উইল ইউ ম্যারি মি? পর্ব ৭
প্রীতি কথাটা শুনার পর বেশ কিছুক্ষণ চুপ রইল। ধাক্কাটা সামলে নেওয়ার চেষ্টা। তারপর অবিশ্বাস্য কণ্ঠে বলল,” আপনি কি সত্যি বলছেন আন্টি? এটা কিভাবে সম্ভব? আশরাফ তো একবারও আমাকে এই ব্যাপারে কিছু বলেনি।”
আরোহী মৃদু হাসলেন। না সূচ মাথা নেড়ে বললেন,” বলবে না তো। কারণ এই কথা সে নিজেও জানে না।”
” মানে?”
” মানে আশরাফ এখনও জানে না যে ফ্লোরা সুইসাইড করেছিল৷ এই ব্যাপারটা ওকে এখনও বিশ্বাস করানো যায়নি। তাই কল্পনায় ফ্লোরার সাথে ও কথা বলে, ফ্লোরাকে নিয়ে ভাবে। ও মনে করে ফ্লোরা এখনও আমাদের সাথেই আছে।”
” তাহলে আপনারা ওকে এটা বোঝাচ্ছেন না কেন? ফ্লোরা যে মারা গেছে এটা ওকে বলে দিলেই হয়।”
” বলা সম্ভব না। স্পেশালিস্টের মতে, আশরাফ যতদিন জানবে ফ্লোরা জীবিত ততদিনই সে ভালো থাকবে। কিন্তু একবার যদি তার মস্তিষ্ক এটা বুঝতে পেরে যায় যে ফ্লোরা মারা গেছে! সে আর কখনও ফিরে আসবে না! তাহলে এটা সহ্য করতে না পেরে আশরাফ ব্রেইন স্ট্রোক করে ফেলবে। তার মস্তিষ্ক থেকে অনিয়ন্ত্রিত রক্তক্ষরণ শুরু হবে। এমনও হতে পারে যে সে সঙ্গে সঙ্গেই মারা গেল।”
প্রীতি মুখে হাত দিয়ে ধপ করে বিছানায় বসে পড়ল। এ কেমন ভয়ংকর ভালোবাসা? আরোহী প্রীতির কাঁধে হাত রেখে বললেন,” জানি আশরাফের মুখে ফ্লোরার নাম তুমি সহ্য করতে পারছো না। কিন্তু বিশ্বাস করো, আশরাফ ইচ্ছে করে তোমাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য এসব করছে না। এটাই তার রোগ।”
” এই রোগের কি কোনো চিকিৎসা নেই আন্টি?”
” আছে তো। চিকিৎসা চলছে। কিন্তু দুইবছরেও কোনো উন্নতি দেখলাম না।”
” আন্টি, ফ্লোরা কেন সুইসাইড করেছিল?”
” আশরাফ তোমাকে ফ্লোরার বাবা-মায়ের সমস্যার কথা বলেনি?”
” হ্যাঁ বলেছে। অনেকবারই বলেছে।”
” ওই প্রবলেমটা নিয়েই ফ্লোরা খুব ডিপ্রেসড ছিল। আর ডিপ্রেশন থেকেই সুইসাইড। তাছাড়া তোমার আঙ্কেলও ফ্লোরাকে খুব বেশি পছন্দ করতেন না। ফ্লোরার সাথে মেলা-মেশা করার জন্য একবার আশরাফকে ঘর থেকে বের করে দিয়েছিলেন।”
প্রীতির নিজেকে স্তব্ধ লাগছে। এজন্যই আশরাফ ওইভাবে প্রীতির কাছে ফ্লোরার বাবা-মায়ের ঝামেলা মেটানোর জন্য অনুরোধ করতো। বার-বার বলতো ফ্লোরার কষ্ট কমিয়ে দিতে। এখন প্রীতির কাছে সবকিছু স্পষ্ট হচ্ছে।
প্রীতি উঠে দাঁড়িয়ে বলল,” কিন্তু এর সাথে আমার আর আশরাফের বিয়ের কি সম্পর্ক আন্টি? ওর মতো পেশেন্টকে আপনারা বিয়ে কেন দিতে চাইছেন? ও তো ফ্লোরার জায়গায় কাউকে সহ্য করতে পারবে না। ওকে কি ওর মতো ছেড়ে দেওয়া উচিৎ না? যেভাবে থাকতে চায় ভালো থাকুক। আস্তে আস্তে সুস্থ হয়ে উঠুক। তারপর না হয় আপনারা ওর বিয়ের কথা ভাববেন।”
” বিয়ের সাথে ওর সুস্থ হওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই মা। ওকে সুস্থ করা আদৌ সম্ভব কি-না এটাই তো আমরা নিশ্চিত নই। আমরা শুধু এমন একজনকে চাই, যে সবসময় আমার ছেলের পাশে থাকবে। ওর খেয়াল রাখবে, বন্ধুর মতো আগলে রাখবে। আশরাফের পেশেন্টদের নিঃসঙ্গ থাকতে দেওয়া যায় না। তাই আমরা একটি বিশ্বাসযোগ্য ভালো মেয়ের খোঁজ করছিলাম। অনেকের সাথে কথা হয়েছে। কিন্তু কেউ দুইদিনের বেশি সহ্য করতে পারেনি। তুমি পেরেছো। এক সপ্তাহ ধরে বন্ধুর মতো ওর পাশে আছো। তোমাকে দেখে আমি ভরসা পেয়েছি। মনে হয়েছে তুমিই যে কাজটা খুব ভালো করে পারবে। আর আশরাফও খুব জলদি তোমার সাথে মিশে গেছে। এতো সহজে ও কারো সাথে মেশে না।”
আরোহীর হাতটা এখনও প্রীতির কাঁধে। শেষ কথাগুলো শুনে প্রীতি ভ্রু কুঞ্চিত করে কাঁধের হাতটা সরিয়ে দিল। রাগান্বিত স্বরে বলল,” এর মানে? আপনারা কি আমাকে বিয়ে দিতে চাইছেন নাকি চাকরি?”
