লোভ
মর্গে যে লাশটা পড়ে আছে সেটা অন্তরার, আমার সাবেক প্রেমিকা, আত্মহত্যা নাকি খুন তা জানার জন্য হয়তো একটু পর খুব সুন্দর দেহটা কাটাকুটি করবে ডাক্তাররা। হয়তো প্রতিমাসে প্রোটিন ট্রিটমেন্ট নেয়া চুল গুলো ছিলে ফেলবে, হয়তো ফেসিয়াল করা চেহারাটা কেটে ছিড়ে দেখবে হয়তো জিমে গিয়ে মেদ ঝরানো পেট টা কেটে সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ গুলো বের করে কেটেকুটে দেখবে, আর ভাবতে পারছি না মাথাটা ছিড়ে যাচ্ছে।
যেদিন ওর বিয়ে হয়ে যায় তার মাত্র দুই সপ্তাহ আগেও আমরা স্বপ্ন বুনে ছিলাম, কিন্তু আমার স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে গেল। কান্নাভেজা চোখে অন্তরা বলেছিলো বিয়েটা না করলে ওর বাবার আবার কোন অঘটন ঘটে যাবে হয়তো, এমনিতেই ওর বাবা দুইবার হার্ট অ্যাটাক করেছে । আমি শেষবারের মতো আমার অন্তরাকে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলাম। মেয়েটা কাঁদতে কাঁদতে চলে গিয়েছিল। আচ্ছা বাবা মা কি সব সময় ভালই চায় তাহলে আজ অন্তরা লাশ কেন?
-হ্যালো রাহাত শুনতে পাচ্ছো, নুসরাত মানে অন্তরার ননদ ওর বয়ফ্রেন্ডকে ফোন করেছে
-হ্যাঁ কি অবস্থা তোমার বাসার?
-ডেড বডি তো পুলিশ নিয়ে গেছে
-বলো কি?
-কিছু করার নেই এখন নাকি পোস্টমর্টেম হবে, বিয়ে হয়েছে দশ মাস আর দেখো কি অঘটন।
-কিন্তু সুইসাইড করলো কেন?
-আগে থেকে নাকি ছেলেদের সাথে বেশ ঘনিষ্ঠতা ছিল, এখন কে কোন দিক দিয়ে কি করেছে আমরা কি করে বলবো? আত্মহত্যা না হয়ে খুন ও হতে পারে পুলিশ আপাতত এতোটুকুই বলেছে।
-হলি কাউ, তাহলে তো অবস্থা খারাপ।
-এমনিতেই আমার ভাই শোক সামলাতে পারছে না তার ওপর আবার পুলিশ ওকেই সন্দেহ করছে।
-আরে তুমি চিন্তা করো না ,সব ঠিক হয়ে যাবে আর ভাইয়া তো কিছু করেনি তাই না?
-ভাইয়া করেনি আমরাও কিছু করিনি কিন্তু পুলিশ বলছে এটা আত্মহত্যা নয় খুন
-আচ্ছা তুমি চিন্তা করো না ,দেখা যাক কি হয়, রাহাত ফোন রেখে দিল।
-আপনাকে না বললাম এখান থেকে চলে যেতে এটা কোন বসার জায়গা হলো?
আমি কাতর স্বরে বলে উঠলাম ,প্লিজ আমিতো ভেতরে যাচ্ছি না আমাকে এখানে একটু বসতে দিন। অন্তরা একা খুব ভয় পায়।
কনস্টেবল আমার দিকে সরু চোখে তাকালো তারপর বললো, ঠিক আছে বসুন কিন্তু সন্ধ্যার আগে চলে যাবেন
আমার চোখ বেয়ে তখন অঝোর-ধারায় পানি পড়ছে।
লাশ বুঝে পেতে অনেক দেরি হলো, অনেক কাগজপত্র ফর্মালিটি প্রাথমিকভাবে ডাক্তাররা বলেছে পটাশিয়াম সাইনাইড খেয়ে সুইসাইড করেছে। ভিসেরাতে তাই পাওয়া গেছে, কিন্তু এই বিষ যোগাড় করলো কি করে ?এটা একদমই এভেলেবেল না। পুলিশ নিজেদের মতো ইনভেস্টিগেশন করে যাচ্ছিলো, কোন খাবারের সাথে মেশানো হয়নি এটা নিশ্চিত। সাধারণ আত্মহত্যা মনে করে পরে পুলিশ কেস বন্ধ করে দিতে বাধ্য হলো।
-আচ্ছা তোমার ভাবি মারা গেছে কিন্তু তোমাকে আপসেট লাগছে না কেন? রাহাত নুসরাত কে প্রশ্ন করল রেস্টুরেন্টে বসে কফি খেতে খেতে।
-আমি ওকে পছন্দ করতাম না।
-আস্তে বলো দেয়ালেরও কান আছে, শুনলে ভাববে তুমি মার্ডার টা করেছ
-মার্ডার আসলো কোত্থেকে ,পুলিশ তো বলেই দিয়েছে এটা একটা সুইসাইড।
-তুমি উনাকে দেখতে পারতে না কেন?
