মায়াবতী পর্ব ১৮
তানিশা সুলতানা
তন্নির জীবনটা হচ্ছে “এই ভালো এই খারাপ ” এই গানটার মতো।
খুব ছোট বেলায় মা মা*রা গেছে। তখন তন্নির সাত বছর বয়স হবে। এখনো ভালোই মনে আছে সব কিছু। মা মারা যাওয়ার পরে বছরখানিক মেয়েকে নিয়ে কাটিয়েছে তারেক। তার মনে হয়েছে আবার বিয়ে করলে সে যদি মেয়েকে ভালো না বাসে?
তন্নির মামা বাড়ি ঘুম বড়লোক। নাম করা পরিবার। তাদের একমাত্র বোন ছিলো তন্নির মা। ভালোবেসে বিয়ে করেছিলো তারা। সংসারে অভাব থাকলেও ভালোবাসার কমতি ছিলো না কখনো। কিন্তু সবার কপালে ভালোবাসা সয় না।
মা মারা যাওয়ার পরে তন্নিকে তার মামা মামি নানা সবাই নেওয়ার জন্য অনেক জোর করেছে তারেক দেয় নি। এই মেয়েটাই যে তার প্রাণ।
এক বছর পরে যখন বুঝতে পারলো সেএকা হাতে মেয়েকে সামলাতে পারছে না। সংসার চালানোর দায়িত্ব নেওয়া আর সংসারের কাজ করা একা হাতে কখনোই সম্ভব না। তারপর ইতিকে ঘরে আনলো। বিয়ের আগেই স্পষ্ট করে বলে দিয়েছিলো “শুধু তার বউ না তার মেয়ের মা হতে হবে”
বিয়ের পর থেকে প্রতিনিয়ত তারেক তার স্ত্রীকে বুঝিয়েছে তন্নি তার জন্য কি।
এতোবছরে ইতি কখনোই তারেকের সামনে তন্নির সাথে উঁচু গলায় কথা বলতে পারে নি। তার সাহসে কুলাই নি।
তারেক যখন জানতে পারলো ইতি তন্নিকে একা রেখে বাবার বাড়িতে এসেছে অনেক রাগারাগি করে ইতির সাথে। ইতি সকাল সকাল ছেলেকে নিয়ে বাড়ি ফিরে আসে। তন্নি বাড়ি আসার একটুখানি পরেই ইতি এসেছে।
ইতির মেজাজ ভালো নেই। প্রচন্ড রেগে আছে। কারণ ইতি ফেরার সময় তার ভাই ভাইয়ের বউরা তাকে নানারকম কথা বলেছে। তন্নির নামে বিষ ঢেলেছে কানে।
তন্নি খাটে বসে পড়ছিলো। তখনই ইতি রুমে ঢুকে পড়ে। তন্নির বই তন্নির থেকে কেড়ে নিয়ে ছিঁড়ে ফেলে দেয়। এতেই সে শান্ত হয় না তন্নির গালে পরপর দুটো চর বসিয়ে দেয় তারপর চুলের মুঠি করে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। খাটের পয়ার সাথে লেগে যায় তন্নির কপাল। মুহুর্তেই কপাল কে*টে গড়গড় করে র*ক্ত পড়তে থাকে।
তন্নি মাথা ধরে চোখ বন্ধ করে কিছুখন ঝিম মেরে বসে থাকে। তার চারপাশ ঘুরছে।
“কু*ত্তা*র বাচ্চা। তোর জন্য আমার অসুস্থ মাকে রেখে আসতে হলো। তুই ম*র*তে পারিস না? তুই ম*র*লে তো আমার ঝামেলা কমে। ঘাড়ের ওপর পা দিয়ে বসে আছিস। তোর বাবা আমাকে দাসী পেয়েছে?
