কাকলি মারা যাওয়ার মাস খানেক পরও আমি তার মেসেজ চেক করি নি। যেদিন সে আত্মহত্যা করেছিল সেদিনও সে আমাকে মেসেজ দেয়। যা আমি “তার মেসেজ কোনো দিন পড়ব না” বলে ইগ্নোর করে ফেলে রেখেছিলাম।
চাইলে মেসেজটি এখন পড়ে ফেলতে পারি। জানতে পারি মৃত্যুর আগে সে আমাকে কী জানাতে চেয়েছিল? কিন্তু আমি এখনো মেসেজটি পড়ছি না।
এখনও যে অভিমানের বশে পড়ছি না তা নয়। এখন পড়ছি না কারণ এক ধরণের বিষণ্ণতা আচ্ছন্ন করে রেখেছে আমাকে। মনে হচ্ছে এটাই কাকলির দেওয়া শেষ কিছু আমার জন্য। যা একবার পড়ে ফেললেই হারিয়ে যাবে। এটা এমনই শেষ যার পর আমি দেয়ালে মাথা আছড়ে মরে গেলেও আর কিছুই ফেরত পাব না।
দীর্ঘ ১৩ বছর পর সে আমার সাথে যোগাযোগ করতে চেয়েছিল। দীর্ঘ ১৩ বছর পর আমার জীবনের সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত মানুষটি আমাকে কিছু বলতে চেয়েছিল। আমি শুনি নি।অবহেলা করেছি। যে অবহেলা সে আমাকে করেছিল একদিন। প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিলাম হয়ত।
কিন্তু হায়! সে বরাবরই এসব ক্ষেত্রে জয়ী। এবারো আমাকে হারিয়ে নিজে জয়ী হয়ে গেলো ।
কাকলি, আমার কাকলি! যে ছিল আমার বাল্য প্রেম, আমার একমাত্র সুতীব্র ভালোবাসা, আমার জীবনের সবচেয়ে পরম পাওয়া যে আমাকে বিনা কোন অপরাধে , কিছু না জানিয়ে, না বলে আরেকজনের বউ হয়ে গিয়েছিল।
এখনো সেই দিনের তীক্ষ্ণ যন্ত্রণা অনুভব করতে পারি। এখনো চোখের সামনে দেখতে পাই কাকলিকে বিয়ের সাজে, লাল জামদানিতে , গাঢ় কাজলে, লাল টিপে, হাতভর্তি লাল চুড়িতে, কপাল ঢাকা সোনালি ঘোমটাতে, আর পাশে বসা একজন অচেনাকে।
আমি স্থির পায়ে দাঁড়িয়ে তার বিয়ের যাবতীয় সকল কার্যক্রম দেখেছি। দেখেছি তার একটা নীল কাগজে সই করা, তার মাথা নিচু করে কবুল বলা, দেখেছি তার দুহাত দিয়ে মালা পরিয়ে দেওয়া সেই অচেনাকে। যে হাত নিয়ে আমি সারাক্ষণ খেলা করতাম, যখনই যে কাছে আসত। যে হাত মুখের কাছে নিয়ে আমি গন্ধ শুকতাম। মনে হত লেবু পাতার গন্ধ পাচ্ছি। তাকে একদিন জিজ্ঞেসও করেছিলাম “তোমার হাত থেকে লেবু পাতার গন্ধ করে কেন সব সময়?”
“তোমার কাছে আসার আগে লেবু পাতা ধরে আসি তাই”
“কেন, লেবু পাতা ধরে আস কেন?”
“কারণ আমার বারান্দায় লেবু গাছ আছে। তুমি যখন বাসার সামনের গলি দিয়ে আস, আমি বারান্দা দিয়ে দেখতে পাই। তোমার সেই আসার দৃশ্য দেখার সময় নিজের অজান্তেই একটা লেবু পাতা ছিঁড়ে ফেলি গাছ থেকে”
শুনে আমি আবারও দু হাত মুঠো করে কাকলির হাত নেই, আবারো গন্ধ শুকি।
এখন মনে হয়, কতশত বার আমি গিয়েছি কাকলির কাছে। কতশত বার সে লেবু পাতা ছিঁড়েছে।
কতশত বার ঐ লেবু গাছ আমাদের অভিশাপ দিয়েছে।
সেই অভিশাপের জন্যই কি কাকলি আমার হয় নি?
