মেঘের দেশে প্রেমের বাড়ি
লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা
|৪|
তরু ভার্সিটির সরু রাস্তা ধরে হাঁটছে। ভার্সিটির এদিকটায় প্রায় হাঁটু সমান ঘাসের প্রলেপ। খেয়াল করে তাকালেই অদূর নদীতে পাল তোলা নৌকা চোখে পড়ে। তরুর অবশ্য নৌকা দেখতে ভালো লাগে না, এখান থেকে আকাশটা খুব বিশাল ঠেকে, তরু ঘাসের ভেতর গা ডুবিয়ে বিশাল ওই আকাশ দেখে। এই জায়গাটা প্রেমিকাদের। খেয়াল করে দেখলে, নৌকার মতো ঝোপেঝাড়ে বন্য প্রণয়ে ব্যস্ত জোড়া জোড়া প্রেমীদেরও দেখা মিলে। এখানে কেউ একা আসে না। একা আসে শুধু তরু। যখনই ক্লাস করতে ইচ্ছে হয় না। তখনই এসে গা ডুবিয়ে দেয় অথৈ ঘাসের মেলায়। তরুর অবশ্য কোনোদিনই ক্লাস করতে ইচ্ছে হয় না। তার ধারণা, সে আচমকা একদিন বড়ো কিছু হয়ে যাবে। ক্লাস করা না-করার মতো ছোটখাটো বিষয় তার বড়ো হওয়া আটকাতে পারবে না। সুতরাং, মনোযোগ দিয়ে আকাশ দেখো, ক্লাস করতে হবে না। তরু কাঁধের ব্যাগটা ঘাসের উপর ছুঁড়ে ফেলে, জুতো জোড়া খোলে, নিজেও গা এলিয়ে দিলো ঘাসের ভেতর। এখন আর তাকে দেখা যাবে না। ঘাসের দলের সাথে মিলেমিশে সবুজ কুর্তী পরা তরুও হয়ে যাবে সত্যিকারের গাছ। তখন তরুকে লাগবে অতিমানবী। হেমা তাকে খুঁজে পেলে গম্ভীর কণ্ঠে বলবে,
‘ তোকে মেঘের দেশের রাজকন্যার মতো লাগছে। রক্তে-মাংসে গড়া একটি মেয়ে আচমকা মেঘের দেশের রাজকন্যা হয়ে গিয়েছে, বিষয়টা মানা যাচ্ছে না। তুই উঠে আয়। আর কক্ষনো ঘাসের বনে শুতে আসবি না।’
তরু তখন হাসবে। তার হাসি দেখে হেমা শিউরে উঠবে। আচ্ছা, মাহবুবও কী এমনই শিউরে উঠবে? আশ্চর্য মুগ্ধতায় হেমার মতো করেই বলে ফেলবে,
‘ তুমি কখনো হেসো না। তুমি হাসলে পৃথিবীর যাবতীয় সৌন্দর্য মিথ্যে মনে হয়!’
