” আমি একজনকে ভালোবাসি। তার নাম ফ্লোরা। বাবা ছেলের বউ হিসেবে চায় বাঙালি মুসলিম মেয়ে। ঠিক তোমার মতো। কিন্তু ফ্লোরা বিদেশী আবার খ্রিস্টিয়ান। ওকে কখনোই আমার ফ্যামিলি মেনে নিবে না। তাই আমরা ঠিক করেছি বিয়ে না করেই সারাজীবন লিভ-ইন করবো। কিন্তু তোমার সাথে আমার বিয়ে হলে সেটা সম্ভব না। তুমি নিশ্চয়ই চাও না তোমার হাসব্যান্ড বিয়ের পরেও গার্লফ্রেন্ডের সাথে লিভ-ইন রিলেশনে থাকুক!”
প্রীতির পায়ের নিচের মাটি নড়ে উঠল। মাথায় আচমকা বিকট শব্দ হলো। আশরাফের কথা শুনে মাথা ঘুরছে। ইংরেজি সে কম বুঝে। কিন্তু আশরাফ ইংরেজি আর বাংলা মিশিয়ে একটি অদ্ভুত শব্দে কথা বলছে। যা বুঝতে একদম অসুবিধা হচ্ছে না প্রীতির। কিন্তু কথাগুলো মানতে অবশ্যই অসুবিধা হচ্ছে।
যখন প্রথমবার সে আশরাফকে দেখেছিল, মনে মনে তখনি ভেবে নিয়েছিল এই ছেলেই তার প্রথম প্রেম। এর আগে কাউকে দেখে এতোটা ভালো লাগেনি প্রীতির। মোবাইলে আশরাফের ছবি বের করে সারারাত বালিশের তলায় রেখে ঘুমিয়েছে। ফ্লাইটে উঠে জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে প্রতিটি মেঘের খন্ডে আশরাফের মুখ দেখতে পেয়েছে।
এক কথায় আশরাফের প্রেমে কল্পনায় প্রীতি বুঁদ হয়েছিল। যার প্রেমে সে এতো উন্মাদ হলো তার থেকে এমন ধরণের কথা শোনা মোটেও কোনো সহজ ব্যাপার না। কিন্তু একটা সত্যি কথা হচ্ছে, ভালোবাসাও জোর করে হয় না। প্রীতি তো হাজার চেষ্টা করেও তাদের পাড়ার রিফাতকে ভালোবাসতে পারেনি। অথচ রিফাত তার জন্য নেশা-টেশা করে কত কান্ড ঘটিয়েছিল। প্রীতি তো জানে আশরাফকেও জোর করা সম্ভব না। তাই নিয়তিকে মানা ছাড়া অন্য উপায় তার কাছে নেই।
” হেই প্রিটি, তুমি কি আমার কথা বুঝতে পারছো?”
আশরাফের ডাকে নড়ে উঠল প্রীতি। মানুষটা এবারও প্রীতির নামের উচ্চারণ ভুল করেছে। অন্যসময় হলে প্রীতি শক্ত চেহারায় বলতো,” আমি প্রীতি, নট প্রিটি।” কিন্তু এবার সে কিছুই বলল না। তার বাকশক্তি হারিয়ে গেছে। আশরাফ আবার জিজ্ঞেস করল,” আর ইউ ওকে প্রিটি?
প্রীতি মাথা নেড়ে বোঝালো,” ইয়েস।”
তারপর ঢোক গিলে নিজেকে একটু সামলে নিয়ে প্রশ্ন করল,” এখন আমাকে কি করতে হবে?”
