#জাকিয়া_সুলতানা_ঝুমুর
“দেখা করবো।”
ফিরোজ কোনো দ্বিমত করেনা।শান্ত স্বরে বললো,
“আসছি।”
তারপর ফোন কেটে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়।হৃদপিণ্ড উত্তেজিত হয়ে বেশামাল ভাবে লাফাচ্ছে।বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে!বললেই হলো?মগের মুল্লুক নাকি হ্যাঁ? তার পাখি অন্যকারো হবে এটাও মানতে হবে?সে কখনোই এটা হতে দেবেনা।নিজেকে যতটুকু দরকার শান্ত রাখার চেষ্টা করে।লম্বা লম্বা পা ফেলে শ্যামার আগেই সে পুকুর পাড়ে চলে আসে।চুপচাপ পুকুর পাড়ে অপেক্ষা করে।নিঝুম রাত ঝি ঝি পোকার ডাকগুলো আজকে কেমন বিষাদ মাখানো মনে হচ্ছে।শেয়ালের ডাকগুলো কারো আত্মচিৎকার বলে কানে ধরা দিচ্ছে।সে অস্থির পায়ে প্রেয়সীর জন্য অপেক্ষা করে।
দূর থেকে ফিরোজকে দেখে শ্যামার বুকের ক্ষতে আরো বেশী যন্ত্রণা হয়।কান্নারা দলা পাকিয়ে গলার দিকে উঠে আসে।দীঘল কালো চোখ দিয়ে অঝোরে পানি পড়ছে।ফিরোজের কাছে গিয়ে চোখের পানির ধারা যেনো আরো বাড়লো।কাঁপা গলায় বললো,
“আব্বা বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে।আমি কিন্তু তোমাকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করবোনা।”
ফিরোজ কিছু না বলে শ্যামার দিকে তাকিয়ে থাকে।মেয়েটা কেঁদেকেটে চোখ মুখ ফুলিয়ে ফেলেছে।ফিরোজের প্রচন্ড রাগ হলো হঠাৎ করে রাগে শরীর কেঁপে উঠলো থরথর করে।
শ্যামা যে শুধুমাত্র তার এটা সবার জানা দরকার ছিলো,সে ছাড়া অন্যকারো কাছে বিয়ে দেয়ার সাহস কি করে হয়?সে শ্যামাকে বললো,
“আমার কথা বলোনি?”
শ্যামা ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদে।মাথা দু’দিকে নাড়িয়ে মানা করে।মুখে বলে,
“ভ,য়ে বলিনি।আমি খুবই খারাপ মেয়ে,তোমার কথা প্রকাশ করার মতো সাহস আমার হয়নি।”
ফিরোজ শান্ত চোখে শ্যামার দিকে তাকিয়ে থাকে।মেয়েটা যে ভ,য় পেয়েছে সে তা স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে।সে অভ,য় দিয়ে বললো,
“কোনো ব্যাপার না।”
শ্যামা কাতর গলায় বললো,
“আমি কিন্তু বিয়ে করবোনা।”
“আচ্ছা।”
শ্যামার ফিরোজের সামান্য আচ্ছায় মন ভরে না।
“আচ্ছা!আচ্ছা কি?দুইদিন পরে বিয়ের তারিখ দেয়া হয়েছে।”
ফিরোজ দুষ্টুমি করে বললো,
“তাতে কি?বিয়ে ঠিক হলে করে নিবা।শুনলাম কানাডার প্রবাসী তাহলে কানাডা যেতে পারবে।”
শ্যামার কান্না আরো বাড়ে।ফিরোজের কথাগুলো শুনে চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করে।ধরা গলায় আধভাঙ্গা সুর করে বললো,
“বিয়ে করে নেবো?”
ফিরোজ হাসি চেপে রেখে বললো,
“হুম।”
শ্যামা আর কিছু না বলে বাড়ির দিকে পা বাড়ায়।ফিরোজ তাড়াতাড়ি হাত চেপে ধরে বললো,
“এই!কই যাচ্ছো?আমি তো দুষ্টুমি করেছি।”
ফিরোজের কথাবার্তা শ্যামার কাছে খাপছাড়া লাগছে।হাত মুচরাতে মুচরাতে বললো,
“এটা দুষ্টুমি করার সময়?”