তরু হেসে ফেললো। আকাশের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতেই তার খুব মাহবুবকে নিয়ে গল্প করতে ইচ্ছে হলো। যদিও তরুর কাছে মাহবুবের কোনো গল্প নেই। তার ঝুড়িতে যাবতীয় গল্প আছে কেবল মাহবুবের কোনো গল্প নেই। তবুও তরুর ইচ্ছে হয়। সকল দেওয়াল ভেঙে নকশীকাঁথার মতো আদর মেখে একটা একটা করে গল্প লিখতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু কার কাছে লিখবে? তার যে কোনো বন্ধু নেই।
উহুঁ, ভুল হলো। এই ছোট্ট জীবনে তরুর কোনো বন্ধু নেই, বলাটা খুব অন্যায় হবে। ভাগ্যবিধাতা তরুর বন্ধুভাগ্য লিখেছিলেন বড়ো আদর করে। ঠিক যেন নকশিকাঁথার মতোন করে। তাই বোধহয় ছোটকাল থেকেই তরুর বন্ধু ভাগ্য চমৎকার। এক ঝাঁক সমবয়সীরা তাকে ঘিরে রাখে অনেকটা মৌমাছির মতো। মৌমাছি যেমন মধুকে আহরণ করতে চায়। মধুকে তার আকাঙ্ক্ষার কথা জানায়। শোনায় তার দুঃখ, সুখ, সমুদয় ক্ষুধার কথা। তরুর বন্ধুমহলও তাদের ভেতরের পুরোটা খুচরো খামে ভরে তুলে দেয় তরুর হাতের মুঠোয়। তাদের সকল হতাশা, বিষাদ, আনন্দে তরুর অংশগ্রহণ বাধ্যতামূলক। কিন্তু তারা জানে না, সকল আমেজের বিপরীতেই একটা করে অন্ধকারের গল্প থাকতে হয়। পৃথিবীর সমস্ত আয়োজনের পেছনেই কোথাও না কোথাও খুব ফাঁকা থেকে যায়। একাকিত্ব থেকে যায়। সেই একাকিত্ব কাউকে বলতে নেই, জানাতে নেই। সেই একাকিত্বগুলো সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন করতে নেই। আমরা আলো মেখে উল্লাস করতে ভালোবাসি। সেই আলোর বিপরীতে যে অন্ধকার আছে সেই অন্ধকার নিয়ে ভাবনা বড়ো নিরর্থক মনে হয়। তবু কেউ কেউ ভাবে। অন্ধকারকে জানতে মন্ত্রমুগ্ধের মতো তলিয়ে যায় অতল অন্ধকারে। তবু যেন ঠিক অন্ধকার খুঁজে পায় না। তারা খুঁজে পায় অসীম ধাঁধা। তরু তার অন্ধকারটুকুকে খুব যত্ন করে লুকিয়ে রাখে আলোর পিঠে। তারা তরুকে দেখে। তরুকে ঘিরে বাঁচে। অথচ তরুর ভেতর যে আস্ত একটা দেওয়াল আছে। সেই দেওয়ালের ভেতর যে কতো কতো গল্প আছে; সেই গল্প ছুঁয়ে দিতে পারে না। দেওয়াল পেরিয়ে অনেকটা পথ হেঁটে যেতে পারে না কেউ। আলো-আঁধারির খেলায় তরু একলা চলে। একলা হাসে। এই পৃথিবী তাকে জানে যৎসামান্য। তবুও তরু স্বপ্ন দেখে। কোনো একদিন কেউ এই দেওয়াল ভেঙে ঢুকে পড়বে অন্তঃপুরে। তরুকে জেনে যাবে। তরুকে হারিয়ে দিয়ে ভেদ করে ফেলবে সমুদয় রহস্য। তরু ঘাসের উপর শুয়ে আকাশ দেখে। আকাশের বুকে চঞ্চলা কিশোরীর মতো ছুটে বেড়ানো মেঘদেরকে শুধায়,
‘ বলো তো, সে কোথায় থাকে?’
মেঘেরা খিলখিল করে হাসে। কাচের চুড়ির মতো রিনঝিন করে উঠে সেই শব্দ। সোনালি আলোয় তরুর চোখ ঝলসে যেতে চায়। তবুও তরু চেয়ে থাকে পলকহীন। সূর্যের সাথে এ তার পুরাতন খেলা। চোখে-চোখে খেলা। তরুর চোখ টলমল করে উঠে জলে। চোখের পাড় উপচে জল গড়ানোর আগেই সূর্যকে আড়াল করে দাঁড়ায় মেঘেদের দল। তরু হেসে ফেলে। বিজয়ের খুশিতে উচ্ছ্বসিত হয়। গর্বিত কণ্ঠে বলে,
‘ এবারও হারলে। এবার বলো দেখি ভাই, সে কোথায় থাকে? সেই দেওয়াল ভাঙার মানুষ, কোথায় তার বাস?’
পরাজিত সূর্য আর চঞ্চলা মেঘেরা সমস্বরে উত্তর দেয়,
‘ প্রেমের বাড়ি।’
তরু বিড়বিড় করে,
‘ প্রেমের বাড়ি?’
তরুর মোবাইল টেলিফোন বিপ বিপ শব্দ তুলছে। তরু ঘাসের উপর পড়ে থাকা ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করলো। রিসিভ করেই বললো,
‘ আপনাকে একটা প্রশ্ন করবো দুলাভাই। প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার সময় হলো তিন সেকেন্ড। তিন সেকেন্ডের মধ্যে উত্তর দিতে পারলে পাবেন আকর্ষণীয় এক উপহার। প্রশ্নটা শুনতে চান?’
