‘স্যান্ডেল’
সিলভি হোটেলরুমে একা একা অপেক্ষা করছে। শেহান খান নামের এক ব্যক্তি ঘন্টাখানেকের মধ্যে হোটেলরুমে আসবে। সিলভির দেহ ভোগ করবে। তারপর চলে যাবে।
রুমের ভেতর বিশাল খাট। খাটের সাথে এমনভাবে আয়না সংযুক্ত যাতে সম্ভোগদৃশ্য সম্ভোগকারী তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে পারে। এই আয়নার দিকে তাকিয়ে কেমন যেন শিউরে উঠে সিলভি। তারপর উঠে ড্রেসিং টেবিলের সামনে যায়। ড্রেসিং টেবিলের আয়নাটা বরং ভালো। এই আয়না সেরকম ভয়ংকর কোন দৃশ্যকে ধারণ করে না।
ড্রেসিং টেবিল আয়নায় নিজেকে দেখে সিলভি। সিলভি সুন্দর করে সেজেছে। সুন্দর মানে যৌন আবেদনের চুড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ। ‘যে দেবতার যে ভোগ’ বলে একটা কথা প্রচলিত আছে। শেহান খান তার কাছে কামের দেবতা হিসেবেই উপস্থিত হবেন। কাজেই সেই দেবতাকে তুষ্ট করার জন্য কামের দেবী না সেজে উপায় নাই।
সিলভি কি আসলেই শেহান খানের জন্য অপেক্ষা করছে?
না, সিলভি শেহান খানের জন্য অপেক্ষা করছে না। শেহান খান তাকে ভোগ করার বিনিময়ে সিলভির তিরিশহাজার টাকা বেতনের চাকরি রক্ষা হবে। চাকরি রক্ষা হওয়াটা সিলভির বড্ড বেশি দরকার।
আয়নায় নিজের কামের দেবী চেহারাকে ছাপিয়ে নিজের আসল চেহারার দিকে তাকায় সিলভি।
পুরো নাম সাদিয়া জাহান সিলভি। এএসএসি, জিপিএ ফাইভ। এইচএসসি জিপিএ ফাইভ। অনার্স( ইংলিশ), সেকেন্ড ক্লাস। পিতা, মৃত সারোয়ার জাহান, প্রাইভেট চাকুরীজীবি। মাতা, জীবিত, আফিফা সারোয়ার, গৃহিনী। বয়সে সিলভির চেয়ে একবছরের বড় ভাই, জীবিত সৌরভ জাহান, ডাইল এবং ইয়াবাখোর!
সেইরাতে বাবা জীবিত।
কলেজছাত্রী সিলভিদের শ্যামলীর বাসা। রাত আটটায় বাবা এককেজি স্পঞ্জ মিষ্টি নিয়ে বাসায় ফিরলেন।
মা বিস্মিত হয়ে বাবাকে জিগ্যেস করলেন- কিসের মিষ্টি? চাকরিতে সমস্যার সমাধান হয়েছে?
বাবা অপরাধী মুখ করে বললেন- না। চাকরি চলে গেছে।
মা কঠিন মুখে বললেন- তোমার চাকরি চলে যাওয়া মানে আমি ছেলেমেয়েদের নিয়ে পথে বসা। আর তুমি মিষ্টি নিয়ে এসে তামাশা করছ?
বাবা চুপচাপ বাথরুমে ঢুকলেন। ফ্রেশ হয়ে এসে বিস্মিত কন্যা আর স্ত্রীর উদ্যেশ্যে বললেন-
এই চাকরিটা টিউমারের মত হয়ে গিয়েছিল। টিউমার অপসারন হয়েছে। মানুষ রোগ থেকে মুক্ত হলে সেলিব্রেট করে না?
মা আবারো কঠিন গলায় বললেন- সব চাকরিই টিউমার। সবাই টিউমার সহ্য করেই চাকরি করে। শুধু তোমার সহ্য হয় না। কারণ তোমার কাছে জীবন মানে সংসারের আয় উন্নতি না। তোমার কাছে জীবন মানে নাটক!
