হিটলারের শেষ দিন
১৯৪৫ সালের শুরুতে জার্মানি আক্ষরিক অর্থেই যুদ্ধের উপর সকল নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছিল। পশ্চিম থেকে মিত্রবাহিনী এবং পূর্ব থেকে রেড আর্মির তীব্র আক্রমণে তার সামরিক ক্ষমতাকে সম্পূর্ণ নষ্ট করে দিয়েছিল। তাই এপ্রিলে রেড আর্মি বার্লিনের উপকন্ঠে পৌছে গেলে নাৎসী জার্মানির পতন সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু হতাশা এবং ক্রোধে উন্মাদ হয়ে যাওয়া হিটলার তখনো হার মানতে রাজি ছিলেন না। ১৫ই এপ্রিল ইর্স্টান ফ্রন্টে যুদ্ধরত সৈন্যদের উদ্দেশ্যে তিনি একটি নতুন নির্দেশ ইস্যু করেন। যেটা ছিল তার ইস্যু করা শেষ নির্দেশ। হিটলারের শেষ আর্দেশ তার অনুগত সৈন্যদের হয়তো উদ্ধুদ্ধ করেছিল ঠিকই, কিন্তু মহাযুদ্ধের ফলাফল পরিবর্তনে সেটার কোন গুরুত্ব ছিল না।
১৬ই এপ্রিল ভারি গোলাবর্ষণের মধ্য দিয়ে ওডার এবং নাইসি নদীর প্রতিরক্ষা ভেদ করে মার্শাল যুকভের নেতৃত্বে এক মিলিয়ন সোভিয়েত সৈন্য নাৎসী রাজধানীতে ঢুকে পড়ে। আক্রমণের প্রথম কয়েক ঘন্টা নবম জার্মান আর্মি এবং চতুর্থ ট্যাঙ্ক ডিভিশন তাদের বিরুদ্ধে তুমল প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। তাদের পাল্টা আক্রমণে সোভিয়েতরা ভারি ক্ষয়ক্ষতির শিকারও হয়েছিল। কিন্তু সেটা নিয়ে সোভিয়েতদের কোন মাথাব্যথা ছিল না। তাদের সংখ্যার কোন অভাব ছিল না এবং সারাটা দিন ধরে তারা টানা আক্রমণ চালিয়ে যায়। বিকেলে দক্ষিণে এবং ওডার নদীর পূর্ব দিকে জার্মান প্রতিরক্ষা লাইনে ফাটল ধরে। সেই সুযোগটা কাজে লাগিয়ে লক্ষ লক্ষ সোভিয়েত সৈন্য এবং কয়েক হাজার রাশিয়ান ট্যাঙ্ক জার্মান আর্মিকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে। এতে বার্লিন অরক্ষিত হয়ে পড়ে।
এপ্রিল থেকে মিত্রদের সম্মিলিত বিমানবাহিনী বার্লিনের উপর দিনরাত অবিরাম বোমাবর্ষণ শুরু করে দিয়েছিল। তারা নাৎসী রাজধানীকে ধ্বংস্তূপে পরিণত করেছিল। বিমান হামলা থেকে বাঁচতে হিটলার এবং তার জেনারেল স্টাফ রাইখ চেন্সেলারির বাগানে বিশেষভাবে প্রস্তুতকৃত ফুয়েরার বাংকারে আশ্রয় নিয়েছিল।
আর্কিটেক আলবার্ট স্পেয়ারের ডিজাইনে তৈরী ব্যাংকারটি মাটির ৫৫ মিটার গভীরে অবস্থিত ছিল। বাংকারটি সরাসরি যে কোন আঘাত সহ্য করতে সক্ষম ছিল এবং একসাথে ৫০০ জন মানুষকে ধারণ করতে সক্ষম ছিল। বাংকারটি উপর এবং নিচ দুটি অংশে বিভক্ত ছিল। উপরের অংশে হিটলারের স্টাফ এবং বডিগার্ডরা থাকতো। আর নিচের অংশে স্বৈরশাসক নিজে অবস্থান করতেন। মাটির নিচের সেই সংকীর্ণ পাতালপুরীতেই হিটলার তার জীবনের শেষ দিনগুলো কাটিয়েছিলন চরম অনিশ্চয়তাই এবং আতঙ্কে।
জীবনের শেষ দিন গুলোতে হিটলার মানসিক এবং শারীরিকভাবে ভেঙ্গে পড়া একজন বৃদ্ধ শাসকে পরিণত হয়েছিলেন। তার চেহারার মাধুর্য ও চোখের উজ্জ্বল আত্মবিশ্বাসী ঝলক উধাও হয়ে গিয়েছিল এবং তাকে দেখে মনে হতো তার বয়স প্রতিদিন ১০ বছর করে বৃদ্ধি পাচ্ছে। চামড়ার ক্ষত, অনিয়মিত হৃদস্পন্দন, সিফিলিস এর মতো বিভিন্ন জটিল রোগ তার দেহে বাসা বেঁধেছিল এবং পারকিনসন রোগের কারণে তার বাম হাত সবসময় অনিয়ন্ত্রিত ভাবে কাঁপতো। তার ব্যক্তিগত ডাক্তাররা কোনভাবে জোড়াতালি দিয়ে তাকে সচল রেখেছিল এবং তাকে নিয়েমিত বিভিন্ন কড়া ঔষধ সেবন করতে হতো।
