কিছু জোড়া শালিকের গল্প পর্ব ২৪ : #ফার্স্টলাভ
লেখিকা : #Lucky_Nova(কপি নিষেধ)
হাসিটা প্রশস্ত হতেই অনুরণিত হলো ত্রয়ীর চোখের পাতা। ঝট করে হাত ছেড়ে দিয়ে সরে দাঁড়ালো ও।
আশ্চর্যন্বিত হয়ে চোখ মেললো।
লোকটা নাটক করছিল! ভারি সাংঘাতিক তো! বিন্দুমাত্র আঁচও করতে পারেনি ও।
উপরন্তু লোকটার অভিনয়ের খপ্পরে পড়ে সে নির্লজ্জের মতো কতো কী বলে ফেলেছে!
নীলের চাহনি এড়াতে চোখ পিটপিটিয়ে অন্যত্র চাইলো ত্রয়ী। দৃষ্টি অস্থির। সারা শরীর চাপা অস্বস্তিতে শিরশির করছে যেন। রক্তিম বর্ণে টসটস করছে দুইগাল। হাত দিয়ে খুব ব্যস্তভাবে ওড়নার প্রান্তভাগ মোড়ামুড়ি করছে ও।
ত্রয়ীর আকুপাকু ভাব বুঝতে দেরি হলো না নীলের। পালানোর অগ্রীম সংকেত এসব। তাই ত্রয়ী পা বাড়ানোর আগেই নীল পথ আটকে দাঁড়িয়ে গেল। ওকে বিন্দুমাত্র অবাক হবার সুযোগ না দিয়ে কোমড় ধরে রেলিঙে বসিয়ে দিলো। চমকে গেল ও। আতঙ্কিত চোখদুটো বিশাল বড়ো করে খামচে ধরলো নীলের কাধের কাছের শার্ট। ভয়ে সিঁটিয়ে গিয়ে অশান্ত হয়ে উঠলো খুব।
“ভয় নেই, পড়বা না।”
নীলের আশ্বাসেও ভয় কমলো না ত্রয়ীর। এমন নয় যে লোকটা ওকে ফেলে দেবে, কিন্তু এভাবে রেলিঙে বসে নি ও কখনো। তার উপর যা চিকন একটা রেলিঙ! ভয় তো করবেই। তাই তটস্থ হয়ে চটপট বলল, “নামিয়ে দিন প্লিজ।”
কথাটার মাঝে বিচলিতভাবে কয়েকবার রেলিঙের বাহিরেও তাকানো হয়ে গেল তার।
নীল দৃষ্টি সংকুচিত করলো। ধরে থাকার পরেও এত ভয় পায় কী করে মেয়েটা?
ত্রয়ীর হাঁসফাঁস বাড়তে দেখে কোমরের দুপাশে রাখা হাতে ওকে ভালোভাবে জড়িয়ে নিয়ে ঘনিষ্ঠ হয়ে এলো।
ত্রয়ী থমকালো। আচমকা নীলকে নিজের এতটা কাছে আবিষ্কার করে ভয় ভয় ভাবটা উবে গেল পলকেই। অন্যরকম অনুভূতিতে মিশে মিইয়ে গেল লজ্জায়।
নীল মুগ্ধ চোখে চেয়ে একহাত উঠিয়ে ওর গালের পাশের চুলগুলো কানের পিছনে গুজে দিতেই শিয়র নত করে চোখ বন্ধ করলো ও।
হাতটা গালের উপরে রেখেই সে প্রশ্ন করলো, “তোমার মনে হয় আমি ছেড়ে দেওয়ার জন্য বিয়ে করেছি তোমাকে?”
বাধ্যের মতো দ্রুত নাসূচক মাথা নাড়লো ত্রয়ী। চেয়ে রইলো নিজের কোলের দিকে।
নীলের অধরকোণে স্মিত হাসির রেশ দেখা গেল। গভীর চোখের চাহনিতে বলল, “তাহলে কেন করেছি?”
