: শোনো তোমার বাম চোখটা না একটু ট্যারা।
: কি!
: হ্যাঁ অবশ্য বেশি না, হালকা। মানে কেমন লক্ষী ট্যারা টাইপ, ভালো লাগছে তোমাকে, মানিয়েছে।
লোকটার কথা শুনে প্রথম কি রিয়্যাকশন দিব ঠিক বুঝতে পারলাম না। তবে হতভম্ব ভাবটা কাটতে মনে হল, এটা ঠিক হতভম্ব হওয়ার মতো কথা না, এটা রাগে গা জ্বলে পুড়ে কয়লা হয়ে যাবার মত কথা। ক্যাম্পাসের ১৭ টা ছেলে যেখানে আমার পেছনে লাইন দিয়ে ঘুরে বেড়ায়, সেই আমার মতো সুন্দরীকে কিনা আধবুড়ো এক লোক বলছে ট্যারা!
: কি তুমি মন খারাপ করলে?
: না।
: আমি কিন্তু খারাপ অর্থে বলিনি, এরকম মিষ্টি ট্যারা চোখের মেয়ে অনেকদিন দেখিনি।
: আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে আগে অনেক ট্যারা মেয়ে দেখতেন!
: তা অবশ্য দেখতাম, তবে বেশি জন না, একজনকেই দেখেছি। আমার এক ক্লাসমেট, ওর নাম ছিল রিমি। ওর দুই চোখই ছিল ট্যারা, সামনের দিকে তাকিয়ে কথা বললে কাকে যে বলছে কিছুই বোঝা যেত না।
মনে মনে অসম্ভব বিরক্ত হলাম। লোকটার কথার কি ছিরি। মেয়ে দেখতে এসে কেউ এসব বলে!
: আপনার তো তাইলে কপালটাই খারাপ মনে হচ্ছে, যেখানে যান, খালি ট্যারা খুঁজে পান।
: হা হা হা, তুমি তো বেশ মজা করে কথা বল।
: জি আমি মজা করেই কথা বলি। এখন আরেকটা কথা বলব কিন্তু সেটা শুনলে আপনার মোটেও মজা লাগবে না।
: বল শুনি।
: আপনাকে আমার পছন্দ হয়নি। আর আপনিও বাসায় গিয়ে বলবেন যে আমাকে আপনার পছন্দ হয় নি। মামলা ডিসমিস।
: এত সহজেই মামলা ডিসমিস কেন জানতে পারি?
: না পারেন না। ডিসমিস মানে ডিসমিস আর কোন কথা নাই। আমি এখন উঠব।
আমি রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে এলাম। লোকটাকে আমার আসলেই পছন্দ হয়নি। একে তো আমার চেয়ে ৮ বছরের বড়, তার ওপর পুরাই ক্ষ্যাত। পরেছে গেভারডিনের একটা প্যান্টের সাথে বয়স্ক লোকেদের মত বড় বড় চেক দেওয়া একটা শার্ট আর পায়ে একজোড়া ফিতা দেওয়া স্যান্ডেল, ইয়াক! এই লোককে বিয়ে করলে আমার বন্ধু বান্ধবের সামনে মান ইজ্জত থাকবে!
: চলো তোমাকে হোস্টেলে নামিয়ে আসি।
: না ধন্যবাদ।
: চলো চলো, এখন বেশ রাত হয়েছে, গাড়ি ঘোড়া তেমন পাবে না।
: দরকার নাই, আমি উবার ডেকে নিব।
লোকটা তেমন জোড়াজুড়ি করল না। আর আমিও মোবাইলে উবার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। যাক ব্যাটা জাহান্নামে, যেদিক খুশি, আমার কি!