” কাইন্ড অফ চাকরিই বলতে পারো!”
প্রীতির ধৈর্য্যের বাঁধ এবার সত্যিই ভেঙে গেল। আশ্চর্য, সে কি এতোই ফেলনা? গরীব হয়েছে বলে কি তার মতামত নেওয়ার কোনো প্রয়োজনই নেই! আশরাফের পরিবারকে সে আলাদা ভেবেছিল। কিন্তু এখন বুঝতে পারছে, সবাই এক। পৃথিবীর সকল পয়সাওয়ালা মানুষ একই রকম। আরোহী বললেন,” তুমি তো এতোদিন ভালোই ছিলে। হঠাৎ করে এখন কি হলো যে বিয়েটা ভাঙতে চাইছো?”
প্রীতি গরম হয়ে বলল,” আবার জিজ্ঞেস করছেন আমি কেন বিয়ে ভাঙতে চাইছি? এতোবড় সত্যি জানার পর বিয়ে ভাঙবো না তো কি করবো? নিজের বিবেককে প্রশ্ন করুন আন্টি, আপনি হলে কি বিয়েটা করতেন?”
” জানি না। হয়তো করতাম হয়তো না! কিন্তু তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে আশরাফের অসুস্থতার কথা তুমি প্রথমবার জেনেছো?”
” প্রথমবারই তো জানলাম। এর আগে কি আপনারা আমাকে বলেছেন? জানানোর প্রয়োজন মনে করেছেন? ধোঁকা দিয়ে বিয়েটা দিতে চাচ্ছিলেন।”
আরোহী এবার ক্ষীপ্ত হলেন।
” কি আবোলতাবোল বলছো? ধোঁকা দিলাম মানে? তোমার সাথে নাফিসা আপা আর জেরিন এই ব্যাপারে আলোচনা করেনি?”
” ওরাও এই ব্যাপারে জানে?”
প্রীতি যেন আকাশ থেকে পড়ল। আরোহী জোর গলায় বললেন,” সবাই সব জানে। তুমি নিজেই তো বলেছো তোমার মাসে মাসে এক লক্ষ ডলার আর একটা উচ্চ পরিচয় লাগবে। তাহলেই তুমি আশরাফের সাথে সারাজীবন থাকতে রাজি।”
প্রীতির মাথায় কিছু আসছে না। এসব সে কবে বলল? টাকার কাছে নিজেকে বিক্রি করার আগে তার মৃত্যু হোক। প্রীতি কাঁদতে শুরু করেছে। আরোহী নরম কণ্ঠে বললেন,” আই এম স্যরি। এভাবে বলতে চাইনি। কিন্তু তুমি ভাবতেও পারবে না তোমার প্রতি আমি কতটা কৃতজ্ঞতাবোধ অনুভব করেছিলাম। নাফিসা আপার কাছে শুনেছিলাম তোমার নাকি মা নেই। ভেবেছি আমি তোমার মা হবো। তোমাকে মেয়ের মতো যত্নে আগলে রাখবো। বিশ্বাস করো, আশরাফ তোমাকে একদম জ্বালাবে না। শুধু মাঝে মাঝে ফ্লোরার গল্প বলবে। তোমার কাজ আশরাফকে হাসি-খুশি রাখা। ওকে একদম কাঁদতে দিবে না। বিনিময়ে তোমাকে আমি আমার সব দিয়ে দিবো।”
প্রীতি চোখ মুছতে মুছতে হালকা হেসে বলল,
” টাকা-পয়সার প্রতি আমার কোনো দূর্বলতা নেই আন্টি। আমার শুধু একটাই দূর্বলতা হলো আমি কারো কষ্ট সহ্য করতে পারি না। কেউ আমার কাছে কেঁদে-কেটে কিছু চাইলে আমি কখনও নিষেধ করি না। যতক্ষণ মানুষটির মুখে হাসি না ফুটবে ততক্ষণ চেষ্টা চালিয়েই যাবো। এটাই আমি।”
আরোহী মিষ্টি করে হাসলেন। প্রীতির গাল দু’টো আলতো করে চেপে ধরে বললেন,” আমি জানি তো মা। তোমাকে দেখেই বুঝেছি। তুমি খুব চমৎকার একটি মেয়ে। সবচেয়ে আলাদা। এজন্যই তোমাকে আমার ঘরে চাই।”
প্রীতি কঠিন মুখে বলল,” কিন্তু আপনার অনুরোধ আমি রাখতে পারবো না আন্টি। এটা অসম্ভব।”
আরোহী বিপর্যস্ত কণ্ঠে বললেন,
” কেন?”
