যেদিন তুমি এসেছিলে
সিজন ২ পর্ব ২২
মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
________________
অর্ষা দ্বিধান্বিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। একটা মানুষকে মুখের ওপর না করা যায় কীভাবে? সে হাসফাস করছে। আহনাফের রাগ দৃষ্টি এড়ায় না হাসিবের। সে আহনাফের কাঁধে হাত রেখে আস্তে বলল,
“রিল্যাক্স!”
এরপর আহিলের উদ্দেশ্যে বলল,
“তুমি আহনাফকে নিয়ে যাও। আমি আসছি।”
আহিল কিছুই বুঝতে পারছে না। আহনাফের রাগ করার কারণ কী? তার বেশি টেনশন হচ্ছিল অর্ষার জন্য। এমন সিচুয়েশন কী করে সামলাবে ও? তাছাড়া অর্ষাও জিসান স্যারকে পছন্দ করে কি? জানা নেই তার। সে আহনাফকে বলল,
“চলুন স্যার।”
আহনাফ মনেপ্রাণে রাগ দমানোর চেষ্টা করছে। কোনো রকম সিনক্রিয়েট করতে চাইছে না বলেই হাসিবের কথা মেনে নিয়ে আহিলের সঙ্গে চলে যায়। হাসিব নিজেকে ফিটফাট করে গুছিয়ে অর্ষা এবং জিসানের কাছে গিয়ে সুন্দর করে হাসল। এক হাত বাড়িয়ে দিল জিসানের দিকে। হাসিমুখে বলল,
“হেই বার্থডে বয়! শুভ জন্মদিন।”
হাসিবের আগমনে জিসান কিছুটা অপ্রস্তুত হলেও চট করেই আবার নিজেকে সামলে নিল। হ্যান্ডশেক করে বলল,
“থ্যাঙ্কিউ।”
“আমায় চিনতে পেরেছেন তো? আমি আহনাফের বন্ধু। আগেরবার দেখা হয়েছিল।”
জিসান সহাস্যে বলল,
“মনে আছে।”
হাসিব তার হাত-ঘড়ি দেখল। দেরি হয়ে গেছে এমন ভঙ্গিতে বলল,
“শিট! সবাই অপেক্ষা করছে আপনার জন্য। চলুন, চলুন।”
এরপর হঠাৎ করেই অর্ষাকে দেখতে পেয়েছে এমনভাবে বলল,
“আপনি?”
উত্তরে জিসান বলল,
“আমাদের এমপ্লয়ি।”
“আই সী! আসুন, আসুন আপনিও আসুন।” বলে জিসানের হাত ধরে নিয়ে গেল হাসিব।
মনে মনে অর্ষা ভীষণ খুশি হলো এবং হাসিবকে মনে মনেই ধন্যবাদ জানাল। আপাতত বিষয়টা এড়ানো গেছে এতেই তার স্বস্তি। পরে না হয় ভেবে-চিন্তে গুছিয়ে জিসানকে না করে দেওয়া যাবে।
কেক কাটার সময় অর্ষা আর আহনাফ ছিল মুখোমুখি। তার রাগী দৃষ্টি তখনও অর্ষার দিকে স্থির। অর্ষা আহনাফের দিকে তাকিয়ে ভড়কে যায়। সে এভাবে রাগ নিয়ে তাকিয়ে আছে কেন? তার দোষটা কোথায়? দৃষ্টি সরিয়ে নিল অর্ষা। কেক কাটা শেষ হলে খাওয়া-দাওয়া করে সবাই আবার সবার কাজে চলে যায়। স্মৃতি অর্ষাকে টেনে অন্যপাশে নিয়ে বলল,
“অ্যাই জিসান স্যার তোমাকে কী বলল?”
অর্ষা প্রলম্বিত শ্বাস নিয়ে বলল,
“প্রপোজ করেছে ভাই!”
“সত্যিই?”
“হ্যাঁ। তাও আবার বিয়ের।”
স্মৃতি চোখ দুটো গোল গোল করে বলল,
“বাপরে! তাহলে আর দেরি কেন? তুমি কী বলেছ তাকে?”
“কিছুই বলিনি। কিছু বলার আগেই আহনাফ স্যারের বন্ধু এসে পড়েছে।”
“ধুর! আর সময় পেল না। বাই দ্য ওয়ে, কী উত্তর দেবে ভেবেছ কিছু?”
