মধুমাস পর্ব ১৯
#জাকিয়া_সুলতানা_ঝুমুর
নিজের চোখের সামনে ছেলেটার বয়স হু হু করে বেড়ে যাচ্ছে তা মোহাম্মদ আলীর ভালো লাগে না।ছেলে বিয়ে করবেনা না করলেও উনি কিন্তু থেমে থাকেনি।গোপনে গোপনে ঠিকি মেয়ে খুঁজে যাচ্ছেন।তেমনি কালকে এক বাল্যকালের বন্ধুর বাসায় গিয়ে বন্ধুর মেয়ে পছন্দ করে ফেলেছে।বন্ধুকে মনের কথাটা বলতেই বন্ধু রাজী হয়ে যায়।মোহাম্মদ আলী ছেলেকে বিয়ে করানোর জন্যে ঘোর প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।সকালে নাস্তার টেবিলেই ফিরোজকে পেয়ে যান।
“ফিরোজ।”
ফিরোজ নাস্তা খেতে খেতেই তার আব্বার দিকে তাকায়।মোহাম্মদ আলী ধীরে সুস্থে বললো,
“তোর না না তো অনেক শুনলাম।আর না শোনার ধৈর্য নাই।আমি মেয়ে দেখে এসেছি।তুই তামিম কে নিয়ে বিকেলে মেয়েটা দেখে আয়।”
মোহাম্মদ আলীর মুখে আবারো বিয়ের নাম শুনে ফিরোজের খাওয়া বন্ধ হয়ে যায়।কপালের চামড়া আপনাআপনি কুঁচকে যায়।সে গম্ভীর গলায় বললো,
“মানে?”
“কথাতো স্পষ্ট করেই বললাম।বুঝতে পারছিস না?”
“আমি আপনাকে বলেছিনা যে এখন বিয়ে করবোনা।”
মোহাম্মদ আলী মূহুর্তেই রেগে যায়।কিড়মিড় করে বললো,
“তুই বললেই আমি শুনতে হবে?”
আফিয়া বেগম সুযোগ হাতছাড়া করেনা।দাঁত কিড়মিড়িয়ে বললো,
“বেয়াদব!মায়ের মতো বেয়াদব হইছে।”
ফিরোজ চোখ তুলে আফিয়া বেগমের দিকে তাকায়।আফিয়া বেগম থমথম খেয়ে অন্যদিকে তাকায়।মোহাম্মদ আলী চেয়ার ছেড়ে উঠতে উঠতে বললো,
“বিকেলে চলে যাবি।আমি কোনো কথাই শুনতে চাই না।”
“আমি যাচ্ছি না।”
“কেনো?”
“কারণ আমি এখনই বিয়ে করতে চাচ্ছি না।”
“কারণটা কি?”
“কোনো কারণ নেই।”
মোহাম্মদ আলী ছেলের দিকে ফিরে তাকায়।ফর্সা মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি সমেত ফিরোজকে ভিষণ সুন্দর লাগছে।ছেলেদের এতো সুন্দর হওয়া ভালো না।আচ্ছা উনার এতো সুন্দর ছেলে প্রেম করছে না তো?উনি সোজা প্রশ্ন করেন,
“তুই কাউকে পছন্দ করিস?”
ফিরোজ তার আব্বার দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে না করে।
“তাহলে সমস্যা কি?”
ফিরোজ নিভু গলায় বললো,
“কিছুনা।”
“তাহলে আর কি?বিকেলেই যাবি।”
ফিরোজ রেগে যায়।তীক্ষ্ম গলায় বললো,
“আমি বলেছি না যাবো না।”
মোহাম্মদ আলী ছেলের এই অবাধ্যতার সাথে পরিচিত না।সবার সাথে ফিরোজ রাগী হলেও উনার সাথে রাগী না।উনি হতভম্ব হয়ে ফিরোজের দিকে তাকিয়ে থাকে।কালকে ফারিয়ার গায়ে হলুদ তাই আর কথা বাড়ায় না।মেয়ের বিয়ের আগে অশান্তি সৃষ্টির দরজার নেই।
ফিরোজ হনহন করে রুমে চলে যায়।শ্যামার সাথে কথা বলতে হবে।যতো তাড়াতাড়ি পারা যায় শ্যামাকে বিয়ে করতে হবে।যা পরিস্থিতি হচ্ছে