আমি অবশ্য শুরু থেকেই লোকটার সাথে দেখা করতে চাচ্ছিলাম না। মাত্র পোস্ট গ্রাজুয়েশন শেষ হচ্ছে, চাকরি-বাকরিতে ঢুকতেই পারিনি, এখনই বিয়ে কিসের! কিন্তু কে শোনে কার কথা। বাড়ির লোকজন তো আর বসে থাকবে না। তাই মামা যখন এই ছেলের প্রস্তাব নিয়ে এলো, মা বললেন, দেখা করে আয়। ছেলেটা ভালো, ভদ্র, ভালো চাকরি করে। ছেলের নিজের গাড়ি আছে। যদিও বয়সটা তোর চেয়ে একটু বেশি, তবে আট বছর এখন আর তেমন কোন ব্যাপার না।
মায়ের জোড়াজুড়িতেই শেষ পর্যন্ত দেখা করতে আসা। মনে মনে ভেবেছিলাম, দেখা করলেই তো আর কিছু হয়ে যায় না। আর তাছাড়া ৩৫ বছর বয়স এখন আর এমনকি। কিন্তু এসে যে একদম ৬০ বছরের বুড়ো আঙ্কেলের মতো কাউকে দেখতে হবে সেটা অবশ্য বুঝতে পারিনি।
: এই মেয়ে, ওঠো।
: জী!?
: বললাম বাইকে ওঠো।
: এটা আপনার বাইক!
: হ্যাঁ, কোন সমস্যা?
: জী না।
আমি অবাক হয়ে বাইকটার দিকে তাকিয়ে আছি। কি সুন্দর! এক পাশ দিয়ে নাম লেখা দেখা যাচ্ছে, yamaha। যদিও মডেল বুঝতে পারছি না তবে এটা যে খুব চমৎকার একটা বাইক এই বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।
: কি হলো, কি দেখো?
: বাইকটা। এটা আপনার? আপনি চালান?
: হ্যা, বাইক আমার খুব পছন্দ, অনেক দিন ধরে চালাই। আমার প্রথম প্রেমও বলতে পার, আসো উঠে পড়।
আমি কিছুক্ষণ ইতস্তত করে, সমস্ত দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছেড়ে উঠে বসলাম। সীটটা ভালোই, আরামদায়ক। এরকম চমৎকার একটা বাইকে বসে নিজের মধ্যে কেমন নায়িকা নায়িকা একটা ফিল হচ্ছে। এই রে, আমি আবার উনাকে পছন্দ করে ফেলছি না তো!
ছোটবেলা থেকে বাইকের প্রতি আমার প্রচন্ড আকর্ষণ। রাস্তায় যখন ছেলেরা সাঁই সাঁই করে বাইক নিয়ে ছুটে যেতো, আমার সব সময় মনে হতো, ইশ আমি যদি ছেলে হতাম, আমিও এরকম সাঁই সাঁই করে বাইক চালাতাম।
একটু বড় হবার পর থেকে মনে হলো, আমার তো আর বাইক চালানো হলো না, তবে যাকে বিয়ে করবো তার যেন অবশ্যই বাইক থাকে। বিয়ের পরে দুজনে উড়াধুড়া বাইক নিয়ে ঘুরবো আর ছবি তুলে ফেসবুকে আপলোড করব। ক্যাপশনে থাকবে, দ্বিচক্রযানে দম্পতি। কিন্তু কি কপাল আমার, আমাকে যতজন পছন্দ করতো, তাদের কারোই বাইক ছিল না। আর এই লোক, একে তো মনে হচ্ছে উড়াধুড়া করে তো দূরে থাক, সামান্য রিক্সার গতিতে বাইক চালাতেও সে হুমরি খেয়ে পড়ে যাবে।
: কি হলো, থামলেন যে!
: আসছি, একটু দাড়াও।
ভাঙাচোরা টাইপ একটা পার্টসের দোকানের সামনে লোকটা বাইক থামিয়েছে। কেন থামিয়েছে কে জানে! আমাকে একটু বলে দাঁড় করিয়ে সে ভেতরে চলে গেল।
: নাও হেলমেটটা পরো, না হলে সামনে পুলিশ ধরবে।
: এটা আপনি এখন কিনলেন!