“অবশ্যই না করে দেবো।”
“কেন বলো তো? সে অফিসের উচ্চপদস্থ একজন স্যার। স্যালারী ভালো, দেখতেও সুদর্শন। তাহলে তোমার আপত্তিটা কোথায়?”
“কাউকে বিয়ে করার জন্য কি শুধু এসবই প্রয়োজন স্মৃতি?”
“ভালো থাকার জন্য এরচেয়ে আর বেশি কী দরকার?”
“ভালোবাসা দরকার। আমি তো তাকে ভালোবাসি না।”
“আমার কী মনে হচ্ছে জানো? তুমি অন্য কাউকে ভালোবাসো। কিন্তু আমার থেকে লুকাচ্ছ। সত্যি করে বলো তো কে সেই ব্যক্তি?”
অর্ষা রহস্য করে হাসল। এর মানে হচ্ছে সে এই ব্যাপারে এখন কিছুই বলবে না। স্মৃতি তবুও কিছুটা জেদ ধরে বলল,
“উহ্! ওভাবে হাসলে চলবে না। আমাকে বলতেই হবে।”
অর্ষা স্মৃতির হাত ধরে বলল,
“অবশ্যই বলব। অফিসে কলিগদের মধ্যে আমার সবচেয়ে প্রিয় এবং কাছের মানুষটি হচ্ছ তুমি। তোমাকে বলব না তো কাকে বলব? তবে হ্যাঁ, এখনই নয়। সময় হলে আমি নিজে থেকেই তোমাকে বলব।”
“সত্যি তো?”
“তিন সত্যি।”
স্মৃতি বলল,
“ঠিক আছে। আমিও অপেক্ষায় রইলাম।”
আহনাফ জিদ্দে নেই। সে অগ্নিমূর্তি ধারণ করে বসে আছে। তার সামনে বসে আছে হাসিব। সে আহনাফকে শান্ত করার চেষ্টা করে বলল,
“এত রেগে কেন যাচ্ছিস তুই?”
“যেই ভয়টা পাচ্ছিলাম সেটাই হয়েছে। রাগ করব না?”
“অর্ষা তো আর এক্সেপ্ট করেনি।”
“যদি করে?”
“করবে না।”
“তুই এতটা শিওর কীভাবে?”
“কারণ ও তোকে ভালোবাসে।”
“ছাই ভালোবাসে! আমাকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে মারছে ও। আমি শিওর, আমাকে জ্বালানোর জন্য ও রাজিও হয়ে যেতে পারে।”
“আরে ব্যাটা না! রিলেশনের জন্য প্রপোজ করলে না হয় ভাবা যেত। তাই বলে বিয়ের জন্য তো আর রাজি হবে না।”
“ভয়টা তো এখানেই। জিসান তো আর কোনোদিক থেকে কম না।”
“হ্যাঁ, কম না জানি। কিন্তু জিসান আহনাফ নয়। আর অর্ষা আহনাফকে ভালোবাসে।”
আহনাফ দিশেহারা হয়ে বলল,
“অর্ষা খুব জেদি দোস্ত! এখন আমার সত্যিই ভীষণ ভয় হচ্ছে। সেই সাথে রাগ তো হচ্ছে পাহাড় সমান। মনে চাচ্ছে ব্যাটাকে কয়েক ঘা দিয়ে আসি। শালা, প্রপোজ করার জন্য আর মেয়ে পেলি না! আমার কুইনের দিকেই নজর দিতে হলো?”
“রিল্যাক্স ব্রো। তোর কিংডমে তুই-ই কিং। কুইনও তোর-ই হবে। একটাবার শুধু অর্ষার ফ্রেন্ডদের সঙ্গে মিট হোক। ওদেরকে একবার কনভিন্স করে ফেলতে পারলে আর কোনো টেনশন নেই।”
“কাজটা কি এত সহজ হবে বলে মনে হয়?”
“সহজ করে নেব। আমি আছি তো।”
“এজন্যই তো ভয়।”
হাসিব ভ্রুঁ কুঁচকে বলল,
“মানে কী?”
“মানে হচ্ছে তোর প্ল্যান বলেই ভয় পাচ্ছি। আগেরটা তো ফ্লপ হয়েছে। এবারও যদি হয়?”
