বিয়ের পর মেয়েদের জীবন
বিয়ের পর আমি সারা বছর টাকা জমাতাম, তারপর সেই টাকা দিয়ে বাবার বাড়িতে যাওয়ার সময় বাবার বাড়ির লোকজনের জন্য এটা সেটা কিনে নিয়ে যেতাম।
বিশেষ করে আমার চা পাগল মায়ের জন্য চা পাতা, চিনি আর গুড়ো দুধ। টোস্ট বিস্কুট।
বাবার জন্য নতুন নতুন আতরের শিশি, টুপি আর বাবার পছন্দের খুরমা খেজুর।
ছোট বোনের জন্য পছন্দের চুলের ব্যান্ড, ডায়েরি, জুতা। ছোট ভাইদের জন্য টেনিস বল, চকলেট। বড় ভাইয়ের বউ, তার ছেলে, মেয়ে, ভাই সবার জন্য কিছু না কিছু নিয়েই যেতাম। সর্বশেষ নাহারের জন্যও একসেট থ্রিপিস হলেও কিনে নিতাম।
আমি বিশ্বাস করি দামি কিছু দিয়ে মানুষকে যতটা না খুশি করা যায় পছন্দের জিনিস দিয়ে এর চেয়ে বেশি খুশি করা যায়। সেটার দাম হোক পাঁচ টাকা।
আমি তো জানি আমার প্রিয়জনরা কি কি জিনিস পেলে বেশি খুশি হয়।
এসব আমি লুকিয়ে করতাম, আবার বর জানতেন না। একাএকা যখন যেতাম তখনই আমি এসব করতাম।
বিয়ের পর থেকে লক্ষ্য করছি আমার বর কেন জানি কারো বাড়ি যাওয়ার সময় একটাকা খরচ করাকেও বড় খরচ মনে করতেন। আর কোনোভাবেই সেটা করতে রাজি হতেন না। এমনি তিনি লোক খারাপ না। শুধু আমার বাবার বাড়ি না, তার বোনের বাড়িও তিনি খালি হাতেই চলে যান। বিয়ের প্রথম প্রথম আমি বিব্রত হতাম, পরে বুঝতে পেরেছি এটা তার স্বভাব।
মাঝেমাঝে পুকুরে মাছ ধরলে তিনি নিজেই সবচেয়ে বড় মাছটাই আমার বাবার বাড়িতে পাঠিয়ে দেন।
কোথাও গেলে পছন্দের কোনো জিনিস আমার শাশুড়ির জন্য কিনলে আমার মায়ের জন্যও কিনে নিয়ে আসেন।
ঈদের সময় কাউকে সালামী নানা দিলেও আমার ভাই, বোনদেরকে দেন। আবার বাবার বাড়ি থেকে কেউ আসলেও তিনি অাতিথিয়েতায় কার্পণ্য করেন না।
বাবার বাড়ি কাছে হলেও আমার খুব একটা যাওয়া হতো না। আমার বাবার বাড়ির লোকজনই সময় অসময়ে আসতো। আমার একা সংসার, শ্বশুর নেই। শাশুড়িও আমার সাথে থাকেন না। মেয়ে বড় হচ্ছে, স্কুলে পড়ে। নানার বাড়ি বেড়ানোর সময় নেই। আবার মা ছাড়া একা ঘরে থাকতেও চায় না। ছেলে দুটো যমজ। তাদেরকে নিয়ে রাতে কোথাও থাকাও যায় না। সারাক্ষণই দুষ্টামি করে।
সংসারে আমার হাঁস, মুরগি আছে, গরু ছাগল আছে। এদের মায়া সন্তানের চেয়েও বেশি। এদের রেখে কোথাও যাওয়া যায় না।
দুই, এক ঘণ্টার জন্য যখন যাই, তখন তিনি আমার পিঁছু নেন। আশ্চর্য লোকটা এক প্যাকেট সুপার বিস্কুটও সাথে করে নেন না।
