যেদিন তুমি এসেছিলে
সিজন ২ পর্ব ২৯
মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
_________________
রাফি মুখ কালো করে ফিরে এলো। অর্ষা তখনও স্তব্ধ হয়ে আছে।
“মামাটা আজকাল মিথ্যা বলাও শিখে গেছে।” বিড়বিড় করে বলল রাফি।
অর্ষা ভ্রুঁ কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,
“কী হয়েছে?”
“মা বকেছে।”
“কেন?”
“মা তো আমায় ডাকেনি। মামা মিথ্যে বলেছে। আমি গিয়ে মায়ের হাত ধরে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কেন ডেকেছ?’ তখন মায়ের হাত থেকে জগ নিচে পড়ে গেছে। এখানে আমার দোষটা কোথায় বলো? দিল বকা!”
“হুম! ভীষণ অন্যায় গেছে। আসলে দোষ তোমার আম্মুরও কিন্তু নয়।”
“তাহলে কার?”
“তোমার মামার। মিথ্যে তো তোমার মামাই বলেছে তাই না?”
“তা ঠিক। কিন্তু মামা যখন মিথ্যে বলেছে তখন অবশ্যই এর পেছনে কোনো কারণ আছে।”
অর্ষা বিড়বিড় করে বলে,
“একদম মামার অ’ন্ধ ভক্ত!”
এই টপিকে আর কথা লাভ নেই বলে অর্ষা রাফিকে পড়ানো শুরু করে। আজ বেশিক্ষণ পড়ায়নি। হাসিবের সঙ্গে কথা বলতে হবে। তাছাড়া সে টায়ার্ডও। ত্রিশ মিনিটের মতো পড়িয়ে রাফিকে বলল,
“তোমার হাসিব মামাকে ডেকে আনো তো।”
“আচ্ছা।” বলে রাফি হাসিবকে ডাকতে চলে গেল।
হাসিব আসার সময় একাই এলো। রাফি কিংবা আহনাফ কেউ সাথে নেই। অর্ষা ভেবেছিল আহনাফও বুঝি আসবে।
হাসিব রাফির খাটে বসে বলল,
“কেমন আছেন?”
“ভালো আছি। আপনি?”
“খুবই ভালো। বলতে পারেন আজ আমি দারুণ খুশি।”
“তাই? কারণ কী?”
“কারণটা হচ্ছে গিয়ে আপনার এবং আহনাফের বিয়ে।”
অর্ষা হতভম্ব হয়ে যায়।
“আমাদের বিয়ে মানে?”
“দেখেন ভাবি, ঝগড়া, মান-অভিমান, রাগ অনেক হয়েছে। যদি কিছু বাকি থাকে তাহলে সেগুলো বিয়ের পর বুঝে নিয়েন। আগে বিয়েটা হোক। এখন বলেন, কবে যাব আমরা?”
“কবে যাব মানে? কোথায় যাবেন?”
“কেন আপনার বাসায়। প্রস্তাব নিয়ে যেতে হবে না? এমনি এমনি তো আর আপনাকে নিয়ে আসা যাবে না।”
“সব আমার মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছে।”
“তাহলে আরেকটু সোজা হয়ে মাথা উচুঁ করে বসুন। আশা করি, তাহলে কথা সরাসরি মস্তিষ্কেই পৌঁছাবে।”
“আমি মজা করছি না।”
“আমিও মজা করছি না। এই বাড়ির সবাই রাজি। বিশ্বাস না হলে আমি আঙ্কেলকে ডাকি। আপনি তার সাথেই কথা বলুন।”
হাসিব উঠে দাঁড়িয়েছে জহির চৌধুরীকে ডাকার জন্য। অর্ষা তড়িৎগতিতে পথরোধ করে বলল,
“না, না। তাকে ডাকতে হবে না। আমি আপনার কথা বিশ্বাস করেছি।”
“ঠিকাছে। তাহলে বসলাম। এবার বলুন, কবে যাব আমরা?”