নাটক?
এই যে চাকরি যাবার পর বাসায় মিষ্টি নিয়ে আসলা। তুমি মনে কর এসব নাটক করাটাই হল জীবন!
জীবনকে কি সবার এক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখতে হবে?
শোন তোমার জীবন যদি শুধু তোমার হত তাহলে তুমি তোমার জীবনকে নিজের ইচ্ছামত দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখতে পারতা। এখন ত তোমার জীবনের সাথে আমাদের জীবনও যুক্ত। জীবনের দৃষ্টিভঙ্গি সেট করার আগে তোমার আমাদের কথা ভাবতে হবে।
প্রতিদিন মানসিকভাবে নির্যাতিত হতে ভালো লাগে না।
প্রতিদিন মানসিকভাবে আদর করার জন্য তোমাকে কে চাকরি দেবে?
শোন, অত বেশি ভাবতে হবে না। আমার অভিজ্ঞতা আছে। প্রতিদিন মানসিকভাবে আদর না করলেও মানসিকভাবে নির্যাতন করবে না, এরকম কোম্পানী আমাকে চাকুরি দিতে ইচ্ছুক।
সেই কোম্পানীকে এখন আমার সামনে ফোন দাও। ওদের ইচ্ছে আসলেই আছে কী না আমি দেখি!
বাবা সত্যি সত্যি ওই কোম্পানীকে ফোন দিলেন। ওরাও বাবাকে পরদিন দেখা করতে বলল।
পরদিন দুপুর একটার দিকে বাবা মায়ের কাছে ফোন করল। বলল- নতুন কোম্পানীতে আমার চাকরি হয়েছে। বেতন আগের চেয়ে দশহাজার টাকা কম, তবে শান্তি আছে!
সন্ধ্যা ছ’টার দিকে বাবার থেঁতলানো লাশ নিয়ে সৌরভ ভাই বাসায় ফিরল। মহাখালি ফ্লাইওভার দিয়ে নামার পরপরই ফ্লাইওভারের উপর দিয়ে আসা আর ফ্লাইওভারের নীচের রাস্তা দিয়ে আসা দ্রুতগামী দুটো বাসের মাঝখানে পড়ে মোটরসাইকেলসহ দুমড়েমুচড়ে গেছে বাবা। মোটরসাইকেলের তেল, মবিল আর বাবার শরীরের রক্ত মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। বাবা সবসময় বলত- মোটরসাইকেলটা আমার দেহ মনের অংশ হয়ে গেছে। যতদিন বাঁচি একসাথেই বাঁচব। মরলেও একসাথেই মরব।
মোটরসাইকেলটা সত্যি সত্যিই রিপেয়ার করে চালানোর আর কোন উপায় ছিল না!
ক’দিন যাবার পর সিলভি যখন বুঝতে পারল ‘বাবার মৃত্যুটা ভয়ংকর একটা সত্য এবং মৃত মানুষ আর কখনোই জীবিত হয়ে ফিরে আসে না’ তখন সে একদিন সৌরভকে জিগ্যেস করল-
আচ্ছা বাবা ত অনেকবছর ধরেই মোটরসাইকেল চালায়। ছোটবেলাতে তোকে আর আমাকে মোটরসাইকেলে চড়িয়ে স্কুলে নিয়ে যেত। আমি সামনে বসতাম তুই পেছনে বসতি। বাবা মোটরসাইকেল চালানো অবস্থায় মাঝে মাঝে আমার মাথায় চুমু দিত! বাবা এরকম অ্যাক্সিডেন্ট করল কেন?
