#যেদিন তুমি এসেছিলে .
#সিজন_টু
#পর্ব ১৫
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
_________________
স্মৃতি সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে হাঁপিয়ে পড়েছে। আচানক সিঁড়িতে সবাইকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সে ভ্রুঁ কুঁচকে তাকায়। সবার মতো তার দৃষ্টিও যখন সামনে গিয়ে আটকায় তখন বিস্ময়ে সেও হতবাক। তড়িঘড়ি করে সে এগিয়ে যায়। সাথে আরও কয়েকজন এসে অর্ষা ও জিসানকে ধরে উঠায়। বেচারা ভয়ানক ব্যথা পেয়েছে। অর্ষাও যে ব্যথা পায়নি এমনটা নয়। তারচেয়েও বেশি পেয়েছে লজ্জা। এতগুলো মানুষের সামনে কী রকম বিচ্ছিরি একটা ঘটনা ঘটে গেল। আহনাফের দিকে দৃষ্টি পড়ায় সে দৃষ্টি সরিয়ে নিল। স্মৃতি জিজ্ঞেস করে,
“ঠিক আছো তুমি?”
অর্ষা উত্তরে মাথা নাড়ায়। তার আর উপরে যাওয়া হলো না তখন। স্মৃতি ধরে ভেতরে নিয়ে যায়। মিজান অর্ষার ব্যথাতুর মুখাবয়ব দেখে জিজ্ঞেস করে,
“কী হয়েছে?”
উত্তরটা স্মৃতি দেয়। বলে,
“পড়ে গেছে স্যার।”
“সেকি কীভাবে! ব্যথা কি বেশি পেয়েছ?”
অর্ষা কোনো রকম মাথা নেড়ে বলল,
“না, স্যার ঠিক আছি। পাঁচ মিনিট পরে গিয়ে ফাইলগুলো এনে দিলে হবে?”
“তোমার যেতে হবে না। আমি অন্য কাউকে পাঠাচ্ছি। রেস্ট করো তুমি।”
অর্ষা নিজের জায়গায় গিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকে। নানানজনের তাকানো, ফিসফিসিয়ে কথা বলে, তাকে দেখে মিটমিট করা হাসি সবই সে লক্ষ্য করে। প্রচণ্ড খারাপ লাগা সত্ত্বেও কিছু বলতে পারছে না। ক’জনকেই বা বলবে?
.
আহনাফের দৃষ্টি ল্যাপটপের স্ক্রিনে। কিন্তু চোখের সামনে ভাসছে অন্য দৃশ্য। অনেকবার চেষ্টা করেও মাথা থেকে বিষয়টি ঝেড়ে ফেলতে পারছে না। এজন্য তার রাগও হচ্ছে ভীষণ। রাগটা আসলে কার ওপর হচ্ছে সেই বিষয়েও সে সন্দিহান। মেয়েটা এত বেশি কেয়ারলেস! আছে শুধু বস্তা ভর্তি রাগ। মিজান তখন দরজায় নক করে বলে,
“স্যার আসব?”
আহনাফ বলল,
“আসুন।”
মিজান ভেতরে এসে ফাইলগুলো দিয়ে বলে,
“একবার চেক দিয়ে সাইন করুন।”
এই ফাইলগুলো সবসময় অর্ষা নিয়ে আসে। কাজটা অবশ্য অর্ষার-ই। আহনাফ ফাইলগুলো চেক করতে করতে বলল,
“ফাইল আপনি নিয়ে আসলেন যে! অর্ষা ঠিক আছে?”
এতক্ষণে পুরো ঘটনাটা মিজানও জেনেছে। সে অর্ষার বিব্রত মুখ দেখে নিজেই ফাইলগুলো নিয়ে এসেছে। সে বলল,
“কিছু তো বলে না।”
“বেশি অসুবিধা হলে ছুটি দিয়ে দিন। বাসায় গিয়ে রেস্ট করুক।”
“ওকে স্যার।”
আহনাফ সাইন করে ফাইলগুলো এগিয়ে এলো।
__________
সকালের আজ টিফিন পিরিয়ডেই ছুটি হয়ে গেছে। আসার সময় সে তার বান্ধবীর কাছ থেকে ছোট্ট একটা বিড়ালছানা নিয়ে এসেছে। সোনালী রঙের বিড়ালটা দেখলেই মনে হয় আস্ত একটা মিঠাই। সে একটু ভয়ে ভয়েই বাড়িতে ঢোকে। সেলিনা বেগম বারান্দায় বসে ছিলেন। সকালকে চোরের মতো ঢুকতে দেখে জিজ্ঞেস করেন,
“লুকিয়ে কী নিচ্ছিস?”
