লেখিকাঃ Tahmina Toma
কালোবউ পর্ব ১০
আকাশঃ একটু অপেক্ষা করো সবার প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবে। (হর্ণ দিতেই বাড়ির গেইট খোলে গেলো গাড়ি ভিতরে নিয়ে গেলাম)
মেঘলাঃ(আমার হা করে দেখা ছাড়া আর কাজ নেই। গাড়ির ভেতর থেকে বাড়িটা দেখতে পাচ্ছি। এটাও দুতলা বাড়ি কিন্তু অনেক সুন্দর আর বড়। বাড়ির ডিজাইনটা দেখার মতো। সামনে নানারকম ফুলের বাগান। এই বাড়ির একপাশ দিয়ে গাড়ি ঢুকে অন্যপাশ দিয়ে মনে হয় বের হয়ে যায় মাঝে বাগান। ও আল্লাহ কালো ড্রেস পরা কতো গার্ড বাড়ি ঘিরে রেখেছে। কার বাড়ি এটা??)
আকাশঃ মা বসে আছো কেন?? নামো,,,, চাঁদ নেমে আয়।
মাঃ আকাশ অনেক হয়েছে এবার বল এখানে কেন এসেছি??
আকাশঃ আমাদের বাড়ি আমরা আসবো না তো কে আসবে?? নিজের আসল ঠিকানায় এসেছি আমরা।
মাঃ আ,,,,আকাশ এটা আ,,,আমাদের বাড়ি ছিলো এখন আর নেই।
আকাশঃ আমাদের ছিলো আমাদের আছে আর আমাদেরই থাকবে ইনশাআল্লাহ।
মা+চাঁদঃ ম,,,,,,মানে???
আকাশঃ আগে ভেতরে চলো সব বলছি। আর মেঘলা কিন্তু এই বাড়িতে প্রথম ঢুকছে। কোন নিয়ম থাকলে পালন করো। টিয়া ভেতরেই আছে।
মাঃ(কাঁপা পায়ে গাড়ি থেকে নিচে পা রাখলাম। তিনটা বছর পর এই বাড়িতে পা রাখছি। আজ থেকে প্রায় ত্রিশ বছর আগে বউ হয়ে এই বাড়িতে পা রেখেছিলাম। ভেবেছিলাম আর মৃত্যুর পর লাশ হয়ে তারপর বের হবো কিন্তু ভাগ্য অন্যকিছু ছিলো।)
চাঁদঃ মা তুমি ঠিক আছো??
মাঃ হুম,,,,আমি ঠিক আছি।
মেঘলাঃ (আমার মাথা ঘুরছে। এটা আকাশদের বাড়ি??? মা আর চাঁদ ভিতরে চলে গেলো।) এ,,,,এটা কাদের বাড়ি???
আকাশঃ বাড়িটা বানিয়েছেন আমার দাদা আশরাফ চৌধুরী। তারপর বাড়ির মালিক হয়েছিলেন আমার বাবা আশিক চৌধুরী। আর এখন এই বাড়ির মালিক আকাশ চৌধুরী।
মেঘলাঃ(গোল গোল রসগোল্লার মতো চোখ করে তাকিয়ে একবার বাড়িটা দেখছি আর একবার আকাশকে। এত বড় বাড়ির মালিক আকাশ?? তাহলে আমি কেন ওর পাশে বসে আছি এখানেতো কোন বড়লোক বাবার সুন্দরী মেয়ে থাকার কথা। আকাশ তাহলে মিথ্যে বলে বিয়ে কেন করেছে আমাকে?? ওতো বলেছিলো ছোটখাটো একটা বিজনেস করে। কোন রহস্য আছে কিন্তু কী সেটা??)
আকাশঃ কী হলো নামো??
