আমার আম্মু ছিলেন আমার আব্বুর ডিরেক্ট স্টুডেন্ট। আব্বু যখন চতুর্থ বিসিএস এ লেকচারার হিসেবে জয়েন করেন আম্মু তখন ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্রী। আবার আমার নানা ছিলেন সহযোগী অধ্যাপক!!! তাই আব্বু আম্মুর বিয়ের কাহিনী নিয়ে কৌতুহলের শেষ নাই। প্রেমের বিয়ে? কিভাবে বিয়ে হল টিচারের সাথে? নাকি তোমার নানা বিয়ে দিয়েছিলেন? আল্লাহ! আম্মুর লজ্জা নাই কিংবা টিচার হয়ে কিভাবে ছাত্রী কে বিয়ে করলেন? এগুলো হলো কমন প্রশ্ন! আমার কিন্তু ভালই লাগে! আমি মাঝে মাঝে চোখ বন্ধ করে ব্যাপারটা কল্পনা করার চেষ্টা করি। আসলেই কেমন ছিল সেইসব দিনগুলি?! বলছি ১৯৮৬ সালের কথা। আম্মুকি আব্বুর উপর (আজকের পোলাপানের মত) ক্রাশ খেয়েছিল?! কলেজে কোন ইয়ং, ব্যাচেলর টিচার জয়েন করলে যেমন আমরা কানাকানি করতাম, বান্ধবী দের খ্যাপাতাম আম্মুও কি এমন করেছিল? আব্বু ক্লাস নিতে আসলে আম্মা কি ট্যারা চোখে তাকাতো?! আমার ছোট ভাই আরো আগ বাড়িয়ে বলে আম্মা, আব্বু যখন ক্লাসে রোল কল করত তুমি কি ‘ইয়েস স্যার’ বলতা নাকি ‘কবুল স্যার’ বলতা?!!
আমার আব্বু কোন আহামরি হ্যান্ডসাম ছিলেন না। ছোটখাটো, ছিপছিপে, সল্পভাষী, চুপচাপ, কালো বরণের একজন মানুষ। সারাজীবন শুধু পড়াশুনাই করে গেছেন। মেট্টিকে বোর্ড স্ট্যান্ড করা মেধাবি শান্তশিষ্ট, নামাজী, ২৯ বছরের এই শিক্ষক এর প্রতি এই জন্যই বোধহয় আমার নানাও মুগ্ধ হয়েছেন। আরো মজার কথা হল আব্বু নাকি আমার নানু কে ‘ভাবী’ বলেও কয়েকবার ডেকেছিলেন! হায় রে কপাল! কে জানতো আজকের ‘ভাবী’ আগামী দিনের ‘শাশুড়ি’!
যাইহোক, অনেক অল্প সময়ের মধ্যে আব্বু-আম্মুর ধুমধাম করে বিয়ে হয়ে যায়। আম্মুর বয়স তখনো ১৮ হয়নি। আমার ছোট ভাই স্বভাবসুলভ ভিলেনের মতো তাই এখনো আম্মু কে খোঁচা দেয় আব্বু যদি এতই আদর্শ শিক্ষক (!) হয় তাহলে বাল্যবিবাহ করল কেন! আর তুমিই বা কেমন আর কয়টা দিন ওয়েট করলে কি হতো?! শুনেছি, পাড়ায় যাদের ঘরে বিবাহযোগ্য মেয়ে ছিল সেই সব অভিভাবকের এতদিনে আব্বুর উপর যা ইনভেস্ট করেছিল সব পানিতে পড়ল বলে অবস্থা!
আম্মুর ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার পর বিয়ে হয়ে যায়, তারপর আমার আগমন তাই আম্মু কখনো ভাবতেও পারেনি পড়াশুনা শেষ করা সম্ভব হবে। কিন্তু আব্বু অটল ছিলেন। আব্বুর উৎসাহ, সাহস, সাহায্য আর অনুপ্রেরণায় আম্মু ২ ছেলে মেয়ে নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স কম্পলিট করেন।
আমার আম্মা ভীষন মিশুক আর অনেক কথা বলেন। আব্বু তার উলটো। আব্বু এমন লাজুক যে কখনো আম্মু কে নাম ধরে ডাকেন নাই। ‘কোথায় গেলে?’ ‘একটু শুনবে?’, তাতেও কাজ না হলে খুব রেয়ার ডাক দিতেন ‘কাব্যর আম্মু”! আব্বু সবসময় অনুরোধসুচক কথা বলতেন। কখনো কাউকে আদেশ বা রাগ হয়ে কিছু বলতে শুনিনি। বিনয়ী মানুষ আমার আব্বু!