” আশরাফকে খুশি করার ক্ষমতা মহান আল্লাহ আমাকে দেননি। যদি আমি তার পাশে থাকি তাহলে সারাজীবন আমাকে তার কষ্ট দেখতে হবে। আমি সেই কষ্ট মেনে নিতে পারবো না। আমি আনন্দবিলাসী মেয়ে। চোখের পানি দেখলে যার বুক দুরুদুরু করে সে সারাজীবন কিভাবে কষ্টের সাথে বাস করবে আন্টি? এই কাজ আমার পক্ষে সম্ভব না। “
আরোহী হাহাকার করে কিছু বলতে নিচ্ছিলেন। প্রীতি সেই সুযোগ দিল না। নিজেই কথা বলতে থাকল,” কিন্তু আপনি বিশ্বাস করুন, যদি আশরাফকে ভালো রাখার বিন্দুমাত্র উপায় থাকতো তাহলে আমি আমার সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা করতাম। মানুষকে ভালো রাখতে প্রীতি ভালোবাসে। তবে আসল ব্যাপার হচ্ছে, সত্যিকারের ভালোবাসা কখনও হৃদয় থেকে মুছে ফেলা যায় না। ফ্লোরার প্রতি আশরাফের যে গাঢ় অনুভূতি আমি দেখেছি তা বিলীন করার এতো ক্ষমতা আমার নেই। আমাকে মাফ করবেন প্লিজ।”
প্রীতি এই কথা বলে আর এক মুহূর্তও থামল না। দ্রুত দরজা খুলে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। আরোহী হতাশ হয়ে বিছানায় বসে রইলেন। তার চোখ দিয়ে বাহিত হচ্ছে দুঃখের স্রোত।
প্রীতি ঘর থেকে বের হতেই আশরাফের সামনে পড়ে গেল। আশরাফকে হঠাৎ দেখে ভয়ে চমকে উঠল প্রীতি। আশরাফ হাসিমুখে বলল,” হেই প্রিটি, কেমন আছো? এতোরাতে আমাদের বাসায় কি করছো? আচ্ছা, ভালোই হয়েছে। ফ্লোরা তোমার সাথে কথা বলতে চাইছিল। তোমার ব্যাপারে আমি সব বলেছি ওকে। ও খুব খুশি হয়েছে জানো? কালকেই তোমার সাথে দেখা করতে চেয়েছে। তুমি আন্টি-আঙ্কেলের সাথে কথা বলে তাদের ঝামেলাটা মিটিয়ে দিতে পারবে না? ওরা যেন ডিভোর্স না করে। তাহলে ফ্লোরা খুব কষ্ট পাবে, খুব!”
প্রীতি কি বলবে বুঝল না। তার কি উত্তর দেওয়া উচিৎ? সরাসরি কি বলে দিবে যে সে আজ বাংলাদেশ ফিরে যাচ্ছে? আর কখনও তাদের দেখা হবে না! কিন্তু এটা বললে যদি আশরাফ তাকে যেতে না দেয়? আশরাফ মোবাইল নিয়ে ফ্লোরার নাম্বার ডায়াল করছে। হেসে বলল,” ফ্লোরাকে ফোন করে জানাই তুমি এসেছো। তোমার কথা শুনলেই ও খুশি হয়ে যাচ্ছে। খিলখিল করে হাসছে। ওর হাসিমাখা কণ্ঠ সুন্দর! তুমি শুনলে অবাক হয়ে যাবে। দাঁড়াও, এখনি শোনাচ্ছি।”
আশরাফ মোবাইল কানে দিয়ে রেখেছে। ওই পাশ থেকে একটা যান্ত্রিক কণ্ঠ স্পষ্টস্বরে জানান দিচ্ছে কল নট রিচেবল। সেই যান্ত্রিক কণ্ঠকে অবজ্ঞা করেই আশরাফ কথা বলে যাচ্ছে। যেন সত্যিই ফ্লোরার সাথে কথা বলছে। সে বুঝতে পারছে না যে ফোনের ওই পাশে কেউ নেই!