ইতি বকতে থাকে তন্নি। তন্নি হাঁটু ভাজ করে বসে কাঁদতে থাকে। দুই গালে পাঁচ আঙুলের দাগ বসে গেছে। কপাল থেকে র*ক্ত পড়ছেই।
” সর তুই আমার চোখের সামনে থেকে। তোকে মে*রে পু*তে দিতে পারলে আমার জ্বালা জুড়োতো।
বলেই আবার মা*র*তে যায় তন্নিকে। তখনই ফোন বেজে ওঠে। স্কিনে বাবা নামটা জ্বল জ্বল করছে। ইতি জোরে জোরে শ্বাস টেনে নিজেকে শান্ত করে। তন্নি হাতের উল্টো পিঠে চোখের পানি মুছে ফেলে। টেবিলে রাখা পানি গ্লাস থেকে ঢকঢক করে পুরো গ্লাস পানি শেষ করে। তারপর লম্বা শ্বাস টেনে নিজেকে শান্ত করে।
তবুও ঠোঁট কেঁপে উঠছে। চোখের পানি গুলো উপচে পড়ছে।
“বাপের কাছে নালিশ দিলে তোকে শে*ষ করে দিবো আমি।
আঙুল তুলে স্বাশিয়ে বলে ইতি।
তন্নি কল রিসিভ করে।
” বাবা কেমন আছো?
ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকে বলে তন্নি।
“এই তো মা আলহামদুলিল্লাহ খুব ভালো। আমার সোনা মা কেমন আছে?
” আমিও ভালো আছি।
“মা টাকা পাঠাচ্ছি। তোমার যা যা লাগবে কিনে ফেলো। যতটাকা লাগে এখন আমি দিবো। তোমার যা খুশি করবা। প্রাইভেট শুরু করে দাও।
” হুমম বাবা।
“মা রে তোমাকে অনেক বড় হতে হবে। বাবার কষ্টের দাম রাখতে হবে তোমায়।
আমি তোমার পরিচয়ে বাঁচতে চাই।
” ইনশাআল্লাহ বাবা। তোমার স্বপ্ন আমি পূরণ করবো। এখন নাও মায়ের সাথে কথা বলো। আমি কলেজে যাচ্ছি।
বলেই ইতির কাছে ফোন দিয়ে দেয়।
তারপর মুখ আঁটকে দৌড়ে রুম থেকে চলে যায়। কান্না আটকাতেই পারছে না সে।
অনেকখন কল পাড়ে বসে কান্না করে। কাঁদতে কাঁদতে গলা বসে গেছে। চোখ দুটো লাল হয়ে গেছে। কপালের র*ক্ত জমাট বেঁধে গেছে।
এভাবে বাড়িতে থাকলে কখনোই কান্না আটকাতে পারবে না। ভালোও লাগবে না। তাই ভাবে কলেজে যাবে।
কপালের র*ক্ত মুছে মুখে একটু পাউডার লাগিয়ে কালো রঙের ওড়নাটা মাথায় চাপিয়ে কাঁধে ব্যাগ নিয়ে তন্নি বের হয় কলেজের উদ্দেশ্য। বলে যায় না ইতিকে। তামিমকে সামনে পায় নি। খোঁজার মতো মনও ছিলো না।
কড়া রোদে তন্নি রাস্তার পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। কাঁদতে কাঁদতে চোখ গুলো লাল হয়ে গেছে।
অথৈদের বাসার সামনে আসতেই দেখতে পায় অথৈ গাড়িতে বসে আছে। পাশে অর্ণব। নিশ্চয় তন্নির জন্যই অপেক্ষা করছিলো।
তন্নি চুপচাপ গিয়ে অথৈয়ের পাশে বসে পড়ে।
অথৈ তন্নির মুখ দেখেই বুঝতে পারে তন্নির মন খারাপ। এক হাতে জড়িয়ে ধরে তন্নিকে।
ড্রাইভার গাড়ি চালাচ্ছে। অর্ণব অথৈয়ের পাশে। সেও তন্নিকে দেখছে।
“কি হয়েছে জান তোর? আমায় বল।
তন্নির গালে হাত দিয়ে বলে অথৈ।
” আমি ঠিক আছি।
একটু হাসার চেষ্টা করে বলে তন্নি।
অথৈ বুঝতে পারে তন্নি বলতে চাইছে না। কিন্তু অথৈয়ের শুনতেই হবে। তন্নির কষ্ট দেখলে তারও কষ্ট লাগে।
“আমার দিকে তাকা তন্নি
তন্নির গালে হাত দিয়ে একটু শক্তি প্রয়োগ করে নিজের দিকে ফিরাতে চায় অথৈ। তন্নি ” ইসসসস” শব্দ করে ওঠে। চমকে ওঠে অথৈ। বুক ধক করে ওঠে।
অর্ণবও চমকায়। কি হয়েছে মেয়েটার?