আমার লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করে। ভাইয়ের ছেলে, মেয়ে যখন জানালা দিয়ে আমাকে দেখে ফুফু, ফুফু করে ছুটে আসে, ছোট বোন, ভাই আপা দুলাভাই বলে জড়িয়ে ধরে।
আমি খালি হাত বাড়িয়ে ওদের কোলে নিতে আমার সংকোচ হয়। আমার চেহারা রক্তিম হয়ে যায় লজ্জায়। আমি নিজের অনুভূতি আড়াল করে মিথ্যা করে বলি একটানে রিক্সা দিয়ে চলে এসেছি, পথে একটা দোকানও খোলা পাইনি।
” যা তো নাহার পাড়ার মোড়ের দোকান থেকে দুই প্যাকেট পাইনএ্যাপেল বিস্কুট নিয়ে আয়।”
নাহার ছোঁ মেরে আমার হাত থেকে চকচকে একশ টাকার নোটটা নিয়ে বিস্কুট আনতে চলে যায়। আমি টাকাটার দিকে তাকিয়ে থাকি। তাকিয়ে থাকি নাহারের উচ্ছস্বিত মুখের দিকে। এই একশ টাকা জমাতে আমাকে অনেক কষ্ট করতে হয়। সংসার খরচ থেকে একটাকা , দুইটাকা করে অনেকদিন ধরে আমি এই টাকা জমাই।
এই টাকায় আমার মায়া আছে, ভালোবাসা আছে, কষ্ট আছে। আমার কেরানি বরের শ্রম আছে। সেই টাকা দিয়ে কেনা পাইনএ্যাপেল বিস্কুট যখন ভাইয়ের বাচ্চারা কাড়াকাড়ি করে খায়। আমার কাছে আনন্দ লাগে। এক টাকা, দুই টাকা করে জমানো একশ টাকায় যে একমুঠো সুখ কেনা যায় সেটা যে না কিনবে সে কখনো উপলব্ধি করতে পারবে না।
বাবার বাড়ি যাওয়ার সময় আমি প্রায় ঠোঁটের কাছে নিয়ে যাই কথাটা,
” বাচ্চাদের জন্য চলেন এক প্যাকেট বিস্কুট নেই!”
পরে আর বলি না। লোকটা কেমন যেন নির্বিকার। যদি মনে করেন বাবার বাড়ির জন্য আমার টান বেশি।অবশ্য বাবার বাড়ির প্রতি টান থাকা দোষের কিছু না। মনে হয় অভিমানেই বলি না। আমাকে বলে দিতে হবে কেন? সে বুঝে না, শ্বশুর বাড়ি খালি হাতে যেতে নেই।
অথচ বিস্কুট আমি ঠিকই কিনে দেই। সেই টাকাটাও তার সংসারের, তার কষ্টে উপার্জিত টাকা। অথচ তার এই বদ স্বভাবের কারণে আমার ভাইয়ের বউরা তাকে কৃপণ ভেবে হাসাহাসি করে।
আমার মা তাকে এক ফোঁটাও পছন্দ করেন না। কেন করেন না সেটা বুঝতে পারি না। খালি হাতে শ্বশুর বাড়ি যাওয়াই কি তার একমাত্র কারণ? আমার মা তার অপছন্দের ব্যাপারটা লুকিয়ে রাখেন না। তিনি সম্ভব হলে বলেই দিতেন,
” বাপু তুমি আর এবাড়ি এসো না। তোমাকে আমার পছন্দ না।”
আমি মায়ের মনোভাব বুঝতে পারি। আমার মনে হয় তিনিও বুঝতে পারতেন। কোনোদিন তিনি আমাদের বাড়ি গেলে আম্মা একটা মুরগি পর্যন্ত জবাই করতেন না। উপস্থিত ডাল, ভাত খেয়েই তিনি শ্বশুর বাড়ি থেকে চলে আসতেন। কখনো কখনো কিছু খেতেনও না।
অথচ আমার ছোট বোনের বর বেড়াতে গেলে আম্মা অস্থির হয়ে যেতেন কি রেখে কি খাওয়াবেন।
