“তোমার ছেলেকে সাবধান করে দিও জলিল মিয়া।”
কড়া গলায় কথাটা বললেন আসলাম শেখ। আমাদের এলাকার মেম্বার। আমার বাবা মাথা নিচু করে রাখলেন। আসলাম শেখ কে কিছুই বললেন না।
বাবা কে চুপ থাকতে দেখে আসলাম শেখের রাগটা হয়ত কমে গেছে! বা তিনি বুঝতে পারছেন কাজ হয়ে গেছে। তিনি হনহন করে হেঁটে চলে গেলেন।
এ ঘটনা নিয়ে আমার বাবা আমাকে কিছুই বললেন না। কেন বললেন না জানি না! আমার খুব খারাপ লাগল। আসলাম শেখের মেয়ে সুইটির সাথে আমার একটু সম্পর্ক আছে। তা মনে হয় আসলাম শেখ জেনে গেছেন। আমার বাবা আবদুল জলিল কৃষি কাজ করেন। জমি জমা খুব একটা নেই। আয়রোজগার ভালো না। বাবা আমাকে অনেক কষ্টে লেখা পড়া করাইছেন।
ঘটনা শুরু হলো কিছুদিন পরে। বি সি এস পরীক্ষার রেজাল্ট দিলো। আমি বি সি এস পরীক্ষায় প্রথম হলাম। পত্রিকায় আমার ছবি ছাপা হলো। হঠাৎ করে সাধারণ কৃষকের ছেলে পুরো এলাকার হিরো হয়ে গেলাম।
আসলাম শেখ দশ কেজি মিষ্টি নিয়ে আমাদের বাড়িতে আসলেন। বাবার কাছে ক্ষমা চাইলেন। ওনার এক মাত্র মেয়ে সুইটির সাথে আমার বিয়ের প্রস্তাব দিলেন। বাবাও মনে হয় বিয়েতে রাজি। মায়ের অবস্থা এখনো বুঝা যাচ্ছে না। আমার মনে হয় মা আমার মতো একটা ঘোরের মধ্যে আছে!
এরপরে আসলেন রইস উদ্দিন। আমাদের এলাকার চেয়ারম্যান। আমরা ঠিক বিশ্বাস করতে পারছি না। রইস চেয়ারম্যান আমাদের বাড়িতে এসেছেন। শুধু ভোটের সময় উনাকে দেখা যায়। এরপরে ওনাকে দেখা ভাগ্যের ব্যাপার! সেই চেয়ারম্যান সাহেব আমাদের একচালা টিনের বাড়িতে এসে বসে আছেন, ভাবা যায়?
আমাকে কাছে ডেকে রইস চেয়ারম্যান বললেন, ” সাবাস বেটা! তুমি আমাদের এলাকার গর্ব!”
আমার বাবা পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। গর্বে ওনার বুকে ফুলে উঠেছে!
রইস চেয়ারম্যান বললেন, ” শুনেন জলিল ভাই। আপনার ছেলেটা কে আমার খুব ভালো লেগেছে! আপনার আপত্তি না থাকলে আমার মেয়েটাকে আপনার বাড়িতে বউ করে পাঠাতে চাই।”
আমার বাবা মনে হয় আকাশ থেকে পড়লেন। রইস চেয়ারম্যানের মেয়ে বিয়ে দিবে আমার সাথে! বাবা সাথে সাথে রাজি হয়ে গেলেন! আমার একটু খারাপ লাগছে! সুইটির কথা ভেবে। অবশ্য চেয়ারম্যানের মেয়ে অধরা আর অনেক বেশি সুন্দরী!
বাবা বললেন, “এতো আমার ছেলের সৌভাগ্য চেয়ারম্যান সাব!”
আসলাম শেখের মুখটা কেমন কালো হয়ে গেল! চেয়ারম্যানের ওপরে কথা বলতেও পারছেন না!
অধরার সাথে আমার বিয়ের কথা বার্তা এক প্রকার ফাইনাল হয়ে গেল।
আমাদের থানার এম পি রেজাউল তালুকদার দলবল সহ আমাদের বাড়িতে হাজির। উনি ঢাকায় ছিলেন তাই আসতে একটু দেরি হয়েছে। খবরটা পেয়েই নাকি ছুটে এসেছেন আমাকে শুভেচ্ছা জানাতে।
আমাদের বিস্মিত হওয়ার ক্ষমতা শেষ হয়ে গেছে! যে বাড়িতে মেম্বার কোনোদিন আসে না! সেই বাড়িতে এম পি সাহেব হাজির হয়েছেন!
আমার বাবা তো অনেকটা সময় ছুটাছুটি করলেন কোথায় বসতে দিবেন এম পি সাহেব কে! মেম্বার সাহেব সব ব্যবস্থা করলেন।
চেয়ারম্যান এবং মেম্বার সাহেবের বাড়িতে ভালো আয়োজন থাকলেও এম পি সাহেব আমাদের বাড়িতে সাধারন খাবার খেলেন। বিকালে যাওয়ার আগে ওনার একমাত্র মেয়ে ফারজানার সাথে আমার বিয়ের প্রস্তাব দিলেন!
