#খুন পর্ব ৩
ফয়সালের মুখে এমন কথা শুনে,ইফতি হতভম্ভ হয়ে গেলো।এই কি সেই,যে কাল রাতেও এত্তো এত্তো মিষ্টি কথা বলছিলো।ভালোবাসি বলে জড়িয়ে ধরেছিলো।তাহলে কি ধরে নিবো কিছুই ওর ভালোবাসা ছিলো না,শারীরিক চাহিদা ছিলো মাত্র।যাকে ভালোবাসা বলে চালিয়ে দিয়েছে।
হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠলো,স্ক্রিনে চোখ পড়তেই মা লেখা ভেসে উঠলো।ইফতি একটু কাশি দিয়ে গলা ঝেড়ে খুব স্বাভাবিক ভাবে কথা বলতে লাগলো,
– হ্যালো,মা?
– কিরে তুই নাকি তোর জা’য়ের সাথে ঝগড়া করেছিস?
– তোমাকে কে বললো?
– তোর শাশুড়ি মা ফোন করেছিলো।
– শুধু এটাই বলেছে,আর কিছু বলেনি?
– বলেছে তুই নাকি মা হবি।
– ইফতি কেঁদে দিয়ে বলতে লাগলো,কিভাবে মা হবো,ওরা তো আমার বাচ্চার কথা শুনতেই পারছেনা।এমনকি আমার উপর সন্দেহ করছে।আমি এসব কিভাবে মেনে নিবো মা বলতে পারো?
– ওরা যখন বাচ্চাটা চায়না,আমিও বলি এই বাচ্চার কোনো দরকার নেই।তুই না হয়…
– মা তুমিও?অবশ্য তোমাকে কি বলবো,বাচ্চার বাবা ই যখন বাচ্চাটা চায়না।
– তোর শাশুড়ি তোর বাবাকে ফোন দিয়ে তোকে আমাদের কাছে এনে রাখতে বলেছে।
– বাড়ী থেকে বের করে দিচ্ছে?
– তুই তো জানিস তোর বাবা কেমন বদমেজাজি,তোর শাশুড়ি ফোন করার পর থেকে আমাকে বকে যাচ্ছে।বলছে আমি নাকি তোকে সঠিক শিক্ষা দিতে পারিনি।
– আচ্ছা মা,তুমি বাবাকে পাঠিয়ে দাও।আমি বাবাকে সবটা বুঝিয়ে বলবো।
– কিন্তূ তুই ফয়সালের কাছে একবার জিজ্ঞেস করে নিতি,তারপর না হয় পাঠাই?
– মা,যতটুকু বুঝেছি ফয়সাল ওর পরিবারের লোকজন যা বলবে তাই করবে।তুমিকি এখানে ফয়সালের ভিন্নমত আশা করছো?যদি তাই করে থাকো তাহলে বলবো ভুল ভাবছো।ওর মা যখন বলে দিয়েছে ফয়সাল তাতে কোনো দ্বিমত করবেনা।তবে আমিও সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছি,আমিও বুঝে গেছি আমার কি করতে হবে।
*****
রাত ৯ টায় ফয়সালের হোয়াটসঅ্যাপ এ,ইফতির নাম্বার থেকে একটা মেসেজ এলো।মেসেজটা সিন করতেই ফয়সালের দম বন্ধ হয়ে আসছিলো। মেসেজে ছোট্ট করে লিখা,
আমি তোমার কথা মতো এবরশন করিয়ে ফেলেছি,আশা করি এখন আর কোনো সমস্যা হবে না।
মেসেজটা পাওয়ার পর অনেকবার ইফতির নাম্বারে ফোন দিলো ফয়সাল কিন্তূ বার বার ফোন বন্ধ বলছে।ফয়সাল ভাবতেও পারেনি ইফতি এমনটা করবে।গতকাল ও তো রাগের মাথায় গায়ে হাত তোলার পর যখন ব্যাগ গুছিয়ে বাড়ীতে চলে যেতে চাইছিলো ইফতি, কিন্তূ তারপর সকাল অবধি ও যায়নি, ফয়সাল ভেবেছিলো আজও সবটা ভুলে যাবে।এমন কিছু হবে কল্পনাও করেনি ফয়সাল।
নিজের বলা কথার উপর খুব আফসোস হচ্ছে তার।
অফিস ছুটি কিন্তূ কিছুতেই বাড়ীতে যেতে ইচ্ছে করছেনা।এই মুখ নিয়ে কিভাবে ইফতির সামনে দারাবে।
বাড়ীতে ঢুকে ফয়সাল চুপচাপ নিজের ঘরে ঢুকে পরলো।ঘরটা অন্ধকার দেখে ভাবলো ইফতি বোধহয় লাইট নিবিয়ে শুয়ে আছে।লাইট জ্বালানো সাহস হচ্ছিলো না তার।কিছুক্ষন মূর্তির মতো দাড়িয়ে থেকে লাইট টা জ্বালালো কিন্তূ ইফতিকে কোথাও দেখতে না পেয়ে বেশ অবাক হলো।রান্না ঘরে কাজ করছে না তো?
