কিছু জোড়া শালিকের গল্প পর্ব ২২
: #টানাপোড়েন
লেখিকা : #Lucky_Nova(কপি নিষেধ)
“এতোই যখন লজ্জা তাহলে এসব পরো কেন? নাকি পোশাকের অভাব তোমার?”
এমন উক্তিতে চোখ ছানাবড়া করে তাকালো ক্যান্ডেল। শিরশির করে উঠলো পুরো শরীর।
ইভান দরজার দিকে একপলক তাকালো। তারপর ভ্রু উঁচিয়ে কটাক্ষ করলো, “তুমি তোমার সিনিয়র এক্সিকিউটিভের মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিচ্ছ?”
ইভানের কথায় দাঁত কিটকিট করে নিজেকে সামলালো ক্যান্ডেল। এদিক সেদিক দৃষ্টি ঘুরাতে ঘুরাতে যথেষ্ট কড়া কণ্ঠে বলতে চেষ্টা করলো, “এখানে কেন এসেছ?”
ইভান ওর মুখের দিক থেকে দৃষ্টি নিম্নপানে নিতেই হকচকিয়ে গেল ক্যান্ডেল। দরজা ছেড়ে ড্রেসটা টেনেটুনে পিছিয়ে গেল খানিক।
ইভান ওর উদর বরাবর একপলক চেয়ে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, “তুমি নাকি প্রেগন্যান্ট? তাও নাকি আমার বাচ্চার মা হতে চলেছ? এজন্যই নাকি তুমি আমাকে বিয়ে করতেও রাজি হয়ে গেছ?”
একনাগাড়ে করা এমন হায়াহীন প্রশ্নগুলোতে হিম হয়ে যেন শরীর। ঝিম ধরে গেল মস্তিষ্কে।
একটার পর একটা ফালতু কথা বলেই যাচ্ছে লোকটা। বিন্দুমাত্র লাগাম নেই।
“এসব বলা হয়েছে আমাকে। আর এসব নিয়েই আলোচনা করতে আমাকে এখানে আসতে বলা হয়েছে।”
কপাল কুচকে তাকালো ক্যান্ডেল। হয়তো কিছুটা আন্দাজও করতে পারলো। ওর মা বিগত কয়েকদিন ধরে উলটা পালটা কথা বলে যাচ্ছিলো। ব্যাপারটা গায়ে লাগায় নি ক্যান্ডেল। সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছিল যে এসব ভুল ধারণা। তবুও বিষয়টা বিয়ে অব্দি গড়ালো কী করে! আর সে-ই বা রাজি হলো কখন!
ইভান আশেপাশে নজর বুলালো। কিন্তু কাউকেই দৃষ্টিসীমার মধ্যে দেখতে না পেয়ে অবাক হলো। তাকে ছয়টায় উপস্থিত থাকতে বলে বাকিরা কোথায় গেছে!
সে বিষয়ে প্রশ্ন করার পূর্বেই সেখানে উপস্থিত হলেন ক্যান্ডেলের মা। এতক্ষণ বাইরে ছিলেন তিনি। দরজা খোলা পেয়ে ভেতরে ঢুকতেই ইভানকে দেখে খানিক অবাক হলেন। বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করলেন, “তুমি!”
ত্রয়ী অনেকক্ষণ ধরেই বেশ মাথা খাটিয়ে ভাবার চেষ্টা করেছে নীলের রাগের কারণটা। কিন্তু তেমন কিছুই মনে পড়ছে না।
লোকটা রাগী স্বরে শুধুমাত্র ‘কী বলেছিলাম আমি তোমাকে’ বলেই খালাস। বাকিটা কীভাবে বুঝবে ও!
কপালে চিন্তার গাঢ় ভাঁজ পড়লো ত্রয়ীর। বিচলিত হয়ে এদিক ওদিক নজর ঘুরিয়ে চিন্তা করতেই হঠাৎ ফোনের কথাটা মাথায় এলো। সকালের পর থেকে এখন অব্দি সেটা ব্যাগের মধ্যেই পরে আছে।
হুড়মুড়িয়ে ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করলো ত্রয়ী। স্ক্রিনে এতোগুলো মিসডকল দেখে মাথায় বাজ পড়লো তার। লোকটা রাতে ছাড়াও যে কল দিতে পারে সে তার ছোট্ট মস্তিষ্কের আশেপাশেও আনে নি। কারণ দিনে তো সে অফিসে ব্যস্ত থাকে তাইনা!