“তুই শালা খালি নেগেটিভ-ই ভেবে যা।”
“আমি কিছু ভাবতে পারছি না। প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে আমার। জিসানের কথাগুলো কানে ঘণ্টার মতো বাজছে।”
“পানি খা।”
আহনাফ ঢকঢক করে এক গ্লাস পানি পান করল। নাহ্, রাগ কমছে না কিছুতেই। সে চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে বিড়বিড় করে বলল,
“ইয়া আল্লাহ্! সহায় হও প্লিজ, প্লিজ!”
বিকেলে অফিস ছুটির পর ফ্লোরের স্যার, বস এবং স্টাফদের নিয়ে অফিসের পাশে থাকা একটা রেস্টুরেন্টে এলো জিসান। আহনাফ প্রথমে ভেবেছিল আসবে না। জিসানের ট্রিট সে নেবে না। কিন্তু হাসিব যখন বলল,
“অর্ষাও তো যাবে। জিসান যদি তখন অর্ষাকে রাজি করিয়ে ফেলে কী করবি তখন? ওদেরকে চোখে চোখে রাখতে হবে।”
ব্যস, আহনাফকও রাজি হয়ে গেল আসার জন্য। জিসান অর্ষার পাশে বসেছে। অর্ষা যে উঠে যাবে সেটাও পারছে না। এতে করে সবার সামনে জিসানকে অপমান করা হবে। অর্ষার একপাশে জিসান এবং অন্যপাশে স্মৃতি। আহনাফ বসেছে অর্ষার মুখোমুখি চেয়ারে আহিল এবং হাসিবের মাঝখানে। ওদের চারপাশে অফিসের বাকিরা বসেছে। অর্ষাকে জিসানের পাশে দেখে চোয়াল শক্ত হয়ে যায় আহনাফের। সে জিদ্দে আহিলের শার্ট টেনে ধরে। আহিল ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তাকায়। বোকার মতো জিজ্ঞেস করে,
“শার্ট-টা কি নেবেন স্যার?”
সম্বিৎ ফিরে পায় আহনাফ। সকলের দিকে তাকিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করে। আহিলের দিকে তাকিয়ে প্রসংশার সুরে বলে,
“এই শার্টে তোমাকে অনেক মানিয়েছে। কোত্থেকে কিনেছ?”
“নিউমার্কেট থেকে।”
“খুব সুন্দর, খুব সুন্দর।” বলে আহনাফ আড়চোখে জিসান এবং অর্ষার দিকে তাকাল। জিসান কিছু বলছে আর অর্ষা নিরব শ্রোতা হয়ে মনোযোগ দিয়ে শুনছে। এত মনোযোগ দিয়ে ওর কথা শোনার কী আছে আহনাফ বুঝতে পারছে না।
আহনাফ হাসিবের কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে,
“হাসিব রে, ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে কিন্তু!”
হাসিব অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলল,
“কষ্ট করে হজম করে যা।”
আহনাফ গম্ভীর হয়ে বসে রইল। ওয়েটার এসে খাবার দিয়ে গেছে। সবাই খাওয়া শুরু করেছে কেবলমাত্র আহনাফ কাঁটাচামচ দিয়ে খাবার নাড়ছে আর দেখছে, জিসান অর্ষাকে খাবার সার্ভ করছে। দেখে মনে হচ্ছে তারা নব বিবাহিত দম্পতি। কেয়ার যেন উপচে উপচে পড়ছে! জিসানের এক্সট্রা কেয়ার বোধ হয় বাকিদেরও নজরে পড়েছে। সবাই মিটিমিটি হাসছিল। অর্ষা অস্বস্তিতে পড়ে যায়। বাইরে হাসলেও মনে মনে জিসানের পিণ্ডি চটকাতে থাকে।
খাবার শেষ হওয়ার পর অর্ষা তড়িঘড়ি করে আহিলকে নিয়ে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে যায়। কারণ জিসান তখন বলেছে, আজকে সে বাড়ি পৌঁছে দেবে। জিসান বিল দেওয়ার সময় এই সুযোগটাকেই কাজে লাগিয়েছে অর্ষা। আহিল পিছু যেতে যেতে বলে,
“এত তাড়াহুড়ো করছিস কেন? কী হয়েছে?”
“কথা পরে বলিস, আগে আয়।”
রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে অর্ষা কিছুদূর এগিয়ে পেছনে তাকায়। আহিল নেই কোথাও। সে একটু এগিয়ে গিয়ে ডাকতে থাকে,
“আহিল, আহিল।”
“আহিল নেই। আহনাফ আছে।”
অর্ষা পাশে তাকাল। অন্ধকার থেকে আহনাফ বেরিয়ে এসেছে।
“আহিল কোথায়?” জিজ্ঞেস করল অর্ষা।
“হাসিবের সঙ্গে আছে।”
“বেয়াদবটা আমাকে একা রেখে গেল!”