রান্না ঘরে ও খুঁজে যখন ইফতিকে পেলোনা ,ফয়সাল তার ভাবীকে জিজ্ঞেস করলো,
– ইফতি কোথায়?ও কে তো দেখছিনা?
– ওর বাবা এসে নিয়ে গেছে।কেনো তোমাকে বলে যায়নি?
– ওর বাবা হঠাৎ কেনো আমাদের বাড়ীতে আসলেন,কে আসতে বলেছে?
– মা, ওনাকে ফোন করে আসতে বলেছিলেন।ইফতিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য।
ফয়সাল এবার নিজেকে আর নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলো না।মা,মা করে চিৎকার করে ডাকতে লাগলো।ফয়সালের ডাক শুনে তার মা ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। সাথে পরিবারের অন্য সদস্যরাও।
– কি হয়েছে এভাবে চিল্লাছিশ কেনো?
– তোমাদের ইচ্ছে পূরণ হয়েছে সেটাই জানাতে ডেকেছি।
– কিসের ইচ্ছে?
– ইফতি বাচ্চাটা নষ্ট করে ফেলেছে।
– এমন ভাবে বলছিস যেনো আমি বলেছি তোর বৌকে বাচ্চা নষ্ট করতে।
– নষ্ট করতে বলোনি, কিন্তূ বাধ্য করেছো।নিজে বলোনি ভাবিকে দিয়ে বলিয়েছো।
– ভাবি পাশ থেকে বললো,আমরা যতোই বলিনা কেনো তোমার বউ তোমার অনুমতি ছাড়া কিভাবে এটা করতে পারে?
– অনুমতি! হ্যা আমিই ও কে অনুমতি দিয়েছি,সকালে যাওয়ার সময় বলে গিয়েছিলাম,আমিও বাচ্চাটা চাইনা।সংসারে এতো ঝামেলা আর ভালো লাগেনা।ইফতি সেটাকেই অনুমতি ধরে নিয়েছে।অনুমতির জন্য কি এই কথাটাই যথেষ্ট নয়?
– তাহলে এর দোষ আমাদের উপর চাপাচ্ছো কেনো,নিজের বলা কথার দায়ভার নিজে নিতে শেখো,অন্যকে দোষারোপ করোনা।
– অন্যকে যদি দোষারোপ করারই হতো তাহলে সকালে ওই কথা বলার জন্য আমি তোমাকে দোষ দিতাম,ইফতিকে কথা শুনাতাম না।মায়ের কথা গুলো মনে চেপে রেখে ইফতির সাথে ঝগড়াও করতাম না।আমি তোমাদের কথার প্রতিবাদ করতেই পারতাম, কিন্তূ আমি ইফতির সামনে তোমাদের ছোটো করতে চাইনি।কারণ আমি তোমাদের ছোটো করলে ইফতি ও তোমাদের ছোটো করে দেখবে।সেই ভাবনা থেকেই চুপ করে ছিলাম। আমি জীবনে কখনো মা,বাবার সাথে বেয়াদবি করিনি।ভাইয়ের সাথেও না।আপনি এতোদিন ধরে এই বাড়ীতে আছেন কখনো বলতে পারবেন আপনার সাথে কোনো কিছু নিয়ে কখনো কোনো ঝামেলা করেছি? আমিতো সব সময় একজন আদর্শ সন্তান,আদর্শ মানুষ হতে চেয়েছিলাম।
– ফয়সালের মা বললো,তুই তো একজন আদর্শ সন্তান ই,আমি কি কখনো এই বিষয়ে তোকে অভিযোগ করেছি?