সকাল থতমত খেয়ে বলে,
“কই কিছু না তো!”
“দেখি এদিকে আয় তুই।”
“ফ্রেশ হয়ে আসি?”
“তোকে আমি এখনই আসতে বলেছি।”
সকাল ভয়ে ভয়ে এগিয়ে যায়। সেলিনা বেগম বিড়াল দেখে আঁৎকে উঠে বলেন,
“এটাকে কোত্থেকে নিয়ে এলি?”
“হিয়ার কাছ থেকে এনেছি মা। আমার একটা বিড়ালের খুব শখ তোমায় বলেছিলাম না?”
“তোরে যে পালতেছি এইতো বেশি! তুই আবার আরেকজনকে পালার জন্য নিয়ে এসেছিস।”
“এমন করো কেন তুমি?”
“অর্ষা দেখলে কেমন রাগ করে দেখিস।”
“আপুকে আমি ম্যানেজ করে নেব।”
সেলিনা বেগম চুপ করে রইলেন। সকাল বলল,
“মা বিড়ালটা কিউট না? ওর নাম কী রাখা যায় বলো তো?”
সেলিনা বেগম এ কথার কোনো উত্তর না দিয়ে বললেন,
“তোফায়েলের সাথে কি তোর দেখা হয়েছিল?”
“না তো! কেন?”
“এমনিই। আচ্ছা তুই যা ফ্রেশ হ গিয়ে।”
সকাল চলে যেতে ধরেই তখন তিনি আবার ডাকেন,
“শোন?”
“কিছু বলবে মা?”
তিনি কাচুমুচু হয়ে বলেন,
“রুহুল তোকেও ফোন দেয় না রে?”
সকালের ভীষণ মায়া লাগে তার বাবা-মায়ের জন্য। মানুষ দুটো ভাইয়াকে কতটা ভালোবাসে! এতকিছুর পরও উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করছে। সে দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলে,
“না, মা।”
“ওহহ।” অসহায় ভঙ্গিতে বললেন তিনি।
সকাল ফ্রেশ হয়ে খাওয়া-দাওয়া করে বিড়ালটাকে নিয়ে বসে আছে। একা একাই ওর সাথে কথা বলছে। গল্প করতে করতে ওর একটা নামও দিয়ে দেয়। প্যাটিস।
.
আহিল এসে বারান্দায় বসে আছে। অর্ষা আজ পাঁচটায় চলে আসবে ফোন করে বলেছিল। তাই সে পৌনে পাঁচটা নাগাদ এসেছে ওদের বাড়িতে। সেলিনা বেগম মিনিট পাঁচেক বসে গল্প-গুজব করেছেন। এখন গেছেন ওমর রহমানকে মেডিসিন খাওয়াতে। সকাল চা বানাচ্ছে। আহিল একা একা বসে আছে তাই ফোন চাপছিল। হঠাৎ মিনমিনে কণ্ঠে শুনতে চায়,
“মিউ, মিউ!”
এদিক-ওদিক তাকিয়ে আহিল নিচে তাকায়। প্যাটিস পায়ের কাছে এসে মিউ মিউ করছে।
আহিল পা সরিয়ে বলে,
“হুস, হুস বিড়াল।”
সকাল চা নিয়ে এসে দেখে আহিল হাত নাড়িয়ে বারবার ‘হুস, হুস’ বলছে।
সকাল কপট রাগ দেখিয়ে বলে,
“একি! আপনি ও-কে হুস হুস করছেন কেন?”
আহিল বলল,
“বিড়াল তাড়াচ্ছি।”
চা আহিলের হাতে দিয়ে সকাল বলে,
“আপনি ও-কে তাড়াবেন কেন?”
আহিল বোকার মতো প্রশ্ন করে,
“তাহলে কী করব?”
“কিচ্ছু করতে হবে না। ও আমার বিড়াল।”
“ওহ স্যরি! আমি ভেবেছি বাইরে থেকে এসেছে।”
সকাল পাশের চেয়ারে বসল। ওর কোলের ওপর প্যাটিস। সে নাক-মুখ ফুলিয়ে বসে আছে। আহিল গলা খাদে নামিয়ে বলল,
“আপনি চা খাবেন না?”
