মেঘের দেশে প্রেমের বাড়ি পর্ব ৯
লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা
|৯|
দুপুর গড়িয়ে বিকেলের ম্লান রোদ এসে পড়েছে আঙিনায়। চৈত্রের ভ্যাপসা গরমে শান্ত হয়ে আছে বাড়ি ঘিরে থাকা গাছ-গাছালির ঝাঁক। কোথাও এক চিলতে হাওয়া নেই। স্বস্তি নেই। এই স্বস্তিহীন তপ্ত বিকেলেই আগুন গরম চায়ের কাপ হাতে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো তরু। চায়ের কাপ প্রাচীরের উপর রেখে বালতি ভর্তি ভেজা কাপড় মেলে দিতে গিয়ে মাহবুবের দেখা মিললো। মাহবুব সরবের সাথে ক্রিকেট খেলছে। তরু খানিকটা আশ্চর্য হলো। এই লোক ক্রিকেটও খেলে? তরু ইচ্ছে করেই বালতি হাতে তাদের খেলার মাঝখান দিয়ে হেঁটে গেলো। তরুকে দেখে দুই ভাই’ই খেলা থামিয়ে শান্ত হয়ে দাঁড়ালো। তরু কাপড় মেলে মাথার তোয়ালে খুলে চুল ঝাড়তে নিতেই কথা বললো সরব,
‘ এই ভাবি? চলো খেলি।’
মাহবুব ব্যাট হাতে তরুর দিকে চেয়ে আছে। তরুর বুকের ভেতর ছলকে উঠলো প্রেম সাগরের ঢেউ। গলা শুকিয়ে এলো। নিশপিশ করে উঠলো হাত-পায়ের পাতা। তরু হাতের তোয়ালেটা রোদে মেলে দিয়ে পিছু ফিরে দাম্ভিক চোখে চাইলো। বললো,
‘ আমি কোনো পুলিশ অফিসারের সাথে ক্রিকেট খেলবো না সরব। এরা খেলাধুলায় ভালো হয় না। নারীর মন বুঝে না যে জন, সে জন ক্রিকেটের কী বুঝবে?’
মাহবুব তখনও ব্যাটের উপর ভর ছেড়ে চেয়ে আছে তরুর দিকে। সেদিকে না তাকিয়েও তরু বুঝতে পারে জোড়া ভ্রুয়ের নিচে শিরশির জাগানো সেই দৃষ্টি। তরুর উথাল-পাথাল লাগে এই পৃথিবী। বুকের ভেতর চিনচিনে ব্যথা হয়। এই লোককে তার এতো কেন ভালো লাগে এই দায়ে ফুঁসে উঠে মন। পরমুহূর্তেই মায়া মায়া হয়ে আসে হৃদয়। গভীর মায়ায় তার গা ঘেঁষে বসতে ইচ্ছে হয়। ইশ, এই ঘেমে যাওয়া শ্যামলা পুরুষটা কী সুন্দর! হয়তো পৃথিবীর সবথেকে সুন্দর। তরু আবারও খেলার মাঝখান দিয়ে হেঁটে যায়। মাহবুবের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় গুনগুন করে গান ধরে,
‘ মিস্টি কথায় ভুইলা তুমি আসল পিরিত খুঁজলা না।
কাটার আঘাত দিলা বন্ধু ফুল তো কভু দিলা না ।
অন্তরেতে দাগ লাগাইয়া রে বন্ধু আমার কভু হইলানা।’
গানের লয়ের সাথে সাথে বুকের উপর পড়ে থাকা দীর্ঘ চুলের রাশি পেছনে ছুঁড়ে দিতেই মাহবুবের মুখের উপর আছড়ে পড়ে। মাহবুব ভেজা চুলের ঝাপটা থেকে বাঁচার চেষ্টা করে না। এই যে তার বউ দিনে দুপুরে তার ছোট ভাইয়ের সামনেই তাকে ঠেস মারার চেষ্টা চালিয়ে গেলো, সেই অত্যাচার সে মুখ বুঁজে সহ্য করে। প্রতিবাদ করে না। সরব অবশ্য ভাইয়া-ভাবীর এই অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বটা ঠিক খেয়াল করলো না। হয়তো খেয়াল করলো কিন্তু ঠিক কতটা করলো বোধগম্য হলো না। সে কিছুক্ষণ উদাস মুখে বাড়ির প্রাচীর ঘেঁষা গাছের দিকে চেয়ে থেকে শুধালো,
‘ ভাইয়া, বল করবো?’