: হু, নাও পরো।
বুঝলাম না, লোকটা কি আমাকে ইমপ্রেস করার চেষ্টা করছে। সামান্য কিছুক্ষণ বাইকে বসার জন্য একটা হেলমেট! তাও যেন তেন মুড়ির টিন মার্কা কোন হেলমেট না, বেশ ভালো মানের একটা হেলমেট।
: খামাখা টাকা নষ্ট করলেন। এই অল্প কিছুক্ষণের জন্য হেলমেটটা না কিনলেও হতো।
: তাইলে বেশিক্ষণের জন্যই পরো। তোমার বাইকে ভালো লাগছে না?
: তা লাগছে।
: তাইলে চলো তোমাকে ঢাকা শহরে একটু চক্কর দিয়ে নিয়ে আসি।
: দিবেনই যখন তখন ঢাকা শহরে চক্কর দিবেন কেন, অন্য কোথাও দেন।
: তাইলে কোথায় যেতে চাও?
: উ…চলেন মাওয়া যাই। শুনেছি হাইওয়েটা খুব সুন্দর। ইলিশও খাওয়া হবে আবার পদ্মা ব্রিজটাও দেখে আসা হবে, আমি এখনও পদ্মা ব্রিজ দেখিনি।
বলার পর পরেই আমার মনে হল, আচ্ছা আমি এই কথা কেন বললাম! এই বেকুবটার সাথে আমি এখন মাওয়া যাব! সব এই বাইকটার কারসাজি।
আর তাছাড়া লোকটাই বা কি ভাববে, আর যদি লোকটা রাজি না হয়, তাইলে তো আমার অপমানের সীমা থাকবে না।
: ভাবতেছি, বুঝছো..
: কি?
: এখন যদি মাওয়া রওনা দেই, তাইলে পৌঁছাতে পৌঁছাতে মিনিমাম রাত বারোটা বেজে যাবে। তারপর ইলিশ খেয়ে ফেরত আসতে আসতে ভোর। সকালে তো আবার অফিস আছে।
: তাইলে যেয়েন না।
: কি আশ্চর্য, তুমি আমাকে সাহস দিবা, তা না, বলতেছো যেয়েন না!
: ঠিক আছে, সাহস দিলাম, চলেন যাই,কিছু হবে না। ভোরে এসে ঢুলতে ঢুলতে অফিসে করবেন।
লোকটা কিছুক্ষণ ইতস্তত করল। লোকটার বোধহয় অফিস নিয়ে বেশ চিন্তা।
: তোমার হোস্টেল? সেখানে কেউ খোঁজ করবে না?
: করবে। রুমমেট কে জানাবো যে, বাইরে আছি, আপনার সাথে, তাইলেই হবে, আপনার সাথে যে দেখা করতে আসবো সেটা তো জানেই।
: আচ্ছা, চলো তাইলে, তোমাকে পদ্মা ব্রিজ দেখিয়ে নিয়ে আসি, হেলমেটটা পরো।
আমি হেলমেট মাথায় গলালাম। আমার কেমন অদ্ভুত লাগছে। এরকম একদিনের পরিচয়ে কারো সাথে ঘুরতে যাওয়া জীবনে এই প্রথম। অবশ্য সমস্যা হওয়ার কথা না কারণ বাসার লোকজন তো সব জানেই।
: এটা কিভাবে আটকায়?
: এদিকে আসো, আমি আটকে দেই।
লোকটা খুব যত্ন করে আমার হেলমেটের ফিতা বেঁধে দিল। এখন মনে হচ্ছে লোকটা বেশ কেয়ারিং আর আমার কাজকর্মে বেশ মজাও পাচ্ছে। হয়তো মনে মনে ভাবছে, মেয়েটা তো ভালো পাগল আছে! না হলে এই রাতে এমন স্বল্প পরিচিত কারো সাথে কেউ বাইকে ঘুরতে চায়!
: আচ্ছা আপনি এত সুন্দর একটা বাইক নিয়ে আসছেন কিন্তু স্যান্ডেল পরেছেন কেন?