ফিরোজ মাথা নেড়ে না করে।শ্যামার কান্না থামে না।ফিরোজ বললো,
“আমার পাখিকে বিয়ে করে নেবে এতো সাহস কার?নিতে আসুক না বুক থেকে কলি,জা আলাদা করে দেবো।”
শ্যামা ফুপিয়ে উঠে।
“আমি কিন্তু তোমাকে ছাড়া বাঁচবো না।”
“আমাকে ছাড়া বাঁচতে হবে না।এসব নিয়ে একটুও চিন্তা করোনা।আমার উপর বিশ্বাস রাখো,আমি সব সামলে নেবো,এই কানাডিয়ান পাত্রের বিয়ে হাতের এক তুড়িতেই ভেঙ্গে দেবো।”
শ্যামা ফিরোজকে নিজের চাইতে বেশি বিশ্বাস করে।ফিরোজ শ্যামার চোখের পানি যত্ন করে মুছিয়ে দেয়।গালে হাত রেখেই বললো,
“কাঁদো কেনো?আমি বললাম না সব সমাধান হয়ে যাবে।”
ফিরোজের কথায় শ্যামার কান্না কমে না বরং সে কেঁপে কেঁপে উঠে কান্নার তোড়ে।
“আমার ভ,য় হচ্ছে।”
“ভ,য় পাওয়ার কোনো কিছু নেই।”
শ্যামা কাঁদতে কাঁদতেই মাথা নাড়ে।ফিরোজ শ্যামার চোখের পানি আলতো স্পর্শে মুছে দেয়।
“আর এক ফোঁটা চোখের পানিও যেনো না পড়ে।এখন হাসো তো দেখি।”
শ্যামা হাসে না।ফিরোজ শ্যামার গালে টোকা দিয়ে বললো,
“হাসে না কেনো আমার পাখি?”
ফিরোজ হাসতে হাসতে এই কথা বলে,ফিরোজের হাসি শ্যামার ঠোঁট পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করে।শ্যামাও হাসে।ফিরোজ শ্যামার দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে।এই মেয়েটা হাসলে তার এতো সুখ লাগে।পাখিটাকে ছাড়া তার বেঁচে থাকা অসম্ভব।এই মুখে হাসি ফোটানোর জন্য যা করা লাগবে সব সে করবে।সে আলতো করে শ্যামার গালে হাত ভুলিয়ে বললো,
“এভাবেই হাসবে তোমার হাসি আমাকে শক্তি যোগায়।”
শ্যামা চোখে জল মুখে হাসি।সে হেসে বললো,
“আচ্ছা।”
“অনেক রাত হয়েছে বাড়ি যাও।”
শ্যামা বাড়ির পথে হাটা ধরেও থেমে যায়।পিছন ফিরে আবার ফিরোজের কাছে আসে।শ্যামাকে আবার আসতে দেখে ফিরোজ বললো,
“কি? “
শ্যামা ফিরোজের চোখের দিকে তাকায়।আস্তে করে বললো,
“একটু জড়িয়ে ধরি?শুধু একটুখানি”
প্রেমিকার এমন আবদারে ফিরোজ হকচকিয়ে যায়।সে বললো,
“অফকোর্স।এটা জিজ্ঞেস করার কি আছে?”
“যদি ওইদিনের মতো আবার মা,রো।”
ফিরোজ হেসে ফেলে বললো,
“তখন তো তুমি আমার পাখি ছিলেনা,এখন তুমি আমার ছোট চড়ুই।এখন নো মা,রা,মা,রি।”
তারপর শক্ত করে তার বুকের মাঝে শ্যামাকে জড়িয়ে নেয়।শুধু বুকে জড়িয়েই ক্ষান্ত হয় না,আলতো করে শ্যামার গলায় মিষ্টি একটা চুমু দিয়ে দেয়।ফিরোজের পক্ষ থেকে প্রথম ভালোবাসায় বাহুবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে শ্যামার নারী মন দিশা হারাতে চায়,পেটে হাজারো প্রজাপতির উড়াউড়ি টের পায়,পুরুষালী উষ্ণ ঠোঁটের স্পর্শে শ্যামা কেঁপে উঠে; ফিরোজের বুকে বিড়ালছানার মতো মিশে যেতে চায়।এতো আদরে সে আবারো কেঁদে দেয়।ফিরোজ বুকে নিয়েই ফিসফিস করে বললো,
“কি হলো?”
শ্যামা ফিরোজের মতোই ফিসফিস করে বললো,
“এতো আদর দিচ্ছো কেনো?আমার কপালে এতো সুখ সইবে না,আমি ঠিক ম,রে যাবো।”
ফিরাজ মিষ্টি করে হাসে।শ্যামার মতোই ফিসফিস করে বললো,
“আমি বোধহয় আমার পাখিটাকে সুখে সুখেই মে,রে ফেলবো।খুবই খারাপ প্রেমিক আমি।”
শ্যামা তার বুকে নাক ঘষে বললো,
“আমার প্রেমিক।”
ফিরোজ শ্যামাকে ছেড়ে দিয়ে আস্তে করে বললো,
“আমাকে তুমি করে সম্মোধন করছো কেনো বালিকা?প্রেম নদীতে কি আজন্ম ডোবাতে চাও নাকি?”
শ্যামা লজ্জামাখা মুখে বললো,
“কখন তুমি বললাম?আচ্ছা আর বলবো না।আপনি বলাই ভালো।”
“আপনি থেকে তুমিই বেশী আদুরে ডাক।তুমি বললে কেমন আপন আপন লাগে।এই অদমকে আদুরে ডাক থেকে বঞ্চিত করার কি দরকার?”
