জলনূপুর পর্ব ৬
Sharifa_suhasini
নবনীর দুই চোখ লাল হয়ে আছে। কিছুক্ষণ আগেই যে মেয়েটা অঝোরে কান্না করেছিল, তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। রিতু ক্ষীণ কন্ঠে ডেকে ওঠে,
-আপা!
-আচ্ছা, আমাকে বল তো, এই ভদ্রলোকটি আমাকে নিয়ে কেন খেলছে, রিতু? আমি তাকে কেন বিশ্বাস করতে পারছি না! আমার কী করা উচিত, একটু বলে দে না।
নবনী বোনকে জড়িয়ে ধরে এমনই মধুর বিরহে আর্তনাদ করে ওঠে, সেই বিরহের সুর স্বয়ং রিতুর বুকের মধ্যখানেও গিয়ে আঘাত করলো। রিতু কোনো জবাব দিতে পারে না। কেবলই অধোমুখী হয়ে নীরবে বোনকে সাপোর্ট করে যায়। নবনী আবার বললো,
-এই আমান নামক ভদ্রলোকটি এখন আমার সামনে মুখোশ পরে আছে। তাই না? তুই সত্যি করে বল রিতু।
না, আপা। উনি নিতান্তই ভদ্রলোক। আমান ভাইয়া শুধু তোমাকে ভালোই বাসে না, বরং তোমার জন্য তার ভিতর যথেষ্ট পরিমাণ শ্রদ্ধাবোধ আছে। আমি কী বলি আপা, আমান ভাইয়ের ব্যাপারে একটু ভেবে দেখতে পারো। তুমি ঠকবে না৷
-আমার চোখের সামনে থেকে সরে যা তো। বিরক্ত হচ্ছি।
-আপা, তুমি সবসময় এমন আচরণ করতে পারো না। আমি তোমার ছোট, ঠিক আছে, কিন্তু একেবারে বাচ্চা নই। ভালো-মন্দ চেনার ক্ষমতা আমারও আছে। তাই, তোমার জন্য আমার কাছে যেটা সঠিক মনে হবে, আমি তোমাকে সেই সিদ্ধান্ত দেবোই। বুঝতে পেরেছো ?
-হ্যাঁ, অনেক বুঝেছি।
-তুমি এত ভয় না পেয়ে একবার আনাম
ভাইয়ের সাথে স্ব-ইচ্ছেয় কথা বলে দেখো। নিজের মনকে একটু সহজ করেই দেখো। জীবনে একবার ঠকেছো বলে কী সারাজীবন সেখানেই থেমে থাকবে? এক বেলার খাবার পছন্দ না হলে সারাদিন পেট খালি রাখো? নিশ্চয় না। তাহলে জীবনের সিদ্ধান্তে এমন অবুঝ কেন আপা? এতকাল তুমি আমাকে জীবনের ব্যাপারে বড় বড় পরামর্শ দিয়ে এসেছো। আর আজ নিজেই অবুঝের মত করলে হবে?
নবনী সচকিত চোখে বোনের দিকে তাকায়। সে তো খুব ভালো করেই জানে- নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে অন্যকে জ্ঞান দেওয়া যত সহজ, সেই বিষয়টি নিজে মুখোমুখি হওয়াটা ঠিক কত কঠিন। অধিকাংশ মানুষ জীবনের অর্ধেক সময় পার করে দেয় একজন উপযুক্ত জীবনসঙ্গীর জন্য নিজেকে উপযুক্ত করে তুলতে, আর বাকি জীবন পার করে সেই সঠিক মানুষের জায়গায় অন্য কাউকে জীবনে পেয়ে ভুগতে ভুগতে।
*
বেশ কিছুদিন কে*টে যাবার পরেও নবনীর পক্ষ থেকে বিশেষ সাড়া পাওয়া গেল না। তাকে নিয়ে আর আমানের বাড়িতে কথাও ওঠে না। বিশেষ করে ফৌজিয়া সবসময়ই মেয়েপক্ষের কথা চেপে রাখে। না রেখেও উপায় নেই। তার চেপে রাখোনা একমাত্র ভাই জীবনে প্রথম কোনো মেয়েকে এত ভালোবেসেছে। কিন্তু নবনীর এতে সম্মতি নেই। ভালোবাসার মানুষটাকে না পাওয়ার দুঃখ সে যে গোপনেই বয়ে বেড়ায়- তা এবাড়ির সবাই জানে। নতুন করে তার ব্যাপারে
আলাপ উঠলে আমানের দুঃখ বাড়ানো ছাড়া কমবে না ।
রাতে খাবার সময় ডাইনিং টেবিলে আমানকে পাওয়া গেল না। সে হাসপাতাল থেকে ফিরেই রুমে এসে শুয়ে পড়ে। অন্যদিন হলে ঘন্টাখানিক টিভি দেখত। কিন্তু গত তিনদিন সে টিভির ঘরে ঢুকছে না। ফৌজিয়া একটি প্লেটে খাবার তুলে ভাইয়ের রুমে ঢুকলো। আমান তখন কপালের উপর
ডান হাত ভাঁজ করে ধরে শুয়ে আছে। ফৌজিয়া খাবারের প্লেটটা পাশের টেবিলের উপর রেখে বলল,
-তুই ডাক্তারি পাশ করেছিস কীভাবে বল তো? পরীক্ষার সময় টুকলি করেছিলি নাকি?
