তিফার আম্মুকে নিয়ে কাব্য রচনা করেছি। কবিতার নাম “বেদনার ঝর্ণাধারা।” কাব্যটিতে প্রেম ও বিরহের মিশ্রণে অতৃপ্ত হৃদয়ের ক্রন্দন ও না পাওয়ার বেদনাকে সযত্নে ধারণ করেছি। কাব্যের প্রতিটি ছন্দে, প্রতিটি অক্ষরে কবি মনের ব্যাকুল বাসনা ফুটে উঠেছে।
কাব্যেটির মূল উপজীব্য তিফার আম্মু হলেও প্রীতি ভাবিকেও ডেডিকেট করা যাবে।
আধুনিক বাংলা সাহিত্যে এমন দ্বিমুখী কাব্য ইতিপূর্বে কেউ রচনা করেনি। প্রথাগত কাব্যধারার বাইরে গিয়ে এটি আমার একটি ক্ষুদ্র প্রয়াস ।
অবশ্য নারীকেন্দ্রিক এই দ্বিমুখী কাব্যধারা কিছুটা ঝুঁকিপূর্ণ। কোনোভাবে এই কাব্যের মূলভাব রিহানের আম্মুর কর্ণকুহরে গেলে বিরাট গণ্ডগোল বেঁধে যেতে পারে ।
রিহানের আম্মুর লিটারেচারের প্রতি কোনো আগ্রহ নাই। কবিতা পাঠ করে কাব্যরস আস্বাদন করার মতো পরিশীলিত মন বিধাতা তাকে দেয়নি। একজন পোয়েটের জীবনসঙ্গী পোয়েট্রি বুঝে না, ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস।
যাহোক দুপুরে রিহানের আম্মু দিবানিদ্রায় গেলে তিফাদের বাসায় যাবো। অনেকদিন ধরে তিফার আম্মুর হাতে মালাই চা খাইনা। কাব্যচর্চার পাশাপাশি চা খেতে খেতে বাংলা সাহিত্যের তমসাছন্ন দিকগুলো নিয়ে বিশদভাবে আলোচনা করবো। মানব মনের অন্ধকার দূরীভূত করে সাহিত্যের আলো প্রস্ফুটিত করতে ঐকান্তিক প্রচেষ্টা চালাবো।
রিহানের আম্মু টিভি দেখছে। আর কিছুক্ষণ পরেই তার চোখ লেগে যাবে। টিভি দেখতে দেখতে ঘুমানো তার নতুন রুটিন।
রিহান সাহেব বাসায় নেই। সে তিফার সাথে গ্রুপ স্টাডি করতে গেছে। লকডাউনের ফলে তার পড়াশোনার ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়েছে। ক্ষয়ক্ষতি পুষাতে তিফার সাথে যৌত প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। ছেলেটা এতো পড়াশোনা করেও প্রতিবছর ফেল কেন করে বুঝিনা। একজন উদীয়মান কবির ছেলে তিন বিষয়ে অকৃতকার্য হয় ! ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস।
একবার কলিংবেল চাপতেই তিফার আম্মু দরজা খুলে দিলেন। তিনি সবেমাত্র গোসল সেরে এসেছেন। তার দেহ থেকে ক্যামেলিয়া সাদা সাবানের সতেজ ঘ্রান ভেসে আসছে। ভেজা চুলে রুমাল প্যাঁচাতে প্যাঁচাতে মুছকি হেসে আমাকে অভ্যর্থনা জানালেন।
– আরে অনি ভাইয়া, আসুন ভিতরে আসুন।
– রিহানকে নিতে আসলাম ভাবি।
– রিহান আর তিফা বারান্দায় খেলছে।
হাতিমার্কা ছেলে গ্রুপ স্টাডির কথা বলে পুতুল নিয়ে খেলে! কতোবড় নালায়েক পুত্র আমার, অধঃপতন তো আর এমনি এমনি হয়নি।
– অনি ভাইয়া বসেন, আপনার জন্য চা করে নিয়ে আসি!