মেঘলাঃ (ভাবনায় হারিয়ে গিয়েছিলাম আকাশের ডাকে হুস হলো। এখন আকাশকে আমার খুব বেশি সন্দেহ হচ্ছে। ধরে গাড়ি থেকে নামিয়ে কোলে করে বাড়ির দিকে নিয়ে এলো। দরজায় মা আমাকে আর আকাশকে বরণ করলো। ভেতরে এসে আমার চোখ ধাঁধিয়ে গেলো। ভেতরটা অনেক সুন্দর আর দামি ফার্নিচার দিয়ে সাজানো। ওই বাড়ি এর তুলনায় কিছুই না। ভেতরটাও অনেক বড়। এর রুম গুনতে পারবো না। আকাশ আমাকে ড্রয়িংরুমের সোফায় বসিয়ে দিলো)
মাঃ আকাশ অনেক হেয়ালি করেছিস এবার বল আমরা এখানে কীভাবে?? আর টিয়া এখানে কখন এলো?? ও আমাকে বলে সকালে ওর মার সাথে দেখা করতে গিয়েছিলো।
আকাশঃ টিয়া ওর মার কাছে যায়নি আমি এখানে পাঠিয়েছিলাম সব ঠিকঠাক আছে কিনা দেখার জন্য।
মাঃ কিন্তু,,,,
আকাশঃ তুমি শান্ত হয়ে বসো আমি সব বলছি।(একটু চুপ থেকে বলতে শুরু করলাম) বাবাকে হারিয়ে তখন এমনিতেই দিশেহারা তার ওপর যখন বাড়ি, কোম্পানি সব সরকার জব্দ করে বাড়ি ছেড়ে দিতে বলে তখন একদম ভেঙে পরেছিলাম। তোমাদের নিয়ে আমাদের বাগানবাড়িতে ওঠি। কিন্তু ভেতরটা কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছিলো। আমার দাদার এতো কষ্টের গড়া কোম্পানি এভাবে ধুলায় মিশে যেতে পারে না। এই কোম্পানি নিয়ে বাবার কত স্বপ্ন ছিলো কিন্তু কী করবো বুঝতে পারছিলাম না। বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যাওয়ার ২য় দিন রেস্টুরেন্টে চরম অপমানের স্বীকার হই। আমি চৌধুরী বাড়ির যোগ্য উত্তরাধিকারী হতে পারিনি। বাবার টাকায় ফুটানি করতাম, বাবা নেই এখন আমার দু’টাকার দামও নেই এমন অনেক কথা শুনতে হয় ভরা রেস্টুরেন্টে। সবাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মজা দেখছিলো। তিন দিন আগে যে আকাশ চৌধুরীর নাম শুনলে মাথা তুলার সাহস হতো না আজ সেই আকাশ চৌধুরীর ওপর সবাই হাসছে। তখন সত্যি মনে হয়েছিলো এতদিন যে ছিলো সে আকাশ চৌধুরী নয় আশিক চৌধুরীর ছেলে আকাশ চৌধুরী। আশিক চৌধুরীর হাত মাথার ওপর থেকে চলে যেতেই রয়ে গেছে শুধু আকাশ যার কোন মূল্য নেই। বেরিয়ে এসেছিলাম রেস্টুরেন্ট থেকে। সারারাত ঘুমাতে পারিনি। অবশেষে ঠিক করলাম এবার আশিক চৌধুরীর ছেলে আকাশ চৌধুরী নয় চৌধুরী বাড়ির যোগ্য উত্তরাধিকারী আকাশ চৌধুরী সবার সামনে আসবে। চৌধুরী গ্রুপ অব কোম্পানির যোগ্য ওনার সবার সামনে আসবে।
মেঘলাঃ (চৌধুরী গ্রুপ অব কোম্পানির মালিক আশিক চৌধুরীই আকাশের বাবা???? বাংলাদেশের টপ বিজনেসম্যানের এওয়ার্ড টানা ৫ বছর পেয়েছে আশিক চৌধুরী। গত ৩ বছর আগে হার্টঅ্যাটাক করে মারা যায় চৌধুরী গ্রুপ অব কোম্পানির মালিক আশিক চৌধুরী। নিউজে প্রায় ৩ দিন হেডলাইন ছিলো এই নিউজ। তারপর ৩ বছরে আর এই কোম্পানির কোন নাম শুনিনি। আমি কিছু ভাবতে পারছি না। এত বড়লোক বাবার ছেলে আমাকে,,,,,,,, কেন?? এত কেন-র উত্তর কোথায় পাবো আমি??)
