যেদিন তুমি এসেছিলে
সিজন_টু
পর্ব_৭
মুন্নিআক্তারপ্রিয়া
অফিসের বাইরে এসে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে অর্ষা। কারও অপেক্ষা কিংবা গাড়ির জন্য নয়; জিদ্দে! জেদটা নিজের ওপর নাকি আহনাফের ওপর ঠিক বুঝতে পারছে না। চাকরিটা হতে হতেও যেন হলো না। মাছের মতো পিছলে গেল! যাবেই না বা কেন? একই তো ইন্টার্ভিউ মানে তার কাছে অন্যতম আ’ত’ঙ্ক। অন্যদিকে আহনাফের পলকহীন তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। আ’ত’ঙ্ক মনের ভেতর চাপা রাখতে পারলেও আহনাফের দৃষ্টি এড়িয়ে চলা যাচ্ছিল না। যার দরুণ জানা প্রশ্নের উত্তরও দিতে পারেনি। উলটো তুতলিয়েছে। এসির মাঝেও ঘেমেছে। যাচ্ছে তাই বিচ্ছিরি একটা ঘটনা ঘটে গেল। বারবার মনে হচ্ছিল কখন ওখান থেকে বের হবে। আর এখন বাইরে এসে মনে হচ্ছে কেন বোকার মতো কাজটা করে ফেলল। কেন একটু স্ট্রং থাকতে পারল না। অনেকক্ষণ যাবৎ বাইরে এসে এসব ভাবার পর ক্লিয়ার মনে হচ্ছে, জেদটা আসলে আহনাফের ওপরই হচ্ছে। মনে মনে সে আহনাফের পিণ্ডি চটকাচ্ছে।
‘তুমি অফিস থেকে বেরিয়েছ আমায় জানাওনি কেন?’
অর্ষা পেছনে ফিরে তাকাল। শামীমকে দেখে মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে যায় তার। এখন লজ্জাজনক কথাটা সে শামীমকে কী করে বলবে?
‘ইন্টার্ভিউতে কী বলল?’ জানতে চাইল শামীম।
অর্ষা নতমুখে জানায়,’মনে হয় না চাকরিটা হবে।’
‘কেন?’
‘আমি কোনো প্রশ্নের উত্তরই ঠিকঠাকমতো দিতে পারিনি। খুব নার্ভাস হয়ে পড়েছিলাম।’
শামীম কয়েক সেকেণ্ড নিশ্চুপ থেকে বলল,
‘আচ্ছা মন খারাপ কোরো না। আমার তো পরিচিত অনেক স্যার আছে এখানে। একটা না একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে।’
অর্ষা প্রত্যুত্তরে দীর্ঘশ্বাস নিল। কিছু বলল না। শামীম হাত ঘড়িতে সময় দেখে নিয়ে বলল,
‘আমি অফিসে যাচ্ছি। তুমি বাসায় চলে যাও। রিকশা ঠিক করে দেবো?’
‘না,না। আমি যেতে পারব। আপনি ভেতরে যান।’
শামীম মৃদু হেসে বলল,’ঠিক আছে। সাবধানে যেও। আর টেনশন কোরো না কেমন।’
স্মিত হাসল অর্ষা। শামীম ফের অফিসের ভেতর চলে যাওয়ার পর অর্ষাও আর দাঁড়াল না সেখানে। এখন সে হাঁটছে। খালি রিকশা অনেক আসছে, যাচ্ছে তবে রিকশায় উঠতে ইচ্ছে করছে না একদম। নিজের বাসায় যাবে নাকি বন্ধুদের সাথে দেখা করতে যাবে বুঝতে পারছে না। অনেক দোটানায় ভুগে অবশেষে সিদ্ধান্ত নিল বাসাতেই যাবে। আগামীকাল তো সবার সাথে এমনিতেও দেখা হবেই। আজ বরং একটু ঘুমানো যাক। সকল দুশ্চিন্তা দূর করার অন্যতম মেডিসিন হচ্ছে ঘুম। অনেকদিন বাদে একটা শান্তির ঘুম হবে আজ।
অর্ষা বাড়িতে ফেরার পর ওমর রহমানের সঙ্গে দেখা হয় প্রথমে। বাবাকে সংবাদটা জানাতে খারাপ লাগলেও মিথ্যে বলার উপায় নেই। ওমর রহমান মুচকি হেসে অর্ষার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
‘এসব নিয়ে চিন্তা করিস না। এক জায়গায় না এক জায়গায় চাকরি হয়ে যাবে দেখিস। এখন রেস্ট কর।’
‘আমি এখন ঘুমাব আব্বা। মাকে বলবে আমায় যেন না ডাকে।’
‘খাবি না নাকি?’