শ্যামা তর্ক করেনা।ফিরোজ শ্যামার হাত ধরে বললো,
“চলো এগিয়ে দেই।”
দুজনে হাতে হাত রেখে এগিয়ে যায়।এই ছোট কাজেও শ্যামার সুখের ছোঁয়া লাগে।মনে মনে ভাবে সারাজীবন যেনো এভাবেই হাতে হাত রেখে চলতে পারে।
রাতে দেরী করে ঘুমানোর ফলে শ্যামা সকালে দেরী করে ঘুম থেকে উঠে।রুম থেকে বেরিয়ে বাড়িটাকে বিয়ে বাড়ি মনে হয় না,মনে হচ্ছে শোকার্ত কোনো বাড়িতে চলে এসেছে।বাড়ির প্রতিটা কোনা চুপচাপ,নিস্তব্ধতায় ঘেরা।শ্যামা খাবারের ঘরে যায় সেখানে শান্তা ফাতেমা বেগমের মাথায় তেল পানি দিয়ে দিচ্ছে।শ্যামা কাছে গিয়ে বললো,
“কি হয়েছে আম্মার?”
শান্তা রাগী চোখে শ্যামার দিকে তাকিয়ে বললো,
“তোর দোয়া কবুল হয়েছে?”
শ্যামা আগামাথা কিছু না বুঝে বললো,
“কিসের দোয়া?”
“বিয়ে ভেঙ্গে গিয়েছে।সেই খবর শুনেই আম্মা অসুস্থ হয়ে পড়েছে।”
শ্যামা কোতুহলী হয়ে বললো,
“কেনো ভাঙ্গলো?”
“তোর বয়স কম উনারা আরেকটু বড়ো মেয়ে চায়।”
শ্যামার নিজের কানকে নিজের বিশ্বাস হয় না,মনের মাঝে খুশীর সমুদ্র হো হো করে বয়ে যায়।কিন্তু এই সুখের লেশমাত্র সে প্রকাশ করে না,বরং চেহারার ভাব করে দুঃখী,মুখ মনমরা হয়ে যায়,চুপচাপ সে তার আম্মার পাশে বসে।আস্তে করে বললো,
“অহ!আচ্ছা।”
ফাতেমা বেগম শ্যামার ব্যাথাতুর চেহারা দেখে ভাবলেন বিয়ে ভেঙ্গে যাওয়াতেই বুঝি মেয়ের মন খারাপ হয়ে গিয়েছে।সে মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
“এসব নিয়ে মন খারাপ করবি না।”
এমন সময় স্বপন ইসলাম এসে রুমে ঢুকে।স্ত্রীর কথা শুনে বললো,
“মন খারাপ করবে কেনো?এরচেয়ে ভালো পাত্র খুঁজে আনবো।”
শ্যামা মাথা নিচু করে রুমে চলে আসে।রুমে এসে দরজা আটকে এলোমেলো হাত পা ছুড়ে কতোক্ষন নাচানাচি করে।ধপাস করে বিছানায় শুয়ে পড়ে।মুখে হাত চেপে খিলখিল করে ছুটে আসা হাসির শব্দ আটকায়।হাসির তোড়ে চোখে পানি চলে আসে।সে তৎক্ষনাৎ ফিরোজকে ফোন দেয়।ফিরোজ তখন উপজেলায় বসে কিছু কাজ করছিলো।শ্যামার ফোন পেয়ে মুখে হাসি ফুটে উঠে।রিসিভ করে শ্যামার হাসি শুনতে পায়।সে আলতো গলায় বললো,
“আমার মহারানী কি নিয়ে এতো খুশী?”
শ্যামা ফিসফিস করে বললো,
“বিয়ে ভেঙ্গে গেছে।”
ফিরোজ হেসে বললো,
“তাই?খুশীর খবর তো ;এই খুশীতে মিষ্টি খাওয়াও।”
শ্যামা হেসে হেসে বললো,
“মিষ্টি তো দোকানে।”
“মধুরানীর মধুরাজা কি দোকানের মিষ্টি খাবে?”
শ্যামা মনোযোগী হয়ে বললো,
“তো?”
ফিরোজ আস্তে করে বললো,
“এতোকিছু বুঝাতে পারবো না।বিয়ে ভেঙ্গে গিয়েছে সেই উপলক্ষে আমার মিষ্টি চাই।অকে মধুমাসের মধুওওওরানী?”
ফিরোজের ইঙ্গিত এতোক্ষণ ধরতে না পারলেও এখন শ্যামার বোধগম্য হয়।তারপর কট করে ফোন কেটে দেয়।লজ্জায় কান দিয়ে গরম ধুঁয়া বের হয়।ইশ!এককালে এই ছেলেটাকেই সে কিনা আনরোমান্টিক বলেছিলো?এই ছেলে তো পাক্কা মধুমাসের রাজা।শ্যামা লজ্জায় মুখ লুকায়।
চলবে…….
(কেউ লজ্জা পেয়েছেন?আমি লজ্জা পেয়েছি।)