহনা বাবদ দুইলাখ টাকা পাঠিয়েছিলাম কিন্ত ছোট ভাই তবুও বললো আরো যেন ৫০হাজার টাকা পাঠাই।ওর হবু বউয়ের নাকি খুব শখ মাথায় সোনার টিকলি দেওয়ার।আমি তখন আরো ৫০ হাজার টাকা পাঠাই।
আমি খুব অবাক হয়ে খেয়াল করতাম আমার পরিবারের লোকজন আমায় যখন ফোন দিতো তখন আমি কেমন আছি সেটা প্রথমে জিজ্ঞেস না করে জিজ্ঞেস করতো আমি কবে টাকা পাঠাবো তার এটা লাগবে ওর ওটা লাগবে।প্রথম প্রথম খুব খারাপ লাগতো কিন্তু তারপর মনে হলো আমি পরিবারের বড় সন্তান। আমার কাছে চাইবে না তো কার কাছে চাইবে। আমার পরিবারের লোকজন কষ্ট করে টাকা খরচ করে আমায় বিদেশ পাঠিয়েছে। কিন্তু এখন আমি যদি আমার পরিবারের লোকের চাহিদা না পূরণ করি তাহলে সেটা অন্যায় হবে। আমার ভাই বোন মা বাবা যখন যেটা আবদার করতো আমি আমার সর্বচ্চো চেষ্টা করতাম সেটা পূরণ করার জন্য।
দীর্ঘ ৯বছর প্রবাস জীবন পার করার পর বাবাকে যখন ফোনে বললাম,
–বাবা, আমি দেশে আসতে চাই
বাবা অবাক হয়ে আমায় বললো,
-”দেশে এসে কি করবি”!
আমি বললাম,
— দেশেই কিছু একটা করার চেষ্টা করবো। তোমাদের ছাড়া আমার একা একা থাকতে ভালো লাগে না।তাছাড়া ছোট ভাই বোনের বিয়ে হলো কিন্তু আমি বিয়েতে থাকতে পারলাম না।খুব ইচ্ছে করছে ওদের দেখতে
বাবা তখন কিছুটা রেগে বললো,
-” দেখতে ইচ্ছে হলে মোবাইলে ভিডিও কলে দেখিস। তবুও দেশে আসতে হবে না। তাছাড়া আমি নতুন বাড়ি বানানোর কাজে হাত দিয়েছি। এখন তুই দেশে আসলে টাকা পাঠাবে কে?”
বাবার কথা শুনে এই মূহুর্তে নিজেকে মানুষ না, টাকা বানানোর যন্ত্র মনে হচ্ছিলো।মানুষ ঠিকিই বলে, প্রবাসীদের ওর পরিবারের লোকজন টাকা বানানোর মিশিন বাদে অন্য কিছু ভাবে না।
আমি এর কয়েকমাস পর পরিবারের কাউকে কিছু না বলে হুট করে দেশে এসে পরলাম। আমি দেশে এসেছি বলে আমার পরিবারের লোকজন খুশি হওয়ার চেয়ে মনে হয় কষ্ট পেয়েছে বেশি। ৯বছর পর আমি দেশে এসেছি কোথায় বাবা আমায় বুকে জড়িয়ে ধরবে তা না, বাবা আমার থেকে দূরে বসে আছে। ছোট বোন রাগ করে বসে আছে আমি কেন ওর স্বামীর জন্য রোলেক্স ঘড়ি না এনে অন্য ঘড়ি এনেছি। আমি ওরে বললাম,
— যে ঘড়িটা এনেছি সেটাও অনেক ভালো।
ছোট বোন রাগে ঘড়িটা হাত থেকে ফেলে দিয়ে বললো,
-”আমার স্বামীর লাগবে না এই ঘড়ি। তোমার ভালো ঘড়ি তুমি হাতে দিয়ে বসে থাকো।”
ছোট বোন একটা ঘড়ির জন্য আমার সাথে রাগ করছে অথচ ছোট বোন যখন যা আবদার করেছে সব আমি পূরণ করেছি
ছোট ভাই রাগ করেছে আমি কেন ওর বউয়ের জন্য আইফোন নিয়ে আসি নি। ছোট ভাইকে যখন বললাম,
–ভাইরে, আমার বেতনের চেয়ে একটা আইফোনের দাম বেশি। তাছাড়া তোকে তো একটা আইফোন দিয়েছি
ছোটভাই রেগে গিয়ে বললো,
-” আমার বউয়ের জন্য তোমার কাছে কি এমন চেয়েছি যে দিতে পারলে না? লাগবে না আমার বউকে তোমার কিছু দেওয়া
এইকথা বলে ছোটভাই রাগ করে চলে গেলো অথচ ছোট ভাই কত সহজে ভুলে গেলো ওর বিয়েতে ওর বউয়ের সমস্ত গহনা আমি দিয়েছি।
বাড়ি আসার পর থেকে প্রতিদিন আমাদের দোকানে গিয়ে বসতাম। একদিন বাবা আমায় হুট করে ডেকে বললো
-” তুই বিদেশ যাবি কবে?”
