কিছু জোড়া শালিকের গল্প পর্ব ২০
: #আর_ভালোবাসা?
লেখিকা : #Lucky_Nova(কপি নিষেধ)
নীল সবটাই লক্ষ্য করলো। ধীরে সুস্থে চায়ের কাপটা নামিয়ে রেখে শান্ত ভঙ্গিতে তাকিয়ে বলল, “তোমার সমস্যা আছে কোনো?”
থতমত খেয়ে গেল ত্রয়ী। শঙ্কিত হয়ে তাকিয়ে ঠোঁট নাড়িয়ে কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারল না। ঘামতে লাগলো রীতিমতো। মেঝের এমাথা থেকে ওমাথা দৃষ্টি বুলিয়ে ঢোক গিললো কয়েকটা।
নীল ক্ষীণ দৃষ্টিতে তাকালো। তারপর ওর দিকে কিছুটা ঝুঁকে এসে বলল, “এত নার্ভাস হচ্ছ কেন? আমি কি বাঘ না ভাল্লুক?”
ত্রয়ী কিছু বলল না। শিয়র নত করে হাতের মুঠোয় ওড়নাটা মোড়ামুড়ি করতে লাগলো। দেখে মনে হচ্ছে অনেক বড়ো সংকটে পড়েছে সে।
নীল আর ঘাটলো না। এমনিই ভীতু। বেশি কিছু বললে কিনা ভয়েই শুকিয়ে যায়!
সে এমনিও থাকবে না। শুধুমাত্র ত্রয়ীর অনুভূতি জানার জন্যই এসব বলা। ত্রয়ী থাকতে বললে সে থাকতো কিনা সেটা সে জানেনা। অন্তত একরাশ ভালোলাগা কাজ করতো।
কিন্তু ত্রয়ী কিছুই বলল না। সে এই সম্পর্কের প্রতি বরাবরই উদাসীন এটা বেশ ভালো করেই বুঝতে পারে নীল। হয়তো এখনো ওকে ঠিক মেনেও নিতে পারছে না। নাকি মানতে চাইছে না!
কে জানে?
ত্রয়ী সরাসরি বললে জানা যেত। কিন্তু কিছু জিজ্ঞেস করলেও তো এড়িয়ে যায়।
দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে শার্টের বোতাম লাগিয়ে নিতে নিতে বিছানার দিকে এগিয়ে গেল নীল।
চোরাচোখে তাকিয়ে দেখলো ত্রয়ী। তাকে টাই বাঁধতে দেখে অবাক হলো।
পরিপাটিভাবে প্রস্তুত হয়ে কোটটা যখনি হাতে তুলে নিলো তখনই বিস্ময় নিয়ে তাকালো ও। থাকবে বলে চলে যাচ্ছে যে!
নীল ফোনটা পকেটে ঢুকাতে ঢুকাতে ত্রয়ী স্তিমিত স্বরে প্রশ্ন করে বসলো, “আপনি চলে যাচ্ছেন?”
“হু।” একপলক তাকালো নীল।
“কেন?” মুখ ফসকে গেল ত্রয়ীর।
নীল ভ্রু উঁচিয়ে আয়নায় ত্রয়ীর দিকে তাকাতেই তড়িঘড়ি করে দৃষ্টি নামালো ও। আমতাআমতা করে চুপ হয়ে গেল।
“তুমিই তো চাও আমি চলে যাই।” টাই-টা আরেকটু ঠিকঠাক করে নিতে নিতে কাটখোট্টা গলায় বলল নীল।
হতবুদ্ধি হয়ে পড়লো ত্রয়ী। সে তো এমন কিছুই বলেনি। যদিও সে থাকতেও বলেনি।
ত্রয়ীর দিকে ফিরলো নীল।
ত্রয়ী চোখ পিটপিটিয়ে তাকিয়ে রইলো। লোকটা সত্যিই যাচ্ছে!
“দরজা পর্যন্ত চলো।” বলল নীল।
ত্রয়ী নড়লো না। ইতস্তত করতে লাগলো।
নীল সন্দিহান চোখে তাকিয়ে ওকে দেখলো।
“কিছু বলবা?”
চট করে হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়লো ত্রয়ী।
“বলো।”
সাথে সাথেই বলল না ত্রয়ী। বেশ কিছুক্ষণ ইনিয়েবিনিয়ে অবশেষে মুখ খুললো।
“আপনি কি রাগ করেছেন?”
শঠভাবে হেসে ভ্রুতে ভাঁজ ফেললো নীল। টানটান স্বরে বলল, “আমি রাগ করলেও কী আর না করলেও কী? তুমি তো এই আমাকে বা সম্পর্কটাকে মেনেই নিতে পারছ না।”
অজানা কারণেই মুখটা মলিন হয়ে এলো ত্রয়ীর। তাকালো ম্লান চোখে। লোকটা অন্যরকম ভেবে বসে আছে।
ফোঁস করে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো নীল। সে তার দিক থেকে একশোভাগ দিয়ে চেষ্টা করলেও, এগিয়ে আসলেও অপরজনের কোনো ইচ্ছে না থাকলে কীভাবে হবে?
নীল আর কথা বাড়ালো না। চোখের ইশারা করে বলল, “যাইহোক চলো।”
দরজার দিকে ঘোরার আগেই ত্রয়ী রিনরিনে স্বরে বলল, “আপনি যেমন ভাবছেন তেমন না। মানে… আসলে আমি…।
বুকে হাতভাঁজ করে রেখে ত্রয়ীর দিকে তাকিয়ে রইলো নীল।
ত্রয়ী একটু থামলো। এদিক ওদিক দৃষ্টি ঘুরিয়ে তারপর গটগট করে বলে উঠলো, “আপনি ভুল বুঝছেন।”
“কী ভুল বুঝছি?”