এসব এখন ভাবার বিষয় না। আপাতত লোকটার ভুল ভাঙানোটা দরকার। ভাগ্যিস ফোনের বিষয়টা মাথায় এসেছিল।
তাড়াহুড়ো করে ওড়না জড়িয়ে নিয়ে রুম থেকে বের হলো ত্রয়ী। দ্রুতপদে সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতেই দেখলো নীল ওর বাবা মায়ের সাথে কথা শেষ করে মাত্রই উঠে দাঁড়িয়েছে। কথা-বার্তা শুনে বোঝা যাচ্ছে যে এখন চলে যাবে সে।
মুখটা ফ্যাকাসে হলো ত্রয়ীর। মায়ের পাশে এসে দাঁড়াতেই একবার চোখাচোখি হলো দুজনের।
তবে পর মুহূর্তে ত্রয়ীর হাতের ফোনটার দিকে চোখ পড়তেই, কপাল কুচকে গেল তার।
ত্রয়ী বুঝলো। তাই প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ফোনটা সরিয়ে পিছনে নিলো। অপরাধ না করেও অপরাধীর মতো হয়ে গেল মুখখানা।
আশপাশের কেউ তাদের এই ক্ষুদ্র, গোলমেলে ঝামেলা আন্দাজ করতে পারলো না।
“আমি আসছি তাহলে।”
“যেতে চাইলে তো আর আটকে রাখতে পারবো না।” মৃদু হেসে বললেন ত্রয়ীর বাবা।
সাবিহাও হাল ছাড়লেন। রাতে খেয়ে যেতে বলেছিলেন কয়েকবার। ছেলেটা শুনলে তো!
নীল আর কথা বাড়ালো না। শুধু যাবার আগে আরেকবার তাকালো ত্রয়ীর দিকে।
কী পরিমাণ অভিযোগ সেই রাশভারি দৃষ্টিতে তা শুধু ত্রয়ীই পরিমাপ করতে পারলো।
বারান্দায় চেয়ারে বসে হাঁটুর উপরে ভাঁজ করে রাখা হাত দুটোতে নিজের চুল খামচে ধরে আছে প্রয়াস। নিজের উপর প্রচন্ডভাবে বিরক্ত সে। এমন একটা ভুল কী করে করলো সে! অঞ্জলি নির্ঘাত চরিত্রহীন ভাবছে তাকে।
কিছুক্ষণ আগে ভদ্রমহিলা তিয়াসাকে নিয়ে চলে যাওয়ার বিষয়টা জানাতেই সরাসরি না করে দিয়েছিল প্রয়াস। থেকে যেতে বলেছিল এখানেই। তিনি যদিও সেটা সিরিয়াসভাবে নেন নি। ভেবেছিলেন ভদ্রতার খাতিরে প্রয়াস থেকে যেতে বলছে হয়তো। তাই এভাবে থাকাটা বেমানান বলে বিষয়টা এড়িয়ে যেতে চাইছিলেন। তখনই প্রয়াস আচমকা তিয়াসাকে বিয়ে করার কথা বলে ফেলেছিল।
ভদ্রমহিলা ওর হুট করে দেওয়া এমন প্রস্তাবে বেশ অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। তবে তার চেয়েও বেশি অবাক হয়েছিল প্রয়াস নিজে। সে নিজের অজান্তেই যে এমন প্রস্তাব দিয়ে বসেছে সেটা টের পেতেই চমকে গিয়েছিল।
অঞ্জলি দেবীকে বিস্মিত হয়ে বড়ো বড়ো চোখ করে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গিয়েছিল ও। পুরোই বেকুব বনে গিয়েছিল কিছু সময়। তবে ভাগ্যক্রমে একটা ফোন এসেছিল তখন। জরুরি না হলেও অস্বস্তিদায়ক পরিস্থিতি এড়াতে বিনাবাক্যে কল রিসিভ করে সেখান থেকে উঠে গিয়েছিল।
আর সেই থেকেই নিজ ঘরে দরজা দিয়ে বারান্দায় বসে আছে। বিভিন্ন রকমের চিন্তায় ঘরময় পায়চারীও করে ফেলেছে কয়েক দফা।
উনি বিষয়টা স্বাভাবিকভাবে অবশ্যই নেবেন না। একটা অবুঝ, বাচ্চা মেয়েকে এভাবে বিয়ে করতে চাওয়াটা ঘুণাক্ষরেও উচিত হয়নি তার।
উনি অবশ্যই ভুল বুঝবেন।
কিন্তু গভীরভাবে ভেবে দেখলে, এছাড়া আর উপায়ও নেই। বিয়ে ব্যাতিত সে তিয়াসাকে আর কীভাবে রাখার প্রস্তাব দিতে পারে! নিশ্চয় একটা কুমারী মেয়েকে উনি অবিবাহিত একটা পুরুষের হাতে দেবেন না! সেটাও তো দৃষ্টিকটু।
প্রয়াস উঠে দাঁড়ালো। এখানে এভাবে বসে থেকে কিছুই সম্ভব নয়। ওনার সাথে কথা বলতে হবে।
এতোসময়ে উনি তিয়াসাকে নিয়ে চলে গেছেন কিনা সেটাই বা কে জানে!