এমন প্রশ্নে বেশ অপ্রস্তুত হলো ত্রয়ী। গলার স্বর জড়িয়ে এলো।
“জানিনা। প্লিজ, নামিয়ে…নামিয়ে দিন আমাকে।”
“ধরে আছি তারপরও ভয় পাও?”
তার নমনীয় স্বরের প্রশ্নে শান্ত হয়ে গেল ত্রয়ী। ভেতর ভেতর ঝড় চললেও বাহিরে প্রকাশ করলো না। চুপচাপ নিম্নপানে দৃষ্টি মেলে বসে রইলো ও।
“তুমি তোমার অনুভূতিগুলো আমার থেকে লুকাও কেন? আর বলো না কেন সরাসরি কখনো?” প্রশ্নসূচক নির্মল কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো নীল।
ত্রয়ী চোখ পিটপিটালো। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে কিছু একটা আমতাআমতা করে চুপ করে গেল পুনরায়।
নীল মুচকি হাসলো। ভারিক্কি গলায় পুনরাবৃত্তি করে বলল, “বিয়ে নিয়ে তারমানে কোনো সমস্যা নেই তোমার! আর তুমি বিয়েটাকে আর আমাকেও মেনে নিয়েছ! তাই তো?”
ওর প্রশ্নে হঠাৎই খুব লজ্জা পেয়ে গেল ত্রয়ী। কেমন লাল হয়ে এলো গালটা। এক কথা বারবার জিজ্ঞেস কেন করছে লোকটা!
ব্রীড়াময় দৃষ্টি এদিক ওদিক বুলিয়ে কাধে ঠেস দিয়ে ঢিমে স্বরে বলল, “সরুন, নামান আমাকে।”
ত্রয়ীর লাজুকতা দেখে নিঃশব্দে হেসে ফেললো। কোমর জড়িয়ে পুনরায় নামিয়ে আনলো ওকে।
চাপা স্বস্তিতে নিঃশ্বাস ফেললো ত্রয়ী। সরে আসতে চাইতেই হাতের বাধন দৃঢ করলো নীল।
ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল ও। অবাক হয়ে তাকাতে না তাকাতেই ওকে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে চুমু খেলো ওর চুলের ভাঁজে।
ত্রয়ী বারকয়েক চোখের পলক ঝাপটালো। মিষ্টি প্রণয়ের ছোঁয়ায় বুকের মধ্যে তোড়পাড় শুরু হলো যেন।
নীল হাতের বাধন আলগা করতেই হালকা পিছিয়ে এলো ও। ওড়না ঠিকঠাক করে নিয়ে গুছিয়ে রাখা চুলগুলো অযথাই আবার কানের পিছনে গুজলো।
তবে আচমকাই পায়ের কাছে কিছু একটার অস্তিত্ব অনুভূত হতেই চমকে উঠলো ও। লাফিয়ে উঠে খানিক সরে পায়ের কাছে তাকাতেই অবাক হলো।
কুকুর! ধবধবে সাদা আর কালোর মিশেলে, মোটামুটি বড়ো সাইজের একটা কুকুর। জিভ বের করে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওর দিকে।
ত্রয়ী বেশ বিস্ময় নিয়ে কিছুক্ষণ সেটার দিকে চেয়ে রইলো। অতঃপর প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকালো নীলের দিকে। অবাক ভাবটা ধরে রেখেই প্রশ্ন করলো, “এটা আপনার?”