তরু চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে বারান্দার দরজায় আঁচল বিছিয়ে বসলো। ভেজা চুলগুলো ছড়িয়ে রইলো পুরো দরজা জুড়ে। গাছের পাতার ফাঁক গলে ছেঁড়া ছেঁড়া রোদ্দুর এসে পড়ছে তার মুখের উপর। গোলাপি শাড়ি পরনে ঠিক যেন প্রতিমার মতো লাগছে তার মুখ। কাটা কাটা নিঁখুত মুখশ্রীর অদ্ভুত সুন্দর এক প্রতিমা। যে মহিমান্বিত, অতিমানবীয়। যার বাস পৃথিবী ছেড়ে ভিন্ন কোনো জগতে। হয়তো কোনো মেঘের দেশে অথবা চির অন্ধকারে। তরু গম্ভীর চোখে মাহবুবের দিকে চেয়ে আছে। দৃষ্টিতে পড়েছে গাঢ় অভিমানের ছায়া৷ এই প্রগাঢ় অভিমান ভুলে মেঘের দেশের রাজকন্যে কক্ষনো মাহবুবকে ক্ষমা টমা করবে না। কক্ষনো না।
তরুর ভাবনার মাঝেই ঝনঝন করে বেজে উঠলো ভাঙা কাচের টুকরো। তরু চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে উদাস চোখে চাইলো। মাহবুব ব্যাট হাতে গম্ভীরমুখে পাশের বাড়ির ভাঙা জানালার দিকে চেয়ে আছে। এইমাত্র সে একটা অঘটন ঘটিয়েছে। দুই ভাইয়ের মুখভঙ্গি দেখে বুঝা যাচ্ছে, এই ধরনের অঘটন তাদের নতুন নয়। প্রায়শই ঘটে এবং এতে তারা অভ্যস্ত। সরব মাথায় হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো। সম্বিত ফিরে পেতেই মিলি সেকেন্ডের মাঝে নিজের হাতের কাছের স্ট্যাম্পগুলো তুলে ভৌ দৌড় লাগালো। যেতে যেতে বললো,
‘ ভাইয়া ভাগো। আম্মু জানলে খবর আছে।’
তরুকে অবাক করে দিয়ে বাকি স্ট্যাম্পগুলো নিয়ে চম্পট দিলো মাহবুবও। লম্বা লম্বা পা ফেলে, তরুর ছড়িয়ে রাখা চুলের রাশি ডিঙিয়ে দুই ভাই’ই অন্তর্ধান দিলো ঘরের ভেতর। আশ্চর্য, এই লোক এমন ছেলেমানুষিও করে? তরু আগের মতোই বসে থেকে চায়ের কাপে চুমুক বসালো। যেন ঠিক এই মুহূর্তে কিচ্ছুটি ঘটেনি তার সামনে। কয়েক মুহূর্ত পর, স্টিলের গেইটে ক্যাচক্যাচ শব্দ তুলে ভেতরে ঢুকলো পরিপাটি দেখতে একটি মেয়ে। হাতে লাল টকটকে ক্রিকেট খেলার বল। তরু চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে মেয়েটির দিকে চেয়ে রইলো। ষোল-সতের বছরের মেয়েটির চোখ-মুখে উজ্জ্বল হাসি। চোখে সযত্নে টানা কাজলের প্রলেপ। তরু কৌতুকবোধ করলো। মেয়েটি এগিয়ে আসতেই হাসিমুখে শুধালো,
‘ কেমন আছো মিষ্টি?’
মেয়েটি চমকে উঠলো,
‘ কী আশ্চর্য! আমি তো আপনাকে কক্ষনো দেখিনি। আপনি আমার নাম জানলেন কী করে?’
তরু মেয়েটির নাম জানে না। মেয়েটির মুখে একটা মিষ্টি মিষ্টি ভাব আছে বলেই অনুমান করতে পেরেছে। তার অনুমান যে এভাবে মিলে যাবে কে জানতো? তরু মৃদু হাসলো। রহস্য করে বললো,
‘ আমি মানুষের মুখ দেখে অনেক কিছু বলে দিতে পারি।’
মিষ্টি সন্দিহান চোখে চাইলো। সরু চোখে চেয়ে বললো,
‘ সত্যি?’
তরু হেসে বললো,
‘ সত্যি।’
‘ বিশ্বাস হচ্ছে না। আচ্ছা, আমার মুখ দেখে আর কী কী বলতে পারবেন আপনি?’
তরু চায়ের কাপটা নামিয়ে রেখে গালে হাত দিয়ে বসলো। মোহনীয় এক হাসি দিয়ে কিয়ৎক্ষণ মিষ্টির দিকে চেয়ে রইলো। চোখে-মুখে অন্যরকম এক রহস্য এনে বললো,
‘ আর কী বলতে পারি? এই যেমন, তুমি কলেজে পড়ো। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে। পড়াশোনা তোমার ভীষণ অপছন্দ কিন্তু একটি বিশেষ কারণে তুমি খুব পড়াশোনা করো। তুমি কল্পনা করতে ভালোবাসো। অবসরে খুব প্রিয় এক পুরুষের সাথে কল্পনায় ঘুরে বেড়াও। তোমার প্রিয় রঙ সাদা। বাসার জানালা ভাঙলে মানুষ রেগে যায়, মন খারাপ করে। তোমাদের বাসার জানালা ভেঙে যাওয়ায় তুমি অত্যন্ত আনন্দিত। ঠিক বলেছি?’
মিষ্টি বিস্মিত চোখে চেয়ে রইলো। কী আশ্চর্য! কী আশ্চর্য! তরু মুখটা একটু এগিয়ে এনে ফিসফিসিয়ে বললো,
‘ আমি আরও একটা কথা জানি। কথাটা খুব গোপন। বলবো?’