সজল প্রশ্ন শুনতে চাইলো। তরু বললো,
‘ বলুন দেখি, হয়ার ইজ প্রেমের বাড়ি? দ্য হাউজ অব অ্যামুয়র।’
সজলের কপালে ভাঁজ পড়লো। ‘দ্য হাউজ অব অ্যামুয়র’ কোথায় সে জানে না। এতো এতো বই পড়েছে অথচ দ্য হাউজ অব অ্যামুয়র কোথায়, তা সে জানে না, আশ্চর্য! তরু বললো,
‘ আপনি দুইটা শূন্য পেয়ে ফেইল দুলাভাই। টাইম আপ। আপনার জেনারেল নলেজ খুবই দুর্বল। এজন্যই বাবা আপনাকে ছাগল বলে।’
সজল ব্যথিত কণ্ঠে বললো,
‘ তুমি কিন্তু আমায় অপমান করছো, তরু।’
‘ একদমই না। আমি সত্যটা বললাম। সত্যে কোনো অপমান নেই; আপনি প্লিজ অপমানিত হবেন না। বাবা যে শ্রেণির পুরুষদের ছাগল বলে, আমার কিন্তু সেই শ্রেণির পুরুষদেরই বেশি পছন্দ। সে হিসেবে আপনাকেও আমার ভীষণ পছন্দ দুলাভাই।’
সজল দীর্ঘশ্বাস ফেললো। শুধালো,
‘ তা তোমার পুলিশ বর কোন ক্যাটাগরিতে পড়ে তরু?’
তরু বললো,
‘ সে একটা গরু।’
সজল হেসে ফেললো,
‘ কেন? বর পছন্দ হয়নি? মাহবুব তো ভালো ছেলে।’
‘ কী করে বুঝলেন ভালো ছেলে?’
‘ আমরা দুজন একসাথেই পুলিশ ক্যাডার পেয়েছিলাম। একই জায়গায় পোস্টিং ছিলো বিধায় হালকা-পাতলা পরিচয়ও হয়েছিলো। খুবই ঠান্ডা মেজাজের ছেলে।’
‘ তারমানে এই মেচ মেকারের উদ্যক্তা আপনি?’
সজল তাড়াহুড়ো করে বললো,
‘ আরে না, আমি তো সিভি দেখে খোঁজ নেওয়ার পর জানলাম ছেলেটাকে আমি চিনি।’
তরু দীর্ঘশ্বাস ফেললো,
‘ আপনার জানায় ভুল আছে। মাহবুবুল হাসান নিরব একদমই ঠান্ডা মেজাজের ছেলে নয়। তার ছোট ভাইয়ের ভাষ্যমতে, রেগে গিয়ে সে মানুষকে ধরে বেগুনের মতো ছুলে ফেলে। বউকে কেমন ছোলা ছুলবে সেটা অবশ্য বুঝা যাচ্ছে না। বেগুন ছোলা, আলু ছোলা, পটল ছোলা, যেকোনো রকমের ছোলা হওয়ার সম্ভবনা আছে।’
সজল অবাক হয়ে বললো,
‘ ছোট ভাই আর বউ কী এক হলো নাকি?ওর নামের মতো ও নিজেও ভীষণ নিরব। তোমার কী মাহবুবের সাথে দেখা হয়েছে?দেখলে বুঝতে।’
তরু রিনরিনে কণ্ঠে গুনগুনিয়ে উঠলো,
‘ বন্ধু তিনদিন তোর বাড়ি গেলাম,
দেখা পাইলাম না।
আমার জামাই তুমি দেখলা,
আমি দেখলাম না।’
তরুর এলেমেলো গানের কথা শুনে হেসে ফেলতে গিয়েও থমকে গেলো সজল। মনে মনে বলতে বাধ্য হলো, মেয়েটা কী চমৎকার গায়! আশ্চর্য চৌম্বকীয় শক্তি তার গায়ে, কণ্ঠে, মননে!
