বিয়ের একমাস দশদিন পর ইফতি বুঝতে পারলো, বিয়ের প্রথম রাতেই সে কনসিভ করেছে।কয়েকদিন ধরে ইফতির শরীরটা অনেক খারাপ যাচ্ছিলো তাই আজকে স্বামী স্ত্রী দুজনেই ডাক্তারের কাছে যাওয়ার পর,এই খুশির খবরটা পেলো।
খুশির খবরটা যখন ফয়সাল তার মা কে জানালেন,উনি ফয়সালকে প্রশ্ন ছুড়লেন,
– বাচ্চাটা কি সত্যিই তোর?
মুহূর্তেই ফয়সালের সব খুশি হারিয়ে গেলো।মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার অবস্থা।ফয়সাল অগ্নিশর্মা হয়ে তার মা কে জিজ্ঞেস করলেন,
– মা এটা কেমন কথা!তুমি কি বলতে চাইছো ইফতির গর্ভের সন্তানের বাবা অন্য কেউ?
– তা নয়তো কি?বিয়ে হয়েছে দেড়মাস ও হয়নি,দেড়মাস হতে এখনও পাঁচদিন বাকি,এর মধ্যে কিভাবে তুই বাবা হতে পারিস?আমি চার সন্তানের মা,নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি এতো তাড়াতাড়ি কেউ মা হতে পারেনা।আমি নিশ্চিত এই বাচ্চা তোর না।কে জানে এই মেয়ের সাথে বিয়ের আগে কোন ছেলের সম্পর্ক ছিলো, যার পাপের বোঝা বয়ে বেড়াচ্ছে।
– মা তুমি ইফতির ব্যাপারে না জেনে এইসব কিভাবে বলছো?আমি তো ওর মধ্যে খারাপ কিছু দেখিনি।আমি ইফতিকে বিশ্বাস করি,ও কখনো এমন কিছু করেনি আমি শিওর।এটা তোমার ভুল ধারণা।
– বাবা এইসব বলে আমাকে বোঝাতে পারলেও,আত্মীয়স্বজন কে বোঝাতে পারবি তো?পারাপর্শিরা যখন কানাঘুষা করবে এইটা নিয়ে তখন তাদের মুখ বন্ধ করবি কি দিয়ে?
– মা বুঝতে পারছিনা,এখানে আত্মীয়স্বজন বা পারাপর্শির কথা উঠছে কেনো?আমাদের সন্তান পৃথিবীতে আসবে কি আসবেনা এটা কি বাইরের মানুষ ঠিক করবে?
– বাইরের মানুষ ঠিক করবে এটা তো বলিনি, কিন্তূ বাবা বোঝার চেষ্টা কর,আমরা বাইরের মানুষ ছাড়া একা একা চলতে পারিনা।বাইরের মানুষদের নিয়েই আমাদের সমাজ।তাই সমাজে মাথা উচু করে বাঁচতে হলে,সব দিক বিবেচনা করে চলতে হয়।
– মা,প্লিজ তুমি এই ব্যাপারে আর কোনো কথা বলবেনা।ইফতি শুনলে কি হবে বুঝতে পারছো? কতোটা কষ্ট পাবে ও?
– দুই দিন ধরে বিয়ে না করতেই বউএর কষ্টের কথা ভাবছিস,এইদিকে যে আমাদের মানসম্মান নিয়ে টানাটানি পরে যাবে সেটার কথা একবারও ভাবছিস না?
– মা,বিয়ের পর থেকেই লক্ষ্য করছি তুমি ইফতিকে পছন্দ করো না।ওকে তুমি পছন্দ না-ই করতে পারো,তাই বলে ওর সমন্ধে এমন কথা বলা তোমাকে মানায় না।আমি কি বিয়ে একা একা করেছি?তোমাদের পছন্দ মতোই করেছি তাও এতো কিসের রাগ তোমার?