আমি সম্মতিসূচক একটা মৃদু হাসি দিলাম। চা খাওয়ার ফাঁকে সুবিধামতো সময়ে কবিতা আবৃত্তি করবো। যথাযথ প্রাঞ্জল ভাষায় আবৃত্তি করলে কাব্যের সূক্ষ্ম মেসেজটা তিনি নিশ্চয় অনুধাবন করতে সক্ষম হবেন।
তিফার আম্মু তার বিখ্যাত মালাই চা নিয়ে এসেছেন। নিজের জন্যও এক কাপ এনেছেন। এই রুদ্ধদ্বার কবিতার আসর আজ নিঃসন্দেহে সফলতার মুখ দেখবে।
চায়ে চুমুক দিয়ে তিফার আম্মুকে বললাম,
– ভাবি আপনাদের আশির্বাদে নতুন কাব্য রচনায় হাত দিয়েছি।
– তাই নাকি?
– জী ভাবি, আপত্তি না থাকলে একটা কবিতা শুনাতে চাই।
– আপত্তি থাকবে কেন! অবশ্যই শুনাবেন।
– থ্যাংকস ভাবি, তাহলে শুরু করি।
– শিওর।
– আবৃত্তি জনিত ত্রুটিবিচ্যুতি নিজগুণে ক্ষমা করবেন। আমার কবিতাটির নাম
“বেদনার ঝর্ণাধারা”
কবি : অনিকেত
“আমি হেঁটেছি ধূসর মরুতে
হৃদয় পুড়িয়েছি তপ্ত বালুতে।
আমি চাইনি কিছুই,
শুধু চেয়েছি তোমাকে।
আমার তেষ্টা পেয়েছিল খুব।
তাই দৌড়ে এসে,
তোমার রূপ সাগরে দিলাম ডুব।
তোমার রূপের সুধা,
আমার মিটিয়েছে ক্ষুধা।
এই নশ্বর পৃথিবীতে শুধু।
চাই তোমার প্রেমের মধু।”
কবিতা শুনে তিফার আম্মুর চোখেমুখে মুগ্ধতা চিকচিক করছে। তার ঠোঁটে অদ্ভুত রহস্যময় হাসি খেলা করছে। কিন্তু তার দৃষ্টি আমার পিছনে নিবদ্ধ কেন? পেছনে তাকিয়ে হাসছে কেন?
হায়! হায়! একি সর্বনাশ! আমার পিছনে রিহানের আম্মু দাঁড়িয়ে আছে। আশ্চর্য, এই রুদ্ধদ্বার কক্ষে সে কখন প্রবেশ করলো?
– একি তুমি! তুমি এখানে কখন এলে?
রিহানের আম্মু আমার কথার জবাব দিচ্ছে না। সে তার ঐতিহাসিক মিহি হাসি দিয়ে বললো,
– এই নশ্বর পৃথিবীতে শুধু।
চাই তোমার প্রেমের মধু।
রিহানের আম্মুর মুখে উদ্ধৃতাংশুটুকু শুনে আমার কলিজা শুকিয়ে গেছে। তার মানে সে পুরো কবিতা শুনেছে!
– অনি তুমি তো দারুণ কবিতা লেখো।
– থ্যাংকস।
– আসো বাসায় আসো, তোমার সাথে জরুরী আলাপ আছে।
– তুমি যাও আমি আসছি!
এহেন পরিস্থিতিতে গৃহে প্রবেশ করতে অনিরাপদ বোধ করছি। জীবননাশের আশংকা উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না।
আমি তাই সুকৌশলে বাসা থেকে নেমে মালিবাগ চলে আসছি। বউয়ের ধাওয়া খেয়ে শ্বশুরবাড়িতে আশ্রয় নিয়েছি। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস।
যাহোক দুতিনদিন পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আবার আপনালয়ে ফিরে আসবো ইনশাল্লাহ।
বেদনার ঝর্ণাধারা
উদ্বাস্তু অনিকেত