সৌরভ নির্জীব কন্ঠে বলল- যে জায়গায় দুর্ঘটনা ঘটেছে, সেই জায়গা বাবা অন্তত কয়েকহাজার বার মোটরসাইকেলে পার হয়েছে। সেই জায়গায় লোকাল বাস বা পিকআপ পেছনথেকে কীভাবে আসে, সামনে দুজনেই বামে টার্ন নেবার জন্য এবং একজন আরেকজনের আগে যাবার জন্য কীভাবে তাদের মধ্যকার স্পেস সংকুচন করে, সেই সংকুচিত স্পেস এর ফাঁদে না পড়ার জন্য কি করতে হয় সেটা বাবার মস্তিষ্ক ভালোভাবেই জানতো।
তাহলে অ্যাকসিডেন্ট কেন হল?
বাবা আর আমার মধ্যে আলাদা একটা পুরুষমানুষ সুলভ বন্ধুত্ব ছিল। তোকে শুধু অন্ধের মত ভালোবাসত। আমার সাথে সাংসারিক নানান বিষয় শেয়ারও করত।
তা ত জানিই।
মৃত্যুর আগের রাতে আমাকে সবকিছু খুলে বলেছিল বাবা।
বাবা কী খুলে বলেছিল, তুই এখন আমাকে খুলে বল ভাইয়া।
চাকরি যাবার পর বাবার আসলে কোথাও চাকরি হয় নাই। সংসারে শান্তি বজায় রাখার জন্য পুরোটাই অভিনয় ছিল। বাবার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের খুব ঘনিষ্ট বড় ব্যবসায়ী এক বন্ধুর সাথে কথা হয়েছিল। সেই বন্ধু বাবাকে বলেছিল- আপাতত প্রতিদিন তুই আমার অফিসে এসে বসবি। বসে বসে নিজের জন্য চাকরি খুঁজবি। আশা করি দু’মাসের মধ্যে চাকরি পাবি।
বাবা লজ্জার মাথা খেয়ে বন্ধুকে জিগ্যেস করেছিল, এই দু’মাসের সংসার খরচ কোত্থেকে আসবে? বন্ধু জবাব দিয়েছিল, হলে থাকতে একবার দু’মাস আমার কোন টিউশনি ছিল না। তুই আমাকে দু’মাস চালিয়েছিলি! এখন দুমাস তোকে আমি চালাব। বন্ধুত্বের প্রতিদান।
বাবা চরিত্রগতভাবে সৎ এবং সত্যবাদী ছিল। এজন্য জীবনধারণের প্রয়োজনে নেয়া যেকোন প্রকার মিথ্যার আশ্রয় তার মনের স্থিরতা ভালোভাবেই নষ্ট করত।মায়ের কাছে মিথ্যে বলে বাবা যখন বাসায় ফিরতেছিল তখন বাবার মানসিক স্থিরতা পুরোপুরি নষ্ট ছিল। বাবার মস্তিষ্কের বেশিরভাগ অংশ নিযুক্ত ছিল মানসিক স্থিরতা ফিরিয়ে আনার কাজে। মস্তিষ্কের এক অংশ বলতেছিল- মিথ্যে কথা বলার কোন প্রয়োজন নাই, বাসায় গিয়ে সব সত্য কথা বলে দিব। আরেক অংশ বলতেছিল, মিথ্যেটাই বহাল থাক। কি দরকার অশান্তি বাড়িয়ে!
মস্তিষ্কের যে ক্ষুদ্রতম অংশ মোটরসাইকেল চালানোর সাথে যুক্ত ছিল সেটা ধেয়ে আসা দুই বাসের এবং মোটরসাইকেলের মধ্যকার গতি এবং দিকের পরিবর্তন ঠিকমত ক্যালকুলেট করতে পারে নি।
চাকরিতে কী সমস্যা হয়েছিল বাবার? চাকরি চলে গিয়েছিল কেন?
