যেদিন তুমি এসেছিলে সিজন ২ সারপ্রাইজ পর্ব ১
মুন্নি আক্তার প্রিয়া
__________________
ক্যাথিওন কোথা থেকে যেন একজন সঙ্গী জুটিয়ে এনেছে। এই সঙ্গীটি বিড়াল। ক্যাথিওনের বাড়ির বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। সিকিউরিটি গার্ডের চোখে ফাঁকি দেওয়া অসম্ভব। তাহলে এই নতুন বিড়ালটিই কোনো না কোনোভাবে বাড়ির ভেতর চলে এসেছে। এসে আবার ভাবও করে ফেলেছে ক্যাথিওনের সঙ্গে। দুজনে বসে বসে লেজ নাড়াচ্ছে। অর্ষা ক্যাট ফুড হাতে করে বসে আছে। দুজনের গতিবিধি লক্ষ্য করছে সে। রাফি দৌঁড়ে রুমে এলো। তার হাতে সাদা রঙের দুইটা জবা ফুল। অর্ষা এই বাড়িতে বউ হয়ে আসার পর থেকে রাফি যেখানেই ফুল দেখবে সেখান থেকেই একটা হলেও ফুল সে অর্ষার জন্য নিয়ে আসবে। সেটা যে করেই হোক না কেন; দরকার হলে টাকা দিয়ে হলেও নিতে হবেই। আজও এর ব্যতিক্রম হয়নি। স্কুল থেকে ফেরার পথে এক বাড়ির সামনে জবা ফুল দেখে বায়না ধরেছে সে এই ফুল নেবেই। রাশেদ জানে রাফির জেদ সম্পর্কে। বাধ্য হয়েই গাড়ি থেকে নেমে সে চুরি করে ফুল ছিঁড়ে দিয়েছে।
রাফি ফুল হাতে ঘরে এসে স্তব্ধ হয়ে যায়। ভীষণ অবাক হয়ে বলে,
“মামি! এই নতুন বিড়ালটা কে এনেছে?”
অর্ষা বিড়াল দুটোকে খাবার দিতে দিতে বলল,
“কেউ আনেনি। ও একাই এসেছে বিনা নিমন্ত্রণে। বেশরম! লজ্জা নেই। তোমার মামার মতো।”
“বিড়ালেরও কি লজ্জা থাকে মামি?”
অর্ষা হেসে ফেলে। রাফিকে কোলে বসিয়ে বলে,
“কী জানি! হয়তো থাকে।”
“এখন থেকে কি এই বিড়ালও আমাদের বাড়িতে থাকবে?”
“তুমি চাইলে থাকবে।”
“সত্যিই? আমি তো চাই ও থাকুক। আমার বিড়াল অনেক ভালো লাগে। তোমার বোনের বিড়ালটাও অনেক সুন্দর। প্যাটিসকে মনে চায় নিয়ে আসি। কিন্তু সকাল আন্টি তো দেবে না তাই না?”
“না তো! প্যাটিসকে নিয়ে আসলে তোমার সকাল আন্টি কষ্ট পাবে। কাঁদবে।”
“না, থাক। আমি তাকে কাঁদাব না। সে অনেক লক্ষী। আচ্ছা মামি শোনো?”
“বলো বাবা।”
“ও আবার চলে যাবে না তো পরে?”
“কেন যাবে? ক্যাথির মতো ওকেও ভালোবাসবে। আদর করবে। খেলবে একসাথে। তাহলে আর যাবে না। মায়া হবে ওর তোমার জন্য।”
“ওর একটা নাম দাও তাহলে।”
“তোমার মামা আসুক। সে এসে নাম দেবে। এখন তুমি যাও স্কুল ড্রেস পালটে কিছু খেয়ে নাও।”
“তারপর আমি ওদের সাথে খেলব আচ্ছা?”
অর্ষা হেসে বলল,
“আচ্ছা।”
রাফি ফুলটা অর্ষার খোঁপায় গুঁজে দিয়ে চলে গেল। বিছানার ওপর অর্ষার ফোন বাজছে। রিংটোন বলে দিচ্ছে কলটি এসেছে ম্যাসেঞ্জারে। সে উঠে ফোন হাতে নিল। ফোনের স্ক্রিনে “গ্যাঞ্জাম পার্টি” নাম লেখা। এটা ওদের ম্যাসেঞ্জার গ্রুপ। গ্রুপের নাম পালটিয়ে এই নাম রাখা হয়েছে। অর্ষা ফোন রিসিভ করতেই দেখল শুধু আশিক আছে। সে এড হওয়ার পর কলে জয়েন করল লামিয়া।
আশিকের এলোমেলো উশকো-খুশকো চুল দেখে অর্ষা বলল,
“তোর এমন দেবদাসের মতো অবস্থা কেন?”
