উইল ইউ ম্যারি মি?
পর্ব ৪
রুফটপের সবচেয়ে উঁচু জায়গায় একটি পতাকা উড়ছে। প্রীতি আর জেরিন হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে একসাথে। হঠাৎ জেরিনের ফোনে ম্যাসেজ এলো। অমনি জেরিন প্রীতির হাত ছেড়ে দিতে দিতে বলল,” প্রীতি, ও নিচে আছে। আমি গেলাম।”
প্রীতি যেন অথৈ সাগরে ঢলে পড়ল। অসহায়ের মতো মুখ করে বলল,” আমাকে ফেলে তুই চলে যাবি? তোর ভরসাতেই আমি এসেছিলাম।”
” কিন্তু এখন কি করবো বল? ও যে এতো দ্রুত চলে আসবে আমি বুঝিনি।”
প্রীতি থমথমে গলায় বলল,” তোর বয়ফ্রেন্ডের কি খেয়ে-দেয়ে কোনো কাজ নেই? সারাক্ষণ তোকে ফলো করে? তুই যেখানেই যাস সেখানেই সে হাজির হয়ে যায়। “
” আমার সুইট, কিউট বোন। রাগ করিস না প্লিজ। আমি জলদি চলে আসবো।”
” কাল শপিংমলেও তুই একই কাজ করেছিস।”
জেরিন তাড়াহুড়ো করে চলে যাচ্ছে। প্রীতি পেছন থেকে ডাকল। কিন্তু জেরিনের শোনার সময় নেই। তার হার্টবীট নিচে দাঁড়িয়ে আছে। ছুটে না গেলে তো মিস হয়ে যাবে। জেরিনের মতো এমন বয়ফ্রেন্ড পাগলী মেয়ে প্রীতি জীবনেও দেখেনি। তার এখন খুব বিরক্ত লাগছে। আজকেও কি আশরাফের সাথে বাড়ি ফিরতে হবে? আশরাফ যদি আজকেও রাস্তা ভুলে যায়!
” সাইকো!”
ফিসফিস করে শব্দটা উচ্চারণ করল প্রীতি। পেছনে ঘুরতেই ভ্যাবাচেকা খেল। আশরাফ একদম তার পেছনেই দাঁড়িয়ে আছে হাতে লম্বা ট্রে নিয়ে। ট্রেতে তিনকাপ কফি। আশফাকের দৃষ্টি ধোঁয়া উঠা কফির চেয়েও উত্তপ্ত দেখাচ্ছে। প্রীতি কথা বলার আগেই আশরাফ প্রশ্ন করল,” কে সাইকো? আমি?”
প্রীতি অপ্রতিভ স্বরে বলল,” না তো। আমি জেরিনের কথা বলছিলাম। বয়ফ্রেন্ডের ব্যাপারে মেয়েটা একদম সাইকো।”
আশরাফ একটু হেসে হাতের ট্রে একটা ফাঁকা টেবিল দেখে রাখল। ওর এই হাসি দেখে প্রীতি বুঝতে পারল না যে কথাটা বিশ্বাসযোগ্য হয়েছে কি-না। আসলে তো প্রীতি আশরাফকেই সাইকো বলেছে।
দুইজন কফি হাতে রুফটপের কিনারায় এসে দাঁড়ালো। প্রীতির ভয় লাগছে। নিচে তাকালেই মনে হয় পড়ে যাবে। সামনে কাঁচের দেয়াল। এই দেয়াল এতো স্বচ্ছ যে স্পর্শ না করলে এর উপস্থিতি বোঝা মুশকিল। প্রীতি অবশিষ্ট কফি পটের দিকে চেয়ে বলল,
” এইটা ফেরত দেওয়া যাবে না? জেরিন তো নেই। এখন এটা কে খাবে? শুধু শুধু ওয়েস্ট হচ্ছে।”
” ফ্লোরা এলে সে খাবে।”
” ততক্ষণে কফি ঠান্ডা হয়ে যাবে না?”