‘ঘুম থেকে উঠে খাব। ঘুম হয় না অনেকদিন।’
‘আচ্ছা মা। তাহলে এখন খেয়ে ঘুমা।’
বাবার সঙ্গে কথা শেষ করে অর্ষা ফ্রেশ হয়ে অল্পকিছু খেয়ে নেয়। সব চিন্তা এক সাইডে রেখে ঘুমের দেশে তলিয়ে যায় সে।
.
.
০৪.৩৫ মিনিট
ভূ’মি’ক’ম্পে সবকিছু উলটে-পালটে যাচ্ছে। ভে’ঙে-চূড়ে যাচ্ছে। মাথা ঘুরাচ্ছে। কী অদ্ভুত! ভূ’মি’ক’ম্প হলে এমন অনুভূতি হয় নাকি? পরক্ষণে অর্ষার হুঁশ এলো আসলে ভূ’মি’ক’ম্প নয়; বরঞ্চ সকাল তাকে ধাক্কাচ্ছিল। আর সে ভেবেছে ভূ’মি’ক’ম্প হয়েছে!
বিরক্ত হয়ে উঠে বসে অর্ষা। রাগান্বিত স্বরে জিজ্ঞেস করে,
‘কী হয়েছে?’
‘ঘুমাচ্ছিস যে! রাফিকে প্রাইভেট পড়াতে যাবি না?’
‘ক’টা বাজে?’
‘প্রায় পাঁচটা বাজতে চলল।’
‘বলিস কী! এত?’
সকাল হাসি চেপে বলল,
‘হুম। ওঠ এখন।’
ঘুমে ঢুলুঢুলু জড়োসড়ো অর্ষার একদম ইচ্ছে করছে না সাধের ঘুম ছেড়ে উঠতে। আলসেমি জেঁকে ধরেছে তাকে। তবুও না গিয়েও তো উপায় নেই। সে মিনিট চারেক আরও কিছুক্ষণ শুয়ে থেকে উঠল। হাই তুলতে তুলতে দেয়াল ঘড়িতে তাকিয়ে দেখল সবে মাত্র ৪:১০ বাজে। সকাল শুধু শুধু এসে ঢপ মারল। আশেপাশে তাকিয়ে সকালকে পাওয়া গেল না। সে রাগে চোখ-মুখ শক্ত করে বলল,
‘আস্ত বে’য়া’দব একটা!’
একমনে ভাবল আরও কিছুক্ষণ শুয়ে থাকবে কিনা। তবে ভাবনাটি তাকে প্রত্যাখান করতে হলো। কেননা এখন আবার শুয়ে পড়লে পরে আর উঠতে পারবে কিনা সন্দেহ রয়েছে। তাই আর না শুয়ে ফ্রেশ হয়ে, আস্তে-ধীরে রেডি হয়ে নিল। যাওয়ার পূর্বে সকালকে পাওয়া গেল বাবা-মায়ের রুমে। সে সকালের মাথায় চা’টি মে’রে বলল,
‘তোর বে’য়া’দ’বি’র শাস্তি।’
সকাল হাত দিয়ে মাথা ডলতে ডলতে অর্ষার চলে যাওয়া দেখছে।
রাফিদের বাড়িতে গিয়ে বাড়ির বাগানে আহনাফকে দেখতে পেল অর্ষা। আহনাফও তখন বাড়ির ভেতরে যাওয়ার জন্য এগুচ্ছিল। অর্ষার মেজাজ প্রচণ্ড খারাপ হয়ে যায় আহনাফকে দেখে। ইন্টার্ভিউয়ের কথা মনে পড়লেই রাগে শরীর রিরি করে উঠছে। চোয়াল শক্ত করে সে আহনাফকে দেখেও না দেখার ভান ধরে এগিয়ে যায়।
রেণু দরজা খুলে দুজনকে একসাথে দেখে। অর্ষা আহনাফের থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে ছিল। আহনাফ তখনও অর্ষাকে দেখতে পায়নি। সে আগে আগে ভেতরে প্রবেশ করে। পেছন থেকে শুনতে পায় রেণু বলছে,
‘কী হইছে? মন খারাপ নাকি?’
আহনাফ অবাক হয় কিছুটা। তাকে দেখে কি মনে হচ্ছে তার মন খারাপ? সে উত্তর দেওয়ার জন্য পেছনে তাকিয়ে দেখতে পেল অর্ষাকে। আর বুঝতেও পারল উক্ত প্রশ্নটি তার জন্য নয়; বরঞ্চ অর্ষার জন্য ছিল।
অর্ষা একবারও তাকাচ্ছে না আহনাফের দিকে। সে রেণুর দিকে তাকিয়ে আছে। ঠোঁটে স্মিত হাসি। বলল,
‘না, মন খারাপ না। ঘুম থেকে উঠেছি তো তাই মনে হয় এমন লাগছে। রাফি কোথায়?’