অর্ষা কিছু কথা আগে মনে মনে গুছিয়ে নিল। পরক্ষণে লম্বা শ্বাস নিয়ে বলল,
“আমি এখনই বিয়ে করতে পারব না।”
হাসিব অবাক হয়ে বলল,
“কেন? এখনও কি রাগ করে আছেন?”
“না। তেমন কিছু নয়। আসলে আমার পরিবারের অবস্থা তো মোটামুটি জানেন সব-ই। ভাইয়াকে আজ বাসায় নিয়ে এসেছি। ও কতটা শুধরিয়েছে বা ভবিষ্যতে কী করবে তা এখনও শিওর হয়ে বলতে পারছি না। এমন অবস্থায় তো আমি বিয়েও করতে পারছি না।”
“আপনি এত ভাবছেন কেন? আহনাফ আপনাদের হেল্প করবে।”
“না ভাইয়া। বিয়ের পর উনার আমাকে সাহায্য করা আর আমার পরিবারকে সাহায্য করা বিষয়টা এক রকম নয়।”
হাসিব জানে, অর্ষার আত্মসম্মান ঠিক কতটা বেশি। এরপরও যদি সে এই বিষয়ে জোড়াজুড়ি করে তাহলে হিতে বিপরীত হয়ে যাবে। এরচেয়ে বরং না হয় মেয়েটাকে সব গুছিয়ে নেওয়ার জন্য একটু সময় দেওয়া যাক।
হাসিব হেসে বলল,
“ঠিক আছে। আপনি যা ভালো বোঝেন। কিন্তু রিকোয়েস্ট থাকবে, বেশি সময় নেবেন না প্লিজ! আর পারলে আমি চলে যাওয়ার আগেই বিয়েটা করবেন। বন্ধুর বিয়েতে থাকতে না পারলে খুব আফসোস লাগবে।”
প্রত্যুত্তরে অর্ষাও মুচকি হাসল।
হাসিবের সঙ্গে কথা শেষ করে বেরিয়ে দেখল আহনাফ গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছে। এতক্ষণ সে গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। অর্ষাকে দেখেই দরজা খুলে দিয়ে বলল,
“উঠুন ম্যাম।”
অর্ষা মুচকি হাসল তবে প্রত্যাখান করল না। আহনাফ গাড়ি ড্রাইভ করছে। কেউ কোনো কথা বলছে না। মৌনতা কাটিয়ে অর্ষা বলল,
“হাসিব ভাইয়ার সাথে কথা…”
পুরো কথা সম্পূর্ণ করার আগেই আহনাফ বলল,
“জানি সব। শুনেছি আমি।”
অর্ষা চোখ দুটো বড়ো বড়ো করে বলে,
“আপনি আড়ি পেতে আমাদের কথা শুনেছেন?”
আহনাফ হেসে ফেলে। অর্ষার দিকে তাকিয়ে বলে,
“না। আমি কলে ছিলাম।”
“ওহ। এভাবে লুকোচুরি করে শোনার কী ছিল?”
“কারণ আমি সামনে থাকলে তুমি এত সহজে কথাগুলো বলতে পারতে না।”
“আপনার রাগ লাগছে না?”
“রাগ লাগবে কেন?”
“এইযে আমি রাজি হলাম না বলে।”
“তুমি তো রাজিই। শুধু এখন বিয়ে করবে না এই যা তফাৎ!”
“তবুও রাগ হচ্ছে না?”