বাবা স্বাধীনচেতা মানুষ ছিল। চাকরির পরাধীনতা নিতে পারতো না। সপ্তাহে সাতদিন, দিনে চব্বিশ ঘন্টার মানসিক দাসত্ব বাবা মেনে নিতে পারতো না।
অনেকেই ত মেনে নেন। সংসারের কথা, ছেলেমেয়ের কথা চিন্তা করে মেনে নেন। তাদের মধ্যে বাবার মত স্বাধীনচেতা মানুষও নিশ্চয় আছেন।
শুধু স্বাধীনচেতা হলে সমস্যা ছিল না। বাবা একই সাথে চরিত্রগতভাবে সৎ এবং সত্যবাদী ছিল।
তাতেই বা সমস্যা হবে কেন?
আমি কি একটা সিগারেট ধরাব? সিগারেট ছাড়া টানা কথা চালিয়ে যাওয়া কঠিন।
ধরা। সিগারেটের মধ্যে গাঞ্জা নাই ত?
না, নাই।
সৌরভ সিগারেট ধরিয়ে লম্বা টান দিয়ে কথা শুরু করল। আচমকা সৌরভের দিকে ভালোভাবে তাকিয়ে সিলভির মনে হল, সৌরভের চেহারা পুরোই বাবার মত। বাবার চোখের কোণে দুই ছেলেমেয়ের জন্য সবসময় স্নেহের জল জমে থাকত। সৌরভের চোখের কোণেও এই মূহূর্তে স্নেহের জল, বাবার জন্য!
বাবা আমাকে যেভাবে বলেছিল তোকে হূবূহূ সেভাবেই বলছি। বর্তমান বাংলাদেশে প্রাইভেট চাকুরিগুলোতে কোম্পানীর মালিক হল পুরোপুরি ঈশ্বরতুল্য আর চাকরিজীবিপক্ষ( এক্সিকিউটিভ ডাইরেক্টর থেকে পিয়ন পর্যন্ত)হল পুরোপুরি দাসতুল্য। দাস যদি ঈশ্বরকে সত্যি সত্যি মন থেকে ভক্তি করতে পারে, তাহলে তার জন্য চব্বিশঘন্টা ঈশ্বরবন্দনা করা সহজ হয়ে যায়। চব্বিশঘন্টা ইশ্বরবন্ধনা মানে চব্বিশঘন্টা ঈশ্বরের কোম্পানীর জন্য কাজ করা!
আর যদি মন থেকে ভক্তি করতে না পারে?
তাহলে চব্বিশঘন্টা ঈশ্বরবন্দনা সহজ না হলেও সম্ভব। তখন মালিককে ভক্তি না করলেও মনে মনে তার ক্ষমতার কাছে নতিস্বীকার করে নিতে হয়। মন থেকে ভক্তি না আসলেও ভক্তির অভিনয় করে যেতে হয়। ‘এই নতিস্বীকারই নিয়তি, এই আজীবনের অভিনয়ই জীবন’ এরকম একটা প্রোগ্রামের অধীনে মনকে নিয়ে আসতে হয়।
এরকম একটা প্রোগ্রামের অধীনে বাবা নিজের মনকে আনতে পারলো না কেন?
চরিত্রগতভাবে সৎ এবং সত্যবাদী মানুষের মনের খুব শক্তিশালী একটা মাস্টার প্রোগ্রাম থাকে। সেই প্রোগ্রাম মনকে কারো কাছেই সার্বক্ষণিকভাবে নতিস্বীকার করতে দেয় না, সেই প্রোগ্রাম কোন সচেতন অত্যাচারকে নিয়তি বলেও কখনো মানতে পারে না। সেই শক্তিশালী মাস্টার প্রোগ্রাম যার মনে থাকে তার মনে আর কোন প্রোগ্রাম ইনস্টল করা যায় না!
তোর মনেও কি শক্তিশালী প্রোগ্রাম ইনস্টল করা আছে?
হ্যাঁ আছে।
এত শক্তিশালী মন নিয়া গাঞ্জা, ডাইল, ইয়াবা খাস কেন শুয়োর?
