মায়াবতী পর্ব ৪২
তানিশা সুলতানা
বিয়ে একটা সামাজিক বন্ধন। দুটি মানুষের সারাজীবন এক সাথে থাকার পাকাপোক্ত প্রতিশ্রুতি হচ্ছে বিয়ে। সেই বিয়েটা যদি হয় প্রিয় মানুষটার সাথে তাহলে নিজেকে পৃথিবীর সব থেকে সুখি ব্যক্তি মনে হয় না? মনে হয় সব পেয়ে গেলাম।
সাগরের পাশে বসে সাগরের দিকে তাকিয়ে ভাবছিলো অথৈ। কিন্তু সাগরের দৃষ্টি খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে থাকা তন্নির দিকে। মেয়েটাকে সে আগেই হারিয়ে ফেলেছে। আজকে থেকে নিজেকেও হারিয়ে ফেললো। দুজনের রাস্তা দুদিকে চলে গেলো। তবে সারাজীবন একটা আফসোস থেকে যাবে “অসম্ভব ভালোবেসেও ভালোবাসার মানুষটিকে হারিয়ে ফেললো। মোনাজাতে চেয়েও তাকে পেলো না”
আল্লাহ যা করে ভালোর জন্যই করে। হয়ত এটাতেই ভালো হবে। কিন্তু মনটা তো মানতে চায় না। নিষিদ্ধ ইচ্ছে মনটাতে মাতিয়ে রাখে। দুমড়ে মুচড়ে শেষ করে দেয়।
এই শেষ সময়ে এসে একটাই প্রশ্ন সাগরের মনে জেগো উঠছে “আল্লাহ যার জন্য যাকে বানায় নি তার জন্য মনের এতো মায়া কেনো দিয়েছে” তার জন্যই কেনো মনটা কাঁদে?
কেনো এলোমেলো হলো সবটা? কেনো ভেঙে গেলো স্বপ্ন গুলো?
তন্নি সাগরের দৃষ্টি খেয়াল করে সরে যায়। আর্থির পাশে গিয়ে বসে। যেখানে থেকে সাগরকে দেখা যাচ্ছে না। তন্নির মনে সাগরের জন্য ফিলিংস কখনোই ছিলো না। সাগরকে কখনো ওই চোখে দেখেই নি। এটা চিন্তাও করে নি।
অথৈয়ের খারাপ লাগে। এই প্রথমবার প্রিয় বান্ধবীকে হিংসা হচ্ছে। তন্নিকে কেনো ভালোবাসলো? অথৈকে কেনো বাসলো না?
দীর্ঘ শ্বাস ফেলে অথৈ। ভালো না বাসলো শুধু একটুখানি কাছাকাছি থাকলেই হবে। একটু কেয়ার করলেই হবে। সারাজীবন প্রাণ ভরে দেখতে দিলেই হবে। আর কি চাই?
থাক না কিছু জিনিস না পাওয়া, এক জীবনে সব পেয়ে গেলে আফসোস করবো কি নিয়ে?
বিয়েটা সাদামাটা ভাবেই হয়ে যায়। রেজিস্ট্রি পেপারে সাইন করে কবুল বলে বিয়েটা শেষ হয়। অথৈ শুকরিয়া আদায় করে। ফাইনালি সে তার ভালোবাসার মানুষটিকে পেয়ে গেলো।
সাগরের বসে থাকতে কষ্ট হচ্ছে। মাথাটা বেশিই ঝিমঝিম করছে। তার পাশে অথৈ বসে।
সাগর অথৈয়ের দিকে না তাকিয়েই বলে
“আমি একটু রেস্ট নিতে চাই।
অথৈ বিচলিত হয়ে ওঠে।
” খারাপ লাগছে? কোথাও ব্যাথা করছে? বাবা কে বলবো?