মিষ্টি আগ্রহ নিয়ে মাথা নাড়লো। তরু আগের থেকেও ফিসফিস করে বললো,
‘ এই বাড়ির একটা ছেলেকে তোমার ভীষণ ভালো লাগে। আমি ভুল না হলে, সে’ই তোমার কল্প পুরুষ। তুমি জানালা ভাঙার রহস্য উদঘাটনের বাহানায় তাকেই দেখতে এসেছো, তাই না?’
মিষ্টি অবাক হলো। পরমুহূর্তেই লজ্জায় লাল হয়ে এলো মুখ। মাথাটা একেবারে বুকের কাছে নামিয়ে এনে বিড়বিড় করলো,
‘ বলটা উনিই মেরেছে, না?’
তরু হাসলো। মিষ্টি মুখ উঠিয়ে বললো,
‘ কিন্তু আপনি কে? উনার কাজিন? আপনি এতো সুন্দর! আমি তো প্রথমে আপনাকে দেখে চমকে উঠেছিলাম। ভেবেছিলাম, ভূত। আপনি আবার মন খারাপ করবেন না। আমি খারাপ ভূতের কথা বলিনি। পরিরাও তো ভূত। আমার দাদি বলেছিলেন, পরিদের লম্বা লম্বা চুল হয়। তারা তাদের বিশাল চুল রোদে ছড়িয়ে দিয়ে বসে থাকে। সেই চুলে কেউ পা দিলে ক্ষতি হয়। আমি ভেবেছিলাম আপনি বুঝি তেমন পরি।’
তরু হাসলো,
‘ আমি মন খারাপ করিনি। বরং তুমি মন খারাপ করছো। আমি সুন্দর বলে মন খারাপ হচ্ছে?’
মিষ্টি মলিন কণ্ঠে বললো,
‘ হ্যাঁ। আপনি আর এখানে বেড়াতে আসবেন না। উনি যদি আপনার প্রেমে পড়ে যান তখন?’
তরু শব্দ করে হেসে উঠলো। তরু কখনোই শব্দ করে হাসে না। আজ হাসলো। তার খিলখিল হাসির শব্দে দোল খেয়ে উঠলো প্রকৃতি। মিষ্টি মুগ্ধ চোখে চেয়ে রইলো এই মোহনিয়া রমণীর দিকে। কী সুন্দর তার হাসি! চোখদুটোতে টলমলে দুটো সমুদ্দুর। তরু হাসি থামিয়ে বললো,
‘ এখানে না এলে কোথায় যাবো আমি? তোমার কল্প পুরুষ তো আমায় কোথাও যেতে দিবেন না।’
মিষ্টি অবাক,
‘ কেন দিবেন না?’
‘তুমি বলো দেখি, কেন দিবেন না?’
মিষ্টির মুখ কালো হয়ে এলো। টলমল চোখে চেয়ে বললো,
‘ উনি আপনার প্রেমে পড়ে গিয়েছেন এইজন্য?’
তরু হাসলো,
‘ উঁহু।’
‘ তাহলে?’
‘ তুমিই বলো।’
মিষ্টি চোখ বড়ো বড়ো করে চাইলো,
‘ আপনি….আপনি…. উনি কী আপনার বর? উনি বিয়ে করে ফেলেছেন?’
তরু আবারও হাসলো। মিষ্টি রুষ্ট কণ্ঠে বললো,
‘ তাহলে আপনি মিথ্যা কেন বললেন? এইযে বললেন, উনি আপনার প্রেমে পড়েননি?’
‘ পড়লো না তো! বিয়ে হলেই বুঝি প্রেমে পড়তে হয়?’
‘ হয়ই তো।’
‘ তাহলে বোধহয় আমি প্রেমে পড়ার মতো মেয়ে নই।’
‘ আপনি এতো সুন্দর! রূপকথার বন্দিনী রাজকন্যাদের মতো সুন্দর। তারপরও…?’
তরু হাসলো,
‘ উনি বোধহয় তোমার মতো কারো প্রেমে পড়তে চেয়েছিলেন। আমার মতো সুন্দরী উনার পছন্দ নয়।’
মিষ্টি টলমলে চোখে চাইলো। কান্নায় বুঁজে এলো ওর কণ্ঠ,
‘ তবে কেন উনাকে বিয়ে করলেন আপনি? আমার এতো কান্না পাচ্ছে! আমি ভেবেছিলাম, উনি আমায় ভালোবাসবেন। হি ওয়াজ গুড উইদ মি। আপনি উনাকে বিয়ে না করলেই উনি আমাকে ভালোবাসতেন।’
তরু শুধালো,
‘ আমি বিয়ে না করলেই উনি তোমায় ভালোবাসতো?’