আমাকে কাকলির পরিবার মেনে নেয় নি কোনো অবস্থাতেই।
কাকলি ছিল তার বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। সেই একমাত্র সন্তানকে তারা তাদের ইচ্ছে মত কাউকে দিতে চেয়েছিল। তখন আমি ছিলাম মাত্র কলেজ পাশ বেকার। আমার কাছে কারো মেয়ে দেওয়ার কথাও না।
চাকরি খুঁজতে আমি ঢাকা আসি। মাসে মাসে বাড়ি যাই, বাড়ি গিয়েই ছুটে যাই কাকলির কাছে। দেখতে পাই কাকলি মলিন থেকে মলিনতর হচ্ছে। চোখের নিচে কাজলের জায়গায় দুশ্চিন্তার কালি জায়গা করে নিয়েছে।
এবং একদিন কথা মত দেখা করতে গিয়ে দেখি সে আসে নি। সেই কলেজের পেছনে পুকুরপাড়ে যেখানে সে এসে আমাকে উজ্জীবিত করে তুলত তার উপস্থিতে সেখানে সে নেই।
বুকটা যে আমার সেদিন থেকেই খালি হয়ে যাবে সে ভাবতেও পারি নি।
সেদিন আসে নি তার পরের দিন আসবে ভেবে আমি ফিরে আসি।
রাতে নির্ঘুম জেগে থেকে ভাবতে থাকি, মানে নিজেকে বুঝাতে থাকি সে আসবে কালকে। না এসে কি পারবে থাকতে?
সে আসে নি তার পরের দিনও। আমি তার বাড়ির আশেপাশে ঘুর ঘুর করতে থাকি যদি তাকে দেখতে পাই এই আশায়।
সারাদিন বাড়ির আশেপাশে ঘুরেও কাকলির দেখা পাই নি। পাই নি তার লেবু পাতা মাখা হাতের স্পর্শ।
আমি চোখে অন্ধকার দেখতে থাকি। কাকলির হাতের লেবু পাতার গন্ধ নেওয়ার জন্য ব্যাকুল হতে থাকি। ভেতরে ভেতরে ভাঙতে থাকি। তীব্র দহনে শরীর মন পুড়তে থাকে।
একদিন খবর আসে কাকলির বিয়ে।
শুনেই ভেতরটা আমার জড়পদার্থ হয়ে যায়। কোনো কিছু অনুভব করার ক্ষমতাও আমি হারিয়ে ফেলি।
আমার মাথায় শুধু একটাই কথা ঘুরতে থাকে , একটা চিঠিও কি সে দিতে পারে নি? একবার বলতেও পারে নি তার বিয়ের কথা?
খবরটি আমাকে তার বান্ধবীই দেয়। তাকে জিজ্ঞেস করি “কাকলি কি আমার কথা কিছু জিজ্ঞেস করে নি? কিছু বলে নি আমাকে বলার জন্য?”
বান্ধবী নত মাথায় জবাব দেয় “না”
আমি যেন মাটির সাথে মিশে যাই।
সেদিন সারারাত রাস্তায় রাস্তায় হেঁটেছি। ভেতরটা আমার চিৎকারে ফেটে যাচ্ছিল কিন্তু মুখে আমি নির্বাক ছিলাম।
শূন্যতা কাকে বলে তার অস্তিত্ব টের পেয়েছিলাম সেদিন। বুকের হাহাকারে আমি বিধ্বস্ত হয়ে রাস্তায় লুটিয়ে পড়ি।
না, কাকলিকে আর ফিরে পাবার কোনো আগ্রহ ইচ্ছে চাহিদা জাগে নি।
শুধু একবার তাকে সরাসরি জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করেছিল,
“একটা বার আমাকে জানান গেলো না? একটা বার আমাকে বলতে পারলে না “চল ,পালিয়ে যাই এখান থেকে। দীর্ঘ ২ মাসে কি একবারও সুযোগ হয় নি আমাকে একটু জানানোর ? এও কি বিশ্বাসযোগ্য কাকলি?”