“উঁহু! একটুও না। যাকে ভালোবাসি তার প্রতিটা সিদ্ধান্তকেই আমি ভালোবাসি। এইযে তুমি নিজের চেয়েও পরিবারের জন্য এত ভাবো, এজন্যই তোমাকে আমার আরও বেশি ভালো লাগে। স্বার্থের এই যুগে ক’জন মানুষ নিঃস্বার্থভাবে পরিবারের পাশে ঢাল হয়ে দাঁড়াতে পারে? বাবা-মা কষ্ট করে লালন-পালন করে বড়ো করে, পড়াশোনা শেখায়। এরপর ছেলে-মেয়েরা কী করে? বিয়ে করে যে যার মতো সেটেলড্ হয়ে যায়। তাদের হাড়ি-পাতিলের ভাত বেশি হলে তার জায়গা হয় ডাস্টবিনে। কিন্তু বাবা-মায়ের জন্য এক বেলার খাবার তাদের হাড়িতে চড়ে না। তখন বৃদ্ধ বাবা-মায়ের জায়গা হয় বৃদ্ধাশ্রমে নয়তো ভিক্ষা করে মানুষের দারে দারে ঘুরে অনাহারে জীবন কাটায়। খুব কষ্ট লাগে অর্ষা জানো? আমার যদি ক্ষমতা থাকত এরকম সব বাবা-মায়ের দেখভাল করার দায়িত্ব আমি নিতাম। কিন্তু আল্লাহ্ আমায় যতটুকুই দিয়েছে ততটুকু দিয়েও আমি আমার সাধ্যমতো এমন অনেক বাবা-মায়ের দায়িত্ব নিয়েছি। আমি বলছি না সব সন্তান স্বার্থপর। এখনও অনেক সন্তান আছে যারা পরিবারের জন্য সর্বস্ব বিসর্জন দিতে পারে। ঠিক তোমার মতো। তাদের প্রতি সম্মানে মাথা নুইয়ে আসে আমার। সেখানে আমি এমন একটা মেয়েকে ভালোবাসি যার কাছে তার পরিবারের প্রায়োরিটি সবার প্রথমে। তাহলে তুমিই বলো তাকে ভালো না বেসে, তার সিদ্ধান্তকে সম্মান না করে আমি কীভাবে থাকি?”
অর্ষা কথা বলতে পারছে না। চুপ করে শুধু শুনে যাচ্ছে। আহনাফ অর্ষার হাতের ওপর নিজের এক হাত রেখে বলল,
“তুমি আমার সাহায্য না নাও। আইডিয়া তো নিতে পারো। আমার মনে হয় না, ভাইয়া আর ভুল কিছু করবে। ভাইয়া যেহেতু পরের অধীনে কাজকর্ম করতে পারে না তখন ভাইয়াকে একটা দোকান দিয়ে দিতে পারো। কাপড়ের দোকান অথবা মুদি দোকান। যেটা ভাইয়ার পছন্দ হয় আরকি। আঙ্কেল আর ভাইয়া মিলে দোকান করল। কষ্টের তো কাজ নয়। এতে বাবা-ছেলের সম্পর্কটাও আগের মতো ভালো হয়ে যাবে। ভাইয়ারও বেকারত্ব ঘুচবে। এর কিছুদিন পর ভালো একটা মেয়ে দেখে ভাইয়ার বিয়ে করিয়ে দাও। একবার সংসারি হয়ে গেলে আর বিপথে যাবে না ইন-শা-আল্লাহ্। এরপর না হয়, এই অধমের প্রতি তোমার করুণা হলে বিয়ে কোরো।”
শেষের কথাটা শুনে অর্ষা হেসে ফেলে। হাসতে হাসতে বলে,
“আপনার আইডিয়া আমার পছন্দ হয়েছে। ভাইয়া আর আব্বার সাথে বাড়িতে গিয়ে এই ব্যাপারে কথা বলব। আর হ্যাঁ, সবটা গুছিয়ে নিতে পারলে আপনার প্রতি করুণাটাও দ্রুত হয়ে যাবে আশা করি।”
“তার মানে আমাদের বিয়েটাও তাড়াতাড়ি হবে আশা করতে পারি?”
অর্ষা হেসে কপালের ওপর পড়ে থাকা ছোটো চুলগুলো কানের পিঠে গুঁজে বলল,
“হুম, পারেন।”
আহনাফ নিজের বুকের বা-পাশে হাত রেখে বলে,
“হায়ে! ওভাবে কানের পিঠে চুল গুঁজবে না বাটারফ্লাই। অন্তত বিয়ের আগে আমার সামনে নয়। একদম নয়! আমি কিন্তু নিজেকে সামলাতে পারি না বলে দিচ্ছি।”
অর্ষা লজ্জা পেয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নিল।
চলবে…
[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।]