রবিনকে মেসেজ করলাম, তুমি আমার একটুও কেয়ার করো না, মেসেজ দিলেও রিপ্লাই করো না ঠিকমতো! বিয়ের আগে তো মধু ঝরতো!
বিকাল পাঁচটার মেসেজ সন্ধ্যা সাতটায় রিপ্লাই এলো, “কই! করি তো!”
রেগেমেগে তরকারিতে পানি ঢেলে দিলাম। না খেয়ে থাক!
বাসায় এসে সেই পানি দেয়া তরকারিই আরাম করে খেতে খেতে রবিন বললো, বাহ! সবজির স্যুপটা তো দারুন হইছে!
আমার সমস্যা হলো আমি সরাসরি বলবো না আমি রাগ করেছি। কেন বলবো? একটা মানুষ নিজের থেকে খেয়াল না করলে বলে কি হবে! জোর করে এটেনশন পাওয়া জিনিসটা আমার পছন্দ না। অথচ বিয়ের আগে না চাইতেই এটেনশন পাইতাম!
এটাই বললাম রাতে চুল বাঁধতে বাঁধতে, বিয়ের আগে কত ছেলে আমার পেছনে ঘুরতো, বাসায় প্রস্তাব পাঠিয়ে বিয়ে না করলে আজও আমি একজন ইলিজিবল সিঙ্গেল থাকতাম। সব ছেলেরা চাইতো,এটেনশন দিতো।
রবিন হু হু করছে দেখে তাকিয়ে দেখি ফোন নিয়ে সে মহাব্যস্ত। অথচ বিয়ের আগে অন্য ছেলের নাম নিলে রেগে, জ্বলেপুড়ে একাকার হয়ে যেত।
আমি চিল্লায়ে বললাম, তুমি কি প্রেম করতেছো? সারাদিন ফোনে কি তোমার?
রবিন ফোনটা উঁচু করে দেখালো আমাকে, এক হুজুরের ওয়াজ শুনতেছে। হুজুর সুর করে বলতেছেন,বৌ রে কখনো মাথায় তুলতে নেই, মনে রাখতে হবে স্বামীর পায়ের নিচে স্ত্রীর বেহেশত।
আমি কঠিন চোখে তাকালাম। রবিন ফোন হাতে ঘর থেকে বের হয়ে গেলো।
সংসার জিনিসটা এমনই,দুদিন পর আর মূল্য থাকে না। মানুষের উচিত সংসার টংসার এসব ফালতু জিনিস উঠিয়ে দেয়া।
আজও তরকারিতে পানি ঢেলে দিয়েছি,খা! সবজির স্যুপ খা! বদমাইশ। বিয়ের আগে তো…..
ঠিক করলাম এখন থেকে আমিও রিপ্লাই করবোনা ওর কথার। মেসেজ দিবোনা,কথা বললে হু হু করবো। ওর জন্মদিন ভুলে যাবো,এনিভার্সারি ভুলে যাবো। কত ধানে কত চাল বুঝিয়ে ছাড়বো।
রবিন অফিস যাবার জন্য রেডি হয়ে আমাকে বললো, “গেলাম..”
না শোনার ভান করে টিভির দিকে তাকিয়ে রইলাম। সারাদিনে ফোন দিলাম না, মেসেজ করলাম না।
রবিন একবার মেসেজ দিয়ে জিজ্ঞেস করলো, বাসায় আটা আছে নাকি আনবো?
এর উত্তর দিতে হ্যাঁ বা না কিছু একটা বলা লাগবে। কিন্তু যেহেতু বলবো না তাই রিপ্লাই দিলাম, “হু।” আসলে আটা নেই। না থাকে না থাকুক,ওর সংসার উচ্ছন্নে গেলেও আমার কিছু না।
সন্ধ্যার দিকে আরেকবার মেসেজ দিলো, “আসতে দেরী হবে। কলিগের বিয়ের জন্য একটু শপিং এ আসলাম তার সাথে..”
তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলাম, কিন্তু কোন জবাব দিলাম না। যদিও ভেতরে ভেতরে অনেক প্রশ্ন, কলিগ ছেলে না মেয়ে? কার বিয়ে? বিয়ে তো আমাকে বলেনি কেন? আমারে কি সাথে নিবে বিয়েতে? তাইলে তো শাড়ি কিনতে হবে,ম্যাচিং গয়না কিনতে হবে। পরে হুট করে বললেই কি যেতে পারবো? আমার কি শাড়ি আছে নাকি? বিয়ের পর থেকে কি দিছে আমারে…….
কিন্তু জিজ্ঞেস করবো না,আমি কিছুই জিজ্ঞেস করবো না। নিজের থেকে বললে বল,নাইলে গেলাম না। এই লাবণ্য জীবনে কম বিয়ে খায়নি! আত্নীয়স্বজন ওরচেয়ে আমার বেশীই আছে, আমার দুইটা মামাতো ভাইই দুইবার দুইবার করে চারবার বিয়ে করেছে…. হেহ!