চিন্তা হতেই চমকে গেল প্রয়াস। দ্রুত এগিয়ে দরজা খুলতে না খুলতে একদম সামনেই পেল তিয়াসাকে। দরজা বন্ধ দেখে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে ছিল সে। প্রয়াসকে দরজা খুলতে দেখে হাসলো কোমলভাবে।
ওকে দেখে হাঁফ ছাড়লো প্রয়াস।
একহাত ধরে কাছে টেনে চোখে চোখ রাখলো। তিয়াসা সজাগ চাহনিতে তাকাতেই ভণিতা ছাড়াই সরাসরি প্রশ্ন করলো, “বিয়ে করবা আমাকে?”
চোখ পিটপিট করলো তিয়াসা। শব্দগুলো মস্তিষ্কে সাজাতে না সাজাতেই প্রয়াস ওর গাল গলিয়ে চুলের ভাঁজে এক হাত রাখলো। আবেমিশ্রিত কণ্ঠে ফের বলল, “করবা বিয়ে?”
‘বিয়ে’। এই শব্দটার মানে তিয়াসা জানে। বিয়ে মানে ‘একটা ছেলে আর একটা মেয়ে সারাজীবন একসাথে থাকবে’। এমনটা রেখাই সেদিন বলেছিল। কিন্তু বিয়ে করে কীভাবে সেটা তো বলে নি। এখন?
চিন্তায় পরে গেল তিয়াসা।
তিয়াসাকে নিরুত্তর থাকতে দেখে ভেতরে ভেতরে শঙ্কায় পড়লো প্রয়াস। হৃদস্পন্দন থমকে গেল যেন।
শুকনো গলাটা ঢোক গিলে ভিজিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে অপ্রকৃতস্থ কণ্ঠে বলল, “করবা না?”
তিয়াসা আর কিছু ভাবলো না। কী মনে করেই যেন মৃদু হেসে উপর নিচ মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ করে দিলো।
সে বিয়ে করবে।
প্রশান্তির হাসি ফুটলো প্রয়াসের মুখে। সে বলল, “সারাজীবন কিন্তু আমার কাছেই থাকতে হবে তাহলে। রাজি আছ?”
তিয়াসার খুশির বাঁধ ভাঙলো। একগাল মুক্ত ঝরানো হাসি দিয়ে সম্পূর্ণ সায় জানালো।
এমনটা তো সে প্রথম থেকেই চায়।
প্রয়াস খুশিতে হেসে জড়িয়ে ধরলো ওকে।
কাচের জালানায় ঠকঠক আওয়াজে ভ্রু কুচকে ফেলল নীল। সীটে মাথা হেলিয়ে চোখ বন্ধ করে ছিল সে।
জালানায় হওয়া শব্দে চোখ খুললো। ঘাড় ঘুরাতেই ত্রয়ীদের বাসার দারোয়ানকে চোখে পড়লো তার। জালানার কাচের কাছে ঝুঁকে আছে সে।
অবাক হলো নীল। গাড়ির কাচ নামাতেই সে হাস্যোজ্জ্বল নম্রমুখে বলল, “স্যার, গাড়ির ভেতর বইসা আছেন যে! ভেতরে গিয়া বসেন। সবাই তো বাসাতেই আছে।”
লোকটা ভালো মনেই বলেছে কথাটা। তার কথায় বিরক্ত বোধ হবার মতো কিছুই ছিল না। তবুও বিরক্ত হলো নীল।
এটা স্বাভাবিক। কারণ মন ভালো না থাকলে সবই তিক্ত ও বিরক্তই লাগে। আর এজন্যই এখন তার ভালো কথাও ভালো লাগছে না।
তবে সে সেটা প্রকাশ করলো না। একজনের উপরকার অভিমানের রাগ অপরকে কেন দেখাতে যাবে সে!