অকস্মাৎ বোনের মুখে এমন প্রশ্ন শুনে আমান কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে সেভাবেই বসে রইলো। প্রশ্নের কারণ খোঁজার চেষ্টাও করলো না। ফৌজিয়া আবার
বলে,
-নিজে ডাক্তার হয়ে মানুষকে নানান চিকিৎসা দিয়ে বেড়াস। অথচ তোর খাওয়াদাওয়া কোনো ঠিক নেই। এটা কোনো কথা? তুই কি বাচ্চা ছেলে, আমান? কুড়ি বা ছেলেদের মত খাবার বিমুখ হয়ে গেছিস।
বোনের কথায় আমান হেসে ফেলে। সে নিজেও জানে, এসব তার মানায় না । বিরহের শোকে তার যে খাবারের প্রতি অনীহা তৈরি হয়েছে,এমনটাও নয়। মানুষের খাবার গ্রহণের একটা মনস্তাত্ত্বিক থিওরি আছে। বিজ্ঞানসম্মত প্রমাণ না থাকলেও আমানের দাদা খুব করে কথাটি বিশ্বাস করতেন।
“মানুষের স্বভাবে মাসের পনেরো দিন খাবারের প্রতি প্রচন্ড টান থাকে। সবসময় ক্ষুধা, ক্ষুধা অনুভূতি আসে। মনে হয়- কী খায়, কী খায়! আবার পনেরো দিন ঠিক তার উল্টো। সেই
মুহুর্তে তিনবেলা খাবারেও বদহজম হয়ে যায়। আমানের অবস্থা হয়েছে ঠিক তাই।”
সে বোনকে জবাব দেয়,
-আপা, আমি কী ভালোবাসিনি? যদি ভালো না বাসতাম, তবে নিজের প্রতি আফসোস থেকে শোক পালন করতাম। কিন্তু আমি তো তাকে নিজের সমস্ত অনুভূতি দিয়েই ভালোবাসি। এক বিন্দু স্থানও ফাঁকা রাখার সুযোগ সেখানে নেই। কোন আফসোসে শোক পালন করবো বলো তো?
ভাইয়ের কথা শুনে ফৌজিয়া মুগ্ধ হয়ে যায়। তার হঠাৎ মনে হচ্ছে- ভালোবাসার অনুভূতিটা আসলে এরকম পরিণত বয়সেই আসা উচিত। এতে যাকে আমি ভালোবাসব, তার জন্য আসমান সমান সম্মান চলে আসবে। কারো প্রতি কারো অভিযোগ থাকে না, অনুরাগ থাকে না ।
সে ভাইকে জানায়,
-নবনীর নারাজ হবার যথেষ্ট কারণ আছে। এর জন্য শুধুমাত্র তুই দায়ী। তুই কী জানতিস না যে, রিতুর বড়বোন আছে? আমরা রিতুকেই তোর জন্য দেখতে গেছিলাম। এসব বলিনি তোকে? তারপরেও ছোটবোনের সামনে ছ্যাবলার মত বড় বোনকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে বসলি। একজন ডিভোর্সি মেয়ে হিসেবে ওর কেমন অনুভব হতে পারে, তোর বোধ হলো না?
– বোধ হলে কী সামনাসামনি বলতাম?
সারাজীবন পড়াশোনা করে, এত স্বল্প সময়ে নামী ডাক্তার হয়েও আমি যে পাশাপাশি এতবড় গাধা হয়ে উঠব, আগে কী জানতাম?
সে বিছানা ছেড়ে নেমে আসে। ফৌজিয়া আপার সামনে দাঁড়িয়ে তার গালে আলতো করে বলে,
– আপা, আমি নবনীর সিদ্ধান্তকে সম্মান করি। তোমার স্বামী অর্থ্যাৎ সাইমন ভাইয়া যখন এক্সিডেন্টে মা*রা গেলেন তখন তোমার কী পরিমাণ স্ট্রেস গেছে আমি জানি। ওর ও তো প্রায় একই, তাই না? তবে আপা, আমি রিতুকে চেনার আগেই নবনীকে চিনি, পছন্দ করি। এটাই সত্যি কথা। ওকে আমি এত বেশি ফলো করেছি, যতটা ডাক্তারির বইগুলোকে করতাম ।
-মানে! কীভাবে?
– সেকথা ওকেই জানাবো?
-তাহলে এরপর কী করবি? ও কী তোর
কথা শুনবে?
– সে নিজেই আমার সাথে দেখা করতে চেয়েছে।
-কী বলিস? কখন?
-আজ ভোর সাড়ে ছয়টায় হঠাৎ ওর কল। মোবাইলের রিংটোন শুনে ফোনেরস্ক্রিণে তাকিয়ে দেখি-নবনীর কল! রিসিভ করলাম। ওর নাম ধরে ডাকতেই হেসে ফেলল। আর বললো-আপনি সত্যিই ভদ্রলোক। নাহলে গোপনে কবে কবে আমার নাম্বার নিয়েছেন! অথচ আজ অব্দি কল দেননি। আপনার সাথে দেখা করতে চাই। সময় হবে?
ওর কথা শুনে আমি রীতিমতো অবাক হয়ে গেলাম। কাল বিকাল সাড়ে পাঁচটায় ওর অফিসের ওদিককার সেই পার্কটাতে, যেখানে সেদিন ও হুট করে
ওর কথা শুনে আমি রীতিমতো অবাক হয়ে গেলাম। কাল বিকাল সাড়ে পাঁচটায় ওর অফিসের ওদিককার সেই পার্কটাতে, যেখানে সেদিন ও হুট করে রেগে চলে গেছিল। অদ্ভুত সুন্দর ব্যাপার না আপা?
আমানের চোখেমুখে যেন তারার মতই আনন্দটুকুও ফুটে উঠছে।
চলবে,,,,,,,,,,,,,