#জাকিয়া_সুলতানা_ঝুমুর
রাত গভীর;ফাতেমা বেগম স্তব্ধ হয়ে চেয়ারে বসে আছে।বিয়ের এতো বছর পরে এই প্রথম স্বামীর হাতে মা,র খেলেন তাও অতী আদরের মেয়ে শ্যামার জন্য।শ্যামাকে এতো আদর ভালোবাসা,দেয়ার পরেও সে কিভাবে এই জঘন্য সম্পর্কে জড়ালো?যে সম্পর্কে জড়ালে বাবা মায়ের মনঃক্ষুন্ন হয় এমন সম্পর্কে জড়ানো আগে বুক কাঁপলো না!শ্যামা খুব ভালো করে জানে এই পরিবারের কেউ ফিরোজকে পছন্দ করে না,এতোসব জানার পরে নিজেকে কিভাবে বিষাক্ত সম্পর্ক নামক বেড়াজালে নিজেকে আটকালো?ফাতেমা বেগম চোখ মুছে উঠে দাঁড়ায়।বেদনাদায়ক দৃষ্টি মেলে মেয়ের রুমের দিকে তাকায়।দুঃখে বুকটা মুচড়ে উঠে,চিৎকার করে কান্না করতে ইচ্ছে করে।এতো কষ্ট করে মেয়ে জন্ম দিয়েছেন এমন কথা শোনার জন্য!সেদিন ঠিক হওয়া বিয়েটা কতো ভালো ছিলো কিন্তু শ্যামার কারণেই ভেঙ্গে গেলো।
শ্যামা লাইট অফ করে শুয়ে আছে।নিঝুম রাত নাম না জানা এক পাখি থেমে থেমে করুন সুরে ডাকছে,এমন করুণ ডাক শুনে মনে হচ্ছে পাখিটা তার মনের দুঃখ বুঝেই এমন করে ডাকছে।তার আব্বা আম্মা এতো সহযে এই সম্পর্ক মানবে বলে মনে হচ্ছে না,শ্যামা চেষ্টা করবে,দরকার হলে নিজের জান বা,জি রেখে হলেও চেষ্টা করবে।তারপরেও ফিরোজকে নিজের করে নেবে।হ্যাঁ সে বাবা মায়ের কষ্টটা বুঝে কিন্তু একবার বিয়ে করে নিতে পারলে ঠিক সবাই মেনে নেবে এই বিশ্বাস শ্যামার আছে।যদিও ফিরোজ তাকে আশ্বাস দিয়েছে যে কালকেই তার আব্বাকে এই বাড়ি পাঠাবে।শ্যামার শান্তি লাগে না,অশান্তিতে ছটফট করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।
ফিরোজ সারারাত ঘুমাতে পারেনি।বারবার মনের পর্দায় শ্যামার কাতর মুখটা ভেসে উঠছে,সেই মুখে ফুটে উঠা কষ্টের পারদ তাকে গভীরভাবে ছুঁয়ে যাচ্ছে।সকাল হলেই তার আব্বাকে শ্যামার কথা বলতে হবে।আর এই বলা নিয়েই ফিরোজের যতো ভয়,তার আব্বা অহংকারী;নাক উঁচু মানুষ।তিনি সহযে কোনোভাবেই শ্যামাকে পুত্রবধূ হিসেবে মেনে নেবে না।এতো সহযে উনার থেকে সম্মতি আশা করাও বোকামি।ফিরোজের ধারণা শ্যামাকে নিজের করে পেতে হলে তাকে প্রচুর বাধা পেরোতে হবে। তা বাধা আসুক সে সব বাধা পেরুতে রাজী শুধু শ্যামা হাতটা শক্ত করে ধরে রাখলেই হয়।
সকালে ফিরোজ নাস্তার টেবিলে নাস্তা করতে যায়।টেবিলের দিকে চোখ ভুলিয়ে সবাইকে’ই দেখতে পায়।মোহাম্মদ আলী চায়ের কাপ হাতে চুপচাপ বসে আছে।কিছুক্ষণ পরে উনি আস্তে করে বললো,
“মেয়েটাকে এতো মনে পড়ছে।”
রোজিনা বেগম বললো,
“মন খারাপ করোনা।কালকেই চলে আসবে।”
ফারিয়া কালকেই চলে আসবে।এরপর পরিক্ষার আগে আর যাবেনা তারপরও ফারিয়াকে ছাড়া ঘরটা খালি লাগছে।একমাত্র মেয়ে বলে সবার’ই মন খারাপ।এই মন খারাপের মাঝে শ্যামার প্রসঙ্গ তুলে ধরা কতোটা যুক্তিসঙ্গত তা ফিরোজের ঠিক বোধগম্য হয় না কিন্তু সে নিরুপায় শ্যামার আব্বা আর ভাই কেমন এটা তার ভালো করেই জানা একবার যেহেতু ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে গিয়েছে এখন শ্যামার উপরে চাপ আরো বাড়বে।যে সময় হোক তার আব্বার সামনে এই কথাগুলো বলতেই হবে তাই সে সিদ্ধান্ত নিলো এখনি বলবে।ফিরোজ কিছু খাচ্ছে না দেখে মোহাম্মদ আলী বললো,
“কিরে!খাচ্ছিস না কেনো?”