প্রীতির প্রশ্নে আশরাফের দৃষ্টিতে খুশির ঝিলিক দেখা গেল। প্রসন্ন কণ্ঠে উত্তর দিল,” বাবার জন্য আমি বিয়েটা ভাঙতে পারছি না। আমার মতামতের কোনো গুরুত্বই বাবা দিচ্ছে না। তাই বিয়েটা তোমাকে ভাঙতে হবে। তুমি বাড়ি ফিরে সবাইকে বলবে, আমি তোমার সাথে খুব খারাপ আচরণ করেছি। তাই তুমি আমাকে বিয়ে করতে চাও না।”
প্রীতি মনখারাপ করা চেহারা নিয়ে মাথা নাড়ল। তার চোখ টলমলে হয়ে আসতে চাইছে। খুব বিরক্ত লাগছে আশরাফকে এখন। ছেলেটার বয়স কত হবে? মিনিমাম চব্বিশ! এতোবড় ছেলে হয়েও তার মতামতের বুঝি কোনো গুরুত্ব নেই! বিয়ে ভাঙার জন্য প্রীতির মতো বাচ্চা মেয়ের কাছে অনুরোধ করছে। তাও জোর করে তুলে এনে। ছি, লজ্জা লাগা উচিৎ।
আশরাফ বিনীত কণ্ঠে বলল,” অর্ডারটা আজকে তুমি করো প্রিটি। তোমার পছন্দমতো। আমি আজ খুব খুশি। মনে হচ্ছে অনেক বড় একটা টেনশন মাথা থেকে নেমে গেছে। আমাকে টেনশন ফ্রী করার জন্য তোমাকে থ্যাংকস। ক্যান উই হাগ?”
প্রীতি কেঁপে উঠল। পর পুরুষকে জড়িয়ে ধরা তার জন্য অতি লজ্জাজনক ব্যাপার। যদিও আশরাফের কাছে এটা ডালভাতের মতো। সে নিউইয়র্ক শহরে বড় হয়েছে। তারা এখন বসে আছে নিউইয়র্কের বিখ্যাত সুশী নোজ রেস্টুরেন্টে। এখানকার মানুষের জন্য এই ধরণের বিষয় খুব সাধারণ। কিন্তু প্রীতির অস্বস্তি লাগছে। যদি বিয়ে ভাঙার প্রসঙ্গ না উঠতো, তাহলে প্রীতি শত অস্বস্তি ঠেলেও কাজটা করতে রাজি হতো। কিন্তু এবার রাজি হলো না। ইতস্তত করে বলল,” না প্লিজ।”
সে ভেবেছিল আশরাফ বোধহয় মাইন্ড করবে। কিন্তু এমন কিছু হলো না। প্রীতির নিষেধটা সে খুব স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করল। কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল,” ওকে।” তারপর ওয়েটারকে ডাকল। প্রীতির এখন কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না। তবুও সে অনীহা নিয়ে অর্ডার করল। বিয়ে ভাঙায় যে তার মনখারাপ হয়েছে এটা আশরাফকে কিছুতেই বুঝতে দেওয়া যাবে না।
খাবার খেতে খেতে আশরাফ ফ্লোরা সংক্রান্ত গল্প শুরু করল। এসব শুনতে প্রীতির কলিজায় লাগছে। বুক ফেটে যাচ্ছে। কিন্তু চেহারা স্বাভাবিক রেখে হাসতে হচ্ছে। ইশ, কে বলেছিল বিদেশী বড়লোক ছেলে বিয়ে করতে? এদের স্বভাব- চরিত্র ভালো হয় না তা প্রীতিকে অনেকেই বুঝিয়েছিল। কিন্তু বাবাই বড়ফুপুর কথায় নেচে উঠলেন। সদ্য এইচএসসি পাশ করা মেয়েকে বিয়ে দিতে বাক্স-পেটরা গুছিয়ে সোজা বাংলাদেশ থেকে নিউইয়র্ক চলে এলেন। এইখানে প্রীতির বড়ফুপু নাফিসা সুলতানা থাকেন। আশরাফের সাথে সম্বন্ধ তিনিই এনেছিলেন। ছেলে দেখতে রাজপুত্র, পরিবার উচ্চবিত্ত, গর্বিত বংশ আবার জন্মসূত্রে সিটিজেনশীপও আছে ইউএসএর।
বাঙালি পরিবার হলেও ছেলের ফুল ফ্যামিলি যুক্তরাষ্ট্রে ওয়েল সেটেল্ড। নাফিসার নিজেরও প্রীতির বয়সী মেয়ে আছে। কিন্তু নিজের মেয়ের কথা না ভেবে তিনি ভাবলেন প্রীতির বিয়ের কথা। কেন? এই প্রশ্ন এসেছিল প্রীতির মনে। পরে তার উত্তর পাওয়া গেছে। নাফিসা আন্টির মেয়ে জেরিনের বয়ফ্রেন্ড আছে। জেরিন তার বয়ফ্রেন্ডের সাথেও লিভিং রিলেশনে আছে। এই দেশে তো এইসব নরমাল!