আশরাফ যেন কথাটা শুনতেই পায়নি এমনভাবে কফিতে ছোট ছোট চুমুক দিতে লাগল। কিছু কিছু মানুষকে চা-কফি খাওয়ার সময় দেখতে সুন্দর লাগে। আরেকটা ব্যাপার হলো অতিরিক্ত কথা বলা মানুষটি যখন হঠাৎ শান্ত হয়ে যায় তখন তার চেহারায় একটা কিউটনেস ভাব চলে আসে। আশরাফ আজ অনেকটাই চুপচাপ। প্রীতি একনজরে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল। তারপর আচমকাই দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। অন্য মানুষের বয়ফ্রেন্ডের দিকে এভাবে তাকিয়ে থাকা অনুচিৎ। যখন আশরাফ প্রীতির ফিয়্যান্সে ছিল তখনও সে তাকিয়ে থাকতে পারতো না। লজ্জা পেতো। এখন আর লজ্জা পায় না প্রীতি। কিন্তু ভয় পায়। নিষিদ্ধ মায়ায় জড়িয়ে পড়ার ভয়। নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতিই যে মানুষের তীব্র আকর্ষণ!
” ফ্লোরা কখন আসবে?”
আশরাফ মনখারাপের কণ্ঠে জবাব দিল,” জানি নাহ!”
তার কণ্ঠে এক পশলা বিরহ। প্রীতি বলল,” মানে? আমরা কতক্ষণ অপেক্ষা করবো? আপনি ফ্লোরাকে ফোন দিচ্ছেন না কেন?”
” ফোন দিয়েছিলাম। ও বলেছে সময় লাগবে।”
আশরাফ হঠাৎ প্রীতির দিকে চেয়ে খুব উতলা হয়ে বলল,” প্রিটি! তুমি সত্যি ফ্লোরার সমস্যাটার সমাধান করতে পারবে তো? ও খুব কাঁদে। ভীষণ দুঃখী মেয়ে আমার ফ্লোরা। আমি ওর এতো দুঃখ টলরেট করতে পারছি না। মনে হয় কোনো বিগ জায়েন্ট আমার ব্রিথ পুশ করে রেখেছে। এতো বেশি কষ্ট হয়। তুমি প্লিজ কিছু করো প্রিটি! ফ্লোরার দুঃখগুলো যেন মুছে যায়। আই বেগ অফ ইউ।”
আশরাফ প্রীতির ডানহাত চেপে ধরে রাখল। যতক্ষণ প্রীতি তাকে প্রমিস না করবে ততক্ষণ যেন এই হাত ছাড়বে না। অদ্ভুত ছেলেমানুষী! প্রীতির বিরক্ত লাগার কথা। কিন্তু লাগছে না। বরং সে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল এক ছন্নছাড়া প্রেমিকের টলমল দৃষ্টির দিকে। কেবল প্রেয়সীর দুঃখের কথা চিন্তা করতেই যার চোখ অশ্রুসিক্ত হয়, সেই অসম্ভব কমলমনা মানুষটির দিকে!
প্রমথকে রান্নাঘরে দেখে নাফিসাও ঢুকলেন।
” তুই আবার এখানে কি করিস ভাই?”
প্রমথ মিষ্টি হেসে বললেন,” আজকে ভাবলাম সবার জন্য বিরিয়ানী রাঁধি। প্রীতিও খুব খেতে ভালোবাসে। আবার শুনলাম জেরিনেরও নাকি ফেভারিট।”
নাফিসা ডাইনিং টেবিলের চেয়ার টেনে বসতে বসতে বললেন,” তোর তো রান্না করার অভ্যাস হয়ে গেছে দেখা যায়। বেড়াতে এসেও রান্নাঘরে ঢুকে পড়েছিস। বাড়িতে কি প্রতিদিন তুই রাঁধিস?”
” বাপ-বেটির সংসার। আমি ছাড়া আর কে আছে? প্রীতি তো লেখাপড়া নিয়েই ব্যস্ত থাকে। চার-পাঁচটা টিউশন করায়। ওর সময় কই?”
” রান্নাবান্না জানে তো?”
প্রমথ স্টোভ বন্ধ করতে করতে বললেন,” তা জানে।”
” রান্না হয়ে গেল নাকি? দে তো, একটু চেখে দেখি। জেরিন আবার ঝাল খেতে পারে না৷ তুই মশলা বেশি দিসনি তো?”
