কুরবানী ঈদের স্মৃতি
কুরবানী ঈদের স্মৃতি দেশে থাকতে ছিল এক রকম, বিদেশে একদম আরেক রকম। আমার কাছে বিদেশের ঈদকে কোনো ঈদ মনেই হয় না।
অনেকে ফার্মে যেয়ে কুরবানী করেন। তবে মূলত এখানে গ্রোসারি তে ঈদের অর্ডার দিতে হয়। এটা আমার মনে হয় বাজার থেকে গোস্ত কিনে এনে খাওয়া, কখনো একা , কখনো বন্ধুদের নিয়ে, তেমন ঈদের আমেজ থাকে না এতে । কোরবানীর পশুর দেখাই তো মেলে না । সারা বছরই তো মাংস কিনে খাওয়া যায়, ঈদে সেটা আর মন চায় না । তাই একবার দিয়েছিলাম, তারপর আমেরিকায় আমরা কোরবানি দেই না। দেশে কুরবানীর ব্যবস্থা করে ফেলি।
আমি তেমন গরু, খাসি খেতেও চাই না। এতো গোস্ত বিতরন করাও একটা সমস্যা হয়ে যায়। সব মাংস নিজে খাওয়াতো নিয়ম নয়।
আজকে এই দেশের কুরবানীর একটা গল্প বলি।
বেশ কয়েক বছর আগের গল্প। কোরবানির সাতদিন পরে আমি গেছি গ্রোসারি করতে।
– আপা, কেমন আছেন ?
– ভালো , আলহামদুলিল্লাহ। ভাই আজকে কোনো তাজা মাছ এসেছে ?
– জি না আপা। ঈদের সময় তো কেও মাছ খেতে চায় না। আপা, আপনি এবার কুরবানী দিয়েছেন ?
– জি না ভাই। তাহলে শুধু সবজি নিয়ে যাই।
– আপা, আপনি কি গরীব ?
আমি দোকানদারের কাছ থেকে এই ধরণের প্রশ্ন আশা করি নাই। আমি কি খুব সাধারণ কাপড় পড়ে দোকানে এসেছি তাই আমাকে গরীবের মতো লাগছে ? আমি বেশ রাগ হয়ে গেলেও হাসতে পারি। নিউইয়র্কে দোকানদারি করছেন বাংলাদেশী ভদ্রলোক, তার সাথে খারাপ ভাবে কথা বলা সমীচীন না। আমি হেসেই বললাম
– ভাই, একথা কেন বললেন বলেন তো ?
– আপা, কিছু মনে নিয়েন না। ভার্জিনিয়ায় একজন বাংলাদেশী ডাক্তার থাকেন, আমাদের কাস্টমার। তিনি ঈদের অনেক আগে, ফোনে একটা গরু গোটাটাই কুরবানীর জন্য অর্ডার দিয়েছেন। বলেছেন কোরবানির পরে এসে মাংস নিয়ে যাবেন। আমাদের ফ্রিজে তার কোরবানির ৪০০ পাউন্ড মাংস। আপনি একটু আগে মাছ চাইলেন না ? আমরা মাছ আনতে পারছি না। কারণ আমাদের ফ্রিজে কোনো জায়গা নাই। উনি গতকাল ফোন করে বলেছেন যে উনি আসতে পারছেন না। আমরা যেন মাংসগুলি গরীবদের মাঝে বিতরণ করে দেই। আপা, সারাদিন ধরে কোনো গরীব পেলাম না। একজনের কুরবানীর মাংস, আমরা বিক্রিও করতে পারছি না। আপা আপনি কি কিছু মাংস নিয়ে আমাদেরকে সাহায্য করবেন ? কোনো দাম দিতে হবে নাতো। যতটুকু ইচ্ছা নিয়ে যেতে পারেন। আজকের পরে আমাদের এই মাংস রাখা সম্ভব হবে না। আমাদের তো ব্যবসা করতে হবে।
– ভাই, আমি অত্যন্ত দুঃখিত। দানের মাংস নেয়ার মতো দারিদ্রতা আমার নাই। তবে আমি আপনাকে সাহায্য করবো। আপনি দয়া করে আমাকে একটা দিন সময় দিন। আপনার ফোন নাম্বার দিন ,আমি জানাবো আপনাকে।
আমি icna ( ইসলামিক সেন্টার ফর নর্থ আমেরিকা ) তে ফোন করে জানালাম, তাদের লিস্টের দরিদ্র মুসলিম ভাই বোনদের জন্য মাংস দেয়া সম্ভব কিনা ? তারা জানালো, তারা এতো মাংস রাখতে পারবে না। লিস্টে অনুযায়ী তারা যোগাযোগ করবে এবং একদিন পরে আমাকে জানাবে কতটুকু মাংস তারা নিতে চায় ।
আমরা আমাদের গাড়ি নিয়ে প্রায় ৩০০ পাউন্ড মাংস পরের দিন তাদের সেন্টারে পৌঁছে দিলাম। নিজেদের হাতে করে এই ভারী ভারী ব্যাগগুলি বহন করা খুবই কঠিন। আমার হাসবেন্ড বেশ বিরক্ত হলো। আমাকে দুই তিনবার পাগল ডেকে ফেললো, আমার কি দরকার এই মাংসের সদ্গতি করা ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি কিছুই কানে ঢুকালাম না। অপ্রয়োজনীয় কথা চলতে থাকলে আমি কান বন্ধ করে রাখতে পারি।
আমি নিজে এখন গরিব না হলেও আমি গরিব একটি দেশে বড় হয়েছি। আমি জানি আমার দেশের ৮০ শতাংশ মানুষই রোজ মাংস কিনে খেতে পারে না। সেখানে ৪০০ পাউন্ড মাংস নষ্ট হয়ে যাবে ? আমি ভাবতে পারি না।
কেবলই মনে হতে লাগলো, লোক দেখানো বা কুরবানী দিয়েছি বলার জন্য এই কুরবানী দেয়া কি ওই ভদ্রলোকের সত্যি প্রয়োজন ছিল ? টাকাটা দেশে পাঠিয়ে দিলে কি কয়েকটি সম্বলহীন পরিবাবের মুখে হাসি ফোটানো যেত না ?
আমরা শিক্ষিত হয়েছি, ডাক্তার হয়েছি। কিন্তু আমরা কেন সচেতন হতে পারি নাই ?