যেদিন তুমি এসেছিলে
সিজন টু পর্ব ২৭
মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
_________________
রাগে মাথার রগ দপদপ করে কাঁপছে তোফায়েলের। সম্মুখেই মাথা নত করে বসে রয়েছে রুহুল। তোফায়েল রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলে,
“অর্ষা যদি বিয়েতে রাজিই না হয় তাহলে তোকে দলে রেখে লাভ কী?”
রুহুল অবাক বিস্ময়ে বলল,
“মানে?”
“মানেটা সিম্পল। অর্ষাকে পছন্দ করতাম আমি অনেক আগে থেকেই। ওকে পাওয়ার জন্যই আমি তোর সাথে বন্ধুত্ব করেছিলাম। তুই না চাইতেও তোকে সাহায্য করেছিলাম। রাজনীতিতে এনে পাওয়ার দিয়েছিলাম। এখন অর্ষাকেই যখন আর পাচ্ছি না তোকেও আমার আর দরকার নাই। চলে যা এখান থেকে।”
রুহুল সামনের তোফায়েলকে চিনতেই পারছে না। বন্ধুত্বের পেছনেও যে এমন স্বার্থ লুকিয়ে ছিল তা কে জানত? রুহুল বসা থেকে উঠে দাঁড়াল,
“অর্ষা ঠিকই বলেছিল, তোর সাথে বিয়ে দিয়ে আমায় যেন আফসোস করতে না হয়। ভাগ্যিস শেষে এসে সব পালটে গেল। নয়তো তোর আসল চেহারা আর সত্য তো অজানাই থেকে যেত। কিছুক্ষণ আগ পর্যন্তও আব্বা-মা আর অর্ষার ওপর আমার প্রচণ্ড রাগ হচ্ছিল। এখন আমি আব্বার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতেছি। তার জন্যই ভবিষ্যতের আফসোসটা আমার করতে হয় নাই। আমার বোনটা বেঁচে গেছে। লাগবে না আমার পাওয়ার, দরকার নাই রাজনীতির; আর না দরকার আছে তোর মতো বন্ধুর। সবকিছুতে আমি রুহুল থু মারি।”
নিজের কথা শেষ করে তোফায়েলকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই রুহুল তার বর্তমান বাড়িটি থেকেও বেরিয়ে গেল। মনে মনে অনুশোচনায় ভুগছে সে। নিজের ভু্লের জন্য ভবিষ্যতে অর্ষাকে এর ফল ভোগ করতে হত এটা ভাবতেই তার মন বিষিয়ে যাচ্ছে।
.
.
“আমার উত্তরটা কিন্তু এখনও পেলাম না অর্ষা।”
অফিসের ক্যান্টিনে মুখোমুখি বসে আছে অর্ষা এবং জিসান। সে ইচ্ছে করেই জিসানের সঙ্গে এসেছে। সব ঝামেলা একেবারে মিটমাট করা উচিত। অর্ষা চায়ে চুমুক দিয়ে বলল,
“সরাসরি কথা বলার জন্যই আপনাকে এখানে ডেকেছি স্যার। অপরাধ নেবেন না, মন খারাপও করবেন না প্লিজ! আমি আপনাকে বিয়ে করতে পারব না।”
জিসান থমথমে মুখে তাকিয়ে আছে। ক্ষীণস্বরে জিজ্ঞেস করল,
“কেন অর্ষা? আমি তোমার যোগ্য নই?”
“ছি, ছি স্যার। এমন কিছুই নয়।”
“তাহলে কী? তুমি কি তাহলে অন্য কাউকে ভালোবাসো?”
কপালে উড়ে আসা ছোটো চুলগুলোকে কানের পিঠে গুঁজে দিয়ে অর্ষা বলল,
“হ্যাঁ।”
“কে সেই ব্যক্তি?”
“সময় হলে বলব।”
“সেই সময়টা কবে আসবে?”
