যেদিন তুমি এসেছিলে
সিজন ২ পর্ব ২৩
মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
__________________
সারা রাস্তা আহনাফ অর্ষার হাত ছাড়েনি। রিকশায় বসেও না। অর্ষা জানে জোরজবরদস্তিতে সে পারবে না আহনাফের সঙ্গে। তাই সেই বৃথা চেষ্টাও করেনি। বাড়ির সামনে এসে আহনাফ বলে,
“একসাথে দুজনের এটাই যেন শেষ পথচলা না হয়। এরপরের প্রতিটা পথচলা একসাথে হোক এটাই চাই।”
অর্ষা দাঁড়িয়ে কথাগুলো শুনল। তবে কিছু বলল না। অন্ধকারেই মৃদু হেসে বাড়ির ভেতর ঢুকে গেল। মেইন দরজা লাগিয়ে এগিয়ে গিয়ে দেখল সকাল বারান্দায় বসে আছে।
“কিরে লাইট অফ করে এখানে বসে আছিস কেন?” এগিয়ে যেতে যেতে জিজ্ঞেস করল অর্ষা।
সকাল দৌঁড়ে এসে অর্ষাকে জড়িয়ে ধরে। পাগলের মতো কাঁদছে সে। অর্ষা বিভ্রান্তিতে পড়ে যায়। সকালকে ছাড়িয়ে দু’গালে হাত রেখে জিজ্ঞেস করে,
“কী হয়েছে সোনা? কাঁদছিস কেন তুই?”
সকাল কান্নার দমকে কথা বলতে পারছে না। তার শরীর কাঁপছে। ভেতরে ভেতরে অর্ষাও ভীষণ ভয় পাচ্ছিল। সে সকালকে ধরে নিয়ে বারান্দায় বসাল। দৌঁড়ে গিয়ে ভেতর থেকে এক গ্লাস পানি এনে সকালকে খাইয়ে দিল। মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
“কাঁদে না লক্ষী! বল আমায় কী হয়েছে? আব্বা, মা কোথায়?”
সকাল তখনও ফোঁপাচ্ছিল। সে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়েই বলল,
“বাবার অবস্থা অনেক খারাপ আপু। আবারও র’ক্তবমি করেছে। তোকে কতবার ফোন করেছি আমরা। কেন রিসিভ করিসনি?”
অর্ষার যেন পাগল পাগল অবস্থা। বাবার চিন্তায় জীবন বেরিয়ে যাচ্ছে তার। তড়িঘড়ি করে ব্যাগ থেকে ফোন বের করে সে। কাজের জন্য বেশিরভাগ সময় অফিসে ফোন ভাইব্রেট করে রাখে সে। আজ কোন পাগলে ধরেছিল যে সাইলেন্ট করে রেখেছে! নাকি তাড়াহুড়ায় ভাইব্রেট করতে গিয়ে সাইলেন্ট করে ফেলেছে! আননোন নাম্বার থেকেও অনেকগুলো কল এসেছে। ফোনটা আবার ব্যাগে ভরে অর্ষা বলল,
“আব্বা, মা এখন কোথায়?”
“হাসপাতালে। তোফায়েল ভাইয়া এসেছিল। সে-ই নিয়ে গেছে। আমি তোর জন্য থেকে গেছি।”
“হাসপাতালের ঠিকানা জানিস?”
সকাল মাথা ঝাঁকাল। অর্ষা চটজলদি ঘরে তালা দিয়ে সকালকে নিয়ে তক্ষুনি বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। মনে মনে নিজেকে সে অসংখ্য গালি দিচ্ছে। কাঁদতে চেয়েও কাঁদতে পারছে না। কেন তার বাবার সঙ্গেই বারবার এমন হয়!
হাসপাতালে গিয়ে রিসিপশনে তোফায়েলের সঙ্গে দেখা হয়ে যায় ওদের। অর্ষা ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করে,
“বাবা কোথায়?”