জেরিনের সাথে আজ প্রীতি শপিংএ বের হয়েছিল বিকালে। সূর্য ডোবার আগ মুহূর্তে শপিংমলে মাইকের মাধ্যমে সবাইকে সাবধান করা হলো, আধঘণ্টার মধ্যে স্নোফল শুরু হবে। তখন জেরিনের বয়ফ্রেন্ড এসেছে শপিংমলে। জেরিন তার সাথে ডেটে চলে গেল আর প্রীতিকে একটা ট্যাক্সি ঠিক করে দিল বাড়ি ফিরে যাওয়ার জন্য। প্রীতির খুব ভয় লাগছিল কিন্তু এই দেশে আঠারো পেরোলেই স্বাধীনতা পেয়ে যায় সবাই।
জেরিন কত উড়নচণ্ডী। ইচ্ছে হলেই বয়ফ্রেন্ডের সাথে রাত কাটাতে পারে। প্রীতির জন্য তো এইসব কল্পনার থেকেও অবাস্তব। বাবার হাত না ধরে সে বাড়ির পাশের বাজারেও যায়নি। সেখানে নিউইয়র্কের মতো সিটিতে ট্যাক্সি নিয়ে একা একা বাড়ি ফিরে যাওয়া কি তার পক্ষে সম্ভব? তবুও সাহস করে সে ট্যাক্সিতে উঠল।মাঝরাস্তায় প্রীতির ট্যাক্সি থামানো হয়।
আশরাফকে দেখে প্রীতি খুশিই হয়েছিল। ভেবেছিল আশরাফ বুঝি তাকে নিরাপদে বাড়ি পৌঁছে দিবে এবার। কিন্তু প্রীতিকে ট্যাক্সি থেকে বের করে আশরাফ নিয়ে এলো এই রেস্টুরেন্টে। প্রীতি আসতে চায়নি। আশরাফ বহু অনুনয়-বিনয় করে একপ্রকার জবরদস্তিই তাকে এনেছে। তাও প্রীতি ভেবেছিল তাদের সময়টা রোমান্টিক কাটবে। কিন্তু হলো বিপরীত।
আশরাফের কথায় বিদেশী ভাব স্পষ্ট। সঠিক উচ্চারণে বাংলা বলতে তার অসুবিধা হয়। এমনকি নিজের নামটাও সে ঠিকমতো উচ্চারণ করতে পারে না। তার নাম আশরাফ কিন্তু তাকে ডাকা হয় ‘অ্যাশ।’ আশরাফ প্রীতির সাথে ইংরেজিতেই কথা চালিয়ে যাচ্ছিল।
” তোমাকে এইভাবে তুলে আনার জন্য স্যরি। কিন্তু আমার কোনো উপায় ছিল না। কেউ তোমাকে আমার সাথে একা দেখা করতে দিতে রাজিই হচ্ছিল না। যেদিন আমরা আলাদা মীট করলাম সেদিনও তুমি তোমার কাজিন জেরিনকে নিয়ে এসেছিলে। রাইট? সেজন্যই আমি আজকে তোমাকে একা পেয়ে এই ব্যবস্থা করেছি। যেন আমরা প্রাইভেসী নিয়ে কথা বলতে পারি।”
প্রীতির খুব লজ্জা করতে লাগল। সে নড়াচড়া বন্ধ করে বরফের মতো জমে গেল। আশরাফ কেন তাকে একা পেতে চায়? তাহলে কি জেরিনের কথাই ঠিক? আশরাফও পশ্চিমা সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত! বিয়ের আগে ঘনিষ্টতা তাদের কাছে কম্পালসারি! আচ্ছা, হঠাৎ আশরাফ তাকে চুমু-টুমু দিয়ে ফেলবে না তো? ভয়ে প্রীতির কলিজা চুপসে গেল। তার ফ্যাকাশে মুখ দেখে আশরাফ দুঃখিত গলায় বলল,” এক্সট্রিমলি স্যরি প্রিটি। যদি আমি তোমাকে বেশি হার্ট করে থাকি তাহলে তুমি আমাকে মাফ করো। কিন্তু আমি বাধ্য ছিলাম।।আমার কাছে অন্যকোনো রাস্তা নেই। তোমার সাথে আমার পারসোনাল এই মিটিং খুব জরুরী। তোমাকে একটা কথা বলি প্রিটি, আমি এই বিয়েটা করবো না।”