বাসায় এসে পানি মেশানো সবজি খেতে খেতে রবিন লাজুক গলায় বললো, “স্যুপ টা ভালো হয়েছে বলেছি বলে রোজ করবা নাকি! তুমি যে কি!…”
রাগে পিত্তি জ্বলে গেলো আমার, আরে ব্যাটা কার বিয়ে? কবে বিয়ে? বিয়ের থিম কি? কি শাড়ি কিনবো বলবি তো? স্যুপ নিয়ে আহ্লাদ মারলেই আমি নিজে থেকে জিজ্ঞেস করবো নাকি? পুরো একদিন গেলো সে বুঝলো না আমি রাগ করে আছি। বদের হাড্ডি একটা…
খেয়ে উঠে রবিন একটা সিগারেট ধরালো,অন্যদিন হলে এই নিয়ে কুরুক্ষেত্র করতাম, আজ না দেখার ভান করে বসে রইলাম।
আসলে বিয়ের পর মেয়েদের কোন মূল্য থাকে না। বিয়ে মানেই মেয়েদের মূল্যহ্রাস। বিয়ে সমাজের একটা টক্সিক সিস্টেম,বিয়ে…..
রবিন আজকে আবার কি একটা ভিডিও নিয়ে বসেছে, উঁকি দিয়ে দেখলাম রোমান্টিক ভিডিও। মেয়ে রাগ চলে যাচ্ছে ছেলে বলছে, “যেও না। আমাকে একটা শেষ সুযোগ দাও।”
কিন্তু তুই কোন শেষ সুযোগ পাবি না রবিন। সব অবহেলা দ্বিগুণ করে ফিরিয়ে দেবো। ক্ষমা চাইলেও লাভ হবেনা।
ভিডিও দেখে হাই তুলে রবিন ঘুমাতে চলে গেলো। আমি সোফার ওপর বসেই রাত কাটিয়ে দিলাম। আশায় ছিলাম একবার টয়লেটে উঠে দেখবে আমি নেই,তখন আসবে আর রাগ ভাঙিয়ে নিয়ে যাবে।
রবিন আসলো না। ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে আমাকে সোফায় দেখে বললো, “বাহ! আজ দেখি আমারও আগে উঠে বসে আছো! গুড গুড!” বলেই ওয়াশরুমে চলে গিয়ে বিকট শব্দে গার্গল করতে লাগলো।
এই সংসারে থাকবো না! বাপের বাড়ি গিয়ে চাকরি বাকরি করে স্বাবলম্বী হবো,একা থাকবো….
রবিন বের হয়ে এসে বললো, নাস্তা দাও।
ঝাড়ি দিয়ে বলতে গেছি,পারবো না। কিন্তু তাহলে কথা বলতে হয়,কথা বলবো না। তাই নাস্তা বানাতে গেলাম। আটা নাই,পরোটা বানালাম।
রবিন পরোটা পছন্দ করে না। বললো, রুটি কই?
জবাব দিলাম না। রবিন রান্নাঘরে গিয়ে রুটি খুঁজলো,পেলো না। আটার কৌটা দেখলো,খালি।
ফিরে এসে বললো,আটা নাই? কাল বললে না কেন?
আমি জবাব দিলাম, ইচ্ছা হয়নি বলিনি। তুমিও বহুকিছু বলোনা।
ও অবাক হয়ে বললো, কি বলিনা?
আমি জবাব দিলাম না। ও বললো, তুমি কি রাগ করেছো? কাল থেকে চিল্লাইতেছো না!…
আমি চিৎকার করে বললাম, আমি কি সবসময় চিল্লাই? চিল্লাই যদি সংসার করো কেন? চলে যেতে পারো না?
ও বললো, কোথায় যাবো?
আমি বললাম,তাই তো! তুমি কেন যাবা! আমি যাবো,আমার যাবার সময় হয়েছে…
রবিন ভয়ে ভয়ে পরোটা গিলতে লাগলো,পরোটা যদিও পছন্দ না তার।
যাবার সময় বললো, আমার মনে পড়েছে তোমাকে কি লুকিয়েছি,সরি! আমার আসলে কাল সারাদিন মনে ছিলো না…..
আমি কঠিন চোখে তাকালাম, এতক্ষনে কলিগের বিয়ের প্রসঙ্গ তাহলে আসবে….
রবিন বললো,আমি ভেবেছিলাম তোমার মনে নাই। বাট তোমার ঠিকই মনে আছে,সরি! তোমার আব্বু আম্মুর এনিভার্সারিটা ভুলে যাবার জন্য….
আমি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম, আব্বু আম্মুর এনিভার্সারি! শীট! গতকালকে ছিলো! এইজন্য আম্মু ফোন দেয়নি, ভেবেছে আমি দিবো উইশ করবো! শীট শীট শীট….
রবিনের দিকে তাকিয়ে হুংকার দিলাম, “সব তোমার জন্য,এই সংসারে রুটি বানিয়ে বানিয়ে আমার জীবনটা শেষ হয়ে গেছে,আমি বলেই তোমার মতো ছেলের সাথে এতদিন ধরে সংসার করছি,অন্য মেয়ে হলে পরকীয়া করতো,চলে যাইতো, থাকতো না,আমি বলেই….”
রবিন দৌড় দিয়ে পালিয়ে গেলো। সন্ধ্যার দিকে মেসেজ দিলো, “কলিগের বিয়েটা হুট করেই আজ হয়ে যাচ্ছে,মেয়ে দেখতে এসে বিয়ে। রাতে এখানেই খাবো, তুমি খেয়ে নিও।”
শালার কলিগ…
Jannatul Firdous