একবার আব্বু আম্মুর ১৯তম ম্যারেজডে। আব্বুর পোস্টিং ঢাকা কলেজে। আম্মুর চাকরির জন্য আমরা সিলেট। আব্বু, আম্মুকে ১৯ পেইজের চিঠি লিখেছেন। আম্মু উঠতে বসতে সেই চিঠি পড়তেন! এমনকি ব্যাগে করে কলেজেও নিয়ে যেতেন! আমি ছিলাম পাকনা, আমার বিয়ে হলে আমিও আমার বরকে চিঠি লিখতে বলবো! কি আছে ওই চিঠিতে! বদলির সুত্রে অনেক জায়গায় দূরে থাকতে হয়েছে কিন্তু চিঠি লেখা থামেনি। আব্বু আমাদের কাছে চিঠি লিখতেন খুবই সংখিপ্ত কিন্তু আম্মুর চিঠি ছিল কয়েক পেইজের। আম্মুর সংগ্রহশালা আব্বুর চিঠিতে পরিপূর্ণ।
আব্বা, আদর ভালবাসা এসব অনুভূতি এক্সপ্রেস করতে পারতেন না। কিন্তু খুবই সাধারন কিছু ছোট ছোট বিষয় সবার থেকে ওনাকে ইউনিক করেছে। মাঝেমাঝে দেখতাম কারেন্ট চলে গেলে আম্মুকে নিয়ে ছাদে যেতেন। যেখানই যেতেন না কেন আম্মুর জন্য কিছুনা কিছু আনতেন, হোক সেটা শাড়ি বা সস্তা কাচের চুরি। বাইরে থেকে বাসায় এসে আম্মুকে না দেখলে অস্থির হয়ে যেতেন। একবার আমাকে, একবার আমার ভাই কে জিগ্যেস করতেন তোমার আম্মু কই? এইজন্য আম্মা, আব্বু আসার আগে সবসময় দেখতাম ফিটফাট হয়ে রেডী হয়ে আছেন।
আব্বুর বিভিন্ন জায়গায় বদলী হওয়াতে আমাদের ৪জন সদস্যের খুব কমই একসাথে থাকা হয়েছে। আম্মু আমাদের ২ভাই বোন নিয়ে সিলেট থাকতেন আর আব্বু প্রতি মাসে অথবা ২সপ্তাহ পর পর সিলেট আসতেন। ২০০৬ এ আব্বু যখন সিলেট শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে জয়েন করেন তখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। আবারও আমাদের বিচ্ছিন্নতা।
অফিসে যাওয়ার আগে সকাল ৭টা থেকে শুরু হতো আব্বুর সাজুগুজু। আর এখানে বিউটিশিয়ান এর দায়িত্বে থাকতেন আম্মু। কোনদিন কি শার্ট পরবেন,কোন কালারের শার্ট,প্যান্ট পরবেন, টাই ম্যাচিং সব কিছু আম্মু করতেন। আব্বুর কাপড় চোপড় সবসময় আম্মু কিনতেন। আব্বুকেও কখনো নিজের জন্য শখ করে কিছু কিনতে দেখিনি। বাসার সবার কাপড় হেল্পিং হ্যান্ড ধুলেও আব্বুর শার্ট আম্মু নিজের হাতেই ধুয়ে দিতেন। তো, আব্বু কে রেডি করানো ছিল আম্মার ফরজ কাজ। আম্মু নিজে আব্বার জুতা ব্রাশ করতেন। জুতা ব্রাশ করা আম্মু একটি শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। জুতা যদি চকচকে না হয় তাহলে কিসের রেডি হওয়া? অনেক সময় নিয়ে অনেক যত্নের সাথে, মনের মাধুরী মিশিয়ে জুতা পলিশ করতেন! কোনদিন মুখে লোশন দিয়ে দাওয়ার সময় যদি
ছেলে মেয়ে সামনে পরে যেতো আব্বু লজ্জা পেয়ে লাজুক হাসি দিয়ে বলতেন তোমার আম্মু পাগল হয়ে গেছে!
কোন কোন দিন আব্বু রাতে অফিসের কাজ নিয়ে বেশি ব্যস্ত থাকলে আম্মু একটা বড় গামলায় ভাত মেখে আমাদের ৩ জনকে খাইয়ে দিতেন। আমাদের সামনে আব্বা ভাত খেতে ইতস্তত করলে আম্মা চিল্লায় চিল্লায় বলত ছাত্রী কে বিয়ে করতে লজ্জা লাগে নাই এখন আবার ছেলে মেয়ের সামনে ভাত খেতে কিসের লজ্জা?!!
২০১২ সালে আজকের দিনটিতে আম্মুর এই মানুষটি আম্মুকে ফেলে একাই চলে গেছেন, না ফেরার দেশে। আমরা দুই ভাইবোন দুই প্রান্তে। যে সময়ে জীবন সংগির সবচেয়ে প্রয়োজন সেখানে আম্মা একা একাই দিন গুলি পার করছেন। বড়ই সার্থপর ছেলে মেয়ে আমরা। না, আম্মু আমাদের সামনে কাঁদেন না। আম্মুর বিশ্বাস আমরা সবাই আবার একসাথে হবো (ইনশাআল্লাহ)। আম্মু হেসে হেসে বলেন, আরে তোর আব্বু কে আগে আগে বেহেশতে যেতে হবে, এই জন্য তাড়াহুড়ো করে চলে গেলো, আমাদের জন্য জায়গা রাখতে হবেনা?!
ওই যে বলছিলাম না বাইরে থেকে বাসায় ফিরে আব্বুর প্রথম কাজ ছিল আম্মুকে খোঁজা? চলে যাওয়ার আগের দিন অফিস থেকে ফিরে আম্মুকে খুজছিলেন। আম্মু ছিলেন ছাদে। আম্মু রুমে ঢোকার সাথে সাথে আব্বু নাকি জিগ্যেস করেছিলেন কাব্য’র আম্মু কোথায় ছিলে? বাসায় এসে তোমাকে না দেখলে ভালো লাগেনা আমার! তুমি জানো আমি বেহেস্তে গেলেও বলবো আমার তোমাকেই লাগবে!” মাঝে মাঝে আমিও ভাবি আব্বু কেন সেদিনই এই কথাটি বলেছিলেন?! চলে যাবেন তাড়াতাড়ি, বুঝতে পেরেই হয়তো আম্মুকে নিশ্চিত করে গেছেন পরপারে দেখা হবে চিন্তা করো না!
আমার আব্বু আম্মু আমার কাছে আদর্শ সুখী দম্পতী। দোয়া করি আব্বু তুমি যেখানেই আছ, ইনশাআল্লাহ ভাল আছ। আল্লাহ আমার আম্মুকে সম্মানের সাথে ইমানের সাথে শান্তিতে রাখুন।