‘ নিশ্চয়। উনি আমাকে বলেছিলেন, আমার সাথে আমার নামের খুব মিল। আমি দেখতেও ভীষণ মিষ্টি।’
তরু ব্যথিত চোখে চাইলো। বুকের ভেতর অদ্ভুত এক জ্বালা হলো। তরু ছোটবেলা থেকেই নিজেকে ভীষণ অন্যরকম দেখেছে। জাগতিক ঈর্ষা। ভালোবাসা না পাওয়ার কাতরতা তার ছিলো না। নিজস্ব এক দেওয়ালে বন্দী থেকেছে নিজের মতোন। সেই দেওয়াল ভেদ করে কেউ তার সত্যিকারের হৃদয় ছুঁয়ে যেতে পারেনি। কারো জন্য তার মায়া হয়নি। মন খারাপ হয়নি। কষ্ট হয়নি। বাচ্চাসুলভ ঈর্ষাবোধ তার নেই। অথচ আজ ভীষণ ছেলেমানুষি মন খারাপ হলো। মাহবুব মিষ্টিকে মিষ্টি বলেছে। কই! তার প্রশংসা তো কখনো করেনি? এই পৃথিবীর সবাই তার প্রশংসা করে। কেবল মাহবুব প্রশংসা করলো না! তরু দুঃখী কণ্ঠে বললো,
‘ সরি মিষ্টি। আমি বুঝতে পারিনি।’
‘ আপনি সব বুঝতে পারেন। এটা কেন পারলেন না?’
সত্যি তো! তরু কেন বুঝতে পারলো না? মিষ্টির চোখের অদৃশ্য বাঁধ ভেঙে গেলো। হঠাৎ ডুকরে উঠেই এক হাতে মুখ চেপে ধরলো। টপটপ করে গড়িয়ে পড়লো দু’ফোটা জল। লাল স্কচটেপ দিয়ে পেঁচানো বলটা তরুর হাতে তুলে দিয়ে রুদ্ধ কণ্ঠে বললো,
‘ আমি আর একটু এখানে দাঁড়িয়ে থাকলেই হাউমাউ করে কেঁদে ফেলবো। আমি বরং আসি?’
তরু গম্ভীর মুখে মিষ্টির দিকে চেয়ে আছে। মিষ্টি দ্রুত পায়ে গেইট পেরিয়ে যাওয়ার পরও সেদিকেই স্থির চেয়ে রইলো তরু। বিড়বিড় করে বললো,
‘ আমি অনেক কিছুই বুঝি মিষ্টি। কেবল তোমার কল্প পুরুষকে বুঝতে পারি না। তাকে বুঝার ক্ষমতা আমাকে দেওয়া হয়নি!’
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামলো। তরু সন্ধ্যা নামার আগমুহূর্ত পর্যন্ত মূর্তির মতো বসে রইলো। ক্লান্ত চিলের ডানা ছোঁয়ে বিধাতার প্রতি ফিরে আসার সুমধুর আহ্বান বেজে উঠার পরপরই জায়গা ছাড়লো তরু। ঝিম ধরা শান্তি শান্তি বাড়ির প্রতিটি ঘরে ঘরে আলো জ্বলে উঠলো। সেই সাথে ঘটে গেলো অত্যন্ত রুষ্ট পুষ্ট এক ঘটনা। বাড়ির কার্ণিশে সন্ধ্যার রঙ নামতেই সরবের পিঠে নারকেল শলার ঝাড়ু ভাঙলো। ঝাড়ু ভাঙার পেছনে অবশ্য মুখরোচক একটা কারণ আছে। কারণটা হলো, সরবের পকেটে হঠাৎ সিগারেটের প্যাকেট পাওয়া গিয়েছে। বেনসনের আস্ত একটা প্যাকেট। বেনসনের সাথে কম দামী বিড়ির প্যাকেটও আছে। সিগারেটের প্যাকেট খুলে দেখা হয়েছে। প্যাকেটে দুটো সিগারেট কম আছে। বাড়ির একমাত্র পুলিশ অফিসার মাহবুবুল হাসান নীরব ঘোষণা করেছেন, ও দুটো সিগারেট সরবই খেয়েছে। সুতরাং, ঝাড়ুর বাড়ি তার জন্য অবধারিত। তরু রান্না ঘরে সন্ধ্যার নাস্তার জোগার যত্ন করছিলো। হঠাৎ বসার ঘরে হৈচৈ শুনে বেরিয়ে এসে সরব আর শাশুড়িমাকে এই অবস্থায় দেখে হতভম্ব হয়ে গেলো। মাহবুব তাদের ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পুরো ঘটনাটা দেখলো। গত দুইদিনে তরু মাহবুবকে এক বিন্দু রেগে যেতে দেখেনি। সরব বারবার ভাইয়ের রাগের কথা বললেও মাহবুবকে তরুর খুব রাগী বলে মনে হয়নি। আপাতত তরুর সামনে সে মৃদু উচ্চবাচ্য পর্যন্ত করেনি। তরু ভেবেছিলো, মাহবুব বুঝি সরবকে বাঁচাবে। কিন্তু মাহবুব তার ধারণাকে সম্পূর্ণ ভ্রম প্রমাণ করে সরবের দিকে এগিয়ে গিয়ে শীতল চোখে চেয়ে রইলো। রাগে শক্ত হয়ে আছে তার মুখের পেশী। চোয়াল কঠিন। ভাইকে