আমি মাথা নিচু করে বললাম,
–আমি তো আর যাবো না। তোমায় তো বলেছিলাম আমি দেশেই কিছু একটা করবো।
বাবা রেগে গিয়ে বললো,
-” দেশে থেকে কি এমন করবি শুনি?”
আমি বললাম
–আমাদের ব্যবসাটা আরো বড় করবো।
পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ছোট ভাই অবাক হয়ে বললো,
-”আমাদের ব্যবসা মানে? দোকান তো আমার।”
আমি তখন বললাম,
–কিন্তু দোকান করতে সব টাকা তো আমি দিয়েছি।
ছোট ভাই সরাসরি অস্বীকার করে বললো আমি নাকি কোন টাকা দেই নি। আমি যেনো তার দোকানে আর না বসি।
ছোট ভাইয়ের কথাতে যতখানি না কষ্ট পেয়েছি তার চেয়ে বেশি কষ্ট পেয়েছি বাবার কথা শুনে। বাবা যখন বললো,
-“ও তো ঠিকিই বলেছে। তুই আর ওর দোকানে বসিস না। পারলে নিজে দোকান দে”
আমি আর কিছু এই বিষয়ে না বলে বাবার দিকে তাকিয়ে বললাম,
–আমি নতুন করেই ব্যবসা করবো টাকা দাও আমায়
বাবা সোজাসাপ্টা বলে দিলো উনার কাছে কোন টাকা নেই। আমি যে ৯টা বছর গাধার খাটুনি খেটে এতো এতো টাকা পাঠিয়েছিলাম সেই টাকা নাকি খাওয়া-পড়াতেই সব খরচ হয়ে গেছে। আমি টাকায় কিনা সকল জমি-জমা ভাই বোনের নামে। আমার নামে কোন সম্পত্তি নেই। ছোট ভাইকে যখন বললাম, কিছু জমি বিক্রি করে অন্তত আমায় কিছু টাকা দিতে। ছোট ভাইয়ের সোজা উত্তর তার ভাগ থেকে এক টুকরো জমিও সে বিক্রি করবে না। ছোট বোনের কাছে যখন কিছু টাকা ধার হিসাবে চাইলাম সেও দিতে রাজি হলো না।
নিজের জন্মদাতা পিতা আর নিজের রক্তের ভাই বোনের থেকে এমন ব্যবহার দেখেও আমি কাঁদতে পারতাম না অথচ আমার ভিতরটা প্রতিনিয়ত ক্ষত বিক্ষত হতো।
আমি যা বুঝার বুঝে গিয়েছিলাম।তাই যেদিন দেশ ছেড়ে চলে যাবো সেদিন আমার পরিবারের লোকদের বললাম,
–তোমারা হয়তো মনে মনে ভাবো বিদেশে টাকা পয়সা রাস্তায় পরে থাকে। কিন্তু বিশ্বাস করো বিদেশে টাকা ইনকাম করা কত কষ্টের সেটা একজন প্রবাসী ছাড়া অন্য কেউ বুঝবে না। ১৮ ঘন্টা হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে বাসায় এসে নিজে রান্না করে খেয়েছি। যে আমি কিনা ৫কেজি ওজনের কিছু মাথায় নিতে পারতাম না সেই আমি ৫০ কেজি ওজনের সিমেন্টের বস্তা মাথায় নিয়ে এক তলা থেকে আরেক তলায় গিয়েছি। তোমাদের জন্য এতকিছু করেও তোমাদের মন পেলাম না। আমি বেঁচে থাকতে এই দেশে কখনো পা রাখবো না। আর যদি মরে যায় তহলে আমার লাশটা যেন বিদেশেই পরে থাকে তোমরা সেটা আর দেশে ফিরিয়ে এনো না
#টাকার_মেশিন
আবুল_বাশার_পিয়াস