-কারন আমার ভাইয়ের মাথাটা চিবিয়ে খাচ্ছিল ,তুমি জানো আলাদা একটা ফ্ল্যাট পর্যন্ত বুকিং দিয়েছিল, নিজের জন্য আলাদা গাড়ি, আর প্রতিমাসে পার্লারের পিছনে এত এত খরচ।
-তারপরও তো আমার দেয়া বিভিন্ন গিফট তুমি তাকে দিয়ে দিয়েছো
-একদম না, কেন দিতে যাবো, আমি নেইলপলিশ ব্যবহার করিনা তাই সাজিয়ে রেখে দিয়েছিলাম। একদিন ঘরে এসে দেখে ভাইয়া বললো এটা নাকি তার বউয়ের প্রিয় রং তাই ভাইয়াকে বললাম নাও এটা তোমার বউয়ের জন্য গিফট। এর বাইরে তোমার সবকিছু আমার কাছে আছে, ওই অসভ্য মেয়ের কাছে না।
রাহাত হেসে উঠলো, আচ্ছা বাদ দাও তোমার কথা শুনে আমারই মনে হচ্ছে যে তুমি কিছু করে ফেলেছ।
-লোভী মেয়েদের এরকমই হয়
-আহা থাক একটা মানুষ মারা গেছে তাকে নিয়ে বাজে কথা বলো না আর তোমার ভাইয়াকে সান্ত্বনা দিও।
-আচ্ছা যাও তোমার কথাই থাকলো আমি চুপ
নুসরাত ঠোটে আঙ্গুল দিয়ে চুপ করার ভঙ্গি করলো।
দিনটা যেমন তেমন যায় কিন্তু রাত আর কাটে না, কেমন আছে কবরে আমার অন্তরা একা থাকতে খুব ভয় পায় মেয়েটা। এই অন্ধকারে একা কিভাবে আছে? একরাতে গিয়ে বসেছিলাম ওর কবরের পাশে কিন্তু গার্ড এসে ঘন্টাখানেক পরেই তাড়িয়ে দিয়েছে।
ভাইয়া আসবো , মারুফের অফিসে রাহাত’এর কন্ঠ
-এসো রাহাত এসো, তোমার জন্য অপেক্ষা করছি। এই নাও তোমার পেমেন্ট
-লাগবে না ভাইয়া
-মানে
-প্রথম কাজ ছিল তো তাই ধরে নিন ফ্রিতে করে দিয়েছি আর আপনার বোনের সাথে কিছুদিন এক্টিং করেছি ,তাই শোধবোধ।
-এখন নুসরাত কে কি বলবে?
-সেটা আমার উপর ছেড়ে দিন
-তুমি খুব বুদ্ধিমান একটা ছেলে বুদ্ধিটা ভালো কাজে লাগাও।
অন্তরা আমার জীবনটা শেষ করে দিচ্ছিল, আমার পরিবার থেকে আমাকে আলাদা করে নিচ্ছিল, এমন কি বিয়ের আগে কয়টা ছেলের সাথে কি কি কুকাজ করে এসেছে কে জানে এমন নষ্টা মেয়েকে আমি বৌ হিসেবে মানতে পারবো না। আবার ডিভোর্স দিতে পারছিলাম না কারণ দেনমোহর ছিল এক কোটি টাকা ওই মেয়ের পিছনে আমার অনেক টাকা ব্যয় হয়ে গেছে আর এক টাকাও খরচ করা যাবে না।
-ভাইয়া আজ তাহলে আসি, ভালো থাকবেন। শিস দিতে দিতে রাহাত বের হয়ে গেল।
-কি হয়েছে রাহাত, আমার হাত বেঁধে রেখেছ কেন আমরা তো গাড়িতে ছিলাম তাই না, এখানে কি করে এলাম, নুসরাত কাতর স্বরে বলে উঠলো।
-নুসরাত ,ভালো মেয়ে ভেবেছিলাম তোমায়, আমি রাহাত আমি অন্তরার এক্স বয়ফ্রেন্ড, অন্তরা যে আমাকে ঠকাতে পারে সেটা বুঝেছি ওর বিয়ের পরে আসলে ওর বাবার হার্ট অ্যাটাক ছিলো একটা ছুতো আসলে কিচ্ছু না, তোমার ভাইয়ের টাকা আছে তাই অন্তরা আমাকে ছেড়ে দিয়েছে । আর কয়টা বয়ফ্রেন্ড ছিল কে জানে?