নীল হাসলো। “হু” বলে মাথা নেড়ে সায় জানাতেই চোখেমুখ জৌলুশতায় ছেয়ে গেল ত্রয়ীর।
“অনেক সুন্দর তো।” বলতে বলতে সেটার দিকে ঝুঁকে গেল ত্রয়ী। গায়ে হাত বুলিয়ে দিতেই সাদরে ত্রয়ীর গায়ে এসে ঘেঁষে রইলো সে। ভালোবাসা প্রকাশার্থে বারকয়েক হাত চেটে দিলো।
সুক্ষ্ম এক ভালোলাগার হাসির রেশ ফুটলো ত্রয়ীর ঠোঁট। কয়েক মুহূর্তের জন্য সব ভুলে কুকুরটাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেল ও।
নীল বুকে হাত গুজে, রেলিঙে হেলান দিয়ে নীরবে দেখে যেতে লাগলো। কুকুর ত্রয়ীর কতটা পছন্দ তা সে খুব ভালো করেই জানে।
কুকুরটার গলার নেমপ্লেটের দিকে চোখ পড়তেই ভ্রুকুটি করলো ত্রয়ী। হাত বাড়িয়ে সেটা দুই আঙুলে ধরে লেখাটা পড়লো।
“ফার্স্ট লাভ! এটা ওর নাম?”
এমন নাম প্রথম দেখায় বেশ কৌতূহলী চোখেই তাকালো ত্রয়ী।
“হু। ফার্স্ট লাভ। কারণ ও আমার ফার্স্ট লাভের দেওয়া গিফট। সে আর তার গিফট, দুটোই আমার জন্য খুব মূল্যবান।”
থমকে গেল ত্রয়ী। শেষোক্ত কথাগুলো যেন সুচের মতো বিঁধলো। এতসময় কুকুরটার গায়ে বুলাতে থাকা হাতটাও থেমে গেল আচমকাই।
অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে নীলের দিকে তাকালো ও। কিছুক্ষণ একাধারে চেয়ে থেকে, ঠোঁট নাড়িয়ে এ প্রসঙ্গে কোনো প্রশ্ন করার আগেই তৃণা ছাদের দরজায় নক করলো।
দুজনেই চকিত ভঙ্গিতে তাকালো সেদিকে।
তৃণা ভিতরে আসতে আসতে চোরা গলায় বলল, “সরি, বিরক্ত করলাম!”
তারপর ত্রয়ীকে উদ্দেশ্য করে বলল, “তোকে আসলে নিচে ডাকছে এখনি। একটু যেতে হবে।”
বলতে বলতে নীলের দিকে তাকাতেই সম্মতিসূচক হেসে হেলান দেয়া থেকে সোজা হয়ে দাঁড়ালো সে।
ত্রয়ীও উঠে দাঁড়িয়েছে ততক্ষণে। তৃণা হাতের ইশারা করতেই উষ্কখুষ্ক দৃষ্টিতে একপলক নীলের দিকে তাকিয়ে এগিয়ে গেল ওর দিকে। অনেকগুলো প্রশ্ন মনের কোণে রেখে দিয়েই নেমে গেল তৃণার সাথে।
ত্রয়ী নেমে যেতেই নীল নিঃশব্দে নিঃশ্বাস ফেলে হাঁটু ভেঙে ঝুঁকে বসলো কুকুরটার সামনে। ডানহাতে ওর মাথা নেড়ে দিয়ে আফসোস করার ভঙ্গিতে বলল, “তোকেও চেনেনি বোধহয়।”
কুকুরটা কী বুঝলো কে জানে! শুধু মুখ দিয়ে অস্পষ্ট আওয়াজ করলো একটু।
কোল্ড কফিতে স্ট্র ঘুরাতে ঘুরাতে সুক্ষ্ণ দৃষ্টিতে জয়িতার দিকে একপলক তাকালো ক্যান্ডেল।
একঘণ্টা হচ্ছে রেস্টুরেন্টে বসে আছে দু’জনে।
মাঝেমধ্যে অবশ্য অল্পসল্প কথা হচ্ছে। তবে খুব ভালো পরিচয় নেই বলেই আলাপ জমছে না৷ তারপরও কেন এতক্ষণ বসে আছে সেটাই বুঝতে পারছে না ক্যান্ডেল।
সন্ধ্যার পরপরই জয়িতার কথায় একত্রে বের হয়েছিল। উদ্দেশ্য শপিং, তারপর ডিনার। এর ফাঁকে অবশ্য একেঅপরকে চেনা জানা।
তবে সে যেভাবে ক্ষণে ক্ষণে নিজ ফোন চেক করছে, তাতে মনে হচ্ছে কারো আসার অপেক্ষা করছে।
চোখ ঘুরিয়ে আরেকবার দেয়ালঘড়ির দিকে তাকালো ক্যান্ডেল। কাঁটায় কাঁটায় নয়টা দশ বাজতে দেখে অবশেষে দ্বিধান্বিত স্বরে প্রশ্নটা করেই ফেলল ও।
“কারো অপেক্ষা করছি আমরা?”
