জলনূপুর পর্ব ৭
#Sharifa_suhasini
#পর্ব ৭
ব্যাপারটা বুঝতে পেরে ফৌজিয়া বললো,তুই সত্যিই ওর প্রতি এত দুর্বল হয়ে গেছিস অবাক হচ্ছি।
আমি কি একটু বেশিই ছেলেমানুষি করছি আপা?
তা তো একটু করছিসই। তবে পুরুষের মাঝে প্রিয়জনের জন্য এরকম একটু আধটু পাগলামি থাকা ভালো।সবাই তো আর তোর মতন করে আহ্লাদ দেখায় না।তারা তো নিজের পুরুষত্বের ঠাট বাট বজায় রাখতেই ব্যস্ত।তোর দুলাভাইকে দেখিসনি? তুই যে তাদের ব্যতিক্রম,এই নিয়ে তো বোন হিসেবে আমার গর্ব করা উচিত।
দুলাভাইয়ের কথা উঠতেই আমলের খেয়াল হয়,ফৌজিয়া আপাকে পুনরায় বিয়ে দিতে কি দুর্বিষহ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি তাদের হতে হচ্ছে। তবে কি আপনার যন্ত্রণাগুলো খুব কাছ থেকে দেখার ফলেই তার নবনীর প্রতি এত দুর্বলতা প্রকাশ পাচ্ছে?কি জানি!
মানুষের মন কত কারণে কত দিকে গলিত দলিত কিংবা মথিত হয়। তবে যাই হোক, নবনীকে সে ভালোবেসে ফেলেছে। সাংঘাতিক রকমের ভালোবাসা। এই সত্য বিন্দুমাত্র শূন্যতা নেই ফৌজিয়া আপা ঘর থেকে বের হয়ে গেলে সে বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবে,
আগামীকাল নবনীর সাথে দেখা করতে গেলে সে কিভাবে যাবে শুরুতে কি কথা দিয়ে আলাপ করবে!
দুচোখ ভর্তি স্বপ্ন নিয়ে একদিকে আমান ঘুমোতে পারছে না অন্যদিকে নবনী সম্পূর্ণ চুপচাপ। আগামীকাল যে সে নতুন ভাবে কিছু শুরু করার সূতোটি বুনতে যাবার পরিকল্পনা করছে এ নিয়ে বিন্দুমাত্র ভাবান্তর তার নেই।
মানুষের জীবনের ধারাপাতের এই এক নিয়ম।প্রথমবার যা কিছু শুরু করে, তীব্র উচ্ছ্বাস আর আবেগে নিজের সবটুকু অনুভূতি দিয়ে তা উপভোগ করে। কিন্তু সেই অনুভূতির জোয়ারে যদি ভাটা পড়ে যায় তবে শতভাগ সুযোগ এলেও তার বিশেষ আগ্রহ জন্মায় না।নবনীরও তাই হল অনেক রাতে ঘুম ঢুলুঢুলু চোখে যখন সে বালিশে মাথা রাখে তখন হঠাৎই মনে হলো-
“লোকে বলে বেশি বয়সে পুরুষেরা প্রেমে পড়লে নাকি তাদের ধ্যান জ্ঞান সবটুকু দিয়েই প্রেমে পড়ে আমান কি সেই শ্রেণী পুরুষ যদিও মানুষটার বয়স খুব বেশি নয় তবে যে কৈশোর বয়সে পুরুষেরা সাধারণত প্রেমে পড়ে সেই বয়সে আমান ছিল প্রেম বিমুখ”
পরদিন দুপুরের পর আরেকবার গোসল দেয় নবনী সর্বোচ্চ গতি চালু করে চেয়ারে চুল ছেড়ে দিয়ে চুল শুকায়। যদিও অন্যান্য দিন কখনোই সে ফ্যানের গতি বাড়ায় না হাজার গরম পরলেও। মেয়ের এই হঠাৎ পরিবর্তনের নবনির মা তোর বেগম বেশ অবাক হলেন তারাও অবাক হওয়ার মাত্রা হতভাগ হওয়ার সীমানা ঠেকলো,
যখন বিকেলবেলা হালকা গোলাপি রঙের শাড়ি পরে একটা ব্লাউজ হাতে দিয়ে নবনী তার মাকে ডেকে বলে আমি কি আগের চেয়ে একটু মোটিয়ে গেছি?এই ব্লাউজ আমার গায়ে সুন্দর দেখাচ্ছে না কেন বলো তো?
