–” মামা এক টুকরো গরুর গোশতের দাম কত টাকা?
–” একশো টাকা পড়বে। সলিড গোশত পাবে।
–” এক টুকরো গোশতের এতো দাম! আমার কাছে দশটাকা আছে। এইটা নিয়ে একটু গোশত দিবে? আমার ভাইয়া কাল রাত থেকে না খেয়ে আছে।
–” কাজের সময় বেশি কথা বলো না তো। দশটাকায় গরুর মাংস হয় নাকি! টাকা না থাকলে খাওয়ার শখ জাগে কেন?
দোকানদার মামার কথায় মুখ কালো করে দাঁড়িয়ে থাকে আয়েশা। গতকাল সকাল থেকে ভাইয়ার অনেক জ্বর। কিছুই খেতে পারছে না। শুকনো মুড়ি খেলে বারবার বমি করছে। আয়শা এখনও অনেক ছোট। সবে মাত্র পাঁচ বছর বয়স তার। জন্মের পর থেকে মা বাবা কাউকে দেখেনি । ভাইয়ের কাছেই তার বড় হয়ে ওঠা। আয়েশার ভাইয়ের বয়সও খুব বেশি নয়, এইতো এই বর্ষায় ১৪ বছর হয়েছে।
ভাইয়া নাকি অনেক বৃষ্টির সময় জন্মগ্রহণ করেছিলো। ভাইয়াই এসব গল্প বলে আয়শাকে। আয়শার ভাইয়ের নাম বাদশা। সারাদিন কাগজ কুড়িয়ে মানুষের দোকানে কাজ করে যে টাকা পায় তাই দিয়ে দুইভাই বোনের কোনো রকম দিন কেটে যায়। কোনো দিন যদি বাদশা চাল আনতে না পারে সেদিন ওদের না খেয়েই রাত কাটিয়ে দিতে হয়।
ওই রাস্তার পাশে একটা ঝুপড়ির ভিতর দুইভাইবোন থাকে। দুইজনে মিলে কাগজ, পলিথিন, ভাঙা বাঁশ এসব দিয়ে নিজেদের ঘর বানিয়ে নিয়েছে। ভাইয়ার কথা মনে পড়েই চোখ দিয়ে অঝোরে পানি পড়তে থাকে আয়শার। ভাইয়া গরুর গোশত খেতে অনেক পছন্দ করে। একটু গোশত হলে হয়তো ভাত খেতে পারতো।
সকালে ভাত রান্না করতে গিয়ে হাতে ভাতের মাড় পড়েছে আয়শার। হাতটা পুড়ে লাল হয়ে গেছে। পোড়া জায়গাতে অনেক জ্বালা করছে। কি আর করবে ভাইয়া জ্বরে অজ্ঞান হয়ে আছে। কোনো কথাও বলছে না। শুধু আয়শার নাম ধরে ডাকছে। ভাইয়া ঠিক থাকলে নিজেই রান্না করতো তারপর নানান গল্প বলে আয়শাকে খাইয়ে দিতো। কিন্তু ভাইয়া তো এখন অসুস্থ।
সকাল থেকে কাপড় ভিজিয়ে বাদশার সারা শরীর মুছিয়ে দিয়েছে আয়শা। এখন বাদশা ঘুমাচ্ছে দেখে নিজের কাছে জমানো দশ টাকা নিয়ে দোকানে এসেছে ভাইয়ার জন্য কিছু কিনতে। এই দশটাকার নোটটা গত ঈদে বাদশা সালামি দিয়েছিলো আয়শাকে। খুব যত্ন করে টাকাটা রেখে দিতো আয়শা। সকলকে কতবার নোটটা দেখিয়ে বলেছে, ভাইয়া তাকে সালামি দিয়েছে।
এসব কথা ভাবছে আর এভাবে কেঁদে চলেছে আয়শা। তারপর কিছু একটা ভেবে নিজের হাত দিয়ে চোখ মুছে দোকানদার মামার কাছে গেলো।
–” আচ্ছা মামা আমি তোমার কাজ করে দিলে আমাকে এক টুকরো গোশত দিবে? “
–” এতটুকু মেয়ে তুই কি কাজ করবি শুনি? কাজের সময় বিরক্ত করিস না। গোশত খেতে ইচ্ছে করলে মা বাবাকে গিয়ে বল। দশটাকায় এখন গরুর গোশত পাওয়া যায় না। “
–” আমি তো গোশত খাবো না। ভাইয়াকে দিবো। তুমি যে কাজ বলবে সেই কাজই করে দিবো শুধু আমাকে একটু গোশত দেও। “