ক্যান্ডেলের প্রশ্নে চকিতে ফোন থেকে চোখ তুললো জয়িতা। প্রকৃতস্থভাবে হেসে মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ, সারপ্রাইজ।”
“কে আসবে?” বিস্মিত কণ্ঠে জানতে চাইলো ক্যান্ডেল।
প্রত্যুত্তরে মুচকি হাসলো জয়িতা। কপটে বলল, “আসলেই দেখবা।”
কপালে প্রশ্নসূচক ভাঁজ পড়লো ক্যান্ডেলের। তবে পালটা প্রশ্ন করলো না।
আরো কিছুক্ষণ কেটে যাবার পর ফোনে টুং শব্দ করে মেসেজ এলো জয়িতার। সেটা চেক করেই ঠোঁটের হাসিটা প্রশস্ত হলো তার।
ওয়েটারকে ডেকে দুজনের জন্য ডিনারের অর্ডার দিলো। অতঃপর একগাল হেসে নিজে থেকেই ক্যান্ডেলকে বলল, “অনেক অপেক্ষা করালাম। যাইহোক, এসে গেছে ওরা।”
“কারা?” সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালো ক্যান্ডেল।
জয়িতা রহস্যময়ীভাবে হাসলো। নিজের হাতব্যাগে মোবাইল ফোনটা ঢুকিয়ে নিতে নিতে চোখ ইশারা করলো দরজার দিকে।
ক্যান্ডেল ভ্রুকুঞ্চন করলো। সন্দিহান চোখে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই অনাকাঙ্ক্ষিত কাউকে দেখে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল বেশ।
অবাক হলো ইভান নিজেও। ভ্রুদ্বয় কুচকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নিজের ভাইয়ের দিকে তাকালো ও। যেন বলতে চাইলো, ‘এই তোর দরকারী কাজ!’
ইমন হয়তো বুঝলো। তাই কাধের উপর চাপড় মেরে ফিচেল হাসি দিয়ে বলে উঠলো, “সারপ্রাইজ!”