তোর বেগম কিছুক্ষণ মেয়েরা আপাতত চেয়ে চেয়ে দেখলেন।কিন্তু মেয়ের শরীরে বিশেষ পরিবর্তন খুঁজে পেলেন না পরিবর্তন যা ঘটার তা শুধুমাত্র নবনির চোখে মুখেই ঘটছে।তরু বেগম মুখের ডান পাশ নড়িয়ে টেনে টেনে জিজ্ঞাসা করলেন, আমার সাধ্যি থাকলে তোকে শোনার কৌটায় যত্নে তুলে রাখতাম রে মা।
আমার মেয়ে তো আল্লাহর দুনিয়ার সবচেয়ে সুন্দর ফুল তোকে সুন্দর দেখাবে না?তরু বেগম নবনীর আরো কাছে এগিয়ে এলেন তারপর মেয়ের থুতনির নিচে হাত রেখে মাথা উঁচু করে ধরে বেশ কয়েকটি চুমু একে দিলেন তিনি।
আমার লক্ষী মেয়েটা আল্লাহ তোকে হাজার বছর বাঁচিয়ে রাখুক খবরদার মা আমাকে এই বদদোয়া দিবে না একদম। ৩০ বছরের আগেই তোমার এই দুনিয়ার প্রতি আমার বিরক্তি ধরে গেছে আরো হাজার বছর বাঁচার দোয়া কোন বিবেকে করছো?আমাকে আরো কষ্ট দুঃখ পেতে বলছো তুমি এক্ষুনি তোমার এই বদ দোয়া ফিরিয়ে নাও।
তরু বেগম ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেন এই দুনিয়ার সব মায়েরাই তাদের সন্তানের জন্য পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরতম দোয়াটি করেন।তিনিও করেছেন। এই দোয়া বদ দোয়া কিভাবে হতে পারে কোনভাবেই তিনি দোয়া ফেরত নিতে পারবেন না নাকি এই অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে নবনী আবার বললো,
ফেরাবে না কিন্তু আমি এই বাড়ি থেকেই বের হয়ে যাব ঈদের কাছে হেরে তিনি অত্যন্ত ক্ষীন কন্ঠে বিড়বিড় করে বললেন, হাজার বছর না হোক অন্তত শত বছর এর চেয়ে আমি কমাতে পারবো না।
কথা বলতে বলতে শেষের দিকে তার কণ্ঠস্বর এক রকম জড়িয়ে গেল।নবনী আড়ালে ঠিক করে হেসে দেয় কিন্তু সামনাসামনি প্রসঙ্গ পাল্টে মাকে আবার জিজ্ঞাসা করে আমি সত্যিই মোটিয়ে গেছি? এই শাড়িতে কি আমাকে ভালো লাগছে না?