প্রীতি বড় চমক খেল। কি বলছে এসব ছেলেটা? বিয়ে না করলে প্রীতির সাথে আলাদা কথা বলার এতো প্রয়োজন কেন? তাহলে কি… প্রীতি মেরুদন্ডে শিথিলতা অনুভব করল। তারপরেই আশরাফ বিনীত কণ্ঠে ফ্লোরার ঘটনা বলা শুরু করল। আর প্রীতির সমস্ত স্বপ্ন-আশা এক নিমেষে ভেঙে চুর্ণ-বিচুর্ণ হয়ে গেল!
আশরাফ এখন তার আর ফ্লোরার প্রথম দেখা হওয়ার গল্পটা বলছে। যদিও প্রীতি শুনতে চায়নি। আশরাফ নিজে থেকেই বলা শুরু করেছে। ছেলেটা বাঁচাল প্রকৃতির। কিন্তু কথা বলার ধরণ অসম্ভব সুন্দর। সারাক্ষণ শুনতেই ইচ্ছে করে। তবে ফ্লোরা সংক্রান্ত আলোচনা প্রীতির বিষাক্ত লাগছে। সে কখন বাড়ি যাবে আর মন খুলে একটু কাঁদতে পারবে?
খাওয়ার-দাওয়ার পর্ব শেষ হলো। তবুও আশরাফের গল্প শেষ হলো না। ফ্লোরার প্রশংসা করে যাচ্ছে সে মহা উৎসাহে। যেন পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ সুন্দরী মেয়ে ফ্লোরা। মেয়েটাকে একবার দেখতে ইচ্ছে করল প্রীতির। কিন্তু সে আগ্রহটা দমিয়ে রাখল। যার গল্প শুনেই ঈর্ষায় মরে যেতে মন চাইছে তার ছবি দেখলে না-জানি-কি হবে!
রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে আশরাফের গাড়িতে উঠল প্রীতি। তার ইচ্ছে করেছিল ট্যাক্সি নিয়ে বাড়ি ফিরে যেতে। কিন্তু এটা করতে গেলে আশরাফ বুঝে ফেলবে যে প্রীতির মনখারাপ হয়েছে। আর যাই হোক, প্রীতি নিজের আত্মসম্মান বিসর্জন দিতে চায় না।
গাড়িতে ওঠার পর প্রীতির খুব শীত করতে লাগল। আশরাফ চাদর এগিয়ে দিল। প্রীতি অবাক। আশরাফ কিভাবে বুঝল?
” তোমার মনে হয় শীত লাগছে। চাদরটা নিতে পারো। “
প্রীতি চাদরটা লুফে নিল। এরপরেই তার কান্না পেয়ে গেল। ছেলেটা বড্ড কেয়ারিং। ছোটখাটো বিষয়ও খুব খেয়াল করে। এমন মানুষ জীবনে পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। ফ্লোরা মেয়েটা ভীষণ ভাগ্যবতী। প্রীতি জানালার দিকে চেয়ে চোখের জল আড়াল করার চেষ্টা চালাল।
চলবে
উইল ইউ ম্যারি মি? পর্ব ১
®Fareen Ahmed
সবগুলো পর্বের লিংক একসাথে