“এখনও শিওর জানিনা স্যার।”
জিসান বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। তার চোখে-মুখে চাপা ক্ষোভ এবং ঈর্ষা। চায়ের বিল মিটিয়ে দিয়ে সে বিনাবাক্যে ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে গেল। অর্ষা দীর্ঘশ্বাস নেয়। মনকে আশ্বস্ত করে এই বলে,
“করুক রাগ! আমার যা বলার তা তো বলতে পেরেছি। এটাই অনেক।”
লাঞ্চের পর সে আহনাফের কেবিনে গেল ফাইলগুলো আনতে। আহনাফ বলল,
“বসো আগে।”
“এখন বসতে পারব না। মিজান স্যার ফাইলগুলো চেয়েছে।”
“আমি ফাইল পাঠিয়ে দিচ্ছি কাউকে দিয়ে। তুমি বসো।”
অগত্যা অর্ষাকে বসতে হলো। আহনাফ চেয়ারে বসে হেলতে-দুলতে বলল,
“আমার মনটা অনেক বড়ো বুঝলে।”
“মানে?”
“মানেটা হলো এই যে, আমি বিয়ে ভাঙা মেয়েটাকে বিয়ে করে তার দায়িত্ব নিতে চাই।”
অর্ষা উঠে দাঁড়াল। টেবিল থেকে ফাইলগুলো নিয়ে চোখ পিটপিট করে বলল,
“কিন্তু বিয়ে ভাঙা মেয়েটার মান-অভিমান এখনও সবটা কমেনি, বরং বেড়েছে। আপনি সেদিন বাড়িতে গিয়ে মেয়েটাকে অনেক কথা শুনিয়েছেন।”
“এখন তাহলে আমায় কী করতে হবে?”
“রাগ ভাঙাতে কাঠখড় পোড়াতে হবে।”
“শেষে আমিই না পু’ড়ে যাই। বলছিলাম যে, সারাবছর যদি রাগ ভাঙাতেই যায় তাহলে বিয়ে করব কবে?”
“আগে রাগ ভাঙান। পরে দেখা যাবে।” বলে অর্ষা কেবিন থেকে বেরিয়ে যায়।
______
সন্ধ্যায় হাসিবের আমন্ত্রণ রক্ষার্থে অফিস ছুটির পর রেস্টুরেন্টে যেতে হলো অর্ষাকে। সকালে এতবার করে বলে গেছে যে, এরপরও না গেলে বিষয়খানা খারাপ দেখায়। ওর সঙ্গে আহনাফ এবং আহিলও গেছে। রেস্টুরেন্টে গিয়ে দেখল গ্যাঞ্জাম পার্টি, হাসিব, আদিব, মুন এবং সকালও আছে। নিশ্চয়ই সকাল মুনের সাথে এসেছে। দিদার বলল,
“এতক্ষণ লাগে আসতে? তোদের জন্য না খেয়ে সবাই বসে আছি।”
ওরা তিনজন বসল। লামিয়া দিদারকে থামিয়ে বলল,
“রাখ তোর খাবার। আগে আসল হিসাবটা মিটিয়ে নিই।”
এই বলে সে হাসিবের দিকে তাকিয়ে বলল,
“এইযে মিস্টার বিড়াল কমিটির চেয়ারম্যান, আমাদের বিড়াল কোথায়?”
হাসিব অসহায় দৃষ্টিতে আহনাফের দিকে তাকায়। আহনাফ মুচকি মুচকি হাসছে। হাসিব কাচুমুচু হয়ে বলে,
“এতগুলো বিড়াল আমি পাব কোথায় এখন?”
রেশমি বলল,
“তা আমরা কী জানি ভাই? বলার সময় মনে ছিল না?”
“আমরা এতকিছু জানিনা। আমাদের বিড়াল লাগবে। কোত্থেকে এনে দেবেন সেটা আপনার ব্যাপার।” বলল জুঁই।
হাসিব বলল,
“বিড়ালের বদলে আজ আপনারা যা যা খেতে চাইবেন তা, তা-ই খাওয়াব।বিল আমার। আপনাদের যত ইচ্ছে খান।”
লামিয়া ভ্রুঁ কুঁচকে বলল,
“আশ্চর্য তো! বিড়াল দিলে কি আমরা বিড়ালকে খেয়ে ফেলতাম? বরং আদর করতাম, যত্ন করতাম, সুন্দর নাম রাখতাম। বিড়ালের বদলে তাহলে খাবার উপযোগী হয় কী করে? এখন কি খাবারকেও আদর-যত্ন করব, নাম রাখব?”