– মা,আমি আদর্শ সন্তান হতে পারলেও,আদর্শ স্বামী হতে পারলাম না।আদর্শ বাবা হতে পারলাম না।নিজের অনাগত সন্তানকে পৃথিবীর মুখ দেখার আগেই মেরে ফেলেছি।
– আচ্ছা বাবা যা হওয়ার হয়েছে,এইসব নিয়ে আর কষ্ট পাসনা ।তোদের তো মাত্র বিয়ে হয়েছে,দোয়া করি ভবিষ্যতে অনেক বাচ্চার মুখ দেখবি তোরা।কালকে ওই বাড়ীতে গিয়ে বউকে নিয়ে আসবি।
– কিন্তূ মা,এই মুখ নিয়ে আমি কিভাবে ইফতির সামনে দারাবো বলতে পারো?
– আচ্ছা আমি তোর বাবাকে পাঠিয়ে বৌকে নিয়ে আসবো।
ফয়সাল আর কোনো কথা না বলে,নিজের ঘরে চলে গেলো।
নিজের ঘরে এসে এক অতভূত শূন্যতা অনুভব করলো ফয়সাল,ইফতির শূন্যতা। বুকের ভিতরে কষ্টের ঝড় বয়ে যাচ্ছে,খুব ইচ্ছে করছে কাদতেঁ কিন্তূ কাঁদতেও পারছেনা।বুকের ভেতর কষ্ট গুলো জমা হয়ে পাথরের মতো ভারী হয়ে আসছে।নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে। এই অবস্থায় ফয়সাল আর ঘরে বসে থাকতে পারলো না।রাত ১১ টা বাজে, ইফতিদের বাড়ীর উদ্দেশে রওনা দিলো।ঘন্টাখানিক পর সেখানে পৌছে গেলো।দরজায় কলিংবেল দিতেই শাশুড়ি এসে দরজা খুললেন।
– বাবা তুমি এতো রাতে?ভেতরে এসো।
– আম্মা,ইফতি কোথায়?
– ওই ঘরে শুয়ে আছে।তুমি খেয়েছো বাবা?
– না।
– তাহলে তুমি ঘরে যাও,আমি তোমার জন্য খাবার তৈরি করছি। এই বলে ইফতির মা রান্না ঘরে চলে গেলেন।
ইফতি ফয়সালের গলার আওয়াজ পেয়েই দ্রুত বিছানা ছেড়ে উঠে ভেতর থেকে দরজার ছিটকিনি আটকিয়ে দিলো ।ফয়সাল দরজায় আস্তে আস্তে ধাক্কাচ্ছে আর ইফতিকে ডাকছে।
– ইফতি দরজাটা খোল।কি হলো ইফতি?
কিন্তূ ভেতর থেকে কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে ঠায় দাড়িয়ে রইলো। ইফতির মা রান্না ঘর থেকে আবার ফিরে এসে দেখলো,ফয়সাল দরজার সামনে দাড়িয়ে আছে।
– কি হলো বাবা,দাড়িয়ে আছো কেনো?