এগিয়ে আসতে দেখেই কাঁচুমাচু হয়ে পিছিয়ে গেলো সরব। মাহবুব তাকে কিছুই বললো না। গভীর ভাবনায় ব্যস্ত এমনই ভাব নিয়ে ভ্রু কুঁচকালো। সরবের মুখের দিকে শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো অনেকটাক্ষণ। তারপর আচমকা ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিলো সরবের গালে। চড় খেয়ে সরব দুয়েক পা পিছিয়ে গেলো। গালের উপর হাত রেখে মাথা ঝুকিয়ে অল্প থুতু ফেলতেই তাজা রক্ত চোখে পড়লো। ইশ! কেমন গলগল করে রক্ত বেরুচ্ছে দাঁতের পাশ থেকে! দাঁতটা নড়ে গেলো না তো আবার? তরুর মায়া হলো। অথচ মাহবুবের চোখে মায়া-দয়ার লেশমাত্র নেই। থমথমে চোখ-মুখ দেখে মনে হচ্ছে সে সরবকে আরও দুটো থাপ্পড় লাগাতে চায়। তরু একটু এগিয়ে গিয়ে চোখে-মুখে গাম্ভীর্য এনে মাহবুবের বাহু খামচে ধরলো। চিরাচরিত বধূদের মতো বললো,
‘ ছেড়ে দাও, বাচ্চা মানুষ।’
কথাটা বলতে গিয়ে ফিক করে হাসি পেয়ে গেলো তরুর। আরে বাহ! এ তো একেবারে বাংলা সিনেমার ডায়েলগ। তরুর সকৌতুক কণ্ঠ যেন বুঝতে পারলো মাহবুব। এমন একটা পরিস্থিতিতে এমন কৌতুকে চোয়াল শক্ত করে তরুর দিকে চাইলো। ধমক দিয়ে বললো,
‘ ওকে তোমার বাচ্চা মনে হয়? ও বাচ্চা? বাচ্চা মানুষ সিগারেট খায়? আমি বিশ্বাসই করতে পারছি না এতোটা উচ্ছনে গিয়েছি এই বেয়াদব। এই তোর সাহস কী করে হলো? কী করে হলো এতো সাহস? এই বয়সে সিগারট, বিড়ির প্যাকেট নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। কয়দিন পর গাজা, ইয়াবা নিয়ে ঘুরবে। হাত-পা ভেঙে ঘরে ফেলে রেখে দিবো।’
কথাটা বলতে বলতেই এগিয়ে গিয়ে দুর্দান্ত প্রতাপে আরও একটা চড় বসিয়ে দিলো মাহবুব। সরব যেন ছিটকে গেলো চড়ের ভারে। সন্ধ্যার নিস্তব্ধতা ছিঁড়ে মাহবুবের ভয়ানক ধমকের আওয়াজ দেওয়ালে দেওয়ালে প্রতিধ্বনি করে উঠলো বার কয়েক। তরু স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। শাশুড়ীমা চাপা আর্তনাদ করে সরবকে আড়াল করে দাঁড়ালেন। মাহবুব গর্জে উঠে বললো,
‘ মা তুমি তোমার ছেলেকে এই মুহূর্তে আমার চোখের সামনে থেকে নিয়ে যাও। নয়তো ওকে খুন করে ফেলবো আমি। বেয়াদব! লাফাঙ্গা হচ্ছে দিনদিন!’
মাহবুবের প্রতাপী ধমকে ঘরের দেওয়ালগুলোও যেন জড়োসড়ো হয়ে গেলো ভয়ে। ঘড়ির পেন্ডুলাম দোলার শব্দ ছাড়া কোথাও কোনো আওয়াজ নেই। রাত পোকারা পর্যন্ত কী নিশ্চুপ! শান্ত। তারাও বুঝি চমকে উঠেছে তরুর মতো?
এই থমথমে নিস্তব্ধতা অবশ্য ঘন্টাখানেকের মাঝেই স্বাভাবিক হয়ে গেলো। শাশুড়ীমা নিজের মতো রান্নাবান্নায় মন দিলেন। তরুর সাথে টুকটাক আলাপ করে ঘরে পাঠিয়ে দিলেন। সরবের গুনগুনিয়ে পড়ার আওয়াজ ঘরে ঘরে মৌমাছির গুঞ্জনের মতো প্রাণ ছড়াতে লাগলো। মাহবুব গায়ে শার্ট চড়িয়ে চুপচাপ সন্ধ্যার আড্ডার জন্য বেরিয়ে গেলো। তরু নিজের ঘরে না গিয়ে সরবের ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ালো। সরব শব্দ করে পড়া আওড়াতে আওড়াতেই খাতায় কিছু লিখছিলো। দরজায় আলতো কড়া নাড়তেই সরব মাথা না ফিরিয়েই বললো,
‘ চলে এসো ভাবী।’
তরু ভেতরে এসে সরবের চেয়ারের পেছনে দাঁড়ালো। মাথাভর্তি চুলগুলো নাড়িয়ে দিয়ে বললো,
‘ কী করে বুঝলে আমি এসেছি?’