– আমার পছন্দে নয়, তোর বাবা পছন্দে বিয়ে হয়েছে।আমার তো প্রথম থেকেই ওই মেয়ের প্রতি সন্দেহ ছিলো।মেয়েটা যে ভালো নয় সেটা আমি প্রথম দিনেই বুঝেছি।তাই বলছি বাবা ওই মেয়েকে বিশ্বাস করিস না,ও মিথ্যে বলছে।
ফয়সাল তার মায়ের কথার কোনো জবাব না দিয়ে,রাগে, ক্ষোভে ঘর থেকে বেরিয়ে বাইরে চলে যায়।
ইফতি আড়াল থেকে সবটা শুনতে পেলেও প্রতিবাদ করার সাহস হয়ে উঠেনি।কারণ এখনও যে ইফতি নতুন বউ।হাতের মেহেদীর রঙ এখনো মুছেনি।এইসময় যদি ইফতি শাশুড়ির সাথে তর্ক করে তাহলে
আশেপাশের সব মানুষ জড়ো হয়ে ইফটিকেই দোষারোপ করবে।গ্রামে কারো বাড়ীতে কিছু হলে পুরো গ্রামের মানুষ জেনে যায় তাই সবকিছু খুব ভেবেচিন্তে করা লাগে।তাছাড়া এমন একটা ব্যাপার মানুষ জানলে কতোটা লজ্জার হবে সবকিছু।এইসব ভেবেই চুপ হয়ে রইলো ইফতি।
তবে শাশুড়ি মায়ের এমন অপমানজনক কথা মেনেও নিতে পারছেনা।মনে মনে ঠিক করলো এই ব্যাপারে ফয়সাল কে যা বলার বলবো।
রাত বারোটা বাজে,ফয়সাল এখনও বাড়ীতে না ফেরায় ইফতি বেশ চিন্তিত হয়ে পড়লো।সেই বিকেলে যে শাশুড়ি মায়ের ঘর থেকে রাগ করে বেরিয়েছিলো তারপর আর ঘরে ফিরেনি ফয়সাল।বিয়ের পর এমনটা কখনো হয়নি।রাত দশটার আগে ফয়সাল অফিসের সব কাজ সেরে বাসায় চলে আসে।আর আজকে তো ছুটির দিন। ছুটির দিনে তো বিকেলে একটু বন্ধুবান্ধব এর সাথে আড্ডা দিয়ে বাসায় চলে আসে। অনেক বার ফোন দিয়েছে ফয়সাল কে ফোনটাও রিসিভ করছেনা।ইফতির মনে নানান চিন্তা ঘুরপাক খেতে লাগলো।কোনো কিছুই ভালো লাগছেনা।একদিকে শাশুড়ির বলা কথা গুলো কানে বাজছে,অন্যদিকে ফয়সালের দেরি করে বাসায় ফেরা একদমই মেনে নিতে পারছেনা।রাগে, কষ্টে দুমড়ে মুচড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছিলো। লাইট বন্ধ করে বিছানায় চুপ করে শুয়ে শুয়ে কান্না করছিলো।
কিছুক্ষন পর দরজার শব্দে ইফতি মাথা তুলে তাকাতেই ফয়সালকে দেখতে পায়।ইফতি রাগ করে কোনো কথা বললো না,মনে মনে ঠিক করলো কথা বলবে ও না।ঘুমের ভান করে শুয়ে রইলো।ইফতি জানে,এখন ফয়সাল ওর রাগ ভাঙ্গানোর অনেক চেষ্টা করবে,এমনই করে ফয়সাল।বিয়ের পর দুই একবার মনোমালিন্য হয়ে ছিলো দুজনার,তখন ইফতি রাগ করে থাকে আর ফয়সাল ইফতির রাগ ভাঙ্গানোর জন্য কাকুতি মিনতি করতে থাকে।ইফতি প্রথম একটু রেগে থাকলেও ফয়সালের এমন পাগলামি দেখে,আর রাগ করে থাকতে পারেনা।
কিন্তূ ফয়সালের ব্যাবহারে আজ বেশ অবাক হয় ইফতি।কোনো সাড়া শব্দ নেই,চুপ করে বিছানায় এসে অন্যদিকে মুখ করে শুয়ে পরলো ফয়সাল।এভাবে কিছুক্ষন যাওয়ার পর,ইফতি অধোর্য হয়ে লাইট জ্বালিয়ে ফয়সালের সামনে দাড়িয়ে প্রশ্ন করতে লাগলো,
– তুমিও কি তোমার মায়ের মতো সন্দেহ করছো আমায়?