–
ঘরের কোণে সন্ধ্যে নামতেই ঘরের সকল আলো নিভিয়ে দিলো তরু। আজ তার ভয়ংকর মন খারাপ। মন খারাপ উদযাপন করতে হয় অন্ধকার ঘরে। আলো জ্বালিয়ে মন খারাপ উদযাপন করা যায় না। তরুর সাধারণত মন খারাপ হয় না। আজ হচ্ছে। আজকাল তার সাথে খুবই উলোটপালোট ধরনের ঘটনা ঘটছে। যার একমাত্র দায়ভার তরু বিনা সালিশে মাহবুবের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছে। চাপিয়ে দেওয়ার পেছনেও অবশ্য যথাযোগ্য কারণ আছে। এই যেমন, আজ তরু সারাদিন মাহবুবের কথা ভেবেছে আর ঠিক সন্ধ্যেবেলায় তার মনে হয়েছে, মাহবুবকে সে একপাক্ষিকভাবে জল্পনা-কল্পনা করলেও মাহবুবের বোধহয় তরু নামটাও মনে নেই। ডিউটিওয়ালা ডিউটি করতে করতে নিজের বিয়ের কথাটাও ভুলে গিয়েছে। আর এদিকে তরু মাহবুব মাহবুব জপ করে ওয়াশরুমে যেতে ভুলে যাচ্ছে। অত্যন্ত অপমানজনক ঘটনা। মাহবুব যদি একবার ফোন দিয়ে বলতো,
‘ প্রিয় তরু, তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচতে পারছি না।’
তাহলেই তরুর মন খারাপ হতো না। যেহেতু বলেনি সেহেতু মাহবুবকে দোষ দেওয়া অন্যায় কিছু হচ্ছে না। মাহবুব দোষী। দোষী মাহবুবকে তরু এতো সহজে ক্ষমা করবে না। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, তরু জানে এইযে মাহবুব তাকে এতো এতো অপমান করলো? মাহবুব এই অপমানের পরিবর্তে কক্ষনো ক্ষমা টমা চাইবে না। না চাইলে না চাক ক্ষমা। তাই বলে কী তরুর রাগের দাম নেই? অবশ্যই আছে। তরু দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তীব্র মনব্যথা নিয়ে সে গভীর ঘুমের প্রস্তুতি নিলো।
গভীর ঘুমে তরু মাকে দেখতে পেলো। কালো পর্দার মতো গাঢ় অন্ধকারে সাদা ধবধবে শাড়িতে দাঁড়িয়ে আছেন মা। তরুর দিকে চেয়ে হাসছেন। হাসতে হাসতেই কেঁদে ফেললেন। ডাকলেন,
‘ তরু! তরু!’
তরুর হঠাৎ গা ছমছম করে উঠলো। অদ্ভুত এক ভয়ে আষ্টেপৃষ্টে ধরলো শরীর। থরথর করে কেঁপে উঠলো দেহ। তরু ফিসফিসিয়ে বললো,
‘ মা! আমি তোমায় ভয় পাচ্ছি মা। তোমাকে মা মা লাগছে না। তোমার পাশে ওটা কে মা? ও কে?’
মা কাঁদছেন হুহু করে। ঠোঁট নড়ছে। কিছু বলছেন। তরু শুনতে পাচ্ছে না। কেবল শুনছে,
‘তরু! তরু!’