প্রমথ প্লেটে অল্প বিরিয়ানী দিয়ে বললেন,” তুই নিজেই দেখে নে।”
বিরিয়ানী খেয়ে নাফিসা ফিদা হয়ে গেলেন।
” তুই তো জব্বর রান্না জানিস ভাই! মনে হচ্ছে হোটেলের বিরিয়ানী খাচ্ছি। উফ, ফাটাফাটি হয়েছে।”
প্রমথ বোনের থেকে এমন প্রশংসা পেয়ে হালকা লজ্জায় পড়ে গেলেন। প্রীতিও খাবার খেয়ে এমন বলে। প্রমথ ভাবতেন মেয়ে বুঝি বাপকে খুশি করার জন্য বলে। বাপ কষ্ট করে রান্না করেছে। ভালো না হলেও বলতে হবে। কিন্তু আজ নাফিসার কথা শুনে বুঝলেন, প্রীতি বাড়িয়ে বলতো না। নাফিসা খেতে খেতে বললেন,” মেয়ের বিয়ে দেওয়ার পর তোর প্ল্যান কি? একা হয়ে যাবি তো একদম। দেশে ফিরে কি করবি?”
প্রমথের বুক এখনি খাঁ খাঁ করছে। তিনি মাথা নিচু করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন।
” এখনও জানি না বোন। দেখি কপালে কি আছে!”
” আমার বাড়িতেই থাকতে পারিস তুই। রোজ এমন মজার রান্না করে খাওয়াবি আমাদের। আবার মেয়ের কাছাকাছিও থাকা হবে। প্রতিদিন প্রীতির সাথে দেখা হবে।”
প্রমথ বিস্মিত কণ্ঠে বললেন,” তুই কি সিরিয়াসলি বলছিস?”
” অবশ্যই সিরিয়াস। তুই থাকলে মাসুদকে বাদ দিয়ে দিবো। ড্রাইভিং তো তুই জানিসই। ওর বেতনটাই তোকে হাত খরচ হিসেবে দেওয়া হবে। ব্যাপারটা কিন্তু ভালোই। দেশে গিয়ে কি আর করবি? সেখানে কে আছে তোর?”
প্রমথ গোসল করতে যাওয়ার বাহানা দেখিয়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। মুখ অপমানে লাল হয়ে গেছে তাঁর। চোখ পানিতে টলমল। তিনি কষ্ট চেপে রাখলেন। মনে পড়ে যাচ্ছে শৈশবের কথা। নাফিসার সাথে তাঁর বয়সের পার্থক্য খুব বেশি নয়। দুই ভাই -বোন পিঠেপিঠি ছিল।
কত হল্লাহল্লি করে বড় হয়েছে। পাতের ভাতও ভাগ করে খেয়েছে। সেই বোন এখন নিজের ঘরে ভাইকে ভাইয়ের পরিচয়ে রাখতে চায় না। রাখতে চায় চাকরের বিকল্প হিসেবে। নাফিসার প্রস্তাব শুনে খুশিই হয়েছিলেন প্রমথ। প্রীতিকে ইচ্ছে করলেই দেখতে পারবেন এর চেয়ে আনন্দের বিষয় আর কিছু নেই। কিন্তু মেয়েটা যখন জানবে তার বাবা তারই আপন ফুপুর বাড়িতে কিভাবে থাকছে! তখন সহ্য করতে পারবে না। প্রীতির কত স্বপ্ন ছিল।
লেখাপড়া করে বড় হবে। অনেক টাকা জমাবে। বাবাকে নিয়ে বড় ফ্ল্যাটে উঠবে। দেশ-বিদেশে ঘুরবে। কিছুই পূরণ হলো না। মাঝখান থেকে মেয়েটার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। সবই আল্লাহর ইচ্ছা। হয়তো এটাই ভাগ্যে ছিল। নাহলে এতোবড় ঘর থেকে হঠাৎ প্রীতির জন্য প্রস্তাব কেন আসবে? সারাজীবনের জন্য মেয়েটা পর হয়ে যাচ্ছে। প্রমথ ঠিক করলেন প্রীতির বিয়ের পর বাংলাদেশেই ফিরে যাবেন। স্কুলের দপ্তরির চাকরিটাই করবেন। তাও বোনের বাড়ির বাবর্চি কিংবা ড্রাইভার হবেন না।
প্রীতিকে কিছু বলতে হয়নি। আশরাফ নিজে থেকেই প্রীতির হাত ছেড়ে দিয়েছে। প্রীতির খুব কষ্ট হচ্ছে এখন। ঈর্ষা হচ্ছে ফ্লোরার উপর। মেয়েটা এতো ভাগ্যবতী কেন?