-এসব তুমি কি বলছ রাহাত?তুমি মেরেছো, তুমি মেরেছো ভাবিকে, ভয়ার্ত কন্ঠে বলে উঠল নুসরাত।
-না তো আমি না তুমি আর তোমার ভাই আমি শুধু একটু বুদ্ধি খাটিয়েছি
-আমি কিছু বুঝতে পারছিনা
-জানতাম তোমার নেইলপালিশ পছন্দ না, তবুও তোমায় অনেকগুলো মেকআপ সামগ্রীর সাথে নেইলপলিশও গিফট করলাম আর তার মধ্যে খানিকটা পটাশিয়াম সায়ানাইড ঢেলে দিলাম। জানোতো অন্তরার ছিল নখ খাওয়ার অসুখ। মনে করে দেখো নেইলপালিশ তো তোমার ভাই তোমার হাত থেকে নিয়েছিল আমি কিন্তু অন্তরাকে দেইনি।
-আমাকে ছেড়ে দাও, কাউকে কিছু বলবো না সত্যি বলছি।
-আমি তোমাকে ছেড়ে দিতাম, চলে যেতাম অন্য কোথাও আর যোগাযোগ করতাম না, কিন্তু কালই দেখলাম অন্য একটা ছেলের সাথে তোমাকে, খোঁজ নিলাম, ছেলের ভালই টাকা পয়সা আছে, মানে অন্তরা যেমন টাকার জন্য আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল তুমিও ঠিক সেই পথেই যাচ্ছিলে তাহলে অন্তরা একা কেন মরবে, এটা কিন্তু injustice. নুসরাত কাতর স্বরে মিনতি করে যাচ্ছিল রাতের অন্ধকার ছাপিয়ে সেই শব্দ বহুদূর পর্যন্ত যাচ্ছিল…
বসে আছি অন্তরার কবরের সামনে আজ ওর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। আশ্চর্য কেউ আসেনি ওর কবরে। শুনেছি অন্তরা মারা যাবার কিছুদিন পর থেকেই ওর ননদ নাকি উধাও হয়ে গেছে, প্রেম ছিল একটা ছেলের সাথে রাহাত নাম।
নামটা কেমন যেন পরিচিত লাগছে, হ্যাঁ মনে পড়েছে কেউ একজন অন্তরার সাথে এই নামের কাউকে জড়িয়ে কিছু একটা বলেছিলো, কিন্তু আমি জানতাম আমার অন্তরা সেরকম নয়। ওর হাজবেন্ডের এক্সিডেন্ট হয়ে একটা পা কেটে ফেলতে হয়েছে, গাড়ির নাকি ব্রেক ফেল হয়েছিল। আশ্চর্য পরপর কতগুলো দুঃসংবাদ। অন্তরা আমাকে একটা কথা বলতো, জানো “নাহিদ ” সুখ আসে একটা একটা করে কিন্তু দুঃখগুলো আসে জোড়া বেঁধে, না না একেবারে এক ডজন হয়ে ,বলেই ও মুগ্ধ হাসি ছড়িয়ে দিতো,আমার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে আমার একটাই দুঃখ অন্তরা আমি তোমাকে হারিয়েছি,তোমাকে ধরে রাখার যোগ্যতা অর্জন করতে পারিনি। আমি হুহু করে কেঁদে উঠলাম।
কাঁধে কারো আলতো স্পর্শে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি , রাহাত।
-আর কেঁদে কি হবে নাহিদ, মেয়েটা একটা নোংরা মেয়ে ছিল, ওর জন্য এত কেঁদো না।
-রাহাতের দিকে তাকিয়ে বললাম, পারলে কি করে, তুমিও তো ভালবাসতে ওকে তাই না?
-দেখো নাহিদ সব মানুষ এক রকম হয় না কেউ তোমার মত কেঁদে বুক ভাসায় কেউ আবার প্রতিশোধ নেয় আমি দ্বিতীয় দলের।
রাহাত শিস দিতে দিতে চলে গেল নাহিদ কবর আঁকড়ে ধরে পড়ন্ত গোধূলি দেখছিল।