আশিক বিষণ্ণতায় ডুবে গিয়ে বলল,
“তোর বান্ধবী পার্বতীর মতো অন্য কাউকে বিয়ে করে ফেললে আমার কি দেবদাস না হয়ে উপায় আছে?”
এর মাঝে বাকিরাও কলে এড হয়েছে। রেশমি প্রশ্ন করল,
“কে পার্বতী? কার কথা বলছিস?”
“স্মৃতির কথা বলছি।”
অর্ষা অবাক হয়ে বলল,
“ওর সাথে তোর কথা হয়েছে?”
“হয়েছে না। সবসময়ই হয়। কিন্তু খুব একটা পাত্তা দেয় না। খুব ভাব। একদম তোর মতো।”
মুন ভাতের প্লেট হাতে নিয়ে বসেছে কথা বলার জন্য। সে গোগ্রাসে খাবার গিলছিল আর কথা শুনছিল। সে আবার মুখে ভাত ঢুকিয়ে বলল,
“মেয়ে মানুষের ভাব না থাকলে তোমরা পুরুষজাতিরা আবার তখন দাম দিতে চাও না। যারা তোমাগো মন-প্রাণ দিয়া ভালোবাসে, ওদেরকে তোমাদের ভালো লাগে না। এইযে স্মৃতি এখন তোমাকে পাত্তা দিচ্ছে না, এজন্যই ওকে তোমার ভালো লাগে।”
লামিয়া বিরক্তসুরে বলল,
“শালার প্রায় সব ছেলেরই এক স্বভাব। মেয়ে দেখলেই ছোঁকছোঁক করে।”
আহিল ভ্রুঁ কুঁচকে শুধাল,
“এসব আবার কী কথা?”
মুন দাঁত বের করে হেসে বলে,
“লামিয়া কিন্তু মিথ্যা কিছু বলেনি। তুমি যে প্রতিদিনই অর্ষাদের বাসায় যাও এটা কিন্তু আমি জানি। কেন যাও তাও জানি। বলব?”
আহিলের বিষম উঠে যায়। সে কেশে বলে,
“না, থাক। তুমি ভাত খাও বোন।”
লামিয়া বলল,
“তোরা আমার কথা শোন। বিশেষ করে অর্ষা, তোকে বলছি শোন। তোর দেবরটাকে সামলে রাখিস বলে দিলাম।”
“আহিল আবার তোকে কী করল?” বলল জুঁই।
আহিলও তাল মিলিয়ে বলল,
“সেটাই তো! আমি কী করেছি?”
লামিয়া আরও বেশি বিরক্ত হয়ে বলল,
“চুপ কর গা’ধা! তোর কথা বলিনি। বিড়াল কমিটির চেয়ারম্যান মিস্টার হাসিবের কথা বলেছি। সে তো আজকাল উঠতে-বসতে, ঘুমাতে, হাঁটতে, দিনে, নিশিতে প্রতিটা মুহূর্তে হয় টেক্সট নয়তো কল করছে। কেন এত কল করে জিজ্ঞেস করলেই বলে, বেয়াইনকে তো কল দেওয়াই যায়। বেয়াইন হই আমি মানলাম। সরকারি তরকারি তো আর না। যখন তখন কেন আমাকে কল করবে?”
দিদার বলল,
“তাতে এমন কী দোষ হয়ে গেছে শুনি? তোর টাকায় তো আর কথা বলে না নিশ্চয়ই।”
“তুই কি হাসিব ভাইয়ার থেকে ঘুষ খেয়েছিস দিদার?” জানতে চাইল জুঁই।
দিদার জিভ কেটে বলল,
“ছি, ছি! আমি দিদার খা’দ’ক, পে’টু’ক হতে পারি। কিন্তু ঘুষখোর নই।”
আশিকের বিরক্তির সীমা রইল না। সে খ্যাঁক করে বলে উঠল,
“কল করলাম আমি আমার দুঃখ তোদের সঙ্গে শেয়ার করার জন্য। আর তোরা তোদের কথা বলেই কুল পাচ্ছিস না।”
জুঁই বলল,
“শুনি তোর কথা। বল।”
“বুঝলি, দুঃখের কথা আর কী বলব! স্মৃতির বিয়ের জন্য নাকি ছেলে খুঁজছে।”
“এটা তো ভালো খবর। খুব শীঘ্রই আরেকটা দাওয়াত পাব। বিয়ে বাড়ির খাবারের সঙ্গে অন্য কোনো খাবারের তুলনা হতেই পারে না।” বলল দিদার।
আশিক চিবিয়ে চিবিয়ে বলে,
“এই পেটুকটাকে কেউ থামা ভাই! একে কিন্তু আমি ম’রা’র খাওন খাওয়াব বলে দিচ্ছি।”
মুন বিস্ময় নিয়ে শুধাল,
“সেকি! স্মৃতির বিয়ের কথা শুনে তুই কি ম’রে যাওয়ার চিন্তা-ভাবনা করছিস নাকি?”