“না তো! আমি আছি।” এই বলে অর্ষার দিকে দু’পা এগিয়ে আসে। চিবিয়ে চিবিয়ে বলে,
“সব রাগ কী শুধুমাত্র আমার ওপর প্রয়োগ করবে বলেই জমিয়ে রেখেছ?”
কপালে ভাঁজ পড়ে অর্ষার। শুধায়,
“মানে কী?”
“জিসান যখন প্রপোজ করল তখন সঙ্গে সঙ্গে না করে দাওনি কেন?”
“আমি কাকে না করব, কাকে হ্যাঁ বলব সেটা আমার ব্যাপার। আপনার এত মাথাব্যথা কেন?”
“গোটা মাথায় তল্পিতল্পা নিয়ে চেপে বসে আছো, আবার জিজ্ঞেস করছ আমার মাথাব্যথা কেন? লিসেন অর্ষা, তুমি আমাকে ইগনোর করো, রাগ দেখাও আমি সব মেনে নিয়েছি। তাই বলে যদি ভেবে থাকো, অন্য কোনো ছেলের সঙ্গেও তোমাকে সহ্য করব তাহলে তুমি ভুল। আমি দুজন নারীর ব্যাপারে ভীষণ সেনসিটিভ। এক. আমার মা আর দুই. তুমি। আমি কিন্তু একদম ছাড় দেবো না।”
অর্ষা থমকে যায়। জবাব দেওয়ার মতো উত্তর নেই তার কাছে। তবে একরাশ ভালোলাগা এসে ভর করেছে তার মাঝে। সে কিছু না বলেই উলটো ঘুরে মুচকি হাসে। চলে যাওয়ার জন্য উদ্যত হতেই ওড়নায় টান পড়ে। পিছু ফিরে দেখে আহনাফের হাতের মুঠোয় তার ওড়নার অংশ। অর্ষা রাগীস্বরে বলে,
“এসব কী?”
আহনাফ উত্তর না দিয়ে অর্ষার ওড়নায় নিজের হাত বাঁধল তারপর বলল,
“এবার যেখানে খুশি সেখানে যাও। আমি নিজে থেকে তো আর যাচ্ছি না সাথে। তুমি আমায় নিয়ে যাবে।”
“ভালো হচ্ছে না কিন্তু!”
“আমি ভালো কিছু করিইনি! তাহলে ভালো হবে কীভাবে? এতদিন ভালো ছিলাম তোমার তো ভালো লাগল না।”
“আমি কিন্তু চিৎকার করব। লোক জড়ো করব।”
আহনাফ শব্দ করে হাসল। বলল,
“তাই? করো চিৎকার।”
অর্ষা দমে গেল। এই কাজ সে জীবনেও করতে পারবে না। আহনাফের গায়ে কেউ হাত তুলবে এটা তার সহ্য হবে? অর্ষার চুপসে যাওয়া মুখ দেখে আহনাফ কিছুটা এগিয়ে গেল। সোডিয়াম লাইটের হলদে আলোয় অর্ষার মুখপানে দৃষ্টিপাত করে মিহিস্বরে বলল,
“কী হলো? এখন চুপ করে আছো যে? করো চিৎকার। লোক জড়ো হোক। আমিও তখন চিৎকার করে বলব,’হে ধরণীর মানুষগণ, আপনারা সবাই শুনে রাখুন, আমি এই রাগী, মিষ্টি মেয়েটাকে ভালোবাসি। এই রাগিণী আমার, শুধু আমার।’ নাও, নাও এবার চিৎকার শুরু করো। দেরি কোরো না।”
অর্ষা গোমড়ামুখে ওড়না থেকে আহনাফের হাত মুক্ত করতে গেলে আহনাফ বাঁধা দেয়। হাতের বাঁধন খুলতে দেয় না। উলটো অর্ষার ডান হাতের আঙুলের মাঝে নিজের বামহাতের আঙুল মিশিয়ে শক্ত করে চেপে ধরে। ফিসফিস করে বলে,
“এই হাত ছাড়ার জন্য ধরিনি বাটারফ্লাই। চলো হাঁটি। সুন্দর রাত্রীকে সাক্ষী রেখে পথচলা আরম্ভ করি।”
চলবে…
[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।]