কবে না তার আব্বা মেয়ে বাড়ি এনে বলবে এখনি বিয়ে কর।সকাল সকাল তার মেজাজ সপ্তম আকাশে উঠে যায়।তখনি এমপি মহোদয়ের কাছে থেকে ফোন আসে।উনার সেক্রেটারি জানায় আজকে পাশের এলাকায় সংবর্ধনা অনুষ্ঠান হবে।স্যার ফিরোজের উপস্থিতি আশা করছে।ফোন কাটার সাথে সাথে শ্যামা ফোন দেয়।ফোন রিসিভ করে কিছু বলার আগে শ্যামা কিছু উতপ্ত বাক্য ফিরোজের দিকে ছুড়ে মা,রে।সে কোনো কিছু বলার আগেই শ্যামা কট করে ফোন কেটে দেয়।সংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়া মোবাইলের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে।পাগল!মেয়েটা কি পাগল নাকি?হুট করে কেউ সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করে দিতে পারে?ফিরোজের বুকের উঠানামা দ্রুত হয়।শ্যামার ফোন নাম্বারে ডায়াল করে কিন্তু বন্ধ।এদিকে এমপি সাহেবের কাছে যাওয়াও জরুরী।ফিরোজ হাত দিয়ে চুল খামচে ধরে,শ্যামা না করলো কিভাবে?ওর জন্যই আজকে তার আব্বার সাথে বাজে ব্যবহার করেছে না হলে এতো অনুরোধের পরে বিয়েতে অবশ্যই মত দিতো কিন্তু সে দেয়নি কারণ তার শ্যামা পাখি আছে যে অধির আগ্রহের সাথে ফিরোজের জন্য অপেক্ষা করে।বাচ্চাদের সাথে প্রেম করার এই এক জ্বালা তারা হুটহাট সিদ্ধান্ত নেবে।আরো কয়েকবার শ্যামাকে ফোন দিয়ে কোনো সুলক্ষণ না দেখে বাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়ে।
শ্যামা আজকে কলেজে যাবে না।সকালেই এমন এক সিদ্ধান্ত নিয়েছে যা শ্যামার শরীরের সর্ব শক্তি শুষে নিয়েছে।বিছানায় শুয়ে কাঁদতে কাঁদতে চোখ মুখ ফুলিয়ে ফেলেছে।ফাতেমা বেগম আর শান্তা এসেছিলো কিন্তু শ্যামা মাথা ব্যাথার দোহাই দিয়ে উঠেনি,কারো সাথে কোনো কথাও বলেনি।শান্তা রুমে গিয়ে রিপনকে বলে,
“আমার মনে হয় তোমার বোন প্রেম করে।”
রিপন মোবাইলে চোখ রেখেই বললো,
“কার সাথে?”
“তা জানি না।কিন্তু প্রেম করে।”
“কিভাবে বুঝলে? “
“মাঝে মাঝে ফোনে কথা বলে,আবার বিয়ের কথা বলাতে কিভাবে কাঁদলো দেখলেনা?”
“সব মেয়েই বিয়ের কথায় কাঁদে।”
শান্তা মুখ অন্ধকার করে বললো,
“আমার কথা বিশ্বাস হয়না তো,যখন অঘটন ঘটবে তখন মিলিয়ে দেখো।”
রিপন বললো,
“শ্যামা এমন মেয়ে না,দেখলেনা আব্বা শ্যামাকে কতো বিশ্বাস করে।”
রিপনের কথাগুলো শান্তার মনমতো হয়না।সে বিরবির করে কি জানো বলতে থাকে।
রাত বারোটার দিকে ফিরোজ বাড়ি আসে।ফ্রেশ হয়ে শ্যামাকে ফোন দেয় কিন্তু যথারীতি বন্ধ।ফিরোজ ক্লান্ত হয়ে চেয়ারে বসে পড়ে।তার শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ব্যাথা।সারাদিন কম পরিশ্রম হয়নি,ক্লান্তিতে চোখদুটো বন্ধ হতে চাইছে।সে উঠে দাঁড়ায়।স্পঞ্জের জোতা পায়ে দিয়ে ঘর ছেড়ে রাস্তায় উঠে আসে।শ্যামার রুমের কাছে এসে সতর্ক চোখে আশেপাশে তাকিয়ে আস্তে করে টোকা দেয়।তিন চারবার পরপর দিতে থাকে।তার বিশ্বাস শ্যামা ঘুমায়নি।
শ্যামা জেগেই ছিলো।এতোবড়ো একটা কান্ড ঘটিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমানোর প্রশ্নই উঠে না।সারাদিন ফোন বন্ধ করে রেখেছিলো ফিরোজ কতোটা রাগবে সেটা ভেবেই কলিজা শুকিয়ে যাচ্ছিলো।জানালায় কারো টুকা শুনে সে এগিয়ে যায়।জানালা খুলে দেখে ফিরোজ দাঁড়িয়ে।তাকে দেখে বললো,
“বের হতে পারবে?”
শ্যামা স্বাভাবিকভাবেই বললো,
“পারবো।”
“রাস্তায় আসো।”
শ্যামা দরজা ভেজিয়ে চুপচাপ রাস্তায় যায়।ফিরোজ শ্যামাকে দেখে বললো,
“কি সমস্যা?”
শ্যামা তখনো কাঁদছে।ফ্যাচ ফ্যাচ করে নাক টেনে বললো,
“কোনো সমস্যা না।”
“তাহলে সম্পর্ক শেষ মানে কি?”