সরব এবার পিছু ফিরে চাইলো। উচ্ছল হেসে বললো,
‘ তুমি ছাড়া কেউ আমার রুমে কড়া নেড়ে আসে না।’
তরু সরবের মুখের দিকে চেয়ে রইলো। খুবই বীভৎস অবস্থা। এক পাশের গালে ভালো রকম ফোলা। ঠোঁট ফুলে আছে। ঘাড়ের কাছে নারকেল শলার আঁচড়। অথচ ছেলেটার মুখভর্তি হাসি। কিছুক্ষণ আগের মারধোর তার চঞ্চলতায় এক টুকরো আঁচড় কাটতে পারেনি। তরু ভ্রু নাচিয়ে বললো,
‘ তো? খুব সিগারেট খাওয়া হচ্ছে আজকাল?’
সরব তরুর দিকে ফিরে বসলো। বললো,
‘ উঁহু, খাইনি। একটা এক্সপেরিমেন্ট করতে কিনেছিলাম। আমি অবশ্য এর থেকেও খারাপ একটা জিনিস সংগ্রহ করেছি। আমার ভাগ্য ভালো ভাইয়া ওটা দেখেনি। নয়তো….’
সরব থেমে গেলো। একটু ভেবে বললো,
‘ আচ্ছা ভাবী? সিগারেট খাওয়া কী খুব খারাপ কাজ?’
‘ একদম না। বড়ো বড়ো জ্ঞানী মানুষদের প্রায় সকলেই ধুমপান করেন। তুমি সত্যজিৎ রায়কেই চিন্তা করে দেখো। সত্যজিৎ রায়ের ঠোঁটের কোনে পাইপ নেই এমন সত্যজিৎ চিন্তা করা যেতে পারে?’
‘ তাহলে সিগারেট খেলে খারাপ ছেলে বলা হয় কেন?’
‘ ওরা ভালো জানে না বলেই বলে। মানুষের ভালো খারাপ হওয়া কখনো সামান্য সিগারেটের উপর নির্ভর করে না। ভালো খারাপ নির্ভর করে যার যার বিবেকের উপর। তুমি তোমার বিবেক কতটা কাজে লাগাতে পারছো সেটাই বড়ো ব্যাপার। তবে আরেকটা বিষয় অবশ্য আছে।’
সরব আগ্রহ নিয়ে চাইলো,
‘ কী বিষয়?’
‘ আবেগ। সৃষ্টিকর্তা মানুষকে যা যা দিয়েছেন তার মাঝে সব থেকে ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হলো আবেগ আর বিবেক। আবেগ আর বিবেককে সৃষ্টি করার পর দেখা গেলো তারা দুজনই মানুষের উপর সম্পূর্ণ কর্তৃত পেতে চায়। দু’জনের কেউই নিজেকে খাটো করে দেখতে রাজি নয়। সৃষ্টিকর্তা তাদের বিভেদ নিষ্পত্তি করতে মানব জীবনকে দুটো ভাগে ভাগ করে আবেগ আর বিবেককে তাদের নিজ নিজ রাজত্ব বুঝিয়ে দিলেন। আবেগ পেলো মানুষের শিশু বয়স থেকে প্রথম যৌবন পর্যন্ত রাজত্ব। আর বিবেক পেলো শেষ যৌবন থেকে বৃদ্ধ প্রারম্ভ পর্যন্ত। যার ফলে, পৃথিবীর মানুষ পৃথিবীর সকল বিতর্কিত কাজগুলোকে প্রথম যৌবনে পদার্পন হওয়া পর্যন্ত নিষিদ্ধ ঘোষণা করলো। বাইরের দেশগুলোতে দেখো, আঠারোর আগে নো এলকোহল। বিশের আগে নো ড্রাইভিং লাইসেন্স। তুমিও যদি আঠারোর পর সিগারেটের প্যাকেট নিয়ে ঘুরে বেড়াও দেখবে ব্যাপারটা এখনকার মতো খুব ভয়ানক ব্যাপার হচ্ছে না। বলো তো এর কারণ কী? কেন এই আঠারো বছরকেই সময়সীমা দেওয়া হলো? অন্যকোনো বয়স নয় কেন?’
সরব আগ্রহ নিয়ে শুধালো,
‘ কেন?’