তরুর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে ভূমিকম্প বয়ে যাচ্ছে। রিখটার স্কেলে মাপলে কত হবে এই ভূমিকম্পের চাপ? তরু এই অন্ধকার কাটিয়ে জেগে উঠার চেষ্টা করছে। কী আশ্চর্য অন্ধকার এখানে! মহাকাশের মতো অতল, অসীম এই অন্ধকারে কী করে থাকছে মা? এতো অন্ধকার কেন? মা বললেন,
‘ আমি আসছি তরু।’
তরু ফিসফিসিয়ে বললো,
‘ তুমি কেন আসবে? তোমার তো আসার কথা না মা। মৃত্যুপুরী থেকে কেউ ফিরে আসে না। তোমাকে ওখানেই থাকতে হবে।’
‘ তোমাকে একটা কথা বলতে আসছি। কথাটা তুমি ভুলে গিয়েছো। ভয়ংকর কথাগুলো মনে রাখতে হয়।’
‘ আমি কিছু মনে করতে চাই না।’
মা কাঁদতে কাঁদতেই হাসছেন। সেই হাসির পেছনে খিলখিল আওয়াজ হচ্ছে। কী অদ্ভুত তীক্ষ্ণ সেই শব্দ! অসীম অন্ধকার ফুঁড়ে বেরিয়ে আসছে। বেরিয়ে এসে কোথায় যাচ্ছে? এখানে একমাত্র সত্য তো কেবল অন্ধকার। তরু প্রাণপণে জেগে উঠার চেষ্টা করছে। মা বিড়বিড় করে বলছেন,
‘ ভয়ংকর কথা। আমি আসছি।’
তরু চিৎকার দিয়ে উঠলো। মা আবারও বিড়বিড় করলেন,
‘ একটু কষ্ট হবে। আমি আসছি।’
তরু ঘুম ভেঙে ধরফর করে উঠে বসলো। কিন্তু একি! ঘরে আলো নেই কেনো? এ কোন দুনিয়ায় চলে এলো তরু? চারপাশে এতো দমবন্ধকর নির্জনতা! এতো অন্ধকার! তরু হাসফাস করে উঠলো। তার দমবন্ধ লাগছে। এখানে কোনো আলো নেই কেন! কেউ আলো জ্বালাও। তরু মারা যাচ্ছে। তরু কালো কাপড়ের ন্যায় গাঢ় অন্ধকারেও যেন স্পষ্ট এক ছায়ামূর্তি দেখতে পেলো পায়ের কাছে। কেমন রোমশ তার গায়ের চামড়া। ছায়ামূর্তি তাকে ডাকছে,
‘ তরু! তরু!’
তরু চেঁচিয়ে উঠলো। তার চিৎকার কেউ শুনছে না কেন? এই অন্ধকার পৃথিবীতে আলো নেই কেন? কেউ আলো জ্বালো! এই অসীম অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছে তরু। এই অন্ধকার কখনো শেষ হবে না। তরু ডুকরে কেঁদে উঠলো।অন্ধকারে তলিয়ে যেতে যেতেই শুনলো কেউ তাকে ডাকছে,
‘ তরু! কী হয়েছে? এই তরু! কথা বলো। কাঁদছো কেন?’
তরু এবার হুহু করে কেঁদে উঠলো। কী অসহায়, করুণ তার হাহাকার।
‘ আমি কিছু দেখতে পাচ্ছি না মাহবুব। এখানে কোনো আলো নেই। এখানে কোনো আলো নেই কেন? আমার দমবন্ধ লাগছে। আমি তলিয়ে যাচ্ছি। তুমি কোথায়? আমার হাত ধরো, নিয়ে যাও আমায়। আমি ভয় পাচ্ছি।’
‘ আমি তো তোমার কাছে নেই। কী করে হাত ধরবো?’
তরু কাঁদছে,
‘ আমি ভয় পাচ্ছি। কোথায় তুমি? হাত ধরো। হাত ধরো।’
মাহবুব নরম কণ্ঠে বললো,
‘ রিল্যাক্স। শান্ত হও। শান্ত হও। কোনো ভয় নেই। তুমি আমায় টেলিফোন করেছো। আমার সাথে কথা বলছো। তারমানে তোমার আশেপাশে ফোন আছে। ফোনের আলো জ্বালো। অন্ধকার কেটে যাবে।’
তরু থরথর করে কাঁপছে। ফাঁকা মস্তিষ্কে পৃথিবীর সকল কিছুই অন্ধকার ঠেকছে; দিক ঠিক করা যাচ্ছে না। তরু বিড়বিড় করলো,
‘ ফোন নেই। কোনো ফোন নেই। আলো নেই।’
‘ আলো আছে। আমি ফোন কেটে কল ব্যাক করছি। তুমি দেখবে তোমার আশেপাশে কোথাও আলো জ্বলবে। শান্ত হও। কিচ্ছু হয়নি। কোনো ভয় নেই।’
মাহবুব ফোন কেটে পুনরায় কল করলো। তরুর হাতেই রিংটোন বেজে উঠলো। তরু ফোনটা উল্টো করে ধরে আছে। এক টুকরো আলোয় তরুর ঘোর সামান্য কাটলো। এই আওয়াজ কীভাবে বন্ধ করা যাবে এই চিন্তায় ফাঁকা মস্তিষ্কে চেয়ে রইলো ফোনের স্ক্রিনে। বেশ অনেকটাক্ষণ সময় নিয়ে ফোন রিসিভ করলো তরু। মাহবুব ওপাশ থেকে উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বললো,
‘ ফোন রিসিভ করতে এতো দেরী করলে কেন? ঠিক আছো?’