“এই তন্নি কি হয়েছে বল আমায়?
তন্নি ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকাতে চায়। কিন্তু পারে না। অথৈ এবার তন্নির কপালে নজর দেয়।
” আল্লাহ কতোটা কেটে গেছে। তন্নি তোর গালে থা*প্প*ড়ের দাগ। তোকে ওই মহিলা মে*রে*ছে?
কতোবার বলেছি তুমি আমার কাছে থাকবি শুনিসই না আমার কথা।
কতোটা কেটে গেছে। র*ক্ত জমাট বেঁধে গেছে।
কাকা গাড়ি হাসপাতালের দিকে নিয়ে যায়।
অথৈ নিজের ব্যাগ থেকে রুমাল বের করতে করতে বলে।
অর্ণব হাত মুষ্টি বদ্ধ করে ফেলে। দাঁতে দাঁত চেপে তাকিয়ে থাকে তন্নির দিকে।
অথৈয়ের এমন অস্থিরতা দেখে তন্নির কলিজা ঠান্ডা হয়ে যায়। যাক বাবার পরে কেউ তো একজন আছে যে তন্নিকে নিঃস্বার্থ ভাবে ভালোবাসে।
বোতলের পানি দিয়ে রুমাল ভিজিয়ে তন্নির গালে ধরে অথৈ। চোখ দুটো তার চিকচিক করছে।
“আমি ঠিক আছি অথৈ। শুধু শুধু টেনশন করছিস।
অথৈয়ের গালে হাত দিয়ে বলে তন্নি।
“ওই মহিলা কি মানুষ না? ওনার কি একটুও দয়ামায়া নাই?
বলতে বলতে কেঁদে ফেলে অথৈ।
তন্নি অথৈকে জড়িয়ে ধরে। নিজের কান্নাগুলো দলা পাকিয়ে যাচ্ছে। ইচ্ছে করছে চিৎকার করে কাঁদতে। কিন্তু অর্ণবের দিকে চোখ পড়তেই কান্না আটকে যায়।
অর্ণবের চোখ দুটো লাল। যেনো সে রেগে আছে।
এখন অর্ণব ভালো মতো তন্নির গাল দুটো আর কপাল দেখতে পেলো।
মুহুর্তেই রাগ তরতর করে বাড়তে থাকে।
” হাউ ডেয়ার সী?
হাত কতো লম্বা হয়েছে তার?
সিটে ঘুসি মেরে চিৎকার করে বলে ওঠে অর্ণব।
কেঁপে ওঠে অথৈ আর তন্নি। তন্নি অথৈকে ছেড়ে দেয়।
“এই মেয়ে তোমার কি পবলেম? কেনো কল করলে না আমায়? কেনো ডাকলে না আমায়? তোমার হাত নেই। নিজেকে সেফ করতে জানো না তুমি? এতো বোকা কেনো তুমি?
তন্নির দিকে তাকিয়ে রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলে অর্ণব। তন্নি মাথা নিচু করে ফেলে।
” তোকে বলেছিলাম না?
চল এগিয়ে যাই ওদের বাড়ির দিকে? বলে ছিলাম কি না?
এগিয়ে গেলে এসব কিছুই হতো না। আমি সেফ করতে পারতাম ওকে।
অথৈ শুকনো ঢোক গিলে।
“ভাইয়া রিলাক্স। এতো হাইপার কেনো হচ্ছিস?
অথৈ অর্ণবের পিঠে হাত বুলিয়ে বলে।
” ওর গাল দেখেছিস তুই? হাইপার হবো না?
আমি তিন বছর অপেক্ষা করতে একদম পারবো না। ওই বাড়িতে ও তিন বছর থাকবে? ফাজলামো পেয়েছিস?
আজকেই বিয়ে করবো৷
তন্নি বড়বড় চোখ করে তাকায়। অথৈ কপালে হাত দেয়। অর্ণব রাগ কমাতেই পারছে না। ড্রাইভার ভয়ে ভয়ে ড্রাইভ করছে। যেনো পেছনে টর্নেডো বইছে।
চলবে………..