আমার বরের উপর আমার খুব রাগ হয়, শ্বশুর বাড়ি কেউ খালি হাতে যায়? কেন যাও? কারো মূল্যায়ন পাও না। অথচ আমার বোনের বর ঠিকই শ্বশুর বাড়িতে জামাই আদর পায়।
আমি তো অনেক কিছু করি বাবা মায়ের জন্য, ভাই বোনদের জন্য, তার টাকা দিয়েই করি অথচ সবাই তাকেই কৃপণ বলে।
কেন জানি আমার বোন ভাইদেরও অভিযোগের অন্ত নেই।
” শিউলি আপার জামাইটা একটা খাচ্চর, একটা কৃপণ। সামাজিকতা জানে না।”
আমার কেমন যেন, বেখেয়ালি, অবুঝ মানুষটার জন্য মায়া হয়। সে তো কম পছন্দ করেন না আমার মা, বাবা, ভাই, বোনকে, অথচ তাদের কী বিশ্রি মন্তব্য! আমি একসময় রাগ করে আর বাবার বাড়ি যাই না। আমি না গেলে তিনিও যাবেন না। এটাই আমার যুক্তি।
এত কাছে বাবার বাড়ি অথচ কোনো উপলক্ষ্য ছাড়া বছরের পর বছর যাওয়া হয় না।
এদিকে বাবা মারা যান, ছোট বোনটার বিয়ে হয়। ভাইয়েরা সবাই বিয়ে করে, কেউ কেউ বউ নিয়ে শহরে চলে যায়।
আমার ছেলে,মেয়েরাও বড় হয়। বড় মেয়েকে বিয়ে দেই। আমার সংসারও বড় হয়। কাজ কমলেও দায়িত্ব বেড়ে যায়। ছেলেদের বিয়ে করাই বড় ছেলের মেয়ে দাদী অন্ত প্রাণ। আমিও একটা বিস্কুটও খেতে পারি না তাকে ছাড়া। বড় মেয়ের মেয়েও আমার কাছে থাকে। এখানেই স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছি।
আমার বরও চাকরি থেকে অবসর নেন। তার একটাই কাজ মসজিদে যাওয়া, নামাজ পড়া আর নাতি নাতনিদের সময় দেয়া।
বাবার বাড়ি যখন তখন না গেলেও খবর পাই মা ভালো নেই। ভাইয়ের বউরা তাদের সংসার নিয়ে ব্যস্ত। ছেলে, মেয়ে তাদের লেখাপড়া আরও কত কি। বৃদ্ধ শাশুড়ির গুরুত্ব কমে গেছে সংসারে।
বোনরা এখন আর মায়ের ভয়ে বাবার বাড়ি যায় না। মা বোনদের দেখলেই বায়না করেন। তিনি আর ছেলেদের সাথে থাকতে চান না। বোনরা যেন কিছুদিনের জন্য হলেও মাকে নিয়ে যান। বোনদের বর কোনোভাবেই শাশুড়িকে নিতে রাজি নয়।
আমার খুব পরান পুড়ে মায়ের জন্য। মাঝেমধ্যে খাবার দাবার রান্না করে পাঠাই। মা খেতে পারেন না। এখন আর ভালো মন্দ খাওয়ার বয়স তাঁর নেই। তিনি সঙ্গ চান, ভালোবাসা চান। অথচ তাঁকে সঙ্গ দেয়ার মতো কেউ নেই।
আমি একদিন মাকে দেখতে যাই। আমার বরও সঙ্গে যান। আমি কেন জানি, না করি না। আজ আর তিনি খালি হাতে যাননি। মায়ের পছন্দের সব খাবার নিজেই কিনে নেন।
মা আমাকে দেখেই কেঁদে ফেলেন,
” শিউলি এত কিছু কেন এনেছিস? আমার কিছুর দরকার নেই। আমাকে তোর সাথে নিয়ে যায়। এখানে আমি সবার বোঝা। কেউ আমার কাছে আসে না।”