‘ হু।’
‘ ফোনের আলো জ্বালো।’
তরু যন্ত্রের মতো আলো জ্বাললো। মাহবুব বললো,
‘ রুমের সুইচবোর্ড কোথায়? রুমের সব আলো জ্বেলে দাও।’
তরু ততক্ষণে কিছুটা ধাতস্থ হয়েছে। বিছানা থেকে নেমে আলো জ্বাললো। মাহবুব তাকে পানি খেতে বললো। তরু বাধ্য মেয়ের মতো কয়েক ঢোক পানি গিললো। পানির বোতল ধরতে গিয়ে বুঝলো হাত-পা এখনও থরথর করে কাঁপছে। অদ্ভুত এক অশরীরী ভয়ে কাটা দিচ্ছে শরীর। তরু বললো,
‘ আমার বাবার কাছে যেতে ইচ্ছে করছে। বাবাকে টেলিফোন করতে ইচ্ছে হচ্ছে।’
‘ সকালে করো। এতোরাতে কল করলে ভয় পেয়ে যাবেন বাবা।’
‘তাহলে আপাকে টেলিফোন করবো?’
‘ কাউকে টেলিফোন করার দরকার নেই। সবাই ভালো আছেন।’
তরু বহু বছর সংসার করে সংসারের গভীর মায়ায় জড়ানো বধূটির মতো সহজ উদ্বেগ নিয়ে শুধালো,
‘ তুমি ভালো আছো?’
মাহবুব আশ্বাস দিলো,
‘ আমিও ভালো আছি। চিন্তা করো না তরু।’
তরু প্রলম্বিত শ্বাস ফেললো। মাহবুব শুধালো,
‘ হলে আছো? তোমার রুমে কেউ নেই?’
‘ উঁহু। সবাই বাড়ি গিয়েছে।’
‘ তুমি যাওনি কেন?’
তরু উত্তর দিলো না। মাহবুব বললো,
‘ ঘুমিয়ে পড়ো এবার। আলো জ্বেলেই ঘুমাও।’
‘ তুমিও ঘুমাও। আর কতক্ষণ ফোন ধরে থাকবে?’
‘ সকাল হতে আর চার ঘন্টা বাকি। সকাল পর্যন্ত আমি ফোনে থাকবো। ভয় নেই, তুমি ঘুমাও।’
তরু দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ফোন কানে শুয়ে পড়ে ভীত চোখে আশেপাশে দেখে বললো,
‘ আমার মনে হচ্ছে কেউ আমার দিকে চেয়ে আছে। যেকোনো সময় সামনে চলে আসবে। ভয় লাগছে। ঘুম হবে না।’
মাহবুব সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলো,
‘ কেউ চেয়ে নেই। বিবাহিত মেয়েদের দিকে অন্য কেউ চেয়ে থাকে না। তাদের দিকে চেয়ে থাকার জন্য তাদের বর আছে। আমি থাকতে তোমার দিকে কে তাকাবে?’
‘ কিন্তু মনে হচ্ছে তো!’
‘ বেশি মনে হলে, আয়তুল কুরসি পড়ো। সৃষ্টিকর্তার নাম নাও। দেখবে, মনে হওয়াটা আর নেই। আয়তুল কুরসি পারো না?’
তরু, ‘পারি।’ বলে আয়তুল কুরসি পড়ার চেষ্টা করলো। কিন্তু আশ্চর্য হয়ে খেয়াল করলো, তার একটা লাইনও মনে পড়ছে না। কী আশ্চর্য! মনে পড়ছে না কেন? তরু করুণ কণ্ঠে বললো,
‘ মনে পড়ছে না তো!’