আমার দুই গালে জুতার বাড়ি দে।
হাইহীল দিয়ে দেব নাকি ফ্ল্যাট সেন্ডেল দিয়ে দেব?
ফ্ল্যাট সেন্ডেল দিয়ে দে।
ভেজাচোখের সামনে দৃশ্যগুলো আস্তে আস্তে ঝাপসা হয়ে এসেছিল সিলভির এবং সে ধীরে ধীরে বর্তমানে ফিরে এসেছিল।
ড্রেসিং টেবিলের উপর পিরিচে ঢাকা একগ্লাস পানি ছিল। পানিটা ঢক ঢক করে খেয়ে ফেলে সিলভি। তারপর হাতঘড়ির দিকে তাকায়। দুইটা তেত্রিশ বাজে। শেহান খানের আসার কথা ঠিক বিকাল তিনটায়। তার মানে আরো সাতাশ মিনিট। এই সাতাশ মিনিট কিসের জন্য অপেক্ষা?
তার চেয়ে ক্ষমতাবান কেউ এসে তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে তাকে ভোগ করে যাবে, তার জন্য অপেক্ষা? কিন্তু সিলভি তো ইচ্ছে করে অপেক্ষা করছে না। বাধ্য হয়ে অপেক্ষা করছে।
চাকরিতে বাবাকেও কি তাই করতে হত না? ইচ্ছের বিরুদ্ধে চব্বিশ ঘন্টা কাজ? ইচ্ছের বিরুদ্ধে ছুটির দিনে মালিকের পিছে পিছে হাঁটাহাঁটি?
নিয়মটাই কি তবে এমন, যে ক্ষমতাহীনের কাজ হল অপেক্ষা করা, ক্ষমতাবান কখন এসে তাকে জোর করে ভোগ করে যাবে? ভোগের বিনিয়ময়ে রুটি। ভোগের বিনিময়ে রুজি।
ভাবনার এই পর্যায়ে এসে খুব আলগোছে রতনের কথা মনে পড়ে সিলভির। রতন তাকে ভালোবাসতো। কিন্তু সিলভিকে স্ত্রী হিসেবে পাবার জন্য যতটা যোগ্যতা সিলভি মনে মনে নির্ধারন করেছিল সেটা রতনের ছিল না।
রতনের চেহারা সুন্দর ছিল। রতন চাকরিও করত। রতনের সিলভির প্রতি ভালোবাসায়ও কোন ঘাটতি ছিল না। কিন্তু সিলভির রতনকে নিজের উপযুক্ত বলে মনে হয় নি। রতনকে দেখে সিলভির কখনো মনে হয় নি, রতন ধুম করে সপরিবারে কানাডায় সেটল করে ফেলবে, চাকরিতে অল্পদিনেই বিশাল উন্নতি করে অফিস থেকে গাড়ি পাবে, বসুন্ধরা আবাসিকে চট করে ফ্ল্যাট বুকিং দেবে।
রতন ভালো কবিতা লিখতো এতেও কোন সন্দেহ নাই, কিন্তু ‘রতনের চেহারা+ রতনের একুশ হাজার টাকা বেতনের চাকরি + রতনের কবিতা’ রতনকে সিলভির কাছে নিজের চুড়ান্ত জীবনসঙ্গী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে নি।
সিলভি নিজেই যখন তিরিশ হাজার টাকা বেতনের চাকরিতে জয়েন করেছে এবং একুশ হাজারি রতন যখন এসে বলেছে, সিলভিকে না পেলে সে আত্মহত্যা করবে, তখন সিলভি বলেছে- রতনকে সে আসলে ভাই হিসেবে দেখত! সে সৌরভ এর বন্ধু। সেই হিসাবে সিলভির বড় ভাই।
রতন তখন লিপকিসের ছবিসহ মেসেজের কথা স্মরণ করিয়ে দিলে সিলভি অকাতরে বলেছে- তার বয়স কম ছিল। কম বয়সের আবেগে ভাইকে অন্যকিছু মনে হয়েছিল। এখন বুঝতে পেরেছে রতন আসলে তার ভাই!