– ফয়সাল কপাল থেকে হাতটা সরিয়ে,এক নজর ইফতির দিকে তাকিয়ে,আবার চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইলো।
– কি হলো,কথা বলছো না কেনো?আমি বিকেলে তোমাদের মা,ছেলের সব কথোপকথন শুনে ফেলেছি। তোমার মায়ের মনমানসিকতা এতোটা নিচ,ছিঃ কি নোংরা মনের মানুষ তোমার মা,তার মনে এমন কথা আসে কি করে?
– ইফতি চুপ করো,এই বিষয়ে আর একটা কথা ও বলতে চাইনা।
– কেনো কথা বলতে চাওনা,একজন মেয়েকে কিভাবে এমন কলঙ্ক দিতে পারে তোমার মা?
– ফয়সাল আবার ইফতির দিকে তাকালো,ও লক্ষ্য করলো শান্ত স্বভাবের মেয়েটা আজ অগ্নিশিখার মতো জ্বলছে।রাগে কষ্টে নিজেকে সামলাতে না পেরে অজস্র ধারায় কেঁদে যাচ্ছে। কিন্তূ নিজের মায়ের নামে এইসব শুনতে একদম ভালো লাগছে না ফয়সালের।
– তুমিও যদি তোমার মায়ের মতো আমাকে সন্দেহ করে থাকো তাহলে বলো,আমি সব ছেড়ে চলে যাবো।
– তোমাকে তো বললাম এই বিষয়ে আর কোনো কথা বলতে চাইনা।অনেক রাত হয়েছে শুয়ে পরো। সকালে উঠতে হবে অফিস আছে আমার।
– তুমি কথা বলতে না চাইলেই কি,সব কিছু বন্ধ হয়ে যাবে?কি ভাবো তোমরা নিজেকে?একদিকে তোমার মা আমাকে যা খুশি বলবে,অন্যদিকে তুমি বাড়ীতে দেরি করে ফিরবে।আমি আর এক মুহূর্তও এই বাড়ীতে থাকতে চাইনা। ইফতি ব্যাগ গোছাতে লাগলো,ফয়সাল ইফতিকে বললো,
– বাড়াবাড়ি করোনা,এখন কিন্তূ তোমার উপর হাত উঠে যাবে।
– হ্যা,এখন তো এটাই বাকি আছে তাইনা?তুলো হাত,তারপরও আমি আর এই বাড়ীতে থাকবোনা। ইফতি যখন ঘর থেকে ব্যাগ নিয়ে বের হতে নিলো,ফয়সাল রাগ সামলাতে না পেরে ইফতির গালে চর বসিয়ে দিলো।
– রাত একটা বাজে,এইসময় তুমি বাসা থেকে বেরিয়ে যাচ্ছো?এতো সাহস তোমার? তোমার যদি যেতেই হয় সকালে যাবে।এই বলে ফয়সাল দরজা লক করে শুয়ে পরলো।ইফতি বিছানার এক পাশে বসে কাদতেঁ লাগলো।
সকালে ফয়সালের ঘুম ভাঙতেই দেখলো ইফতি বসে বসে ঘুমাচ্ছে।
চলবে…
#খুন
পর্ব ১