গ্রামের সাধারণ একজন কৃষক এম পির মেয়ের বিয়ের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়ার সাহস পেলেন না! বাবা এককথায় রাজি হয়ে গেলেন। রইস চেয়ারম্যানের মুখ আন্ধার হয়ে গেল! অবশ্য মুখে বললেন, “এত আমাদের নাবিলের বিরাট সৌভাগ্য! “
ফারজানার সাথে আমার বিয়ে কথাবার্তা ফাইনাল হয়ে গেল। এম পি সাহেব খুশিতে গ্রামের সবাইকে মিষ্টি খাওয়ালেন। অবশ্য বিয়েটা এখন হচ্ছে না। কারণ ফারজানা আমেরিকায় পড়তে গেছে। বিদেশ থেকে ফিরলেই আমাদের বিয়েটা হবে। ফারজানার ছবি দেখলাম। মেয়েটা অসম্ভব সুন্দর! কী মায়া মায়া চোখ। তাকালেই কেমন নেশা ধরে যায়। এমন একটা মেয়ের জন্য অপেক্ষা করাই যায়।
ট্রেনিং শেষ করে আমি এ এস পি হিসেবে জয়েন করলাম। ফারজানা এখনো দেশে আসেনি। এরমধ্যেই আমাদের এলাকায় আমি পরিচিত হয়ে গেছি এম পির জামাই হিসাবে।
এম পি সাহেব নিজেও আমাকে জামাই বলে পরিচয় দেন। আমাদের বাড়িঘরের অবস্থাও ওনার জন্য পরিবর্তন হয়ে গেছে। বাবা এখন বাজারে দোকান চালান। মাঝেমধ্যেই এম পি সাহেব এটা-সেটা পাঠান। আমিও ওনার বাসায় দাওয়াত খেতে যাই। আমাকে জামাই আদর করা হয়।
সুইটির বিয়ে হয়ে গেছে। আমাদের এলাকার এক স্কুল শিক্ষকের সাথে। চেয়ারম্যানের মেয়ে অধরার বিয়ে ঠিক হয়েছে এক প্রবাসী ছেলের সাথে। খুব শীঘ্রই বিয়ে হয়ে যাবে। আমার বিয়ে এখনো হয়নি। অবশ্য আমি এম পির জামাই হয়ে আছি!
সময় আর কেটেছে। আমি এ এস পি থেকে প্রোমোশন পেয়ে এস পি হয়েছি। ফারজানা অনার্স শেষ করে মাস্টার্স করছে। এখনো দেশে আসেনি। দেশে আসলেই আমাদের বিয়েটা হবে। ফারজানার সাথে আমার কথা হয় না। আমার শশুর মাঝেমধ্যে কল দিয়ে খবর নেন। ফারজানার খবর দেন। ” মাস্টার্স শেষ হলেই চলে আসবে। তুমি চিন্তা করো না বাবা। “
আমি খুব একটা চিন্তা করি না। আমার বউ তো আছেই। রাতে বউয়ের ছবি দেখে ঘুমাতে যাই।
সময় কেটে গেছে পনেরো বছর! আমার বাবা মা দুইজনই মারা গেছেন! আমার বয়স চল্লিশ পেরিয়ে গেছে! আমার শশুর এখন মন্ত্রী হয়েছেন। ফারজানা মাস্টার্স শেষ করে পি এইচ ডি করছে। পি এইচ ডি শেষ হলেই দেশে চলে আসবে। তখনই আমাদের বিয়েটা হবে!
আমি এখন মন্ত্রীর জামাই! নিজেরও প্রোমোশন হয়েছে। আমি এখন এ আই জি। কোয়ার্টারে থাকি একা একা। বাবা মা নাই! ফারজানার একটা সুন্দর ছবি আছে। বন্ধুরা বেড়াতে আসে। আমাকে হিংসা করে বলে,” তোর রাজ কপাল। তুই হলি মন্ত্রীর জামাই!”
অবশেষে মন্ত্রী সাহেব কল দিয়ে বললেন, “বাবা রায়হান আমার বাড়িতে চলে এসো। ফারজানা দেশে আসবে আগামীকাল। তোমাদের বিয়েটা দ্রুত দিয়ে দিতে হবে।”
আমার কী যে ভালো লাগছে! সুইটির বড়ো ছেলেটা এস এস সি পরীক্ষা দিয়েছে। এলাকার সবাইকে মিষ্টি খাওয়ালেন আসলাম শেখ। উনি এখন চেয়ারম্যান।
শশুর বাড়িতে এসে বসে আছি। ফারজানা এখনো আসেনি। সন্ধ্যার সময় ফারজান আসল। আমার শশুর কে দেখা যাচ্ছে না। ওনার ছোটো ভাই আমাকে ডেকে বললেন, “আস জামাই তোমার সাথে পরিচয় করিয়ে দেই। এ হলো ফারজানা। “
ফারজানা কে দেখলাম। দেখতে এখনো ছবির মতোই আছে। আমার কী যে ভালো লাগছে! আমার দিকে তাকিয়ে ফারজানা বলল,” আপনার কথা শুনেছি। আপনি আমাদের এলাকার গর্ব।”
আমি একটু হাসলাম। ফারাজানার পাশে একটা পনেরো ষোল বছরের ছেলে দাঁড়িয়ে আছে আর একটা মেয়ে বয়স দশ বছর হবে হয়ত। মেয়েটা দেখতে খুব সুন্দর! এ বাড়ির সবাইকে আমি চিনি না। হয়ত ওর কোনো আত্মীয় হবে।
এ সময় ফারজানা বলল, “এ হলো আমার বড়ো ছেলে রোয়ান। আংকেলকে সালাম দাও বাবা! এটা আমার মেয়ে রুজি!”
© Nabil Mahmud