বাংকারে হিটলারের সাথে যোগ দিয়েছিলেন তার অনুগত ভ্যালেট, তার প্রপাগান্ডামন্ত্রী এস.এস সাজেন্ট হারম্যানন ফেগেলাইন এবং ইভা ব্রাউন। ইভা ১৯৩২ সাল থেকে হিটলারের প্রেমিকা ছিলেন। নিজের প্রেমিকের দুঃসময়ে সঙ্গ দিতে এবং তার প্রতি অনুগত্য প্রদর্শন করতেই ইভা বাংকারে অবস্থান করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। ইভাকে বাংকারে আসতে দেখে হিটলারের এস.এস বডিগার্ডরা বুঝে গিয়েছিল খেল খতম। তাই তারা ইভাকে মৃত্যুর ফেরেশতা হিসাবে আখ্যা দিয়েছিল।
সে বছর ২০ এপ্রিল হিটলারের ৫৬তম জন্মদিন ছিল। দিনটা অন্যান্য বছরের মতো ঘটা করে পালন করার কোন অবস্থা ছিল না এবং কেন ঘটা করে পালন করা উচিত হবে না, তা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া বার্লিন শহরই নীরবে জানান দিচ্ছিল। হিটলার নিজেও সেটা অনুভব করতে পেরেছিলেন এবং তার উপদেষ্টা ভ্যালেটকে কোন অয়োজন করা থেকে বিরত থাকতে বলেছিলেন। কিন্তু ২০ এপ্রিল সকালে বাংকারে ভিড় দেখে হিটলার বিস্মিত হন। তাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে সেদিন তার জেনারেল স্টাফের সবাই একত্রিত হয়েছিল। তবে তাদের কাছ থেকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা গ্রহণের সময় স্বাভাবিকভাবেই হিটলার অত্যান্ত বিব্রত ছিলেন। জন্মদিনের শুভেচ্ছা গ্রহণের পর চলতি যুদ্ধ সম্পর্কে আলোচনা করতে হিটলার তার ব্রিফিংরুমে প্রবেশ করেন। সেখানে রিপোর্ট করার জন্য তার সেনাপতিরা অপেক্ষা করছিল। তারা তাকে জানায় যে বার্লিনের পতন এখন শুধুই সময়ের ব্যাপার। কোন ভাবেই বার্লিনকে রক্ষা করা যাবেনা। তারা হিটলারকে অনুরোধ করে বার্লিন ত্যাগ করে উত্তরে পালিয়ে যাবার জন্য। কিন্তু তিনি তাদের প্রস্তাব নাকচ করে দেন। তিনি কাইটেলকে বলেছিলেন-
“কাইটেল আমি জানি আমি কি চাই। আমি যুদ্ধ চালিয়ে যাবো বার্লিনের ভেতর থেকে নয়তো পেছন থেকে।”
হিটলার নিজে বার্লিন ত্যাগ না করলেও তার সেনানায়কদের বার্লিন ত্যাগ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। যেটা তার মনের কথা ছিলনা। তিনি মনে করেছিলেন তারা তাকে ছেড়ে কখনো যাবে না এবং তিনি তাদের তাকে ত্যাগ করার আদেশ দিলেও তারা তাকে ত্যাগ করবে না। কিন্তু হিটলারের সেই ভাবনাটা ভ্রান্ত ছিল। কারণ সেই দিন সকালে তার সেনাপতিরা তাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা নয় বরং তার কাছ থেকে পালানোর আদেশ নিতেই এসেছিল। তাই হিটলার যখন সেদিন বিকেলে জানেতে পারে তার সেনানায়করা বার্লিন ত্যাগ করেছে তখন সে ক্রোধে ফেটে পড়েন এবং যার উপর রাগ করছিলেন তাকেই হত্যা করার আদেশ দিয়ে যাচ্ছিলেন।