মাহবুব আশ্বাস দিয়ে বললো,
‘ ব্যাপার না। বেশি উত্তেজিত হয়ে গিয়েছো তো তাই মনে পড়ছে না। সকালে মনে পড়বে। আমি তোমাকে পড়ে শোনাচ্ছি। চোখ বন্ধ করে মনোযোগ দিয়ে শোনো।’
তরু বাধ্য মেয়ের মতো মাথা নেড়ে চোখ বন্ধ করলো। মাহবুব অদ্ভুত শান্ত কণ্ঠে সূরা তিলাওয়াত করলো। তরুর হঠাৎ মনে হলো সে যেন কোনো স্নিগ্ধ গাছের তলায় শুয়ে আছে। গাছের ছায়ায় শরীর জুড়িয়ে ঘুম আসছে। মাহবুব টানা এক ঘন্টা তাকে বিভিন্ন সূরা তিলাওয়াত করে শোনালো। তরু অবশ্য তার আগেই ঘুমিয়ে গিয়েছে।
সকালে ঘুম ভেঙেই তরুর প্রথমে আয়তুল কুরসির প্রথম লাইনটা মনে পড়ে গেলো। তরু তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থাতেই আয়তুল কুরসি পড়ে বুকে ফু দিলো। তার মনে হচ্ছে, সে মাত্রই একটা স্বপ্ন দেখেছে। স্বপ্নটা ঝাপসা ; কিছুতেই মনে করা যাচ্ছে না। তরু আরও কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইলো। স্বপ্নটা আবার দেখার ব্যবস্থা করা যায় না? তরুর মনে হচ্ছে, স্বপ্নটাতে মাহবুব ছিলো। কিন্তু তার স্বপ্নে মাহবুবের কী কাজ? স্বপ্নে মাহবুবের চেহারাই-বা কেমন ছিলো? তরু অনেকটাক্ষণ ভেবেও মাহবুবের চেহারা মনে করতে পারলো না। কেন মনে পড়ছে না? আশ্চর্য! জানালার কংক্রিটে চৈত্রের রোদ পড়েছে। এই গরমের দুপুরেও খুব আরাম নিয়ে রোদ পোহাচ্ছে মেটে রঙের ঘুঘু। সোনালি আলোয় ভরে যাচ্ছে তরুর বিশাল অথচ জনশূন্য ঘর। তরু বিছানায় পদ্মাসন হয়ে বসলো। বিছানায় বসে বসে ঘুঘু দেখতে ভালো লাগছে। ঘুঘুটা কোন ঋতুর পাখি তরু জানে না, মাহবুবকে জিজ্ঞেস করতে হবে। মাহবুবের নামটা ভেবেই চমকে উঠলো তরু। মাহবুবকে জিজ্ঞেস করতে হবে মানে কী? মাহবুবকেই কেন জিজ্ঞেস করতে হবে? এই পৃথিবীতে তরুর অসংখ্য পরিচিত মানুষ আছে। সবাইকে রেখে এই অর্ধ-পরিচিত মানুষটির কথায় কেন মনে পড়লো? তরুর তৎক্ষনাৎ কাল রাতের কথা মনে পড়ে গেলো। কল হিস্ট্রি চেক করে দেখলো, ঘটনা সত্য। মাহবুব সত্য সত্যই ছয় ঘন্টা আগে টেলিফোন করেছিলো। কল ডিউরেশন, চার ঘন্টা। তরু আবারও বিস্মিত হলো। আজ বোধহয় আশ্চর্য হওয়ার দিন। তরু আজ সারাদিন আশ্চর্য হবে। তরুর ধারণা ঠিক থাকলে, পরবর্তী আশ্চর্যের ঘটনা ঘটবে ঠিক এক ঘন্টা পর। কী ঘটবে সেটা অবশ্য বুঝা যাচ্ছে না। তরু বিছানার উপর ঠাঁই বসে রইলো। পরবর্তী এক ঘন্টা সে অপেক্ষা করবে। দিনের তিন নম্বর আশ্চর্য ঘটনাটা ঘটার পর সে ফ্রেশ হতে যাবে।
#চলবে…..