: নখে ব্যথা পেয়েছি, দেখো কেমন ফুলে গেছে।
লোকটা পা সামনে এগিয়ে দিল। আসলেই তার কেনি আঙ্গুলটা ফুলে ঢোল।
: অফিস থেকে ফিরতে আজকে বেশ দেরি হয়েছিল। তাড়াহুড়া করে তোমার সাথে দেখা করতে আসতে গিয়ে এই অবস্থা। টেবিলের কোনায় এমন বাড়ি লাগলো! বাবা! অফিসের ড্রেসটাও চেঞ্জ করার সুযোগ পেলাম না।
ও আচ্ছা, ভদ্রলোকের এই বেশভূষার তাহলে এই কারণ! ভালো।
বাইক নিয়ে গুটিগুটি করে প্রথমে আমরা ঢাকা শহর পার হলাম। এরপর হাইওয়েতে উঠতেই সে কি টান! বাতাসে চুল, ওড়না সব উড়ে যাওয়ার দশা।
: এত জোরে বাইক চালাচ্ছেন কেন?
: কেন ভয় লাগতেছে? আমাকে ধরো।
এতক্ষণ লোকটাকে না ধরেই বসে ছিলাম। কিন্তু লোকটা এমন জোরে বাইক চালাচ্ছে যে ধরবো না ধরবো না করেও শেষমেষ কাঁধে ধরেই ফেললাম।
: দেখো একশো তে চালাচ্ছি।
: স্পিড কমান।
: ১১০।
: কমান বলতেছি, না হলে কিন্তু আমি লাফ দিব।
: আচ্ছা, কমাচ্ছি। কিন্তু তুমি যে এমন ভয় পাও তোমাকে দেখে কিন্তু সেরকম মনে হয়না। ভেবেছিলাম বিয়ের পর তোমাকে নিয়ে সাঁই সাঁই করে বাইক চালাবো কিন্তু এখন দেখছি সেটা আর হচ্ছে না।
: আমি আপনাকে বিয়ে করব আপনি এতো নিশ্চিত হলেন কিভাবে?
লোকটা কোন উত্তর দিল না। মনে হল সে যেন মিটিমিটি হাসছে।
: পেছনের চাকায় কেমন যেন একটা শব্দ হচ্ছে, শুনতে পাচ্ছেন?
: হুম দেখছি।
লোকটা হাইওয়ের মধ্যেই বাইক থামালো। দেখা গেল, তার নাম্বার প্লেটের একটা স্ক্রু খুলে আলাদা হয়ে গেছে, সেটাই ঘটাং ঘটাং করে শব্দ করছে।
: তোমার ওড়না থেকে একটু কাপড় ছিড়ে দিবা? তাইলে নাম্বার প্লেটটা বেঁধে রাখতাম, স্ক্রুটা পড়ে গেছে।
: আপনি কি আমাকে নায়িকা শাবানা ভাবেন যে শাড়ির আঁচল, ওড়না ছিড়ে এখন আপনাকে দিব? ওই যে সামনে আপনার ন্যাকড়া দেখা যাচ্ছে, ওখান থেকে ছিঁড়ে নেন।
লোকটা আর উত্তর দিল না। বাইকে রাখা ন্যাকড়া থেকে কিছুটা কাপড় ছিড়ে নিয়ে নাম্বার প্লেটটা বেঁধে ফেলল।
: আর পড়বে না, চলো, রওনা দেই।
আবারো সাঁই সাঁই করে বাইক চলতে শুরু করল। এই রাত, এই বাতাশ, এই গতি, সব মিলিয়ে আমার কি আশ্চর্য রকম লাগছিল যে বলে বোঝাতে পারবো না। সবকিছু কেমন অপার্থিব মনে হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল কোন কিছুতেই যেন আমার আর কিছু যায় আসে না। এই মধ্যবয়স্ক লোক, তার বুড়োদের মতো চেক চেক শার্ট, ফোলা গাল কোন কিছুতেই না।
আর অল্প কিছুদূর এগোতেই রাস্তায় কিছু টহল পুলিশ আমাদের আটকালো।
: এই আপনারা কোথায় যাচ্ছেন?