আহনাফ আঙুল দিয়ে কপাল চুলকাচ্ছে। বেচারা হাসিব তার জন্যই ফেঁসে গেছে কিনা! সে গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
“ওকে গার্লস, তোমরা সবাই বিড়াল পাবে। তবে সেটা এখন নয়। হাসিব বিদেশ যাক। প্রতিবার আসার সময় তোমাদের সবার জন্য এক এক করে বিড়াল নিয়ে আসবে ওকে?”
মুন হাত উঠিয়ে বলল,
“দুলাভাই, আমি কুকুর নেব।”
আদিব ধমকে বলল,
“কুকুর দিয়ে করবেটা কী?”
মুন বিরক্ত হয়ে বলল,
“হাল চাষ করাব। তোমার সমস্যা?”
সবাই হাসল মুনের কথা শুনে। আহনাফের কথায় রাজিও হয়ে গেল সবাই। আফটারঅল, হবু দুলাভাইয়ের কথা কি আর ফেলে দেওয়া যায়?
সবার পছন্দ করা খাবার এক এক করে দিয়ে গেল ওয়েটার। আজ আহনাফ এবং অর্ষা পাশাপাশি বসেছে। টেবিলের ওপর অর্ষার পার্স ছিল। আহনাফের হাতের সাথে লেগে সেটি নিচে পড়ে গেল। অর্ষা ঝুঁকে যখন পার্সটি তুলবে তখন আহনাফের হাত থেকে চামচ নিচে পড়ে যায়। বলা বাহুল্য, ইচ্ছে করেই ফেলেছে। সে ঝুঁকে চামচ তোলার বাহানায় ফট করেই অর্ষার নাকের ডগায় চুমু দিয়ে দিল এবং চামচটি তুলে আগের মতো স্বাভাবিক হয়ে বসল। কিন্তু অর্ষা স্বাভাবিক হতে পারল না। সে দ্বিতীয়বারের মতো হতভম্ব হয়ে গেল। সেদিন গালে চুমু দিল, আর আজ নাকে! সে পার্স হাতে নিয়ে কাঠের পুতুলের মতো বসে রইল। ঘটনার প্রত্যক্ষ দর্শক আর একজন ছিল। আশিক! বেচারা নিচু হয়ে পায়ের জুতো খুলতে গিয়ে টেবিলের নিচ দিয়ে ঘটনাটি দেখে ফেলেছে সম্পূর্ণ অনিচ্ছায়। তার চক্ষু চড়কগাছ। বিষম খেয়েছে। হেঁচকি তুলছে সমানে। সকাল পানির বোতল এগিয়ে দিয়ে বলল,
“ভাইয়া পানি খান!”
আশিক পানির বোতল ধরে বসে রইল। এক ঢোক, দুই ঢোক করে প্রায় বোতলের অর্ধেক পানি শেষ করে ফেলল। তবুও তার বিষম গেল না। সে হেঁচকি তুলতে তু্লতে কবিতার মতো আবৃত্তি করল,
“কী দেখিতে কী দেখিলাম
খেলাম আমি বিষম,
আর এখানে জুতা খুলব না;
দুলাভাইয়ের কসম।”
আশিকের এই কবিতা শুনে হেঁচকি ট্রান্সফার হয়ে আহনাফের কাছে চলে যায়। সবাই ভ্রুকুটি করে তাকিয়ে আছে। আহনাফ এবং অর্ষা ব্যতীত তারা কেউ আশিকের কবিতার মানে কিছুই বুঝতে পারেনি। আবার হঠাৎ করে আহনাফের বিষম খাওয়া! আহিল পানির বোতল এগিয়ে দিল আহনাফকে। পানিটুকু শেষ করল আহনাফ। নাক-মুখ জ্বলছে ভীষণ। সে ক্রমাগত মাথা ঝাঁকাচ্ছে। সকাল বোকা বোকা চাহনীতে তাকিয়ে বলল,
“কী হচ্ছে এসব? খাবারে কি কোনো সমস্যা আছে নাকি?”