তাই নম্র স্বরেই উত্তর করলো।
“গিয়েছিলাম। এখন ফিরবো আবার।”
“ও।” ছোট করে বলল লোকটা।
কথোপকথন এখানেই শেষ হবে ভেবেছিল নীল। কিন্তু হলো না। তার কপালের কাছের ছোটো ব্যান্ডেজটার দিকে চোখ পড়লো লোকটার। খানিকটা বিস্ময় নিয়ে বড়ো বড়ো চোখে চেয়ে জিজ্ঞেস করলো, “কপালে কী হইছে?”
প্রশ্নটা শুনে মুখটা আচমকাই গুরুতর থমথমে হয়ে গেল নীলের। কাঠ গলায় প্রত্যুত্তর করলো, “তেমন কিছু না।”
সে ভেবে পায় না, এই যে তার কপালে সাদা একটা ব্যান্ডেজ, এটা ত্রয়ীর মা দেখেছে, বাবাও দেখেছে, এমনকি এই দারোয়ানও দেখেছে।
শুধু ত্রয়ীই কী দেখে নি!
বাকিরা তো দেখার সাথে সাথেই প্রশ্ন করেছে।
কই সে তো করে নি!
মুহূর্তেই বিষাদময় কুয়াশায় ছেয়ে গেল পুর মুখটা।ভেতরটায় কেমন অসহ্য দহন শুরু হলো।
মেয়েটা এতো কেন জ্বালাচ্ছে ওকে? ইচ্ছে তো করছে আজ, এই মুহূর্তেই তুলে নিয়ে যেতে। তারপর দেখবে কীভাবে ইগনোর করে!
দারোয়ান আরো কিছু বলতে চাচ্ছিলো। কিন্তু এখন কথা বলতে ভালো লাগছে না নীলের। তাই তার কথার মাঝপথেই ফুলস্টপ বসিয়ে দিয়ে বলল, “আমি যাব এখন। দেরি হচ্ছে।”
লোকটাও আর কথা বাড়ালো না। হাসিমুখে বিদায় জানিয়ে প্রস্থান করলো স্বস্থানে।
একরাশ অসহনীয় অনুভূতি নিয়ে গাড়ির কাচ তুলে দিলো নীল। স্টিয়ারিং হুইলে দু’হাত রেখে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো একটা।
মনটাকে স্থির করতে চোখ বুজলো। তবে কয়েক সেকেন্ড না পেরুতেই ফের ঠকঠক আওয়াজ কানে এলো তার।
চোয়াল শক্ত হয়ে এলো সঙ্গে সঙ্গেই। কপালটাও কুচকে গেল বাজেভাবে।
লোকটা এতো বিরক্ত কেন করছে!
মুখ দিয়ে বিরক্তসূচক শব্দ করলো নীল। চোখ খুলে বেশ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে জালানার দিকে তাকাতেই থমকালো।
যতটা বিরক্তি নিয়ে মুখটা তুলেছিল তারচেয়ে কয়েকগুন বেশি বিস্ময়ে মুখটা ছেয়ে গেল নিমিষেই।
ভুল দেখে না থাকলে, এই মূহুর্তে ত্রয়ীই দাঁড়িয়ে আছে তার গাড়ির দরজার সামনে।
বিশ্বাসই হচ্ছে না ওর। অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে চেয়ে থাকতে থাকতে ও ভুলেই গেল গাড়ির কাচ নামানোর কথা।
ত্রয়ী শঙ্কিত হলো। লোকটা কী রাগ করেই খুলছে না!
ফাঁকা ঢোক গিললো ও। তবুও আলতো করে আরেকবার নক করলো।
এবার যেন সম্বিৎ ফিরলো নীলের।
গাড়ির দরজা খুলে বেরিয়ে আসতেই এক’পা পিছিয়ে দাঁড়ালো ত্রয়ী।
পুনরায় গম্ভীর হয়ে যাওয়া নীলের মুখটার দিকে অপরাধী চোখে চেয়ে মিনমিন করলো, “আমি দেখিনি।”
ভ্রুদ্বয়ের মাঝে ভাঁজ পড়লো নীলের।
“কী দেখো নি?”