সবকিছু মলিন হয়। ভালোবাসাও মলিন হয়ে যায়। নক্ষত্র অবশ্যই মরে যায়।
১৩ বছরে আমার বিয়ে হয়, দুটো দেবশিশু জন্ম নেয়। অফিসের উচ্চপদে আসীন হই। বাড়ি হয়, সম্পত্তি হয় যা যা কাকলির বাবার চাহিদা ছিল সবই হয়।
সুখী মানুষ বলতে যা বুঝায় তা আমি ছিলাম নিঃসন্দেহে। আমার স্ত্রীকে আমি ভালবাসি, আমার সন্তান দুটো আমার জীবন। আমার কোনো ইচ্ছে অপূরণীয় ছিল না।তবে অতৃপ্তি ছিল। ছিল বলেই সেই প্রশ্নটা বুকের ভেতর কোথাও নীরবে বড় হতে থাকে। বড় হয়ে প্রকাশ্যে আসে যখন আমি মেসেঞ্জারে অজানা কারো প্রোফাইল থেকে মেসেজ পাই ।
“কেমন আছো ?আমাকে চিনতে পেরেছো? আমি কাকলি।”
নামটা পড়েই আমার সর্বাঙ্গ যেন জ্বলে গেল। তীব্র আক্রোশে মোবাইলটা ছুড়ে মারতে চাইলাম। অদৃশ্য কারো প্রতি সমস্ত ক্রোধ, রাগ, হিংসা উথলে ফেলতে চাইলাম।
অকল্পনীয় রাগে আমি থরথর করে কাঁপতে থাকি। কাকলির প্রতি যে আমার এত রাগ জমে আছে সেটা সেদিনই বুঝতে পারি।
কখনই সিন করি নি ওই প্রোফাইলের মেসেজ। শুধু দেখতে পেতাম প্রতিদিন মেসেজ আসছে।
জমতে থাকে। যেভাবে আগে তার চিঠি জমত আমার পড়ার টেবিলের ড্রয়ারের ভেতর।
মেসেজ দেওয়ার পর্ব চলতে থাকে প্রায় এক মাস ধরে।
এই এক মাস আমি এক অমানবিক আনন্দে ভাসতে থাকি। কাউকে অবজ্ঞা করার মধ্যেও আনন্দ আছে সুখ আছে তৃপ্তি আছে সে আমি ধীরে ধীরে বুঝতে পারি। সেই সুখকে পৈশাচিক সুখ বলে সেটি বুঝতে আমার দেরি হয়ে যায়।
এরপর মেসেজ আসে না। আমার ঠোটের কোণে একটা বক্র হাসি উঁকি দেয় । বাহ! এত অল্পেই হেরে গেলে কাকলি?
অদৃশ্য রাগ জমতে জমতে কবে যে দানবের আকার ধারণ করেছে সেও বুঝতে পারি নি।
দানবটির মৃত্যু ঘটে যখন আমি বাড়ি যাই পরিবার নিয়ে। বেড়াতে, শীতের ছুটিতে।
গিয়ে যখন আমি বাজারে যাই আড্ডা দিতে, তখন কেউ একজন আমাকে বলে “কাকলি তো মরি গেছে বদ্দা”
আমি কথাটি আক্ষরিক অর্থেই শুনতে পারি নি। জিজ্ঞেস করি “কে মারা গেছে?”
“কাকলি, মনে নাই? তোঁর লগে স্কুলে আছিল”
আমি বুঝতে পারি কিছুটা। কিন্তু তখনও পুরোটা নয়।
“গেল হপ্তায় গলায় হাস দি মরি গেছে”
গলায় কী দিয়েছে? যেন আমি বুঝতে পারি নি। যেন আমি বুঝেও না বুঝার ভান করছি। যেন আমি এসব শব্দের মানে বুঝি না। যেন আমি এসব শব্দ শোনার জন্য জন্ম নেই নি।
“হাস, হাস। আরে গলাত দড়ি দিছে দড়ি”
আরও স্পষ্ট করে বলতে যাচ্ছিল লোকটা। আমি উঠে দাঁড়াই তড়িৎ বেগে। সবাই ফ্যাল ফ্যাল করে তাকায় আমার দিকে।
আমি সেদিকে ভ্রূক্ষেপ না করেই হাঁটা দেই। সন্ধ্যা হয়ে আসে ধীরে ধীরে। গ্রামের শীতের কুয়াশাচ্ছন্ন অগ্রিম সন্ধ্যা।
সেই সন্ধ্যায় হাঁটতে হাঁটতে আমি কাকলিদের বাড়ির পেছনে চলে আসি। আমাকে কেউ বলে দেয় নি। কিন্তু মনে হয় কেউ যেন বলেছে যে এখানেই কাকলি থাকতে পারে।
এবং সে ছিল সেখানে। মাটির অনেক আস্তরণের ভেতরে। লাশ হয়ে ।
সন্ধ্যার আলোতে তার কবর দেখা যাচ্ছিলনা স্পষ্ট। কিন্তু আমি স্পষ্ট তার নাম পড়তে পারছিলাম,
“কাকলি আক্তার। জন্ম ৫ নভেম্বর ১৯৭৬। মৃত্যু ২৯ ডিসেম্বর ২০১২”
বুকটা ধক করে উঠে। ২৯ ডিসেম্বর থেকেই সে আমাকে মেসেজ দেওয়া বন্ধ করে।
আমি কম্পিত হাতে মোবাইল বের করি। তার মেসেজ পড়তে চাই। তার শেষ মেসেজ।
কিন্তু আমি পারি না পড়তে। হাঁটু গেড়ে বসে পড়ি কাকলির কবরের পাশে।
বুকে তীব্র যন্ত্রণা আর মাথায় তীক্ষ্ণ ব্যথা নিয়ে আমি ফিরে আসি চিরচেনা জগতে। দিন যায় কিন্তু কাকলির মেসেজ পড়া হয় না। পড়তে আমার ভয় লাগে। এটাই শেষ অংশ কাকলির। এটা একবার পড়া হয়ে গেলে আর কিছুই নতুন থাকবে না তার। আর কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না।
কিন্তু এই অবশিষ্ট অংশকে বহন করতে করতে একসময় আমি ক্লান্ত হই। এবং সেই ক্ষণ আসে যখন আমি তার শেষ অংশ পড়তে শুরু করি ।
– হাই, আমি কাকলি। চিনতে পারছ?