“আই এম ওকে
জাস্ট মাথাটা ঝিমঝিম করছে।
” আচ্ছা চলুন তাহলে
অথৈ সাগরকে নিয়ে নিজের রুমে যায়। এমনিতেই অথৈ বেশ গোছালো। তবুও সাগরের জন্য একটু বেশিই পরিপাটি করেছে সব কিছু। সাগর একবার কথায় কথায় বলেছিলো গোলাপি তার পছন্দ। সেই কথা অনুযায়ী অথৈ পুরো রুম গোলাপি বানিয়ে ফেলেছে। দেয়াল থেকে শুরু করে বিছানার চাদর সব জায়গায় লাগিয়েছে গোলাপির ছোঁয়া।
পুরো রুমে চোখ বুলিয়ে সাগর মুচকি হাসে। মেয়েটা একটু বেশিই পাগল।
এটা ভালোবাসার জন্য না কি মোহে পড়ে জানা নেই।
তবে এটা মোহ ই হবে। ভালোবাসা কি আর এতো সহজে হয়ে যায়?
সাগর বিছানায় বসে।
অথৈ সাগরের পাশে বসে।
“মাথা টিপে দিবো?
” নো নিড
তুমি যেতে পারো।
অথৈ একটু অপমানিত হলেও যায় না। বুঝতেই পারছে সাগরের মাথাটা একটু বেশিই ব্যাথা করছে। আলতো করে চুলে হাত বুলিয়ে দিলে কমে যেতে পারে বা একটু আরাম লাগতে পারে।
নিলজ্জ অথৈ আবারও বলে ওঠে
“বসে কেনো? শুয়ে পড়ুন না। আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। একটু হলেও আরাম পাবেন।
সাগর অথৈয়ের দিকে তাকায়। ঠোঁট প্রসারিত করে একটু হাসার চেষ্টা করে বলে
” লাগবে না অথৈ। তুমিও রেস্ট নাও। তোমাকে দেখেও ক্লান্ত মনে হচ্ছে। খাও নি বোধহয় কিছু?
অথৈ মাথা নিচু করে লাজুক হাসে। লোকটা সত্যিই অসাধারণ। ঠিক বুঝে গেলো খায় নি। অথৈ তো তার আর তন্নির জন্যই অপেক্ষা করছিলো। এক সাথে খাবে বলে। কিন্তু মুখ ফুটে বলবে কি করে?
লজ্জা পাবে যে।
তবুও রিনরিনিয়ে বলে
“আপনার মাথা ব্যাথা কমলে সবাই মিলে এক সাথে খাবো।
সাগরের মুখটা সাধারণের চেয়েও একটু বেশি কালো হয়ে যায়। আবার তন্নি? এক সাথে খেতে হবে? এখন থেকে প্রতি পদে পদে তন্নির মুখোমুখি হতে হবে।
সাগর আর কথা বাড়ায় না। বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলে। অথৈ মাথার কাছে বসে নরম হাতে আলতো করে চুল টানতে থাকে৷ বেশ আরাম লাগছে সাগরের। তবুও মুখ দিয়ে বলে না।
অথৈ এক দৃষ্টিতে শুকনো মুখটার দিকে তাকিয়ে মাথা টিপতে থাকে।একদিনে মুখটা পুরো শুকিয়ে গেছে। একটু অন্য রকম লাগছে। কিন্তু তবুও ভালো লাগছে। বরং একটু বেশিই ভালো লাগছে।
কারণ এই মানুষটা তার স্বামী। সারাজীবন তার সাথে থাকার টিকেট পেয়ে গেছে।
” তুমি খুশি তো অথৈ?