একটু পর পর নড়েচড়ে বসছে ক্যান্ডেল। কয়েকগ্লাস পর্যন্ত পানি খাওয়ার পরও গলা শুকিয়ে কেমন কাঠ হয়ে আছে মনে হচ্ছে। এসির মধ্যেও শরীর গরমে চিটচিট করছে।
এই সমস্ত কিছুর কারণ অবশ্য সামনের ব্যক্তি৷ যার সাথে একা ফেলে জয়িতা তার স্বামীকে নিয়ে সটকে পড়েছে।
কিন্তু ওদেরকে কে বুঝাবে, এই লোকের সাথে মোটেও ওর কোনোপ্রকার খাতির নেই! না আছে গলায় গলায় ভাব যে একসাথে বসে হাসতে হাসতে ডিনার করবে। হাসতে হাসতে না হোক স্বাভাবিকভাবেও তো করা হবে না। এজন্যই তো আধঘণ্টা যাবত মূর্তির মতো বসে আছে সে। কয়েকবার আড়চোখে তাকানো ছাড়া কোনো কথাও হয়নি।
আর সামনের ব্যক্তির বিষয়ে আর কী বলবে ও! সে তো এসে থেকেই ফোন নিয়ে ব্যস্ত। এমনকি এখনও তো ফোন ঘাটতে ঘাটতে আপন মনে চামচ দিয়ে খাবার মুখে তুলে যাচ্ছে। এমন ভাব যেন তার সামনে কেউই নেই। কেউ না।
এই গা-ছাড়া ভাব দেখেই রাগে, অস্বস্তিতে শরীর জ্বলছে ক্যান্ডেলের। এভাবে বসে থাকার কোনো মানেই খুঁজে পাচ্ছা না ও।
একবার ভাবছে উঠে চলে যাবে। পরক্ষণেই আবার ভাবছে, উঠে চলে গেলে যদি মনে করে ও এতসময় মনোযোগ চাচ্ছিল!
কিন্তু ও তো মোটেও মনোযোগ চাচ্ছিল না, তাইনা?
এক মিনিট! এই লোক যা ইচ্ছা মনে করুক তাতে ওর কী!
মনে মনে উঠে চলে যাওয়াটাই স্থির করলো ক্যান্ডেল।
তাই প্লেটের পাশ থেকে নিজের ফোনটা তুলে নিয়ে হাতব্যাগে ঢুকালো ও। সশব্দে চেইন আটকে ব্যাগটা কাধে ঝুলিয়ে উঠতে যাওয়ার আগ মুহূর্তেই ফোনের দিকে দৃষ্টি রেখে ইভান বলে উঠলো, “খাবার নষ্ট করা পছন্দ করি না আমি।”
ক্যান্ডেল উঠতে গিয়েও থেমে পড়লো। কথাটা কর্ণধার হতেই কপালটা বাজেভাবে কুচকে ঘাড় ফিরিয়ে তাকালো ইভানের দিকে।
সে শান্ত ভঙ্গিতে ফোন নামিয়ে রাখলো। তারপর এতক্ষণের স্থির থাকা দৃষ্টি ফোনের উপর থেকে সরিয়ে সোজাসুজি তাকালো ক্যান্ডেলের দিকে।
হাত বাড়িয়ে ক্যান্ডেলের সামনের প্লেটটা ওর দিকে আরেকটু এগিয়ে দিয়ে নির্বিকার স্বরে বলল, “শেষ করো তারপর বাসায় দিয়ে আসবো।”
অবাক না হয়ে পারলো না ক্যান্ডেল। বিহ্বলিত দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ চেয়ে দাঁত কিটকিট করলো ও।
কাটকাট গলায় জানিয়ে দিলো, “খাবো না আমি।”
“কেন?” কথার পিঠেই প্রশ্ন করলো ইভান।
ক্যান্ডেল বাঁকালো দৃষ্টিতে তাকাতেই বুকের কাছে হাতদুটো গুজে কাটখোট্টা গলায় বলল, “আমি জানি তুমি অন্তত এটা আশা করছ না যে আমি তোমাকে রোমান্টিক গল্প বলতে বলতে খাইয়ে দেবো!”
ব্যস, এই কথাটাই যথেষ্ট ছিলো আগুনে ঘি ঢালার জন্য। লোকটার এসব ত্যাড়া কথা সে কেন শুনবে!