“মি-স কল। সকাল থেকে সাইলেন্ট ছিল আমার ফোন। আপনি যে সকালেও ফোন দিবেন বুঝিনি আমি। রাতে ঠিকই ফোন হাতে ঘুমিয়েছিলাম আমি। বিশ্বাস করুন। শুধু সকাল থেকেই…।” এটুকু বলে থামলো ত্রয়ী। অপরাধমূলক উৎসুক দৃষ্টি মেলে তাকালো নীলের দিকে। লোকটা মিথ্যা ভুল বুঝুক সেটা ও চায় না।
তখন লজ্জায় সবার সামনে এবিষয়ে বলতে পারে নি কিছু। তাই নীল বেরুনোর পরে সবাই একটু ব্যস্ত হতেই বেরিয়ে এসেছে ও।
যদিও তাকে এখনো অব্দি গেটের সামনে পাওয়ার কথা ছিল না। তবুও এক অজানা কারণেই কেন যেন সে বেরিয়ে এসেছে। মনে হয়েছে, সে থাকবে হয়তো।
হয়েছেও তাই।
নীলকে নিশ্চুপ হয়ে থাকতে দেখে ত্রাসিত ভঙ্গিতে তাকালো ত্রয়ী। দ্বিধান্বিত হয়ে বলল, “আপনি বিশ্বাস করেন নি?”
“না।”
নীলের থমথমে কণ্ঠের জবাবে মুখটা চুপসে গেল ত্রয়ীর। বোকার মতো চেয়ে রইলো সে।
বুকের ভেতরের অভিমানের বরফ গলতে শুরু করলেও শুধুমাত্র ত্রয়ীকে জব্দ করতে নীল বলল, “তোমার সত্যতার প্রমাণ কী? তুমি তো মিথ্যাও বলতে পার আমাকে।”
নীলের আঁটসাঁট স্বরের এমন কথায় থমকে গেল ত্রয়ী। অসহায়ত্ব ফুটে উঠলো চেহারাতে।
কী প্রমাণ দেখাবে সে? মুখের কথা ছাড়া আর কোনো প্রমাণই যে নেই তার কাছে!
তাই মলিন চোখের দৃষ্টিতে চেয়ে স্তিমিত স্বরে আরেকবার আওড়ালো, “সত্যিই দেখি নি আমি।”
ত্রয়ীর মুখটা দেখে অধরকোণে হাসি ফুটলো নীলের। এক কদম এগিয়ে এসে বুকের কাছটায় হাত গুজলো। থমথমে একটা ভান ধরে বলল, “রাতে আমি ফোন দিই নি, কিন্তু তুমি তো দিতে পারতা! তাই না?”
ত্রয়ী বেজার জব্দ হলো। চুপসানো মুখটা ছোট হয়ে গেল যেন। চোখ তুলতে অব্দি সাহস হলো না।
তার দ্বারা আবার ভুল হয়েছে। লোকটাকে ফের কষ্ট দিয়ে ফেলেছে।
কিন্তু এমনটা তো সে চায় নি। সে তো চেষ্টা করছে সম্পর্কটার সবকিছু ঠিকভাবে করার। তবুও কেন হচ্ছে না! নাকি সে-ই চেষ্টায় কমতি রেখেছে!
ভাবতেই নিজের প্রতি ক্ষোভে ওড়নার প্রান্তভাগটা হাতের মুঠোয় মুচড়ে ধরলো ত্রয়ী। দৃশ্যমান ভাঁজ ফুটিয়ে কুচকে এলো কপাল।
এসবের কিছুই নীলের চোখ এড়ালো না।
সে আর জ্বালালো না। হাত বাড়িয়ে ত্রয়ীর হাতটা ধরে কোমল চাহনিতে চেয়ে বলল, “আমি বিশ্বাস করি তোমাকে।”
পুরোদস্তুর অবাক হয়ে গেল ত্রয়ী। হতভম্ব হয়ে তাকাতেই নীলের অধর জুড়ে ফুটে থাকা হাসি দেখে বুঝলো সবটা।
নীল ততক্ষণে সর্বোচ্চ কাছে এসে আঙুলের ভাঁজে আঙুল ডুবিয়ে মুঠোয় আঁকড়ে ধরেছে ওর হাতটা।
ত্রয়ী চমকালো। একবার অপ্রস্তুত হয়ে গেটের দিকটায় তাকালো।
দারোয়ান দাঁড়িয়ে আছে ওখানটায়। এদিকে ঘুরলেই দেখে ফেলবে ওদের। কিংবা হয়তো দেখে ফেলেই উলটো দিকে ফিরেছে!