‘ কারণ আঠারো বছর বয়স থেকে আবেগের রাজত্ব দুর্বল হয়ে আমরা বিবেকের রাজত্বে যেতে শুরু করি। আমরা আবেগ দিয়ে না ভেবে বিবেক দিয়ে ভাবার চেষ্টা করি, কোনটা ঠিক। কোনটা ভুল। কোন জিনিসটা আমায় কষ্ট দিবে। অথবা কোনটা আমাদের এড়িয়ে যাওয়া উচিত। আবেগ ভীষণ অহংকারী। সে নিজেকে অত্যন্ত বুদ্ধিমান ভাবে বলেই ভুল করার সম্ভবনা বেশি থাকে। কিন্তু বিবেক হলো বিচক্ষণ। সে যুক্তি দিয়ে ভাবতে ভালোবাসে। তাই মানুষের বয়স যত বাড়ে তারা তত বাস্তবধর্মী হয়। তোমার মধ্যে এখন আবেগের রাজত্ব চলছে। তুমি যেন আবেগের বশে না ভেবে ভুল কিছু করে না বসো এজন্য এই সিগারেট, এলকোহল, প্রপম, নারী ইত্যাদি কঠিন কঠিন বিষয় থেকে তোমায় দূরে রাখার চেষ্টা করে বিবেকবান মানুষজন। তারা আতঙ্কিত থাকে। কখনো কখনো নিজের ইচ্ছে, মতামতটাও চাপিয়ে দেয়। এটা অবশ্য ভুল। তারা আসলে তোমার ভেতরের বিবেকের রাজত্বের জন্য অপেক্ষা করে। যাতে পরবর্তীতে তোমার মনে না হয়, ইশ! এটা আমি এভাবে কেন ভাবলাম না? এই কাজটা এভাবে কেনো হলো না? এই আফসোসটা তখন অনেকেরই ভালো লাগে না। আমার মনে হয়, তোমারও বিবেকের জন্য অপেক্ষা করা উচিত। তবে তুমি চাইলে এখনও সিগারেট খেতে পারো। তোমার ইচ্ছে। তুমি যখন খাবে আমায় ডাকবে। আমিও টেস্ট করে দেখবো।’
সরব মুগ্ধ চোখে চেয়ে ছিলো। এবারে হেসে ফেললো। তরুর কথা শুনতে তার ভালো লাগে। তরু কী সুন্দর করে কথা বলে! তরু যখন কথা বলে সরবের মনে হয় তরুর প্রতিটি কথা বেদবাক্যের মতো সত্য। এতো সুন্দর করে যে বলে, তার কথা মিথ্যে হতে পারে? তরু আজ গোলাপি শাড়ি পরেছে। ঘাড়ের উপর বিশাল খোঁপাটা প্রায় খুলে খুলে গিয়েছে। ঘর্মাক্ত মুখ। ক্লান্ত দু’চোখ। সরব হাত বাড়িয়ে তরুর শাড়ির আঁচল ধরে বসে রইলো। তরু হেসে শুধালো,
‘ মাইর খেয়ে কেমন মজা পেলে ছোটে সুলতান? ব্যথা করে?’
সরব হেসে বললো,
‘ ডান পাশের একটা দাঁত নড়ে গিয়েছে। নড়া দাঁতের মাড়ি ফুলে গাল ফুলে গিয়েছে। ভাইয়ার যে কী শক্তি!’
কত সহজ করে বলে ফেললো! কোথাও যেন একবিন্দু ক্ষোভ নেই। আক্ষেপ নেই। মন খারাপ নেই। তরুর ভীষণ মায়া হলো। তরুর অনুভূতি শক্তি খুব একটা প্রখর নয়। কে জানি কেন, কারো সংস্পর্শই তাকে গভীরভাবে স্পর্শ করতে পারেনি কখনো। তবুও তরুর মনে হয়, এই ছেলেটির মতো গভীর মায়া বোধহয় তরুর আর কারো প্রতি হয়নি কখনো। তরু গভীর মায়ায় হাত বুলিয়ে দেয় সরবের মাথায়। সরব হাসি হাসিমুখে চেয়ে থাকে। একদম ঠিক মাহবুবের মতো তার দৃষ্টি। নিঃসংকোচে শুধালো,
‘ মেয়েদের কী গোপন কোনো পারফিউম হয় ভাবী? মায়ের ঘরে তো কোনো পারফিউমের শিশি দেখি না। তারপরও তোমার গায়ে মায়ের গায়ের মতো সুগন্ধ। একদম মা মা গন্ধ।’
তরু উত্তর দিলো না। অবাক হয়ে খেয়াল করলো, বুকের ভেতর আস্ত এক শেকড়ের নাড়াচাড়া। শেকড়ের শিরায় শিরায় আশ্চর্য এক মায়ার বাঁধন। তরু মনের গহ্বরে অনুভব করে, এই সংসার নামক অদৃশ্য শেকড়ের প্রতিটি মানুষের প্রতি তার আশ্চর্য মমতা। আশ্চর্য আকর্ষণ। যে আকর্ষণ তরুকে বেঁধে ফেলছে। ভীষণ মায়া নিয়ে জড়িয়ে ফেলছে আষ্টেপৃষ্টে। এটা কী তবে বিয়ের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া? নাকি সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত ঐশ্বরিক শক্তি?