তাই গনগনে গলায় বলে উঠলো, “তোমার খাবার তুমিই খাও। আমি মোটেও…”
কথাটা শেষ করতে পারলো না ক্যান্ডেল। তার আগেই কাটা চামচের আগায় থাকা মিটবলটা তুলে ওর মুখে ঢুকিয়ে দিলো ইভান।
ক্যান্ডেল বড়ো বড়ো চোখ মেলে তাকাতেই নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, “বেশি কথা বলো তুমি।”
বিয়ে নিয়ে তিয়াসা যতটা খুশি, ততোটা খুশি হয়তো কোনো মেয়ে নিজের বিয়েতে হয়নি। বিয়ের হালকা পাতলা শাড়ি, আর মোটামুটি সাজ নিয়ে নিজেকে আয়নায় ঘনঘন ঘুরে ঘুরে দেখছে সে।
একস্থানে স্থির না থেকে সামনে, পিছনে করছে। বারংবার পাদু’টো নড়াচড়া করছে। করবে না-ই বা কেন! না হাঁটলে, না নড়ানড়ি করলে যে তার নূপুর জোড়া ঝুনঝুন শব্দে বাজছে না। তাদের বাজানোর জন্য হলেও সে সারারাত পায়চারি করতে রাজি।
সাথে চুড়ির টুংটাং আওয়াজ তো আছেই।
অঞ্জলি দেবীর অমত না থাকায় একটু আগেই সাদামাটাভাবে বিয়েটা সম্পন্ন হয়ে গেছে।
উপস্থিত লোকজন বলতে তিয়াসার পক্ষ থেকে তিনি ছিলেন, আর প্রয়াসের মামা-মামি।
ছোটবেলায় বাবা মায়ের মৃত্যুর পর দাদু আর মামা,মামির কাছেই বড়ো হয়েছে সে৷ বছর কতক আগে দাদু মারা যাওয়ায় নিজের বলতে এই দু’জনই আছে তার। অন্য কোনো আত্মীয় স্বজনের সাথে যোগসূত্র নেই।
আর তিয়াসার তো আপন বলতে শুধু অঞ্জলি দেবীই আছেন।
তিয়াসার কাজকর্মে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো প্রয়াস। সেই কখন থেকে এই মেয়েকে ধরে এনে বসানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে সে, অথচ সে বসতেই নারাজ। এমনকি গায়ের গহনাগাঁটিও খুলতে চাইছে না। ঘড়িতে এখনি একটার বেশি বাজে। বাকিরাতটুকু কি এভাবেই পায়চারি করবে নাকি ও!
বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো প্রয়াস। বিনাবাক্যে হাত চেপে ধরে টেনে বিছানায় নিয়ে এসে বসালো তিয়াসাকে।
তিয়াসা সংকুচিত চোখে প্রশ্নবোধকভাবে তাকাতেই রাশভারী কণ্ঠে বলল, “ঘুমাবা এখন। কাল এসব আবার পড়িয়ে দেবো তখন যতো ইচ্ছা নাচানাচি করবা।”
কথার মাঝেই তিয়াসার ঘাড়ের পেছনে হাত দিয়ে গলার হারটা খুলতে উদ্যত হতেই বাধ সাধলো তিয়াসা। ওর নাসূচক মাথা নাড়নো আর ভার হয়ে আশা মুখোভাবই বলে দিচ্ছে, এসব ও আজ কিছুতেই খুলবে না।
প্রয়াস তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো। কাটকাট গলায় কটাক্ষ করে বলল, “বিয়ে হতে না হতেই অবাধ্য হচ্ছো!”
প্রয়াস বকা দিচ্ছে বুঝে মুখটা সংকীর্ণ হয়ে এলো তিয়াসার।
প্রয়াস আমলে নিলো না। কারণ এখন ওর সাথে তালেতাল মিলানো মানে সারারাত জেগে বসে থাকা। না এই মেয়ে ঘুমাবে আর না ওকে ঘুমোতে দেবে।
তাই ওর পাগলামিকে আশকারা না দিয়ে সরাসরি বলল, “ঘুমাবা মানে ঘুমাবা। এসব পরে কেউ ঘুমায় না। আর না এতো লাফালাফি করে। যথেষ্ট হয়েছে।”
গলার হারটা খুলে আনলো প্রয়াস। মুখটা একদম চুপসে গেল তিয়াসার। তবুও রা করলো না। অভিমানে টইটুম্বুর হয়ে মুখটা ফুলিয়ে রাখলো।
প্রয়াস একে একে কানের দুল, কপালের টিকলি, হাতের চুড়ি খুলে নিলো। শুধু পায়ের নূপুর জোড়া রেখে দিলো।
সবগুলো গহনা নিয়ে ড্রেসিং টেবিলের উপর আলমারি থেকে সুতির শাড়ি বের করে আনলো প্রয়াস। তিয়াসার পাশে সেটা রেখে বলল, “শাড়ি চেঞ্জ করে নেও। একা পারবা? নাকি রেখাকে ডেকে দেবো?”