‘ওর ঘরে আছে। আপনে যান।’
অর্ষা এবারও আহনাফকে পুরোপুরি এড়িয়ে রাফির রুমে চলে গেল। এতে অবশ্য আহনাফ বেশ ভড়কে যায়। সে নিজের রুমের দিকে যাবেই ঠিক এমন সময় অর্ষাকে আবার ফিরে আসতে দেখা যায়। প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকিয়ে রয়েছে আহনাফ।
অর্ষা মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কাঠকাঠ গলায় বলল,
‘আপনার সাথে আমার কিছু কথা আছে।’
আহনাফ শান্তস্বরে বলল,’বলুন।’
অর্ষা আশেপাশে একবার তাকাল। রেণু কিংবা অন্য কেউ নেই এখন এখানে। সে গোপনে ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে প্রশ্ন করল,
‘আপনি ওভাবে তাকিয়ে কেন ছিলেন?’
আচমকা অর্ষার এমন প্রশ্নে আহনাফের অবাক হওয়ার সীমা রইল না। সে বিস্মিতকণ্ঠে জানতে চাইল,
‘হোয়াট! কখন? কোথায়? কীভাবে তাকিয়ে ছিলাম?’
‘সকালে। অফিসে। কেমনভাবে জানি! আপনার জন্যই আমার চাকরি হয়নি।’
আহনাফ এবার কয়েক সেকেণ্ড চুপ করে থেকে বলল,
‘আমার জন্য নয়; বলুন যে আপনি একটা গা’ধী! কিচ্ছু পারেন না তাই চাকরি হয়নি। আপনি রাফিকে পড়ান কী করে?’
‘আপনি কিন্তু আমাকে অপমান করছেন।’
‘আপনি নিজেই সেই সুযোগটা করে দিয়েছেন।’
‘আমি কোনো সুযোগ করে দিইনি। আমি শুধু সত্যিটা বলেছি। আপনি মানুন কিংবা না মানুন, স্বীকার করুন আর না করুন; সত্যি এটাই যে আপনার ওরকমভাবে তাকিয়ে থাকার জন্যই আমি চাকরিটা পেলাম না।’
‘এখন সব দোষ আমার চোখের?’
‘না, আপনার তাকানোতে।’
‘আমার তাকানোতে কী ছিল? আমি তো নরমালি তাকিয়ে ছিলাম। সবার বেলাতেই তাকাই।’
‘ওদের কারও চাকরিই নিশ্চয়ই হয়নি?’
‘আপনার মতো গা’ধা কিংবা গা’ধী যারা; তাদের হয়নি।’
‘ফের অপমান করছেন।’
‘ফের সুযোগ করে দিয়েছেন।’
‘শুধু শুধু আমাকে ব্লেইম করছেন। আমি বলছি তো, আপনার অন্যরকম ভাবে তাকানোর জন্যই আমি কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে পারিনি।’
‘কেন? আমার চোখ, দৃষ্টি কি আপনাকে উত্তর দিতে বারণ করেছিল?’
‘সম্ভবত।’
‘সম্ভবত মানে? সম্ভবত কী?’
‘সম্ভবত বারণ করেছিল।’
‘তাই? কী করে শুনি?’
‘অত কিছু আমি জানি না। কিন্তু আপনার উচিত আমাকে স্যরি বলা।’
‘কোন সুখে?’
‘সুখে নয়। দুঃখে। আপনার জন্য আমার চাকরি হয়নি। এজন্য আমার প্রতি আপনার দুঃখবোধ হওয়া উচিত। ঠিক এ কারণেই আপনি এখন আমাকে স্যরি বলবেন।’
‘অসম্ভব! কখনও না।’
‘আশ্চর্য! কেন বলবেন না?’
‘কারণ আমার কোনো ভুল নেই। আর হ্যাঁ, তাও যদি আপনার কথাগুলো মেনে নিই; তাহলে আপনার ভাষ্যমতে স্যরি আমার বলা উচিত নয়।’
‘তবে কার বলা উচিত?’
‘আমার দৃষ্টির। এই নিন, আমার চোখের দিকে তাকান। তখন যেভাবে আমার দৃষ্টি আপনাকে উত্তর দিতে বারণ করেছিল, এখন সেভাবেই আবার স্যরি বলবে।’
অর্ষা আহনাফের চোখের দিকে তাকিয়ে দু’সেকেণ্ড পরই দৃষ্টি সরিয়ে নিল। আহনাফ বলল,
‘কী হলো? চোখ সরিয়ে নিলেন কেন? স্যরি শুনবেন না?’
অর্ষা চোখ-মুখ পাকিয়ে বলল,’আপনি অসম্ভব রকম ফাজিল!’
চলবে…
[বিঃদ্রঃ কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।
নোটঃ কয়দিন ধরে এই পর্ব লিখেছি নিজেও হয়তো জানিনা। অল্প অল্প করে লিখেছি বলে লেখার মাধুর্য নষ্ট হতে পারে! এজন্য আমি দুঃখিত।]