“ভেতরে আছে। তুমি টেনশন কোরো না। এখন তিনি ঠিক আছেন।”
অর্ষা সকালকে নিয়ে ভেতরে গেল। সেলিনা বেগম প্যাসেজ ওয়েতে বসে আছেন। অর্ষাকে দেখেই তিনি গুমড়ে কেঁদে ওঠেন। মাকে জড়িয়ে সান্ত্বনা দেয় অর্ষা। জীবন যুদ্ধে সে নিজেও হাঁপিয়ে পড়ছে। দুই ঘণ্টা পর অর্ষা ওমর রহমানের সঙ্গে দেখা করতে যায়। বাবার মলিন মুখ দেখে বুক কেঁপে ওঠে তার। পাশের টুলে বসে বাবার হাতের ওপর হাত রেখে শান্তকণ্ঠে জিজ্ঞেস করে,
“এখন কেমন লাগছে?”
তিনি মিহিস্বরে বললেন,
“ভালো, মা। তোর মুখটা এমন লাগছে কেন? অফিস থেকে এসে খাসনি?”
এতটুকু কথা বলতেই যেন হাঁপিয়ে উঠলেন ওমর রহমান। বড়ো করে শ্বাস নিলেন। অর্ষা বাবার বুকে হাত বুলিয়ে বলল,
“কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে? তাহলে কথা বোলো না।”
সেলিনা বেগম তখনও স্বামীর মাথার কাছে বসে কেঁদে চলেছেন। সকাল বসে আছে বাবার পায়ের কাছে বেডে। বাবা মৃদু হেসে অর্ষার হাতের ওপর হাত রাখলেন। বিমর্ষস্বরে বললেন,
“রুহুলকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে।”
অর্ষা হতাশ হয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। সেলিনা বেগম কেঁদে বলেন,
“আর রাগ করিস না মা! ওকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে নিয়ে আয়।”
“ধরে নে শেষবারের মতো কিছু চাইছি তোর কাছে।” বললেন ওমর রহমান।
অর্ষা বলল,
“এভাবে কেন বলছ বাবা? আর তুমি এত কথা বোলো না তো! কষ্ট হচ্ছে তোমার। আর আমি যাব ভাইয়ার কাছে। নিয়ে আসব।”
ওমর রহমানের মলিন মুখ উজ্জ্বল হলো। তিনি মহানন্দে বললেন,
“কাল সকালেই আনবি মা?”
“হ্যাঁ। এখন ঘুমাও তুমি।”
অর্ষা কেবিন থেকে বাইরে বেরিয়ে আসে। রুহুলকে সে ভালোবাসে। তার রক্তের কেউ থাকলে রুহুলই তো আছে। তার ভাই! কিন্তু সে মানুষ হিসেবে অর্ষার একদমই পছন্দ নয়। যারা এত কষ্ট করে ছোটো থেকে বড়ো করেছে তাদের থেকে কী করে রুহুল মুখ ফিরিয়ে নিতে পারে? মানুষ দুটো বিনাস্বার্থে পাগলের মতো ভালোবাসে। অথচ সে এসবের যোগ্যই না। বিতৃষ্ণায় মুখ তেঁতো হয়ে আসে অর্ষার। রাতটা পার হলেই সে রুহুলের কাছে যাবে। তোফায়েলের থেকে ঠিকানা নিতে হবে তার আগে।
সেই রাতে কেউই ওরা বাসায় যায়নি। সকাল ন’টা নাগাদ তোফায়েলের বলা ঠিকানায় যাওয়ার জন্য বের হয় অর্ষা। অফিসে মিজানকে ফোন করে তার বাবার অসুস্থতার কথা জানিয়ে দিয়েছে। কয়েকদিন যেতে পারবে না অফিসে এটাও জানিয়েছে। মিজান কোনো দ্বিমত করেনি কিংবা আপত্তিও করেনি। বাবার খেয়াল রাখতে বলেছে।
.
.
অনেকদিন পর অর্ষাকে দেখে খুশি হলো রুহুল। সে এখন মাস্তান বনে গেছে। রাজনীতিও করে। অর্ষাকে বসিয়ে সাঙ্গপাঙ্গকে খাবার আনতে পাঠায়। খুব তোড়জোড় করে জানতে চায়,
“কী খাবি বল?”