এদিকে ২৮ এপ্রিল স্টালিন ব্রিটিশদের কাছ থেকে গোপন সংবাদ পান যে হিটলার বার্লিনেই আবস্থান করছেন। তিনি সময় নষ্ট না করে তার সেনানায়ক যুকভকে দ্রুত বার্লিনের নিয়ন্ত্রন নেবার আদেশ দেন এবং হিটলাকে জীবিত অথবা মৃত তার সামনে হাজির করার নিদের্শ দেন। শীঘ্রয় তিন মিলিয়ন সোভিয়েত সৈন্য বার্লিনের উপর ঝাপিয়ে পড়ে এবং রণক্লান্ত নাৎসী সৈন্যদের নির্বিচারে হত্যা করতে থাকে।
২৯ এপ্রিল হিটলার বুঝতে পারে যে তার পালানোর কোন পথ খোলা নেই। তার সামনে এখন শুধু দুইটি পথই খোলা আছে। প্রথমটি আত্মসমর্পণ এবং দ্বিতীয়টি আত্মহত্যা। মিত্র বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণের কোন ইচ্ছা হিটলারের ছিল না। তিনি তার বন্ধু মুসলিনির করুণ পরিণতি থেকেই শিক্ষা নিয়েছিলেন। ২৮ এপ্রিল যখন মুসলিনি মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলেন তখন ইতালির বিক্ষুব্ধ জনতা তাকে এবং তার স্ত্রীকে পিটিয়ে হত্যা করে মিলান স্কায়ারে উল্টা করে ঝুলিয়ে রেখেছিলেন এবং তাদের গলায় জুতোর মালা পরিয়ে দিয়েছিল। হিটলার ভীত ছিলেন এই ভেবে যে তার সাথেও হয়তো এমনটি করা হতে পারে। তাই তিনি আত্মহননের পথটাই বেছে নেন।
এস.এস সার্জন ড. লুডউইগ বার্লিন ত্যাগের আগে হিটলারকে প্রুসিক এসিডের ক্যাপসুলের একটা অ্যামপুল দিয়ে গিয়ে ছিল। হিটলার সেই বিষটার কার্যকারিতা পরীক্ষা করতে চেয়েছিলেন। তাই তিনি সেটি তার প্রিয় কুকুর ব্লন্ডির উপর পরীক্ষা করেছিলেন। হিটলারের নির্দেশে একজন সৈন্য কুকুরটির মুখে সায়োনাইট বিষের একটি ক্যাপস্যুল ঢুকিয়ে দেয়। সাথে সাথে কুকুরটি মারা যায়। ব্লন্ডি হিটলারের অত্যান্ত প্রিয় কুকুর ছিল। তাই কুকুরটির মৃত্যুতে তিনি শোকহত হয়েছিলন।
৩০ এপ্রিল রাত দুইটার পর থেকে হিটলার তার অনুগত সবার কাছ থেকে বিদায় নিতে শুরু করেন। তিনি সবাইকে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে বলেন এবং বিজয়ের আশ্বাস দিতে থাকেন। হিটলার এই সময় তাদের কাছে অনুরোধ করেন তার মৃত্যুর পর, তার মৃত দেহটা যেন পুড়িয়ে ফেলা হয়। যাতে কেউ তার হদিস করতে না পারে এবং কেউ যেন তার মৃতদেহের অসম্মান করতে না পারে।
দুপুর তিনটার পর হিটলার তার পাঠাগারে প্রবেশ করেন। তার কিছুক্ষণ পরে ইভা তার সাথে যোগ দেন। এরই মধ্যে হিটলার ইভাকে বিয়ে করে তাকে তার স্ত্রীর সম্মান দিয়েছিলেন এই শর্তে যে তাকেও হিটলার সাথে আত্মহত্যা করতে হবে।
হিটলার এবং ইভা পাঠাগারটির দরজা বন্ধ করে দিলে সমগ্র বাংকার জুড়ে পিনপতন নিরবতা নেমে আসে। কয়েক মিনিট অপেক্ষা করার পর কক্ষটির মধ্যে থেকে কোন সাড়া শব্দ না পেয়ে হিটেলারের অনুগত লিনগি এবং ব্যারম্যানন কক্ষটির মধ্যে প্রবেশ করে। তারা সেখানে একটা ছোট সোফাতে হিটলার এবং ইভা ব্রাউনের নিথর দেহ পাশাপাশি পড়ে থাকতে দেখে। ইভার মুখ থেকে তখন প্রুসিক এসিডের কটু গন্ধ বের হচ্ছিল এবং হিটলারের মাথার পেছন দিয়ে রক্ত বের হচ্ছিল। একটা ৭.৬৫ এম.এম পিস্তল স্বৈরশাসকের পায়ের কাছে পড়েছিল। ইতিহাসের খলনায়ক নিজের মুখের মধ্যে গুলি চালিয়ে আত্মহত্যা করেছিল।
দেওয়ান মেহেদী অজেয়