“সম্পর্ক না মানা আর…।”
“আর?” গম্ভীর চোখে তাকিয়ে ওর কাছে এসে দাঁড়ালো নীল।
ত্রয়ী গলা ভেজালো। পায়ের আঙুলগুলোর দিকে তাকিয়ে থেকে কথা গুছলো।
“আমাকে একটু সময় দিন। আর তাছাড়া আমি এই সম্পর্কটা মানিনা এটা বলিনি।”
“তারমানে মানো?”
দ্রুত মাথা নেড়ে সায় জানিয়ে দিলো ত্রয়ী।
“তাহলে আমাকে এড়িয়ে যাও কেন? আর আমার প্রশ্নের উত্তরও দেওনি তখন। সত্যিটা জানতে চাই আমি। আমাকে ভালো লাগে না তোমার?”
এই প্রশ্নের উত্তর দিতে হিমশিম খেতে হলো ত্রয়ীকে। একাধারে ঘামতে লাগলো। গলার কাছে মুক্তোর মতো চিকচিক করতে লাগলো ঘামের বিন্দুগুলো। বুকের ভিতরে হাতুড়ি পেটাচ্ছে।
“বলো?” রাশভারি গোছে শুধালো নীল।
ত্রয়ী দ্বিধান্বিত হলো। এড়িয়ে যাওয়ার কোনো উপায় একদমই নেই। সরাসরি শুনেই ছাড়বে লোকটা। তাই কিয়ৎপল ওড়না মোড়ামুড়ি করে নিচু স্বরে বলল, “আমি…আমি অপছন্দ করি না আপনাকে। আমার আপনাকে বা এই সম্পর্ককে নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। আমি… আমি মানি এই সম্পর্কটা। কিছুদিনের মধ্যে আমি ঠিক মানিয়ে নিতে পারবো।”
“আর ভালোবাসা?” নীলের গম্ভীর গলার প্রশ্নে চকিত ভঙ্গিতে তাকালো ত্রয়ী। দ্রিমদ্রিম আওয়াজ করতে লাগলো হৃদযন্ত্রটা।
লোকটা তো ভারি সাংঘাতিক!
উত্তরের জন্য স্থবির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো নীল। মুখোভাব যথেষ্ট সিরিয়াস।
ত্রয়ী কিছুসময় হাঁসফাঁস করলো। তারপর গলার কাছটায় কাঁপা হাতে ছুঁয়ে বলল, “পানি…পানি খাবো আমি।”
বলেই সে পাশ কাটিয়ে রুম থেকে বের হলো।
রাতের খাবারের শেষে তিয়াসাকে বিনাবাক্যে রেখার সাথে গেস্টরুমে ঢুকতে দেখে বেশ অবাক হলো প্রয়াস।
তবুও কৌতূহল দমিয়ে চুপচাপ নিজের রুমে এলো সে। ভাবলো হয়তো তিয়াসাও চলে আসবে খানিক বাদে। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেও যখন তিয়াসা এলো না তখন বেশ আশ্চর্য হয়ে গেল সে।
খানিক বাদে বুঝলো তিয়াসা আসলে রেখার সাথেই ঘুমোতে গেছে।
ব্যাপারটায় বেশ অবাক হলো প্রয়াস।
যদিও সে এমনটাই চেয়েছে এতোদিন কিন্তু আজ কেন জানি বিষয়টা মানতে পারলো না সে। বেশ অস্থির আর বিরক্তবোধ করতে লাগলো।
তিয়াসা কী তাহলে ওর থেকে দূরে চলে যেতে চাইছে?
অজানা, অযাচিত আশঙ্কায় মনটা কেমন খচখচ করতে লাগলো ওর।
বিছানায় এপাশ-ওপাশ করে ছটফটিয়ে গেল সে।
মেয়েটা সাথে থেকেও ঘুম নষ্ট করেছে, এখন দূরে গিয়েও ঘুম কেড়ে নিয়েছে।
.
“ঘুমান না কেন আপনে? শুইয়া পড়েন।” তিয়াসাকে বিছানায় থম মেরে বসে থাকতে দেখে বলল রেখা।
তিয়াসা শুলো না। তার এখানে ভালো লাগছে না।
রেখা বুঝলো। তাই গনগনে কটাক্ষ করলো, “আপনেরে সকাল থেইক্কা কী বুঝাইলাম আমি? মাইয়া মানুষ হইয়া একটা পুরুষ মানুষের সাথে রাতে থাহন ঠিক না। ভাগ্য ভালা এতদিন কিছুই হয়নাই। সর্বনাশ একখান হইয়া গেলে কী হইতো! তহন তো কেউই বিয়া করতো না আপনেরে। মাইনষেও খারাপ কইতো। ছি ছি করতো। হে-ও আপনের দিকে ফিইরা তাকাইবো না। পুরুষ মানুষ এমনই হয়।”
তিয়াসা ম্লান চোখে তাকালো রেখার দিকে। আজ সকালে ওদের একসাথে থাকার বিষয়টা জানতে পারার পর থেকেই উনি শুধু এসবই বলে যাচ্ছেন। কী ধরনের সর্বনাশের কথা চলছে তা সে বুঝতে পারছে না। কিন্তু সবাই যা ইচ্ছা ভাবলেও, প্রয়াস তাকে খারাপ মেয়ে ভাবুক এটা সে চায় না। আবার নাকি ফিরেও তাকাবে না।
রেখা আরো কিছুক্ষণ বকবক করে তিয়াসাকে শোয়াতে পারলো। যদিও তার ঘুম আসলো না।
এ কদিনের অভ্যেস বলে কথা। ছুটতে তো সময় লাগবেই।
(চলবে…)