অর্ষা চারদিকে তাকিয়ে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করছিল। রুহুলের প্রশ্ন শুনে গম্ভীর হয়ে বলল,
“কিছু খাব না।”
“কিছু খাবি না মানে? তুই আমার কাছে এসেছিস এতদিন পর। আমি তোকে না খাইয়ে রাখব?”
“এতদিনে তো একটাবারও খোঁজ নিয়ে দেখোনি আমি খেয়ে আছি নাকি না খেয়ে ম’রে গেছি।”
রুহুল কিছুটা দমে গেল। পরক্ষণেই বলল,
“তোর তো ফুসকা পছন্দ। ফুসকা আনতে বলি।”
বলেই সে ছেলেগুলোকে বলল,
“নাস্তা আনবি আর ফুসকা আনবি যা।”
দুজন চলে গেল নাস্তা আনতে। এখনও ভেতরে পাঁচজন আছে। রুহুল ওদেরকেও বলল,
“তোরা নিচে গিয়ে অপেক্ষা কর।”
ওরা চলে গেল। রুহুল এবার অর্ষাকে বলল,
“এতদিন পর ভাইয়ের কথা মনে হলো?”
অর্ষা কোনোরকম ভনিতা না করেই বলল,
“আমি তোমাকে নিতে এসেছি।”
রুহুল অবাক হয়ে বলল,
“কোথায়? বাসায়?”
“হ্যাঁ। বাবার শরীরটা ভালো না। অসুস্থ খুব। এখন হাসপাতালে আছে।”
“জানি।”
“জানার পরও একটাবার গেলে না? এতটা নিষ্ঠুর তুমি!”
রুহুল সিগারেট ধরাতে গিয়েও অর্ষার জন্য ধরাল না। অর্ষার প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়ে বলল,
”ঠিক আছে, যাব। তবে এক শর্তে।”
”কী শর্ত?”
”বলছি। তার আগে বল, আগের তুলনায় আমায় এখন কেমন দেখলি?”
”ভালো কিছুই দেখলাম না। বরং খারাপটাই নজরে এলো। পার্থক্য যদি বলতে হয় তাহলে বলা লাগে, শুধু বেকারত্ব আর ভবঘুরে স্বভাবটাই নেই। রাজনীতি করে, নেতাদের গোলামী করে ইতিমধ্যে মাস্তান বনেও গেছ।”
অর্ষার স্পষ্ট অপমানেও রুহুল হাসল। আগের মতো রাগারাগি করল না। অনেকদিন পর সে বোনকে কাছে পেয়েছে। নিজে থেকে এসেছে বাড়িতে। ভুল করেও বোনকে সে এখন আঘাত দিতে চায় না। মুচকি হেসে বলল,
”তা অবশ্য ঠিক বলেছিস। কিন্তু যেটাই হোক, এই অবস্থানটা কিন্তু এমনি এমনি হয়নি। বেকারত্ব বলিস, ভবঘুরে স্বভাব বলিস সেটাও এমনি এমনি দূর হয়নি। আগে মানুষজন আমাকে পাত্তা দিত না। কিন্তু এখন আমার আন্ডারেই কত ছেলেপুলে রয়েছে। ওরা আমার কথায় উঠে, বসে। এসবকিছুর পেছনে আমার বন্ধু তোফায়েলের অবদান রয়েছে।”
”ওহ আচ্ছা! পেছন থেকে তাহলে কলকাঠি সে নেড়েছে।”
”তোফায়েল আমার বন্ধু হলেও আমার মতো নয় অর্ষা। ও অনেক ভালো একটা ছেলে। ওর জন্যই আজ আমি খেয়ে, পড়ে ভালো আছি।”
”তাই? বাবা-মায়ের কোনো অবদান নেই তোমার জীবনে?”