আশিক এরচেয়েও বেশি বিস্ময় নিয়ে বলল,
“আমি এই কথা কখন বললাম?”
“মাত্রই তো বললি ম’রা’র খাওন খাওয়াবি। চল্লিশার দাওয়াত আগেই দিয়ে রাখছিস?”
বাকিরা হেসে উঠল। আশিক কপাল চাপড়ে বলে,
“তোর এত বুদ্ধি বইন! তুই ঘুমাস কীভাবে রাতে?”
“বিছানায় শরীর রাখি। বালিশে মাথা রাখি। জামাইকে জড়িয়ে ধরে তারপর ঘুমাই। আরও কিছু শুনবি?”
“না, বইন। থাম তুই। মাফ চাই আমি। আমার কথাটা একটু সিরিয়াসলি নে তোরা প্লিজ!”
অর্ষা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল,
“তুই স্মৃতিকে নিয়ে সিরিয়াস বলতে চাইছিস?”
“হ্যাঁ, ভাই।”
“আগের গার্লফ্রেন্ডদের কী হবে তাহলে?”
“সব বাদ। স্মৃতি রাজি হলে আর কাউকে চাই না আমার।”
আহনাফ অফিস থেকে চলে এসেছে। অর্ষা সামনে তাকিয়ে দেখল একবার তাকে। এরপর আশিকের উদ্দেশ্যে বলল,
“এতই যখন প্রেম। তখন সরাসরি গিয়ে প্রপোজ কর। দেখ ও কী বলে। আমাদের সামনে কান্নাকাটি করে কী লাভ হবে?”
“অবশ্যই লাভ হবে। তোরা সবাই একটু ওকে বোঝালেই তো হয়।”
“দেখ আশিক, ভালোবাসা বুঝিয়ে করার মতো কোনো জিনিস নয়। এমন হতো যে, তোদের সম্পর্ক ছিল কিন্তু ভুল বুঝাবুঝি হয়েছে। অথবা ঝগড়া হয়েছে। তাহলে না হয় আমরা বুঝিয়ে সব মিটমাট করে দিতে পারতাম। কিন্তু এখানে বিষয়টা তো ভিন্ন। তুই এক তরফাভাবে স্মৃতিকে পছন্দ করিস। আমরা তো ওকে জোর করতে পারি না। ভালোবাসা পেতে হলে তোকেই যা করার করতে হবে। এখানে আমরা শুধু তোকে সাপোর্ট-ই করতে পারব এই যা!”
আশিক মুখটা মলিন করে বলল,
“তাহলে এখন আমি কী করব?”
“ওর সঙ্গে সামনা-সামনি কথা বলবি। এখন রাখছি আমি। পরে কথা বলব।”
লামিয়া তড়িৎগতিতে বলল,
“এই দাঁড়া, দাঁড়া। রাখছি মানে কী আবার? আমার সমস্যার সমাধান কে করবে?”
অর্ষা মুচকি হেসে বলল,
“তোর বিড়াল কমিটির চেয়ারম্যানের বিচার তোদের দুলাভাইকে দেবো। সে যা করার করবে।”
“দুলাভাই আসছে?” জানতে চাইল মুন।
“হ্যাঁ।”
“আচ্ছা যা তাহলে এখন। পরে কথা বলিস।”
“আল্লাহ্ হাফেজ।” বলে ফোন কেটে দিল অর্ষা।
আহনাফ দু’হাত ছড়িয়ে বিছানায় আকাশমুখী হয়ে শুয়ে আছে। ঘেমেনেয়ে শার্ট ভিজে গেছে। ফোন বিছানার ওপর রেখে অর্ষা কিছুটা এগিয়ে গেল। আহনাফ চুলের মাঝে হাত বুলিয়ে বলল,
“শুয়ে পড়লেন যে? ফ্রেশ হয়ে আসুন। খাবেন না?”