তিয়াসা মোটেও তাকালো না। মাথা নেড়ে উত্তরও দিলো না। ফুলকো লুচির মতো গালদুটো ফুলিয়ে মুখ ঘুরিয়ে রইলো।
এটুকুন মেয়ের গাল ফোলানো রাগ দেখে না হেসে পারলো না প্রয়াস। নিঃশব্দে হাসলো সে। তিয়াসার দিকে ঝুঁকে কাধের কাছে শাড়ির পিনটা খুলে দিতে দিতে বলল, “I think, পারবা। না পারলে আমি তো আছিই।”
পিন পাশের রেখে শাড়িটা হাতে ধরিয়ে দিলো প্রয়াস। তিয়াসা রাগমিশ্রিত সরু চোখে তাকাতেই স্পষ্ট স্বরে বলল, “তাড়াতাড়ি। ঘুমাতে হবে। সকালে অফিস আছে আমার।”
তিয়াসা গোমড়া মুখ নিয়ে উঠে দাঁড়ালো।
“বেলকনিতে আছি আমি। তুমি এখানেই চেঞ্জ করে নেও।” বলে বেলকনিতে চলে গেল প্রয়াস। যাবার আগে আলো নিভিয়ে টেবিল লাইট জ্বালিয়ে দিয়ে গেল।
তিয়াসা শাড়ি বদলে নিলো একা একাই। এ বিষয়ে সে এখন পারদর্শী। ছোটোবেলা থেকেই যেকোনো জিনিস এক-দুবার দেখলেই সে করতে পারে। সমস্যা হয় না।
তিয়াসা এগিয়ে গিয়ে বেলকনির দরজার সামনে দাঁড়ালো। প্রয়াস ফোনে কিছু করছিলো। তিয়াসা পাশে এসে দাঁড়িয়েছে আঁচ করে চোখ তুলে তাকালো একপলক।
ওকে তখনো অভিমানে গমগমে হয়ে মুখটা ফুলিয়ে রাখতে দেখে মুচকি হাসলো।
কাছে এগিয়ে এসে কপালের উপরের চুলগুলো কানের পিছনে গুজে দিয়ে বলল, “রাগ করেছ?”
মুহূর্তে ব্যয় করলো না তিয়াসা। কপালটা বাজেভাবে কুচকে তৎক্ষণাৎ উপরে নিচে মাথা নেড়ে সায় জানালো।
“অনেক বেশি?” ঠোঁটে ঠোঁট চিপে হাসি আটকালো প্রয়াস।
এবারো একই ভঙ্গিমায় মাথা নাড়লো তিয়াসা।
“এত পছন্দ হয়েছে সবকিছু?”
তিয়াসা ঠোঁট ফুলিয়ে মাথা নোয়ালো। পছন্দ তো তার হয়েছেই। সব মনমতো হয়েছে। কিন্তু সব দিয়েও আবার নিয়ে নিলো প্রয়াস।
প্রয়াস দুহাতের মাঝে তিয়াসার মুখটা তুলে ধরে আদুরে স্বরে বলল, “বলেছি তো কাল আবার পরিয়ে দেবো। হবে না?”