সাগরের হঠাৎ করে করা প্রশ্নে চমকে ওঠে অথৈ। সে সাগরের মাথা থেকে হাত সরিয়ে সোজা হয়ে বসে। সাগর চোখ খুলে তাকায় অথৈয়ের দিকে।
মেয়েটা সুন্দর। একটু বেশিই সুন্দর।
“আমাকে একটু সময় দিও অথৈ। ভুল বুঝো না। তন্নিকে হিংসা করো না। আমার জন্য এটলিস্ট তোমাদের এই সুন্দর সম্পর্ক নষ্ট করো না।
আমি সবটা ঠিক করে দিবো। জাস্ট একটু সময়,প্রয়োজন। সবে একটা ধাক্কা সামলে উঠলাম তো।
অথৈ মুচকি হাসে
” তন্নিকে হিংসা করার প্রশ্নই ওঠে না। আমার ভালোবাসার মানুষটিকে আপনি ভালোবাসেন। এতে আমি সত্যিই খুশি। আমি সারাজীবন আপনাকে আর তন্নিকে নিয়ে ভালো থাকবো। হ্যাপি থাকবো। আর কিচ্ছু চাই না।
সাগর মুচকি হাসে। হাত বাড়িয়ে অথৈয়ের নাক টেনে দেয়।
“তোমার মাথা থেকে একটুখানি বুদ্ধি তোমার পাগল ভাইকে দিও। সে তন্নির ব্যাপারে বেশ লয়াল। কিন্তু বেপরোয়া।
” এভাবেই ভালো আমার ভাই। সবাই তো সব্ভ প্রেমিক। আমার ভাই না হয় একটু বেপরোয়া প্রেমিক হলো।
__
তন্নি আশা বেগমের হাতে হাতে সাহায্য করছে। কেউ কারো সাথে কোনো কথা বলছে না। তন্নিরও ওনার সাথে কথা বলার খুব বেশি ইচ্ছে নেই।
এখানে আসতো না। শুধুমাত্র বয়ষ্ক মানুষ এতো কিছু একা একা করতে গিয়ে হাঁপিয়ে উঠবে। তাই এসেছে। আর্থিও এসেছিলো কিন্তু তার বর কল করাতে সে চলে গেছে।
খাবার গোছানো প্রায় শেষ তখন তন্নি চলে যায়। অর্ণবকে দেখে না অনেকখন হলো। কোথায় গেলো লোকটা? এমনিতে তো সারাক্ষণ পেছন পেছন ঘুরতে থাকে দুষ্টুমি করতে থাকে। তাহলে আজকে কোথায় গেলো?
রেগে গেলো না কি লোকটা?
তন্নি অর্ণবকে খুঁজতে খুঁজতে অর্ণবের রুমে চলে আসে।
এতো সুন্দর করে সাজানো দেখে মুচকি হাসে। লোকটা আসলেই একটা পাগল। না হলে কি বউ আসার খবর নেই বাসর সাজিয়ে বসে থাকতে পারে?
খাটের পাশে তন্নির চোখ যেতো চমকে ওঠে। কারণ ওইখানে অর্ণব আর তার একটা কাপল পিক। যেখানে অর্ণব তার দিকে তাকিয়ে আছে আর সে আকাশের দিকে। দুজনকেই সুন্দর লাগছে। পিকটা অর্ণবের বার্থডের দিনকার।
ব্যালকুনি থেকে অর্ণবের কথার আওয়াজ আসছে। তন্নি মুচকি হেসে সেদিকে এগিয়ে যায়। কিন্তু কিছু কথা কানে আসতেই থেমে যায় তন্নি।
অর্ণব ফোনে বলছে
“অর্ণব চৌধুরী ফেলে দেওয়া জিনিস কুড়িয়ে নেয় না।
তুমি কি ভেবেছিলে? আমাকে অপশন হিসেবে রাখবে আর আমি জানবো না? আর জানলেও তোমাকে নিয়েই পড়ে থাকবো?
ওপাশ থেকে কিছু বলার পরে অর্ণব বলে
“তন্নিকে আমি ভালোবাসি। আমার কাছে পৃথিবীর সব চেয়ে সুন্দরতম মানুষ হচ্ছে আমার অনির মাম্মা। মিস ওয়ার্ল্ড সে আমার। তাকে ছেড়ে দেওয়ার মতো অনেক গুলো কারণ আছে কিন্তু আমি সেসব দেখবো না।
আর তন্নি সম্পর্কে আমি অন্য কারো থেকে কিছু শুনবোও না। সী ইজ মাই ওয়াইফ। তার সম্পর্কে কিছু বলতে হলে দশ বার ভেবে বলতে হবে। নাহলে জি*ভ টে*নে ছিঁ*ড়ে দিবো।
চলবে………….