অর্ষার কোলে মাথা রাখল আহনাফ। দু’হাতে অর্ষার কোমর জড়িয়ে ধরে বলল,
“হ্যাঁ, একটুপর।”
অর্ষা কিছু বলল না। আহনাফ নিজেই বলল,
“ক্যাথিওন নাকি একটা বিড়াল নিয়ে এসেছে?”
“ও আনবে কীভাবে? বিড়ালটা বোধ হয় একাই এসেছে। আপনাকে কে বলল?”
“রাফি বলল। রেণু তো বিড়াল রাখতে চাচ্ছে না। রাফি এজন্য কাঁদছে এখন।”
“কেন? থাকুক। সমস্যা কী?”
“সমস্যা নেই আমার। তুমি চাইলে থাকবে।”
“রাফি ওর একটা নাম রাখতে বলেছে।”
“কী নাম রাখব? উমম…অ্যানিওন। আজ থেকে ওর নাম অ্যানিওন।”
অর্ষা হাসল। বলল,
“হাসিব ভাইয়া কি লামিয়াকে পছন্দ করে নাকি?”
“হঠাৎ এই প্রশ্ন?”
“লামিয়া আজ বলল, সে নাকি ফোন করে, ম্যাসেজ করে বারবার।”
“হয়তো করে। এতে সমস্যা কী? ভালো লাগে তাই কল করে।”
“খুব যে বন্ধুর সাফাই গাইছেন।”
“গাইবোই তো। ও আমাকে অনেক হেল্প করেছে।”
“বেশ! তাহলে আমার কী করা উচিত?”
“ওদের ব্যাপারে? ওদের ব্যাপার নিয়ে তোমার কিছু করতে হবে না। তুমি শুধু আমায় ভালোবাসো।”
“হুহ! আর তো কাজ নেই খেয়ে-দেয়ে।”
“নেই-ই তো! শুধু আমায় ভালোবাসবে ব্যস।”
“আর আপনি? আপনি ভালোবাসবেন না?”
“আমি তো ভালোবাসিই। সেই প্রথম থেকেই।”
“কখন থেকে?”
“যখন থেকে আমার মন চু’রি করেছ। মনে আছে একবার অফিসে পড়ে গিয়ে ব্যথা পেয়েছিলে?”
“হ্যাঁ।”
“সেই মেডিসিন, চিরকুটের কথা মনে আছে?”
অর্ষা কৌতুহলী হয়ে বলল,
“আরে হ্যাঁ! কিন্তু ওগুলো কে দিয়েছিল আমি তে জানতাম না।”
আহনাফ মুচকি হেসে বলল,
“অফিসের করিম চাচাকে দিয়ে আমিই পাঠিয়েছিলাম।”
“সরাসরি আমায় না দিয়ে ডেস্কে কেন রেখেছিল?”
“আমি বলেছিলাম তাই। সরাসরি দিলে তো আমার নামটাও চলে আসতো। ভীষণ ইন্ট্রোভার্ট ছিলাম কিনা! ইন্ট্রোভার্ট অবশ্য এখনও আছি। তুমি বাদে সবার কাছেই আমি গম্ভীর।”
অর্ষা বিস্মিত হলো। জানতে চাইল,
“আপনি কি তাহলে তখন থেকেই আমায় ভালোবাসতেন?”
“তা কী করে বলি? তবে তোমার ব্যথায় আমার কষ্ট হয়েছিল।”
“আপনি ভীষণ অদ্ভুত!”
“আর আমার ভালোবাসা?”
“তা তো সীমাহীন।”
“একটা গান মনে পড়ে গেল।”
“কী গান?”
আহনাফ সুর দিয়ে গানের কয়েকটা লাইন আওড়াল,
“খোলাখুলি বলতে গেলে
পড়ে গেছি তোর কবলে
তলিয়েছে মন, ভীষণ রকম,
অথৈ জলে।
সাঁতার কেটেছি, ঘুমিয়ে হেঁটেছি
এতটা ডুবেছি, তোর-ই তো কারণে
তোকে ভালো বাসতে গিয়ে।”
অর্ষা লজ্জা পেলেও মুচকি হাসল। আহনাফ অর্ষার মুখটা টেনে নিচু করে নিচে ঝুঁকিয়ে আনল নিজের মুখের ওপর। এরপর আলতো করে চুমু খেল অর্ষার গালে। আরও বেশি লজ্জা পেয়ে মুখ সরিয়ে নিল অর্ষা। আহনাফ শব্দ করে হাসে। অর্ষার হাতের উলটোপিঠে চুমু খেয়ে হাতটি বুকের ওপর রাখল। ম্রিয়মাণ কণ্ঠে বলল,
“আমার প্রজাপতি!”
[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।]