ভাবতেই লজ্জা পেল ত্রয়ী। টেনে নিতে চাইলো হাতটা। কিন্তু নীল আরো শক্ত করে ধরলো বলে বেশ ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। প্রায় সাথে সাথেই চাপা স্বরে আওড়ালো, “দেখবে কেউ।”
নীল ভ্রু উঁচালো। ত্রয়ীর এলোমেলো দৃষ্টি অনুসরণ করে গেটের কাছটায় তাকাতেই বুঝলো সেই ‘কেউ’ বলতে কাকে বুঝাচ্ছে ত্রয়ী।
মুচকি হাসলো ও। ঘাড় ঘুরিয়ে নিজের গাড়ির পেছনের দরজার দিকে তাকালো। অতঃপর প্রেয়সীর কোমল হাতজোড়া একহাতে ধরে রেখেই অন্যহাতে গাড়ির দরজাটা খুলে তাকে ভেতরের সীটটায় বসিয়ে দিলো।
অবাক হবার অবকাশ পাবার আগেই নীল নিজেও বসে পড়লো তার পাশ ঘেঁষে।
হকচকিয়ে উঠলো ত্রয়ী। সরে গেল কিছুটা।
নীল সশব্দে দরজা বন্ধ করে দিতেই চোখ ছানাবড়া হলো ওর।
ত্রয়ীর ওমন মুখোভাব দেখে সরু চোখে তাকালো নীল। কাটখোট্টা গলায় বলল, “কিছু করবো না, রিল্যাক্স!”
মোটেও শান্ত হলো না ত্রয়ী। একপ্রকার তোড়পাড় শুরু হলো হৃদ প্রকোষ্ঠে। চোরা চোখের দৃষ্টিতে ভর করলো একরাশ অস্থিরতা। যতবার লোকটার দিকে তাকায়, ভুলে চোখাচোখি হয়, ততোবারই বাড়ে যেন।
নীল নিঃশব্দে হাসে। ত্রয়ীর হাতটা নিজের কোলে টেনে সীটের পিছনে মাথা হেলিয়ে দিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে চেয়ে দেখতে থাকে ত্রয়ীকে।
সেই মদকতা মাখা চাহনিতে বুকে কম্পন তোলে ত্রয়ীর। তবুও শান্ত, স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে নিজেকে।
পিনপিনে নীরবতার কেটে যায় কিছুটা সময়। অবশেষে ত্রয়ী বারকয়েক জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে লঘুস্বরে জিজ্ঞেস করে, “কপালে কী হয়েছে আপনার?”
চার শব্দের সমান্য একটা বাক্য। তবুও এক অদ্ভুত প্রশান্তি অনুভূত হলো নীলের। অধর প্রসারিত হলো নৈশব্দ হাসিতে।
ত্রয়ী আড়চোখে তাকাতেই সে বলল, “Are you concerned?”
পালটা প্রশ্নটাতে বেশ ভড়কে গেল ত্রয়ী।
নীল ভ্রু উঁচিয়ে নামালো। ফিচেল চাহনিতে তাকাতেই উশখুশ করে উঠলো ত্রয়ী। তাড়াহুড়ো বুঝিয়ে বলল, “আমি এখন যাই। কেউ জানে না আমি এসেছি। খুঁজবে আমাকে।”
ত্রয়ী হাত টেনে নিতে চাইতেই রাশভারী কণ্ঠ কানে এলো।
“যেতেই হবে?”