– মনে হয় ইফতি ঘুমিয়ে পড়েছে।
– আমিতো মাত্রই ও কে ওষুধ খাইয়ে কলিংবেল এর শব্দ শুনে ঘর থেকে বের হলাম,এর মধ্যেই ঘুমিয়ে গেলো।আচ্ছা দাঁড়াও আমি ও কে ডেকে দিচ্ছি।
– ইফতি মা,জামাই এসেছে দরজা খুল।
– মা ও কে চলে যেতে বলো।
– এমন পাগলামি করেনা মা,দরজা খোল।ভেতর থেকে আর কোনো সাড়াশব্দ নেই।তরকারির পোড়ার কথা বলে,ইফতির মা ওখান থেকে চলে আসলেন।তিনি ভাবলেন ওদেরকে একা ছেড়ে দেওয়াই বোধহয় ভালো হবে।
ফয়সালের ও বুঝতে বাকি রইলো না,ইফতি ভেতর থেকে ছিটকিনি লাগিয়ে রেখেছে।ফয়সাল আবার ইফতিকে ডাকতে লাগলো,
– ইফতি প্লিজ একটাবার দরজা টা খোল,তোমার সাথে কথা আছে।
– কিন্তূ কোনো সাড়াশব্দ নেই।তবে দরজার এপাশে একটা ছায়া খেয়াল করলো,ছায়ার কারণে ফয়সাল বুঝতে পারলো ইফতি দরজার পাশেই বসে আছে।
– ইফতি আমি জানি তুমি আমার কথা শুনছো, কিন্তূ জবাব দিচ্ছো না।ইফতি কেনো তুমি এমনটা করলে? আমিতো এমনটা চাইনি।আমার রাগের মাথায় বলা কথা গুলো এতো সিরিয়াসলি নিবে বুঝতে পারলে,কখনোই এইসব বলতাম না।আমি জানি আমি অনেক বড়ো অপরাধ করেছি,ক্ষমার অযোগ্য।তবুও আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাইছি,প্লিজ আমাকে ক্ষমা করো।তুমি এভাবে আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলে,আমি কোথায় যাবো?তুমিকি ভাবছো আমার কষ্ট হচ্ছেনা?আমারও অনেক কষ্ট হচ্ছে, কিন্তূ এই কষ্ট কাওকে বোঝাতে পারছিনা।
– দরজার ওপাশ থেকে চিৎকার করে কান্নার শব্দ ভেসে আসছিলো।ইফতি চিৎকার করে কাঁদছে।
– এর আগে কোনদিন নিজেকে এতোটা অসহায় মনে হয় নি। ইফতি তোমার কষ্ট হলে কান্না করে হালকা হতে পারো, কিন্তূ আমি এতোটাই অভাগা যে,কষ্ট হলেও কাঁদতে পারিনা।প্লিজ ইফতি একটু দরজাটা খোলো,আমি তোমাকে এক নজর দেখেই চলে যাবো।
ফয়সালের এতো অনুরোধেও ইফতির মনে একটুও সহানুভূতির জন্ম নেয়নি।ফয়সাল অনেকক্ষন অপেক্ষা করলো, কিন্তূ ইফতি শেষ পর্যন্ত দরজা খুল্যই না।
ফয়সাল আর অপেক্ষা না করে দরজা খুলে বেরিয়ে যাচ্ছে,শাশুড়ি পেছন থেকে ডেকে বললো,
– চলে যাচ্ছো বাবা?রাত টা নাহয় এখানেই থেকে যেতে?
– না,চলে যেতে হবে।
– অন্তত ভাত খেয়ে তো যাও,আমি তোমার জন্য রান্না করেছি।
– অন্যদিন খাবো।আজকে আসি।
– ইফতির মা,ফয়সাল কে আর কিছু বলার মতো খুঁজে পেলোনা।এই সময় আসলে কি বলা উচিত উনি বুঝতে পারছেন না।তাই চুপ করে দাড়িয়ে থেকে ফয়সালের চলে যাওয়া দেখছিলো।
চলবে…
সকল পাঠ নোটিফিকেশন পেতে পেজে ফলো দিন