অভিমানী ‘রতন ভাই’ সিলিং ফ্যানে ঝুলে আত্মহত্যা করেছিল। চিরকুটে লিখেছিল- আমার মৃত্যুর জন্য আমার কোন বোন দায়ী নয়!
হোয়াটস অ্যাপে শেহান খানের ম্যাসেজ( টেন মিনিটস টু কাম) দেখতে দেখতে নিজের মনকে প্রশ্ন করে সিলভি, রতনের প্রতি তার আচরণও কি ক্ষমতাহীনের প্রতি ক্ষমতাবানের আচরণের মত ছিল না? সে যদি রতনকে তার সমপর্যায়ের মানুষ মনে করত তাহলে নিশ্চয় মাত্র নয়হাজার টাকার জন্য প্রেমিককে ভাই বানিয়ে ফেলত না!
রতনের মৃতদেহটা সিলিং থেকে নিঃসাড়ে ঝুলেছিল। কিন্তু মৃত রতনের ঠোঁটের কোণাল অভিমানে কী এক গভীর বানী যেন সঞ্চিত হয়ে ছিল। আগে কখনোই বুঝতে না পারা সেই গভীর বানীটা কী এক অদ্ভুত ক্ষমতায় সিলভি এই মুহূর্তে বুঝতে পারে-
পৃথিবীতে ক্ষমতাবান মানুষ আর ক্ষমতাহীন মানুষ কখনোই সম পর্যায়ের নয়। ক্ষমতাবান মানুষ তার সুখের প্রয়োজনে ক্ষমতাহীন মানুষকে নির্যাতন করবে এবং বিনিময়ে তাকে ঠিক ততটুকুই দেবে, যতটুকু দিলে সে পরবর্তী নির্যাতনের উপযুক্ত থাকে।
এই বুঝতে পারার আলোয় সে তার আর রতনের সম্পর্ককে পূনরাবিস্কার করার চেষ্টা করে।
রতন প্রথম দেখাতেই সিলভির প্রেমে পড়েছিল। প্রেমে পড়ে সে সিলভির ক্ষমতাকে বাড়িয়ে দিয়েছিল। সেই ক্ষমতাবলে সিলভি তার সুখের প্রয়োজনে তার সাথে প্রেম করেছে। কিন্তু রতন যখুনি সিলভিকে বিবাহ করে তার সমপর্যায়ে উঠতে চেয়েছে তখন তাকে ভাই বানিয়ে সম্পর্ক টিকিয়ে রেখে তাকে সময়ে সময়ে নির্যাতনের উপযুক্ত রাখতে চেয়েছে। কিন্তু মানুষ হিসেবে রতন আরো বেশি সংবেদনশীল!
শেহান খানের সর্বশেষ হোয়াটস আপ মেসেজ ( ইন দ্য লিফট) দেখার পর সিলভির মনের ভেতর এক অদ্ভুত পরিবর্তন ঘটে। তার মনে হয়, তার বাবার জগত বা রতনের জগতে এক ধরণের শক্তি ছিল। রতন জীবনযুদ্ধ না করে কাপুরুষের মত আত্মহত্যা করেছে, এটার মধ্যে মহৎ কিছুই নাই। কিন্তু তার অভিমানটা মূল্যবান। অভিমান থেকে আত্মহত্যা না করে সে যদি সেই অভিমানশক্তিকে সৃষ্টিশীল কোন জনকল্যানমূলক এমনকি আত্মকল্যানমূলক কাজেও রূপান্তরিত করতে পারতো, তাহলেও পৃথিবী কিছু না কিছু উপকৃত হত।
বাবার এবং রতনের শক্তির জগত আবিস্কার করার সিদ্ধান্ত নেয় সিলভি এবং তার কোম্পানীর এমডির কাছে হোয়াটস অ্যাপে চাকুরি থেকে রেজিগনেশন দেবার মেসেজ পাঠিয়ে আরেক লিফট দিয়ে নিচে নেমে যায়।
সৌরভ চাকরি করে। একই হোটেলের রিসিপশনে একই সময়ে সে অপেক্ষা করছিল একজন বিদেশী ভদ্রলোকের জন্য। এটা কাকতালীয় ঘটনা অবশ্যই। কিন্তু কাকতালীয় ঘটনা জগতে ঘটে বলেই ত শব্দটা এসেছে!