আজ বিকালেও প্রীতি প্রত্যাশা করছিল আশরাফ আর ফ্লোরার মতো ভালোবাসা যেন তার জীবনেও আসে। কিন্তু এখন প্রীতি আর সেই প্রত্যাশা করছে না। বরং এমন সর্বনাশা ভালোবাসা কারো জীবনে কখনোই না আসুক। যে ভালোবাসা সবকিছু ধ্বংস করে ছাড়ে সেই ভালোবাসার কোনো প্রয়োজন নেই। প্রীতি এক দৌড়ে ছুটে চলে এলো আশরাফের সামনে থেকে। লিভিং রুমে এসে বাবার হাত ধরল। চোখমুখ মুছে কান্না সামলে বলল,” বাবা চলো আমরা বাড়ি যাই।”
প্রমথ সরফরাজ সাহেবকে বিদায় জানালেন। তিনি অনুরোধ করলেন, অন্তত আজরাতে এখানে থাকার জন্য। সকালে তিনিই প্রীতিদের ফ্লাইটে তুলে দিবেন। কিন্তু প্রীতি রাজি হলো না। এই কষ্টমহল থেকে সে মুক্তি চায়।
আশরাফ লিভিং রুমে যতক্ষণে এসেছিল ততক্ষণে প্রীতিরা বের হয়ে গেছে। আশরাফ বাবাকে জিজ্ঞেস করল,” বাবা, প্রিটি চলে গেল কেন?”
সরফরাজ হাসার চেষ্টা করে বললেন,” ওর বাংলাদেশে একটা জরুরী কাজ পড়ে গেছে। তাই ওরা দেশে ফিরে যাচ্ছে।”
” দেশে ফিরে যাচ্ছে? ওরা কি আর আসবে না?”
” আসবে তো। নিশ্চয়ই আসবে। একমাস পর আসবে।”
আশরাফ একটু চিন্তা করল, একমাস তো খুব বেশি দেরী হয়ে যাবে। ততদিনে ফ্লোরার কষ্ট আরও বেশি বেড়ে যাবে। প্রীতির আসার আগেই যদি সে সুইসাইড করে? না,না আশরাফ আবার ফ্লোরাকে সুইসাইড করতে দেবে না। কিছুতেই না। প্রীতিকে আটকাতে হবে। আশরাফ দৌড়ে দরজার কাছে গেল। চিৎকার করে ডাকল,” প্রিটি!”
সাউন্ড প্রুফ ঘরের বাহিরে আশরাফের চিৎকার প্রীতির কানে গিয়ে পৌঁছাল না। আশরাফ বাহিরেও বের হতে পারছে না। রাতের বেলা তার বাড়ির বাহিরে বের হওয়া নিষেধ। দরজা লক করা থাকে। চাবি থাকে সরফরাজ সাহেবের কাছে।
প্রীতি বাবার হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে বলল,” এবার দেশে ফিরে আমি খুব মন দিয়ে লেখাপড়া করবো আব্বু। একটা ভালো ভার্সিটিতে ভর্তি হবো। একদিন আমি খুব ভালো কিছু করবো। বিয়ের কথা কিন্তু আর কোনোদিন আমাকে বলবে না তুমি। মনে থাকবে?”
প্রমথ সাহেব শুধু মাথা নাড়লেন। তিনি গভীর মনোযোগে কিছু ভাবছেন। প্রীতি বলল,” কি হয়েছে আব্বু তোমার?”
” সরফরাজ ভাই বোধহয় আমাকে কিছু বলতে চাইছিলেন।”
” কি বলতে চাইছিলেন?”
” শোনার সুযোগটাই তো পেলাম না। এর আগেই তো তুই এসে হাত ধরে বললি চলো বাড়ি যাই।”
প্রীতি মুচকি হেসে বলল,” একদম ঠিক করেছি।”
” তোর চোখে পানি কেন মা?”
” এটা খুশির অশ্রু আব্বু। তোমাকে ছেড়ে আর যেতে হচ্ছে না। আমার চেয়ে খুশি আজ এই পৃথবীতে কেউ নেই।”
প্রমথ মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,” আমার মা!”
চলবে
®Fareen Ahmed