”বাবা-মায়ের অবদান আমি অস্বীকার করছি না। একটা সময় পর্যন্ত তারা আমায় দেখেছে, লালন-পালন করেছে এ সবটাই আমি মানি। স্বীকার করি। তবে তারা আমার প্রয়োজন পূরণ করতে পারেনি, যেটা তোফায়েল করেছে। বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর ও-ই আমাকে জায়গা দিয়েছে। ওর বাবাকে বলিয়ে রাজনীতিতে নাম দিয়েছে। সুন্দর একটা জীবন পেয়েছি আমি।”
অর্ষা তাচ্ছিল্য করে হাসল। বলল,
”বেশ। ভালো লাগল শুনে। এখন আমি তোমার কাছে এসেছি ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। বাবা-মায়ের কান্নাকাটি আর সহ্য করা যাচ্ছে না।”
”বললাম তো যাব। তোর কথা রাখব যদি তুই আমার শর্ত মানিস।”
”নিজের বাড়িতে ফিরে যাবে এর জন্য আবার বোনকে শর্তও দিচ্ছ? না, না ঘাবড়ানোর কিছু নেই। তোমার কাছ থেকে এসব আশা করা যেতেই পারে। বলো শুনি এবার শর্ত কী?”
”শর্তটা হচ্ছে তোফায়েলকে তোর বিয়ে করতে হবে।”
”মানে!”
”হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছিস। তোফায়েল তোকে অনেক বেশি পছন্দ করে। তোকে বিয়ে করতে চায়। কথাটা অনেক আগেই আমায় বলেছিল, কিন্তু তখন তোর সাথে আমার সম্পর্ক ভালো ছিল না। তুই আমার কথা শুনতি না বলে তোকে বলাও হয়নি।”
অর্ষা শ্লেষাত্মক কণ্ঠে বলল,
”তাই এখন সুযোগ পেয়ে সুযোগের সদ্ব্যবহার করছ?”
”খারাপ কিছু তো করছি না অর্ষা। তোফায়েল ভালো একটা ছেলে। শিক্ষিত, সুদর্শন। ও যে তোকে বিয়ে করতে চেয়েছে এটা তোর ভাগ্য।”
”তুমি যে নিজ স্বার্থ হাসিল করার জন্য বোনকে কু’র’বা’নি দিতে প্রস্তুত এটা আমার দুর্ভাগ্য!”
“আমি তোর খারাপ চাই না। তোফায়েল যথেষ্ট ভালো। তোকে সুখে রাখবে।”
“আমার ভালো চাইছ নাকি বন্ধুর ঋণ শোধ করতে চাইছ?”
রুহুল নিরুত্তর। অর্ষা নিজেই বলল,
“আমি যদি তোমার শর্ত না মানি, তাহলে তুমি ফিরবে না?”
”না।”
অর্ষা অনেকক্ষণ যাবৎ নিরব রইল। এই মুহূর্তে তার আহনাফের কথাই কেন সবার আগে মনে পড়ছে? কেন তার মুখটাই চোখের সামনে ভেসে উঠছে? উহ্! বুকের ভেতরটায়ও অসহ্য চিনচিনে ব্যথা শুরু হয়েছে। এত কেন কষ্ট হচ্ছে তার? পরক্ষণেই বাবার অসুস্থ মুখটা চোখের দৃশ্যপটে ভেসে ওঠে। মায়ের কান্নার সুর কানে বাজছে। অর্ষা বড়ো করে শ্বাস নিল। দু’হাতে চুলগুলো ঠিক করে নড়েচড়ে বসে বলল,
”বেশ! তুমি নিমকহারাম হতে পারো কিন্তু আমি নই! আমি বাবা-মাকে ভালোবাসি। শুধুমাত্র তাদের কথা ভেবেই আমি নিজেকে উৎসর্গ করতে প্রস্তুত। তোমার শর্তে আমি রাজি।”
খুশিতে চোখ-মুখ চকচক করে ওঠে রুহুলের। সে অর্ষার এক হাত ধরে বলে,
”সত্যি বলছিস? আমি ভীষণ খুশি হয়েছি কলিজা। এখন হয়তো তুই আমাকে ভুল বুঝছিস। কিন্তু বিয়ের পর বুঝবি ভাইয়া তোর খারাপ চাইনি।”
অর্ষা তাচ্ছিল্য করে হাসল। রুহুলের হাতটা শক্ত করে ধরে বলল,
”তখন তোমায় যেন আফসোস না করতে হয়!”
চলবে…
[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।]