তিয়াসা চোখ তুললো। প্রয়াসের দিকে তাকাতেই মণি দুটো কিয়ৎপল তার সুদর্শন মুখের সাবলীল হাসিতে স্থির হয়ে পড়লো। কপালের ভাঁজগুলো গায়েব হয়ে এলো নিমিখেই।
চোখের তারায় উচ্ছলতা নিয়ে সেও পালটা হাসল।
নির্মল, সতেজ সেই অধরজোড়ার হাসিতে কেমন থমকালো প্রয়াস। আঁখিপল্লব অনুরণিত হলো তার। খুব নিভৃতেই বুকের ভিতরটায় সুক্ষ্ণ যন্ত্রণাময় ভালোলাগা আলোড়ন তুললো যেন। আচমকিত উষ্ণ এক অনুভূতিতে ছেয়ে গেল পুরো শরীর ও মন।
প্রয়াস অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো। ফাঁকা ঢোক গিলে হাতদুটো নামিয়ে নিলো সে। ঘাড় ফিরিয়ে এদিক সেদিক এলোমেলোভাবে পলক ফেলে সামলালো নিজেকে।
হঠাৎ করে প্রয়াসকে গম্ভীর হতে দেখে হাসিটা সীমিত হয়ে এলো তিয়াসার। কিছুটা উৎকন্ঠিত হলো বোধহয়। একহাত আলতো করে প্রয়াসের বাহুতে রেখে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকাতেই অবাক হয়ে ঘাড় ঘুরালো প্রয়াস।
তিয়াসা মাথা নাড়িয়ে চোখের ইশারায় জিজ্ঞেস করলো কী হয়েছে?
প্রয়াস মৃদু হাসলো। লাগামহীন চিন্তাগুলো হুস করে উড়িয়ে দিয়ে ‘কিছুনা’ বোঝাতে নাবোধক মাথা নাড়লো। অতঃপর তিয়াসার হাত ধরে ভেতরে ফিরে এলো।
তিয়াসাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে চাদর টেনে দিলো ওর গায়ে। পাশে থাকা টেবিলল্যাম্পটা নিভিয়ে সেও যখন পাশে এসে শুয়ে পড়লো তখন আকাশসম খুশি হলো তিয়াসা। অধরজুড়ে হাসি ফুটলো ওর।
রেখা একটু আগেই বলেছে এখন থেকে নাকি সারাজীবন একসাথে থাকতে পারবে ওরা। সবসময় প্রয়াসকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাতেও পারবে। কেউ কিচ্ছুটি বলবে না। প্রয়াসও খারাপ ভাববে না। বরং অনেক আদর করবে আর ভালোবাসবে।
এজন্যই তো সে এত খুশি।
গায়ে চাদর টেনে নিতে নিতেই প্রয়াসের খেয়াল হলো তার প্রতি তিয়াসার খুশির প্রাণোচ্ছল হাসিসমেত চাহনির দিকে।
ভ্রু উঁচালো ও। সন্ধানীমূলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো কিছু। তবে কিছুমাত্র বোঝার আগেই তাকে সর্বোচ্চ অবাক করে দিয়ে ছিটেফোঁটা দূরত্ব ঘুচিয়ে খুব কাছাকাছি এগিয়ে এলো তিয়াসা।
সম্পূর্ণ নির্দ্বিধায় একহাত বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরে বুকে মাথা গুজলো সে।
ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে গেল প্রয়াস। নির্বোধের মতো পলক ঝাপটালো বারকয়েক।
বিষয়টা বুঝতে তার সময় লেগে গেল কিছুটা। অতঃপর বুঝতেই সুপ্ত ভালোলাগায় মুচকি হেসে আলতো করে সেও জড়িয়ে ধরলো তিয়াসাকে। চুলের ভাঁজে চুমু খেয়ে চোখ বন্ধ করতে করতে বলল, “গুড নাইট।”
(চলবে…)