তরু শোবার ঘরে ফিরলো এগারোটা পেরিয়ে। মাহবুব বালিশে আধশোয়া হয়ে মাথাটা পেছন দিকে এলিয়ে শুয়ে আছে। বামহাতটা কপালের উপর। বুকের উপর বই। চোখদুটো বোজা। তরু ঘরে ঢুকেই বিছানার পাশের জানালাটা খুলে দিলো। ঘরের আলো নিভিয়ে ম্লান জ্যোৎস্নায় মাহবুবের ঘুমন্ত মুখের দিকে চেয়ে রইলো। সাদামাটা চেহারার মাহবুব। আহামরি বিশেষত্ব কিছু নেই। অথচ তরুর কাছে মনে হয় মাহবুব যেন সৃষ্টিকর্তার এক অভিনব সৃষ্টি। সবথেকে সুন্দর সৃষ্টি। তরু বালিশে ঠেস দিয়ে ঘাড় বাকিয়ে চেয়ে থাকে। মাহবুবের প্রশস্ত কপাল, ঘামে ভেজা চুল, তীক্ষ্ণ নাসা, দাঁড়িহীন পরিপাটি গাল, কালচে ঠোঁট, থুতনীতে মিষ্টি গর্ত, ডানহাতে বুকের সাথে আলতো করে চেপে রাখা বই, রুক্ষ শক্তিশালী হাতের দৃশ্যমান শিরা। তরু সবই সময় নিয়ে দেখে। মাহবুবের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে টের পায় গোপন দেওয়ালের নড়বড়। এইযে এই বিয়েটা, এই মানুষটাকে তরু পেয়েছিলো একদমই মজারচ্ছলে। ধারাবাহিক জীবনে হাঁপিয়ে উঠে নতুন কিছু পাওয়ার কৌতুকে খুব আগ্রহ নিয়েই বিয়ে করেছিলো তরু। তরুর সঙ্গ চাওয়া না-চাওয়া সকল পুরুষই যেমন তাকে বিশেষ চোখে দেখে। তরু ভেবেছিলো, মাহবুব বোধহয় হবে তেমনই এক মুগ্ধ পুরুষ। কিন্তু কোথায় যেন কিছু একটা উল্টো হলো। টেলিফোনের ওপাশে মাহবুবের দ্বিধাহীন গমগমে কণ্ঠস্বর, তার জড়তাহীন নির্বিকার ব্যবহার তরুর মনের ভেতর বর বর ব্যাপারটাকে আরও ভারী করে দোলা দিয়ে গেলো। একবিন্দু বিস্মিত না হয়ে তরুর তালে তাল মিলিয়ে তরুর প্রতি মাহবুবের এই প্রগাঢ় অধিকারবোধ শিরশির তুলে দিলো হৃদয়ে। মেকী আহ্লাদ, কপটতা, সভ্য পুরুষের সাধারণ সভ্যতা, তরুকে মুগ্ধ করার চেষ্টাবিহীন এই পুরুষকে তরুর কেন যে এতো ভালো লেগে গেলো! যতটা না ভালো লাগলো তার থেকেও বেশি মাহবুব যেন তার নিজের হলো। একেবারে নিজের মানুষ। তার নামেই বুক বেয়ে নামতে লাগলো কেমন ঘর ঘর প্রশান্তি। তরু তার এক জীবনের সকল অভিমান তার ঘাড়ে ছড়িয়ে দিয়ে আরাম করে বসলো। সে পুরুষও যেন মাথা পেতে নিলো সকল অভিমান। কেমন পুরুষোচিত তার হার মানার পদ্ধতি। তবুও কোথাও যেন ভীষণ ফাঁকা ফাঁকা। পেয়েও না পাওয়ার স্বাদ। দিয়েও না দেওয়ার জেদ। তরু হাত বাড়িয়ে মাহবুবের ঘামে ভেজা চুলগুলো সরিয়ে দিলো। ধীরে ধীরে হাত নামিয়ে স্থির করলো মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে চাওয়া তীক্ষ্ণ রোমরাজি ভর্তি খসখসে গালের উপর। তরুর নরম হাতের স্পর্শে ঘুম ছুটে গেলো মাহবুবের। চোখ মেলে তরুর দিকে তাকালো। তরু চমকালো না। দূরে সরে যাওয়ার চেষ্টা করলো না। তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে রইলো মাহবুবের চোখে। মাহবুব হাতের বইটা শিয়রের কাছে সরিয়ে রেখে তরুর হাত ধরে কাছে টানার চেষ্টা করলো। তরু আগের জায়গাতেই স্থির বসে থেকে রহস্য করে হাসলো। ভ্রু উঁচিয়ে বললো,
‘ এতোই সহজ?’
মাহবুব তার সেই শিরশির অদ্ভুত দৃষ্টিতে তরুর দিকে চেয়ে রইলো। তরুর বুক কেঁপে উঠলেও হাত-পা ছড়িয়ে আরাম করে বসলো। অসাবধানে সরে যাওয়া শাড়ির আঁচল, নড়নে চড়নে আবেদনময়ী মোহনীয়তা যে তরুর ইচ্ছেকৃত তা মাহবুব বুঝলো। তরু হঠাৎ ঘাড় বাঁকিয়ে চাইলো। আধ খোলা চুলের রাশি পুনরায় খোঁপায় মোড়তে মোড়াতে বললো,
‘ এইযে স্বামী? অন্য মেয়েকে মিষ্টি বলে আমাকে বিয়ে করা কেন শুনি?’
মাহবুব তরুর কথার অর্থ ধরতে পারলো না। সবল হাতে আচমকা তাকে টেনে নিলো বুকের কাছে। তরু খোঁপা বাঁধছিলো, আকস্মিক আক্রমনে বাঁধনহারা হলো চুলের বহর। কপালে পড়ে থাকা চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে তরুর কোমল ঘাড়ের খাঁজে মুখ লুকালো মাহবুব। চাপা কণ্ঠে বললো,
‘ আর যন্ত্রণা করো না তো তরু।’
তরু ফিসফিস করে বললো,
‘ কাল আমি হলে চলে যাবো। যেখানে আমার দাম নেই সেখানে থেকে যাবো, আমি কী এতোই সহজ?’
‘ কোথাও যাবে না তুমি। চুপ!’
চলবে….