– চিনতে পারার কথা না অবশ্য। বহু বছর আগের আমি।
– মেসেজ দেখছ না মনে হয়। ইচ্ছে করে দেখছ না নাকি আসলেই খেয়াল করছ না?
– শোনো তোমাকে কিছু বলতে চাই আমি। একবার মেসেজ দেখবে?
– মামুন, একবার মেসেজ দেখো। আমি জানি তোমার বউ বাচ্চা আছে। আমারও আছে জানো তো। দুটো মেয়ে। তোমারও শুনেছি দুইটি ছেলেমেয়ে।
– মামুন প্লিজ,একবার কিছু বলো। মেসেজ দেখো। তোমাকে মেসেঞ্জারে কলও দিয়েছি। সত্যি অবহেলা করছো?
– রেগে আছো আমার উপর? রাগ করাই স্বাভাবিক। তোমাকে না বলে তোমার থেকে দূরে সরে গেছি। তোমাকে না বলে বিয়েও করে ফেলেছি। একবার কি আমার কথা শুনবে?
– শুধু একবার শুনো আমার কথা। এরপর আর কোনোদিন তোমাকে বিরক্ত করব না।
– তোমার সাথে আমি অন্যায় করেছি অনেক। কিন্তু বিশ্বাস করো, আমার কোনো উপায় ছিল না তোমাকে জানানোর যে আমার বিয়ে ঠিক হয়ে যাচ্ছে। ২৪ ঘণ্টা আমার সাথে কেউ না কেউ থাকত যাতে আমি তোমার সাথে যোগাযোগ করতে না পারি। তোমাকে চিঠিও লিখতে না পারি।
– মামুন,আমি ক্লান্ত। ১৩ বছর আমি তোমাকে ছেড়ে থাকতে থাকতে ক্লান্ত। ভাবছ, এতবছর পর কেন আবার পুরাতন স্মৃতি নিয়ে টানছি? তোমার কাছে হয়ত পুরাতন কিন্তু আমার কাছে এখনো সেই লেবু পাতার ঘ্রাণের মত তরতাজা।
আমি এখনো তোমাকে ভালবাসি। এই ভালোবাসা আমাকে সুখী হতে দিলোনা মামুন। আমার স্বামীটি আমাকে ভালই বাসে। কিন্তু আমি শুধু সংসার করে গেছি। ভাল তাকে বাসতে পারি নি। শুরুতে অনেক কষ্ট হলেও মনে করেছি ধীরে ধীরে ভুলে যাব তোমাকে। কিন্তু যত দিন গড়াচ্ছিল তত তুমি আমার মননে স্বপনে অস্তিত্বে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে যাচ্ছিলে। এই জড়িয়ে যাওয়া আমি মেনে নিতে পারছি না আর। প্রতিদিন আমি আমার স্বামী সন্তানকে ঠকাচ্ছি। আমি ঘর করছি তার সাথে কিন্তু ভাল বাসছি তোমাকে। আমি থাকছি তার সাথে কিন্তু অপেক্ষা করি তোমার।
এই দ্বৈত জীবন বাঁচতে বাঁচতে আমি ক্লান্ত মামুন। ভীষণ ক্লান্ত। আর পারছি না।
এই অসীম জ্বালা আমাকে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। কিন্তু যাওয়ার আগে আমি তোমাকে শেষবারের মতো দেখতে চাই। শেষবারের মত একবার তোমাকে বলতে চাই, আমি তোমাকেই ভালবাসি। ভীষণ ভালোবাসি।
আমার এই অপারগতার জন্য আমায় ক্ষমা করো মামুন। আমায় ক্ষমা করো।
আমি যাচ্ছি। ভাল থেকো। মনে রেখো।
—————–
#লেবু_পাতার_অভিশাপ
ফারজানা নীলা