দিদার বলল,
“না, সকাল বাবু। খাবারে সমস্যা থাকলে আমি পেটুক দিদার সবার আগে ধরতে পারতাম। তুমি নিশ্চিন্তে খেতে পারো। যদি বেশি হয় তাহলে আমার সাথে শেয়ার করতে পারো। আমি মাইন্ড করব না।”
“নিন ভাইয়া। সমস্যা নেই।”
“আরে তুমি তো এখনও খাওয়াই শুরু করোনি। আগে খেতে থাকো।”
সবাই খাচ্ছে। বেচারা আশিক হেঁচকি তুলছিল আর খাচ্ছিল। বাকিরা সবাই বিড়ালের টপিক নিয়ে হাসিবের পেছনে এখনও লেগে আছে। সেই সুযোগে অর্ষা ফিসফিস করে বলল,
“কাজটা আপনি একদম ঠিক করেননি।”
আহনাফও ফিসফিসিয়ে বলল,
“বেশ করেছি! এত রাগ নাকের ডগায় না? দিলাম চুমু।”
কথার মাঝে অর্ষা টেবিলের ওপর বাম হাত রাখতে গিয়ে আবারও পার্সটি নিচে পড়ে যায়। আহনাফ, অর্ষা দুজনই একসাথে নিচু হয় পার্সটি তোলার জন্য। সঙ্গে সঙ্গে আশিক চিৎকার করে দাঁড়িয়ে যায় আর বলে,
“এইই না!”
পার্স না তুলেই দুজনে হকচকিয়ে তাকায় আশিকের দিকে। খেয়াল করে দেখে শুধু ওরাই না, ওদের টেবিলের এবং রেস্টুরেন্টের সবাই আশিকের দিকে বিস্ময় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ওয়েটার খাবার নিয়ে পেছনে যাচ্ছিল সার্ভ করতে। বেচারা নিজেও আশিকের চিৎকার শুনে মাঝপথে থেমে যায়। লামিয়া চিবিয়ে চিবিয়ে বলে,
“তোরে কি গুড়া কৃ’মি’তে কা’ম’ড়া’য়?”
আশিক সবার দিকে তাকিয়ে বোকা হাসি দিয়ে বসে পড়ল। টিস্যু দিয়ে মুখ, গলা মুছছে। বিষম আর হেঁচকির যন্ত্রণায় ভেবেছিল আবারও ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে। তাই তো উত্তেজনায় এভাবে চিৎকার করে উঠল। যা তা একটা অবস্থা! মুন বলল,
“তুমি মনে হয় ভাই, ছোটোবেলায় ঠিকমতো কৃ’মি’র ওষুধ খাও নাই। সময়েরটা সময়ে খাওয়া লাগে। টয়লেটের সাথে কি বের হয়?”
আশিক অসহায় কণ্ঠে শুধাল,
“কী?”
“কী আবার! কৃ’মি। বইতে পড়ো নাই গোল কৃ’মি, লম্বা কৃ’মি…’
আদিব মুনের মুখ বাম হাতে চেপে ধরে বলল,
“ফর গড সেইক বিবিজান, চুপ করো প্লিজ! এখানে আমরা সবাই খেতে এসেছি।”
সবার খাওয়া বন্ধ হয়ে গেলেও দিদারের খাওয়া বন্ধ হয়নি। সে এসব কানেই তোলেনি। আহনাফ ছোটো করে শ্বাস ফেলে। একেকজন একেক ক্যাটাগরির। কেউ কারও থেকে কম যায় না। যেমন তাদের ক্যাটাগরি, তেমন তাদের কথাবার্তা। মুখে ব্রেক নাই একজনেরও। আহনাফ আবারও শ্বাস নিল। বাকি জীবনটা বোধ হয় এদের দরুণ তার ছোটো শ্বাস, বড়ো শ্বাস, দীর্ঘশ্বাস নিতে নিতেই যাবে।
চলবে…
[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।]