থতমত খেলো ত্রয়ী। দুরুদুরু বুকে চোখ পিটপিটিয়ে তাকাতেই চোখে পড়লো একজোড়া গম্ভীর চোখ। সেই নিবিড় চাহনিতে চোখাচোখি হতেই চোখ নামালো ত্রয়ী। তাড়াহুড়ো ভুলে বসলো স্থির হয়ে। ও জানে, লোকটা নিজে থেকে না ছাড়লে সারারাতেও যেতে পারবে না ও।
আরো কিছুক্ষণ মন ভরে ত্রয়ীকে দেখলো নীল। তারপর মাথা তুলে বসলো সোজা হয়ে।
জড়িয়ে ধরার জন্য কাছে আসতে চাইতেই চমকে উঠলো ত্রয়ী। বা হাতটা বুকে ঠেস দিয়ে দ্বিধান্বিত হয়ে বলল, “আমি গোসল করিনি। রান্না…রান্না করেছি একটু আগে। ঘেমে আছি আমি।”
“সমস্যা নেই।” নীলের ভাবলেশহীন উত্তরে আঁতকে উঠলো ত্রয়ী। লোকটা কী পাগোল নাকি!
সে মাথা পিছিয়ে নিয়ে বলে উঠলো, “আমার… আমার সমস্যা আছে।”
নীলের চোখেমুখে অসন্তোষ প্রকাশ পেলেও সেটা এড়িয়ে গেল ত্রয়ী। ফের তাড়াহুড়ো কণ্ঠে বলল, “আপনার দেরি হচ্ছে। দেখি ছাড়ুন।”
“আমার কোনো দেরি হচ্ছে না। একদম ফ্রি আমি।” লোকটার একরোখা ভাবে হতবুদ্ধি হয়ে গেল ত্রয়ী। নেহাতই ছেলেমানুষী করছে সে।
নীল ফের কাছে আসতে চাইতেই রসগোল্লার মতো চোখ করে ঠেস দেওয়া হাতটা দৃঢ় করে বাধা দিলো। অপ্রস্তুত কণ্ঠে বলল, “আমি যাব, ছাড়েন। সবাই খু্ঁজছে। ছাড়েন না!”
ছটফটিয়ে উঠলো ত্রয়ী। কারণ ও জানে, এখানে আর এক মুহূর্ত থাকলে লোকটা নির্ঘাত জড়িয়ে ধরবে তাকে। ঘৃণাবোধ বলে কিছুই নেই লোকটার।
নীল হাত ছাড়লো না। রাশভারি মুখে বলল, “তোমাকে জড়িয়ে না ধরলে রাতে ঘুম হবে না আমার। একটু ধরি।”
হা হয়ে বোকার মতো তাকালো ত্রয়ী। এ কেমন কথা!
নীল ফের কাছে এলো। ত্রয়ী কিছু বুঝে ওঠার আগেই জড়িয়ে ধরলো সে। মুখটা গলায় ঢুবাতেই দ্বিধাপূর্ণ অস্বস্তিতে চোখ খিচলো ত্রয়ী।
চার, পাঁচ সেকেন্ডের মাথায় ঠেলেঠুলে সরিয়ে দিলো নীলকে।
নীলের আরেকটুক্ষণ কাছে পাওয়ার জন্য আকুল হওয়া গম্ভীর, ক্ষয়িষ্ণু দৃষ্টি উপেক্ষা করে মন্থর স্বরে বলল, “আমি যাই, ছাড়েন।”
নীল হাতটা ছাড়লো না বলে অবাক হলো ত্রয়ী। ভ্রুতে মৃদু কুঞ্চন উঠলো। থেমে থেমে উচ্চারণ করলো, “ছা-ড়েন। যাই আমি।”
বলতে বলতে চোখ তুলে জিজ্ঞাসুক দৃষ্টিতে তাকাতেই নীল ভারি স্বরে বলে উঠলো, “আরেকটু থাকো। আমি একটু আদর করি তোমাকে।”
পীলে চমকে উঠলো ত্রয়ীর। চোখ বের হয়ে আসার উপক্রম হলো কোটর ছেড়ে।
সবাই আসা অব্দি অপেক্ষা করতে হলো ইভানকে। সে যে নীলের কথাতে রাজি হয়ে এখানে দেখা করতে আসবে সেটা বুঝতে পারেন নি ইশারা।
এজন্যই ক্যান্ডেলের পরিবারকেও এখানে পরিবারসহ আসার বিষয় কিছু জানান নি তিনি।
ক্যান্ডেলের মা ফোন করে ইভানের আসার কথাটা জানাতেই আবীর চ্যাটার্জী আর জয়িতাকে নিয়ে চলে এসেছেন তিনি। ইমন অফিসের কাজে থাকায় আসতে পারেনি।
(চলবে…)
(চলবে…)