আকাশঃ পরদিন সকালে সরকারি ব্যবস্থাপানায় যোগাযোগ করি। বাবার প্রজেক্ট আমি শুরু করতে চাই কিন্তু তারা প্রথমে রাজি হয় না। আমি এর আগে বিজনেসে জড়িত ছিলাম না আমার কোন অভিজ্ঞতা নেই তাই। বাবা আমার নামে একটা একাউন্ট করেছে আমার জন্মের পরই, সেটা কেউ জানতো না। মা তুমিও জানতে না মনে হয়?? শুধু আমার নামে না চাঁদ আর মার নামেও আছে।
মাঃ কই আমাকেতো কিছু বলেনি কখনো।
আকাশঃ বাবার মৃত্যুর পর এডভোকেট আব্দুল আমাকে সব জানায়। আমাদের তিনজনের নামে তিনটা ব্যাংক একাউন্ট আর তিনটা বাড়ি রেখে গেছে বাবা। যাতে তার অবর্তমানে আমাদের কোন কষ্ট না হয়। প্রত্যেক প্রজেক্টের লাভের প্রায় ৩০% আমার একাউন্টে, ১০% চাঁদ আর ১০% তোমার নামে জমা হতো। সেখানে এত টাকা জমা হয়েছিলো সারাজীবন কিছু না করলেও ভালোভাবে চলে যেত আমাদের। আমি চাইলে নতুন বিজনেস শুরু করতে পারতাম কিন্তু এই কোম্পানি দাদা আর বাবার স্বপ্নের কোম্পানি তাদের রক্ত ঘামে তৈরী এটা কিভাবে ধুলায় মিশে যেতে দেই। বাবার এই প্রজেক্টটা ছিলো একহাজার কোটি টাকার। যার জন্য বাবা বাড়ি, কোম্পানি সব জামানত রেখে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে লোন নিয়েছিলো। যার জন্য বাবা মারা যাওয়ায় সরকার সব জব্দ করে নেয়। মা আর আমার নামের একাউন্টটাও জামানত রেখে আমার বিজনেসের ওপর পিএইচডি করার সার্টিফিকেট জমা দেওয়ার পর আমাকে প্রজেক্ট কন্টিনিউ করার পারমিশন দেয়। ৩ বছর সময় লাগলো প্রজেক্ট কমপ্লিট করতে। গতকাল প্রজেক্ট কমপ্লিট হয়ে গেছে, ব্যাংকের লোন পরিশোধ করে বাড়ি আর কোম্পানি গতকাল ফিরে পেয়েছি।
মাঃ আ,,,আকাশ তুই তোর বাবার স্বপ্নের প্রজেক্ট কমপ্লিট করেছিস????
আকাশঃ হ্যাঁ মা,,,,,,,(টলমল চোখে)
মেঘলাঃ(মা আকাশ আর চাঁদকে বুকে জড়িয়ে হাও মাও করে কাঁদছে। আকাশ আর চাঁদও কাঁদছে। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি। চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে কিন্তু আমি কেন কাঁদছি??)
আকাশঃ সবাই রুমে গিয়ে রেস্ট নাও এখন।(মেঘলাকে কোলে নিয়ে রুমের দিকে গেলাম।)
মেঘলাঃ (আমার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। আমি আর কিছু ভাবতে পারছি না। যা হচ্ছে শুধু নিরব দর্শকের মতো দেখে যাচ্ছি। মানুষের সামনে যখন তার কল্পনার বাইরে কিছু ঘটে তাহলে হয়তো তার অবস্থা আমার মতোই হয়)
আকাশঃ ফ্রেস হয়ে নাও।
মেঘলাঃ হুম,,,,,,,
মেঘলাঃ( দিনগুলো কেটে যাচ্ছে। আজ এক সপ্তাহ এই বাড়িতে এসেছি। রুমেই কেটেছে দিনগুলো, মা আর চাঁদ দিনে দুএকবার এসে দেখা করে যায়। এই বাড়িতে আসার পর আকাশের সাথে দূরত্বটা কমার থেকে অনেক বেড়ে গেছে। সেদিন আসার পর আকাশ শেষবার কোলে করে রুমে নিয়ে এসেছিলো তারপর আর তার সাথে দেখা হয়নি। তারপর থেকে টিয়া আপু হেল্প করতো রাতে আমার রুমেই থাকতো। উনি কোথায় থাকে আমি জানি না। গতকাল পায়ের ব্যান্ডেজ খোলে দিয়েছে এখন আর কারো হেল্প লাগে না। আজ টিয়া আপু তার নিজের রুমে চলে গেছে। অনেক প্রশ্ন মনে জমা হয়েছে যার একটার উত্তরও আমার জানা নেই। বেডে শুইয়ে এসব ভাবছিলাম তখনি কেউ দরজায় নক করলো।) কে????
,,,,,,,,,,,,,,,,,,,
মেঘলাঃ আরে কথা বলছো না কেন?? টিয়া আপু কী???
,,,,,,,,,,,,,,,,,
মেঘলাঃ টিয়া আপু আজ আর তোমার কষ্ট করে এখানে থাকতে হবে না। তুমি নিজের রুমে চলে যাও।(এবার আরো জোরে নক হলো। তাই দরজা খোলে দিলাম) আরে বল,,,,,,,, আ,,,,আপনি??
চলবে,,,,,,,,