” অ্যাশ, হাউ আর ইউ মাই ডিয়ার!”
ফরসা, লাল চুলের একটি মেয়ে এসে উপস্থিত হয়েছে। আশরাফ মেয়েটিকে দেখেই ছুটে গেল। আলতোভাবে আলিঙ্গন করল। ইংরেজিতে বলল,” মিয়েলা, কতদিন পর দেখছি তোমাকে। কেমন আছো?”
আশরাফের মুখে মেয়েটির নাম শুনে প্রীতির ভুল ভাঙল। সে এই মেয়েকে ফ্লোরা ভেবেছিল। মিয়েলা প্রীতির কাছে এসে বলল,” কে এই প্রিটি গার্ল?”
আশরাফ হেসে বলল,” শী ইজ একচ্যুলি প্রিটি। ওর নামটাই প্রিটি।”
” ওয়াও, নাইস নেইম৷ নাইস টু মীট ইউ প্রিটি।” মিয়েলা প্রীতির সাথে হ্যান্ডশেক করল। তারপর আশরাফ আর মিয়েলা নানান বিষয় নিয়ে গল্প শুরু করল। হুটহাট পুরনো বন্ধুর সাথে দেখা হলে যা হয়। প্রীতি ওদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে। একসময় আশরাফ বলল,” এতোদিন পর তুমি নিউইয়র্ক এসেছো। ফ্লোরার সাথে দেখা করবে না? ও কিন্তু একটু পরেই এখানে আসবে।”
ফ্লোরার নাম শুনে মিয়েলার মুখটা কেমন গম্ভীর হয়ে গেল। প্রীতি বিষয়টা খেয়াল করল। তারপর কি যেন হলো। মিয়েলা ঠুনকো একটা বাহানা দিয়ে খুব দ্রুত বিদায় নিয়ে চলে গেল। প্রীতির মনে হলো তাদের আলোচনা আরও দীর্ঘায়িত হতো। যদি না ফ্লোরার প্রসঙ্গ উঠতো। মিয়েলা ইচ্ছে করেই আশরাফের থেকে পালিয়ে গেছে। কারণ ফ্লোরা সংক্রান্ত আলোচনা সে শুনতে চায় না। কিন্তু কেন?
মিয়েলা চলে যাওয়ার পর আশরাফ প্রীতিকে বলল,” মিয়েলা হচ্ছে আমার আর ফ্লোরার বেস্টফ্রেন্ড। আমরা তিনজন এক কলেজে ছিলাম।”
প্রীতি হেসে বলল,” আমি কিন্তু মিয়েলাকে দেখে প্রথমে ফ্লোরা ভেবেছিলাম।”
আশরাফ অবাক হয়ে বলল,” কেন?”
” আপনার থেকে গল্প শুনে আমি ফ্লোরাকে মনে মনে যেমন ভেবেছি মিয়েলা ঠিক তেমনই।”
” কিন্তু আমি তো তোমাকে ফ্লোরার লুকস নিয়ে কিছু বলিনি।”
” তবুও আমি মনে মনে ভেবে নিয়েছি। ফ্লোরা ওয়ান্ডারফুল। “
আশরাফ চোখ বন্ধ করে মগ্ন কণ্ঠে বলল,
” ইয়েস। শী ইজ ওয়ান্ডারফুল। ওয়ান্ডারফুল স্মাইল, ওয়ান্ডারফুল হেয়ার, ওয়ান্ডারফুল ভয়েস! আমি ওর চেয়ে ওয়ান্ডারফুল পুরো পৃথিবীতে আর একটাও দেখিনি। শী ইজ দ্যা বেস্ট বিউটি ইনট্যায়ার ওয়ার্ল্ড!”
” আমার কিন্তু এখন ফ্লোরাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। ও কখন আসবে?”
” তুমি দেখতে চাও? আমি তোমাকে ওর ছবি দেখাচ্ছি।”
আশরাফ মোবাইল থেকে ফ্লোরার ছবি বের করল। প্রীতি খুব আগ্রহ নিয়ে ছবিটির দিকে তাকাল এবং চমকে গেল।
চলবে
®Fareen Ahmed