লাগছে তো।কিন্তু হঠাৎ এত সুন্দর করে শাড়ি পড়ে কোথায় যাচ্ছিস? আমানের সাথে দেখা করতে যে সেদিন রিতুকে দেখতে এলেন তারপর সবার সামনে হঠাৎ করে বলে উঠলেন উনি নাকি আমাকেই বিয়ে করবেন তোমার মনে আছে মা?সেই আমান।
বিস্ময়ে তরু বেগমের দুই ঠোঁট হা হয়ে সামান্য দূরত্ব তৈরি হলো।নবনী আবার বললো জিতুকে দেখতে আসাটা একটা উপলক্ষ মাত্র তুমি জানো তুমি আমান সাহেব কে আগেই না করে দিয়েছিল ওদের দুজনের পরিকল্পনা ছিল রিতুকে দেখতে এসে আমার নিজে থেকে রিজেক্ট করবে।আর তোমার ঋতু হবে তাই মুক্ত।
তুই এসব কি বলছিস আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।
এখন বুঝার দরকার নেই আর বিস্তারিত তোমাকে বলতে ইচ্ছে করছে না আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে কপালে টিপটা ঠিক জায়গায় আছে কিনা দেখো।
নবনী মাকে বললেও নিজে নিজেই আয়না দেখে শাড়ি টিপ সবটা যাচাই করে নেয় তারপর ডানে বামে কোন দিকে না ফিরে সোজা বের হয়ে গেল।
ব্যাঙ্কে বসে আমান বার বার ঘাম মুছছে পাঁচটা বাজার ঠিক ২৭ সেকেন্ড আগে সে উপস্থিত হয়েছে নবনীতা কে প্রথমবারের মতো নিজে থেকে ডেকেছে মোক্ষম সময় দেরি করাটা মোটে উচিত হবে না কিন্তু যার জন্য এত ত্যাগ সেই নবনী কোথায় সুখ চোখে চাতক পাখির মতো এদিক ওদিক ফিরে ফিরে তাকায়।
অবশেষে সেই কাঙ্খিত নারীটিকে দেখা যায় শাড়ির সামনের অংশ সাবধানে ধরে রিকশা থেকে নামছে কি ভীষণ মিষ্টি দেখাচ্ছে তাকে বিশেষ চাকচিক্য নেই কৃত্রিমতা নেই যেটুকু চোখে উপলব্ধি করা যায় ঠিক ততটাই সুন্দর।
আমাদের খুব ইচ্ছে করছে ওকে চেয়ে চেয়ে দেখতে কিন্তু বেশিক্ষণ তাকালো না নবনির চোখে চোখ পড়ার আগেই সে অন্যদিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয় খুব বেশি প্রিয় দিকে নাকি বেশিক্ষণ তাকাতে নেই তাকালে নাকি সেই মুহূর্তেই সেটা নিজের করে পেতে ইচ্ছে করে এই দোষেই তো মানুষ বাগানের সবচেয়ে প্রিয় ফুলটা ছিড়ে ঘরে তুলে আনে।
নবনী ঠিক ওর পাশেই বসল ভালো-মন্দ কেউ কোন প্রশ্ন করে না।শুধু নবনী হঠাৎ সরাসরি প্রশ্ন করে উঠলো,
আমাকে সত্যি সত্যি বলুন তো এবার আমাকেই কেন বিয়ে করতে চান? কি কেন এত পছন্দ আপনার আমি কি রূপকথার হুরপরী?
উহু হুরপরী দেখার সুযোগ আমার কখনো হয়নি। কিন্তু উপন্যাসের রূপকথার মত আপনার নির্বিকার স্বীকারোক্তি শুনেছিলাম।
উপন্যাসের রূপকথা?
হুম “তবু বেঁধে রাখি মন” উপন্যাসের রূপকথা কখনো সময় পেলে পড়ে নিয়েন ঠিক যেন আপনারই আরেক রূপ কারণেই আপনাকে আমার ভালো লেগে গেছিল।
ঠিক বুঝলাম না একটু সহজ করে বলুন।
সেদিন আপনার প্রাক্তন স্বামীর সাথে ডিভোর্স হয়েছিল আপনি মাঝারি সাইজের কয়েকটি লাউডস টানতে টানতে সি ব্লকের আট নম্বর রোডের মোড়ে দাঁড়িয়ে আপনার বাবাকে ফোনে বলেছিলেন,
বাবা ওর সাথে আমার ডিভোর্স হয়ে গেল মাত্রই কিছুক্ষণ আগে আমি সব ছেড়ে চলে আসছি অফিসিয়াল ডিভোর্স ব্যাপারে শুধু সাইন করা বাকি তুমি কি আমাকে তোমার ঘরে আমার প্রাপ্য সম্পদ বাবদ একটু ঠাঁই দেবে? আর না পারলেও বল আমি নিজেই নিজেকে সামলাতে পারবো।
চলবে,,,,,,,,?