দোকানদার কিছু না বলে নিজের কাজে মন দেয়। আয়শা আবার বলে উঠে, ” আমি সব কাজ করতে পারি। আমার কথা শুনবে একটু। একটা কাজ দিয়েই দেখো না। আমি ঠিকঠাক করে দিবো। “
দোকানদার বিরক্ত হয়ে বলে উঠলো, ” আচ্ছা নাছোড়বান্দা মেয়ে তো তুই। আচ্ছা এদিকে আয়। এই থালাবাটি গুলো ধুয়ে দিলে তোকে গোশত দিবো। পারলে কর না পারলে এইখান থেকে যা। “
ছোট আয়শার মুখে হাসি ফুটে ওঠে। সে হাসিমুখে বলে, ” আমি এখনই করে দিচ্ছি দাঁড়াও। “
ছোট ছোট হাত দিয়ে থালাবাটিগুলো পরিষ্কার করতে থাকে আয়েশা। পোড়া হাতে সাবান পানি লেগে বড় জ্বালা করছে। কিন্তু না কাজ না করলে দোকানদার মামা গোশত দিবে না।
আর গোশত না দিলে ভাইয়াকে খেতে দিবে কি? ভাইয়া রোজ আয়শার জন্য চকলেট নিয়ে আসে। নিজের হাতে খাইয়ে দেয়। ভাইয়ার জন্য কি একদিন কষ্ট করতে পারবে না সে। আস্তে আস্তে থালাগুলো পরিষ্কার করতে থাকে।
ঘন্টা খানেক বসে সব থালা পরিষ্কার করা শেষ করে। আয়েশাকে ও-র ভাই বিশ পর্যন্ত গুনতে শিখিয়েছিল, বিশ পর্যন্ত গোনার পর আরও অনেক থালা ছিলো কিন্তু আর গুনতে পারেনি। সিক হিসাব না জানলেও ছোট মাথায় এটা বুঝতে পেরেছে এখানে বিশটার বেশি প্লেট আছে। কাজ শেষ করে আর এক মুহুর্ত সেখানে দাঁড়ায় না আয়শা। দৌড় দিয়ে দোকানদারের কাছে চলে যায়।
–” মামা কাজ শেষ এখন গোশত দেন। “
দোকানদার একটা পলিথিনে ভরে দুই পিচ গোশত দেয় আয়শাকে। গোশতের প্যাকেট হাতে পেয়ে আয়শার মুখে বিশ্বজয়ের হাসি ফুটে ওঠে। এক দৌড় দিয়ে ভাইয়ার কাছে চলে যায়। বাদশা তখন ঘুম থেকে উঠে আয়শাকে খোঁজ করছে। আয়শা দৌড়ে গিয়ে বাদশাকে জড়িয়ে ধরে।
–” ভাইয়া দেখ তোর জন্য গরুর গোশত নিয়ে এসেছি। দাঁড়া আমি তোকে খাইয়ে দিচ্ছি। “
বাদশা কিছু না বলে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে বোনের দিকে। আয়শা প্লেটে ভাত এনে, পলিথিন থেকে গোশত বের করে তারপর ছোট হাতে খাইয়ে দেয় বাদশাকে।
–” ভাত আর গরুর গোশত কোথায় পেলি বোন?”
–” তুমি যে দশ টাকা সালামি দিয়েছিলে না ওটা দিয়ে কিনে এনেছি। ভাতও আমি রান্না করেছি। এখন কথা না বলে তুমি খেয়ে নাও দেখি। কাল থেকে কিছুই খাওনি। “
আয়শার ফর্সা হাতটা রক্তের মতো লাল হয়ে গেছে। বোনের হাত দেখে বাদশা খুব ভালো করে বুঝতে পেরেছে আয়শা গোশত কোথায় পেয়েছে। এ শহরের বাস্তবতা বাদশা খুব ভালো করেই জানে।
আয়শা খুব যত্ন করে ভাইকে খাইয়ে দিচ্ছে। মাঝে মাঝে বলছে, ভাইয়া একটু বড় হা করো।
বাদশার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ছে। তার ছোট বোনটা কত বড় হয়ে গেছে!
পৃথিবীতে এর থেকে সুন্দর দৃশ্য হয়তো আর নেই।
‘আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’ (বুখারি ও মুসলিম)
সমাপ্ত
#সুন্দর_দৃশ্য
কলমে ঃ- #ফারহানা_কবীর_মানাল