: জী, পদ্মা সেতু দেখতে।
: এই রোডে যাওয়া যাবে না, পাশেরটা দিয়ে যান। এই রোডে বাইক নিষেধ।
ভদ্রলোক বাইক ঘুরিয়ে পাশের অন্ধকার রাস্তায় নেমে এলেন।
: এই রাস্তায় তো লোকজন নেই। যদি ডাকাত ধরে!?
: ধরলে আর কি করা, তোমাকে ওদের কাছে দিয়ে আমি উধাও হয়ে যাব, হা হা।
: খুব মজা না!
বলতে বলতে লোকটার পিঠে বিশাল জোরে খামচি দিলাম। খামচি দেয়া আমার বদ অভ্যাস। আমার ভাই বোন যার সাথেই মারামারি হয়েছে, সে আমার খামচি খায় নাই, এমন ইতিহাস এখনও রচনা হয়নি।
: উঃ তুমি এরকম খামচিও দাও নাকি!
: জী, ব্যাথা পেয়েছেন?
: না, ঘাড়ের একটু ডান পাশে দাও তো, ওখানে চুলকাচ্ছে।
কি আশ্চর্য। অন্য সময় হলে লোকটার এই কথা শুনে আমার পিত্তি জ্বলে যেতো কিন্তু শুধু সময় আর পরিস্থিতির কারণেই বোধহয় এই কথাতেও আমার বিরক্ত লাগলো না। বরং কেমন মজা লাগলো। মনে হল, ঠিকই তো আছে, ঘাড়ে চুলকালে মানুষ তো এভাবেই কথা বলবে, আর কি ভাবে বলবে শুনি!
ঠিক সাড়ে বারোটার দিকে আমরা মাওয়া পৌঁছালাম। ভেবেছিলাম মানুষজন থাকবে না কিন্তু কিসের কি, এখানে তো প্রায় মেলা বসে গেছে।
লোকজনের ভিড় ঠেলে ঠিক পদ্মা নদীর পাশে একটা কাঠের বেঞ্চিতে আমরা বসলাম। একটু দূরে নৌকায় আমাদের জন্য ইলিশ ভাজা হচ্ছে।
: ইয়ে শুনুন, আপনাকে না একটা কথা বলা হয়নি।
: কি?
: আমি ইলিশ মাছের কাঁটা বাছতে পারি না। বাসায় সব সময় মা নয়তো আপু বেছে দেয়।
: তো এখন আমাকে কাঁটাও বেছে দিতে হবে?
: না দরকার নেই, আপনি ইলিশ খান, আমি অন্য কিছু খাচ্ছি।
আমি মনে একটু অভিমান নিয়েই বললাম। যদিও লোকটা ঠিক খেয়াল করেছে কিনা, বুঝতে পারলাম না।
একটু পরে নৌকার লোকটা ইলিশ মাছ, ভাত, আরো কি কি সব আমাদের কাছে দিয়ে গেল।
আমি একটা চিপসের প্যাকেট নিয়ে বসে থাকলাম। অভিমান, যদিও তার সাথে আমার অভিমানের সম্পর্ক না কিন্তু কি অবাক করা ব্যাপার, এই সামান্য কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে আমার আবার অভিমানও হচ্ছে!
: নাও, হা কর।
: থাক লাগবে না।
: খাও তো, খাও।
বলে লোকটা জোর করে মুখের মধ্যে খাবার দেয়ার চেষ্টা করল।
: তোমার ছবি দেখে তোমাকে প্রচন্ড রাফ অ্যান্ড টাফ মনে হয় কিন্তু তুমি যে এরকম আহ্লাদী সেটা জানা ছিল না।
: আহ্লাদি হওয়া ভালো না খারাপ?