ফিরোজের শীতল কন্ঠস্বর শ্যামার অন্তরাত্মা কাঁপিয়ে দেয় কিন্তু সাহস করে বললো,
“শেষ মানে শেষ।”
ফিরোজ রেগে যায়,সারাদিনের ক্লান্তিতে মেজাজ ঠিক রাখতে পারে না।
“বললেই হলো?আমাকে কি গাধা মনে হয়?আমিতো প্রেম করতে চাইনি তুমি আমাকে পাগল বানিয়েছো,আমার অন্তরে ঢুকে সব উল্টাপাল্টা বানিয়ে দিয়েছো।এখন বলো সম্পর্ক রাখবে না।কি মনে করো আমাকে?”
ফিরোজ যা বলছে সব সত্যি।শ্যামা মুখে হাত চেপে কেঁদে ফেলে।ফিরোজ হাত দিয়ে নিজের মুখ মুছে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে।কান্নারত শ্যামার কাছে এসে শ্যামার হাত ধরে চোখের পানি মুছে দেয়।আলতো হাতে কাছে টেনে শ্যামাকে বুকে জড়িয়ে নেয়।মাথার চুলে চুমু দিয়ে বললো,
“তুমি আমার পাখি না!এসব কেনো বলো?সারাদিন অনেক প্যারায় ছিলাম তোমার এমন কথাগুলো শুনে মাথা ঠিক রাখতে পারছিনা।প্লিজ এসব বলোনা।”
ফিরোজের বুকে গিয়ে শ্যামার মনে হলো সারাদিনের কষ্টগুলো নিমিষেই দূর হয়ে গেলো।ফিরোজের কাতরতা শ্যামাকে ছুঁয়ে যায়।সে ফিসফিস করে বললো,
“আব্বা জানলে খুব কষ্ট পাবে।আমাকে নিয়ে আব্বার খুব আশা।”
“আমরা তো পালিয়ে যাচ্ছি না।আমরা সবাইকে মানিয়ে বিয়ে করবো।তাহলে আর কেউ কষ্ট পাবে না।”
“আমার ভ,য় হয়।”
“আমি আছিতো এতো ভ,য় কিসের?”
শ্যামা ফিরোজের হাত থেকে ছুটতে চায়।
“যাইহোক আমি সম্পর্ক রাখবনা।”
ফিরোজ শ্যামাকে আরো কাছে টেনে নেয়।
“আমি ছাড়লে তো যাবে।”
শ্যামা কাঁদে।দু’দিকে মাথা নেড়ে বললো,
“কেউ মানবেনা।”
ফিরোজ সযত্নে শ্যামার চোখের পানি মুছিয়ে বললো,
“এসব চিন্তা আমার।তুমি শুধু এই উল্টাপাল্টা কথাগুলো বলো না,আমার শান্তপাখি হয়ে থাকো।”
শ্যামা চোখভরা পানি নিয়ে ফিরোজের দিকে তাকিয়ে থাকে।ফিরোজ অশ্রুভেজা চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,
“তোমাকে ছাড়া আমি শূন্য।বাঁচবোনা সোনা।”
শ্যামা মাথা দুলিয়ে বললো,
“আমিও।”
“আর এসব বলবে না।ওকে?”
“কিন্তু “
“কোনো কিন্তু না।সব বাধা অতিক্রম করে আমার পাখিকে বুকের খাঁচায় আনবই।”
“আচ্ছা।”
“আর এসব বলবে?”
“না।”
“তুমি আমার শান্তির কারণ,এটা মনে রেখো।”
শ্যামা বাড়ি আসার আগে থমকে দাঁড়িয়ে যায়।ফিরোজ কিছু বললেও উত্তর দেয় না।জুলুজুলু চোখে ফিরোজের দিকে তাকিয়ে থাকে।ফিরোজ মিহি গলায় জানতে চায়,
” কি হয়েছে।”
শ্যামা মাথা নাড়ে।ফিরোজ হঠাৎ হো হো করে হেসে ফেলে।তারপর শক্ত করে শ্যামাকে নিজের সাথে জড়িয়ে নেয়।কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললো,
“আমাকে ছাড়া থাকতে পারবেনা,সেটা আমি জানি।”
শ্যামা হেসে বললো,
“রাজা ছাড়া রানী থাকে কি করে?”
শ্যামা সকল চিন্তা দূরে ঠেলে বাড়ির দিকে হাটে।ফিরোজ ঠিক তাকে জয় করে নেবেই।কিন্তু হাসিহাসি মুখে নিমিষেই ভ,য়ের চিহ্ন ফুঁটে উঠে।চলন্ত পা থেমে যায়।
রিপন দারাজ গলায় বললো,
“কই গিয়েছিলি এতো রাতে?”
চলবে…..
“সব মেয়েই প্রেম করা অবস্থায় পরিবারের কথা চিন্তা করে এমন পিছু হটে কিন্তু অবাধ্য প্রেমিকগুলো পিছু হটতে দেয় না।”
“চোরের দশ দিন,গেরস্তের একদিন।”