ভাইবোনে দেখা হয়। বিদেশী ভদ্রলোক তখনো তার রূম থেকে নামে নাই। সৌরভ বোনের চেহারার দিকে তাকিয়ে চমকে উঠে। তারপর অফিসে ফোন করে তার এক কলিগকে বলে দেয় যেন সে বিদেশীকে নিতে আসে। বিদেশীকেও ফোন করে বলে, আর কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে।
ভাইবোন রিকশা চড়ে বাসায় ফিরছে। প্রচন্ড বৃষ্টি হচ্ছে। সৌরভকে কেউ কখনো কাঁদতে দেখে নি। সিলভির মুখে সবকিছু শুনে সে আজ কাঁদছে। সিলভির হাত শক্ত করে চেপে ধরতে ধরতে সৌরভ বলল- তুই বাবা আর রতনের থেকে শক্তি নিয়েছিস। আমি আজকে তোর থেকে শক্তি নেব! আমার অফিসে নিজের ঘাড়ের চাবি আমি কারো হাতে দেইনি। ঘাড়ের চাবি যতদিন নিজের হাতে রাখতে পারবো, ততদিনই চাকরি করবো। তবে এই মূহূর্তে আমার নিয়ন্ত্রক হল ইয়াবা ট্যাবলেট। দিনে এবং রাতে আমাকে ইয়াবা ট্যাবলেটের আদেশ পালন করতে হয়। আজকে থেকে ইয়াবা ট্যাবলেট যখুনি আমাকে তাকে সেবন করার আদেশ দেবে তখুনি আমি তোর কাছে যাব, আর তুই তোর সেন্ডেল দিয়ে আমার দুই গালে দুইটা বাড়ি দিবি!
আফিফা সারোয়ার আজকে অসম্ভব কাঁদছেন। সাত বছর আগে পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়া স্বামী সারোয়ার জাহানের চেহারাটা বার বার তার চোখে ভেসে উঠছে। আজ থেকে আটবছর আগে বলা সারোয়ার জাহানের কথা আজ সত্য হয়েছে।
সেদিন রাতে আফিফা গভীর কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিলেন। ফুঁপাতে ফুঁপাতে বলেছিলেন- শুনেছি অনেকে ড্রাগস নিতে নিতে মরে যায়। আমার ছেলেটা বাঁচবে তো?
সারোয়ার জাহান গভীর প্রত্যয়ের সাথে স্ত্রীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলেছিলেন, আমাদের পরিবারের বাতাসটা দূষিত না। আমরা চারজনের মধ্যে সুন্দর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। এটার কারণেই সে একদিন ফিরে আসবে। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে পারস্পরিক সুন্দর সহজাত সম্পর্ক পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী জিনিষ। এই শক্তির কাছে সব শক্তি পরাজিত।
গত তিনমাস সিলভি প্রতিদিন দুবেলা নিয়ম করে সৌরভের গালে ফ্ল্যাট স্যান্ডেলের বাড়ি মেরেছে। ইয়াবার নেশা সৌরভকে পুরোপুরি ছেড়ে গেছে। এই মাসের বেতন পেয়ে সৌরভ সিলভির জন্য খুব দামী নতুন একজোড়া ফ্ল্যাট স্যান্ডেল কিনে এনেছে!
মহিউদ্দিন খালেদ
২৩ জুলাই, দু’হাজার একুশ।