মায়ের জন্য আমার কষ্ট হয়। ভাই, বোনদের উপর রাগ হয়। তারা কেন মাকে অবহেলা করেন। মায়ের হাতের নখ বড় হয়ে আছে, মাথার চুলে জট হয়ে আছে।
আমি মায়ের পাশে বসি। নখ কেটে দেই, চুল অাঁচড়ে দেই। গোসল করিয়ে দেই, খাইয়ে দেই।
প্রতি সপ্তাহ মাকে দেখতে আসব বলে প্রতিশ্রুতি দেই।
মা বারবারই বলেন,
” আমার কিছু লাগবে না, তুই শুধু আমাকে নিয়ে চল।”
আমি মায়ের একথা শুনেও না শোনার ভান করে থাকি। আমি কোথায় নেব? আমি থাকি স্বামীর সংসারে, ছেলেদের আয়ে আমার সংসার চলে। এখানে আমি আমার মাকে নিয়ে কোথায় রাখব।
সবচেয়ে বড় কথা মা আমার বরকে পছন্দ করেন না। এটা কোনো গোপন বিষয় নয়। আমার ছেলে মেয়েও সেটা জানে।
মাকে নিয়ে আমি কি করব? দুই ঘণ্টা থেকে সবার থেকে বিদায় নিয়ে যখন আমি রওনা হই নিজের বাড়ি। হঠাৎ আবার বর বলে উঠেন,
“কোথায় যাচ্ছ তুমি একা একা? মা কোথায়?”
আমি অবাক হয়ে বলি,
” কেন, কী হয়েছে? আমি বাড়ি যাচ্ছি। নানি,নাতনিদের জন্য মন খারাপ লাগছে। মা শুয়ে আছেন।”
তিনি আদেশের সূরে আমাকে হুকুম দিলেন,
” এখুনি মাকে রেডি করে আমাদের সাথে নিয়ে চলো। আজ থেকে মা আমাদের সাথে থাকবেন। মেয়ে হিসাবে তোমার দায়িত্ব আছে না?”
আমি যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারি না। লোকটা কী বলছে এসব! আমার যে মা কোনোদিন একটা মোরগ পর্যন্ত জবাই করেনি যার জন্য সে আমার মায়ের দায়িত্ব নিতে চাচ্ছেন, আমার মায়ের!
আমি মেকি রাগ করে বললাম,
” কোনো দরকার নেই। মায়ের ছেলেরা আছে। মা ছেলেদের কাছেই থাকবেন।”
” কেন একা ছেলেদের কাছে মা থাকবেন? তুমি মায়ের মেয়ে না! পিতা, মাতার দায়িত্ব সন্তানের, সেখানে ছেলে, মেয়ে উল্লেখ নেই।”
আজ ছয়মাস মা আমার কাছে থাকেন। সংসারের দায়িত্বের চাপে কখনো কখনো মায়ের কি লাগবে না লাগবে ভুলে যাই। তিনি ভুলেন না, নিয়ম করে মায়ের ঔষধ,পথ্য সব নিয়ে আসেন।
দুইমাস পর ভাই এসেছে মাকে নেয়ার জন্য। তিনি যেতে দেননি, বলেছেন মা সারা জীবন আমাদের সাথে থাকবেন।
যে জামাইকে মা পছন্দ করতেন না, নামাজ পড়ে সে জামাইর জন্যই মা হাত তুলে দোয়া করেন।
একদিন আমার বর আমাকে ডেকে বলেন,
” শুনতে পাচ্ছ মা মোনাজাতে কার জন্য যেন দোয়া করছেন।”
আমি তার কথা শুনে হাসি। গর্বে আমার বুক ফুঁলে উঠে। এমন স্বামীর স্ত্রী হতে পেরে আমার নিজেকে সৌভাগ্যবতী মনে হয়।
সৌভাগ্যবতী
কামরুন নাহার মিশু