লোকটা হেসে আবার আমার মুখের মধ্যে একগাদা খাবার দিয়ে দিল।
আর কি আশ্চর্য, আমি সম্পূর্ণ অপরিচিত একজন লোকের হাতে আরাম করে ভাত খেতে লাগলাম। আমার একটুও খারাপ লাগলো না। একবার মনেও হলো না যে ব্যাপারটা কেমন অনুচিত। বরং বেশ লাগলো।
আমার পায়ের কাছে পদ্মার পানি আর একটু দূরে পদ্মার ব্রিজ। মৃদু বাতাস বইছে। ঠিক এই খানে বসেই আমি আমার জীবনের সবচেয়ে বড় সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেললাম।
এক মাস পর….
গতকাল আমার বিয়ে হয়েছে। সকাল হতে না হতেই লোকটাকে আমি ধাক্কা দিয়ে ঘুম থেকে তুলেছি। ক্যাম্পাসের এক ফটোগ্রাফার ছোট ভাই কে ডেকে এনেছি। সে ড্রয়িং রুমে বসে আছে, বাইক নিয়ে আমাদের ছবি তোলার জন্য। ছবি তোলার পর পরই সেটা গরম গরম আপলোড করা হবে।
: এই চলেন না, ছবি তুলব।
: এই সকাল বেলা কিসের ছবি?
: কিসের আবার, আপনার আর আমার, সাথে দ্বিচক্রযান, চলেন চলেন, ওঠেন, ফেসবুকে আপলোড দিতে হবে।
বেচারা অনিচ্ছা সত্ত্বেও উঠে দাঁড়ালো। মনে হচ্ছে যেন সে যেতে চাচ্ছে না। আমি সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে রেডি হয়ে বাইরে গেলাম। বাসার সামনের রাস্তাটা চমৎকার, এখানেই ছবি খুব সুন্দর হবে।
: আপু দুলাভাই কই?
: আসতেছে দাঁড়া, বাইক বের করতেছে, একটু তো সময় লাগবেই।
খানিক বাদেই লোকটা এসে দাঁড়াল। কিন্তু একি! তার সাথে বাইক কই! তার হাতে তো একটা সাইকেল!
: আপনার বাইক কই আর আপনি সাইকেল দিয়ে কি করেন!?
: তুমি তো বললা, দ্বিচক্রযানে ছবি তুলবা, তাই আনলাম।
: আশ্চর্য তো, তাই বলে কি আমি সাইকেলের কথা বলছি? আপনার বাইক কই?
লোকটা একটু গলা খাঁকারি দিয়ে গলা পরিষ্কার করল।
: ইয়ে বাবু শোন, তুমি এখন থেকে বাইকের কথা ভুলে যাও, মাথা থেকে ঝেড়ে ফেল।
: মানে?
: মানে হচ্ছে ঐ বাইকটা আসলে আমার ছিল না, ঐটা আমার বন্ধুর। তুমি বাইক দেখলে বিয়েতে সহজে রাজি হবা, এই জন্য তোমার মা আর মামা মিলে এই বুদ্ধি করেছে। আমার কিন্তু কোন দোষ নাই।
: মানে কি, কি বলছেন এসব!
: ঠিকই বলছি। তবে তোমার এত শখ দেখে আমিও ভেবেছিলাম একটা বাইক কিনে ফেলবো, কিন্তু এখন তেলের যে দাম, তাতে কুলাতে পারব না। তাই তোমার শখ মেটাতে সাইকেলটা কিনে আনলাম। বউয়ের দ্বিচক্রযানের শখ বলে কথা, পূরন না করে পারা যায়!
এই ছেলে দাঁড়িয়ে আছো কেন, ছবি তোল।
মানুষ অধিক শোকে পাথর হয় আর আমি অধিক শোকে কংক্রিট হয়ে ক্যাম্পাসের ছোট ভাইয়ের সামনে দাঁড়িয়ে।
আমার কপালে শেষ পর্যন্ত এই সাইকেলই ছিল!
#দ্বিচক্রযান