“না। আপনার ওপর আমি ভীষণ রেগে আছি। সাথে বসে যে আপনাকে সঙ্গ দিচ্ছি এটাই বেশি।”
“রাগ করার কারণ?”
“আপনি বাচ্চা একটা বিড়ালকে কীভাবে ধমকাচ্ছিলেন? একটুও মায়া-দয়া নেই আপনার। আপুর ফ্রেন্ড বলে একদম আপুর মতোই কঠিন হৃদয়ের আপনি।”
আহিল ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। সকাল বলে,
“ওভাবে ভ্যাবলাকান্তের মতো তাকিয়ে দেখছেনটা কী? চা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে। শেষ করুন।”
থতমত খেয়ে চায়ে চুমুক দেয় আহিল। গরম চা গিলতে সমস্যা হয়। ঢোক গিলে বলে,
“আপনার বিড়ালের নাম কী?”
সকাল বিড়ালের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
“প্যাটিস।”
“বিড়ালের নাম আবার প্যাটিস কী করে হয়?”
সকাল গম্ভীর হয়ে জিজ্ঞেস করে,
“আপনার নাম কী?”
আহিল কয়েক সেকেণ্ড নিশ্চুপ চেয়ে থেকে বলে,
“আহিল।”
“আপনার নাম যেভাবে আহিল হয়েছে, ওর নাম সেভাবেই প্যাটিস।”
আহিল বিড়বিড় করে বলে,
“রিল্যাক্স আহিল! অর্ষার বোন বলে কথা; কথার স্টাইল এমন তো হবেই।”
.
.
লিফ্টে অর্ষার সঙ্গে আহনাফের দেখা হয়ে যায়। বাটন প্রেস করে সে বলে,
“আপনি যাননি এখনও? মিজান ছুটি দেয়নি?”
অর্ষা অন্যদিকে তাকিয়ে বলে,
“দিয়েছিল। আমিই যাইনি।”
“কেন?”
“ছুটির দরকার হয়নি তাই।”
“আপনি আমার ওপর রেগে আছেন।”
“সেই রাইট কি আমার আছে?”
“রেগে আছেন তার একটা প্রমাণ দিতে পারি।”
অর্ষা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়। আহনাফ বলে,
“আপনি আমার রাগ রাফির ওপর প্রয়োগ করছেন।”
“মানে?”
“আপনি ও-কে পড়াতে আসছেন না।”
“সমস্যা নেই। আজ থেকে রাফি আবার প্রাইভেট পড়তে পারবে।”
এর মানে আহনাফ ধরে নেয় অর্ষা আজ থেকে রাফিকে পড়াতে যাবে। লিফ্ট গ্রাউন্ড ফ্লোরে আসার পর অর্ষা আগে আগে বেরিয়ে যায়। আহনাফ তার গাড়িতে গিয়ে বসে। রাশেদ ড্রাইভ করছে। যাওয়ার সময় রাস্তায় অর্ষাকে হাঁটতেও দেখে। দীর্ঘশ্বাস নিয়ে সে গাড়ির সিটের সাথে মাথা হেলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে। সে আবারও অর্ষার সাথে যেচে কথা বলে ফেলেছে। অর্ষার ভালোর জন্য হলেও ভেবেছিল সেও অর্ষাকে এড়িয়ে চলবে। কিন্তু সম্ভব হচ্ছে না। মন কথা শোনে না। চোখের সামনে দেখে মায়া আরও বাড়ে। কথা বলার ইচ্ছে সংবরণ করে রাখতে পারে না। জেদ, রাগের আড়ালেও যে কষ্টের পাহাড় নিয়ে মেয়েটা ঘোরে সেটা জানে সে। বোঝে। খুব ইচ্ছে হয় তখন পাশে থেকে সাপোর্ট করতে। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে। দিশেহারা লাগছে তার নিজেকে। কোনো পথই যেন সে খুঁজে পাচ্ছে না। কী করবে, কী করা উচিত কিছুই বুঝতে পারছে না।
অনেক ভেবে-চিন্তে সে চোখ খোলে। ফোন বের করে হাসিবকে কল করে। রিসিভ করার পর হাসিবকে কিছু বলতে না দিয়েই বলে,
“হাসিব, আমার মনে হয় শশীর সাথে খোলাখুলি কথা বলা উচিত।”
চলবে…
[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।]