ফিরোজ বললো,
“আব্বা একটা কথা বলি?”
“বল।”
ফিরোজ খুব গোপনে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।বলে,
“আব্বা আপনি সম্মতি দিলে আমি বিয়ে করতে চাই।”
মোহাম্মদ আলীর মুখে হাসি ফুটে উঠে।
“সত্যি?”
ফিরোজ কিছু না বলে মাথা নেড়ে সায় জানায়।মোহাম্মদ আলী বললো,
“তাহলে মুনিয়ার আব্বাকে খবর দেই?উনিতো সেদিনও জিজ্ঞেস করলো।”
ফিরোজ দ্রুত বললো,
“না না।আমি মুনিয়াকে বিয়ে করতে চাই না।”
মোহাম্মদ আলী ভ্রু কুঁচকে তাকায়।হাতের কাপ টেবিলের উপরে রেখে বললো,
“মেয়ে দেখবো?”
“না।”
“তাহলে!কাকে?”
ফিরোজ তার আব্বার চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,
“শ্যামা কে।স্বপন কাকার মেয়ে।”
মোহাম্মদ আলী বিষ্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যায়।কয়েকজোড়া বিষ্ফোরিত চক্ষু তার উপরে এসে নিবন্ধ হয়।মোহাম্মদ আলী নিজের কানকে এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না।উনি গম্ভীর গলায় বললো,
“কি বলছিস?মাথা ঠিক আছে?”
ফিরোজ মাথা দুলিয়ে বললো,
“হ্যাঁ।আমরা একে অপরকে পছন্দ করি।”
রোজিনা বেগম হতবাক।শ্যামা মাঝে মাঝেই তাদের বাড়িতে আসতো।উনি ভাবতেন ফারিয়ার কাছে আসে কিন্তু এই মেয়ে যে এই বাড়ির ছেলের সাথেই সম্পর্ক গড়ে তুলবে তা কে জানতো?সবচেয়ে বড়ো কথা হচ্ছে এক দিনও এসব উনার চোখে পড়েনি।অবাক হওয়া চোখে উনি ফিরোজকে দেখছে।এই ছেলে এতোদিন বিয়ের কথা শুনলে লাফাতো কিন্তু তলে তলে ঠিকি প্রেম করেছে।
মোহাম্মদ আলী ছেলের দিকে তাকিয়ে আছে।কি সাবলীলভাবে সে মনের কথা ব্যক্ত করছে।ছেলে এতোদিন বিয়ে করবেনা করবেনা বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলতো এখন দেখা যাচ্ছে বিয়ে না করার পেছনে কঠিন কারণ ছিলো।সব ঠিক আছে কিন্তু শ্যামাকে?অসম্ভব।স্বপন ইসলাম সারাজীবন স্কুলের ছাত্র ঠেঙ্গিয়ে সংসার চালিয়েছে,কোনমতে ছেলেমেয়ে ভরনপোষণ করে মানুষ করেছে,উনাকে বেয়াই বলে পরিচয় দিতে হবে ভাবতেই মোহাম্মদ আলীর পেট ঘুরঘুর করে উঠে।শ্যামাকে কোনোভাবেই এই বাড়ির ছেলের বউ করা সম্ভব না।
“এতোদিন তোকে রুচিশীল,বিচক্ষণ ভাবতাম কিন্তু তুই এমন কাজ কিভাবে করলি?প্রেম করেছিস ভালো কথা।জাতপাত দেখে প্রেম করবিনা?”
ফিরোজ গম্ভীর গলায় গমগমে আওয়াজ তুলে বললো,
“আমার রুচির খারাপ দেখলেন কি?”
“খারাপ রুচি না হলে এতো ছোটলোকের মেয়ে চোখে পড়ে?”
“আব্বা।স্বপন কাকা ছোটলোক না।উনারা মধ্যবিত্ত পরিবারে লোক।এই দুনিয়ার সবাই যে পয়সাওয়ালা হবে তা তো কোনো কথা না।”
মোহাম্মদ আলীর মেজাজ খারাপ হয়।
“তুই আমাকে ছোটলোক আর বড়োলোক এর সংজ্ঞা শিখাবি?”
“শিখাই নি বললাম শুধু।”
“এমন পরিবারের সাথে আত্মীয়তা করা সম্ভব না।কই আমাদের বংশ আর কই ওরা!”
ফিরোজ শান্ত কন্ঠে বললো,
“আব্বা আমি শ্যামাকে ভালোবাসি এটাই আসল কথা,এসব বংশ পরিচয়ে আমার কিছু যায় আসে না।”
“আমার যায় আসে।”
ফিরোজ তার আব্বার দিকে তাকিয়ে থাকে।মোহাম্মদ আলী আবার বলেন,
“কথা বুঝা গেলো?”
ফিরোজ আস্তে করে বললো,
“আমি শ্যামাকে বিয়ে করবো।আমি চাই আপনি স্বপন কাকার কাছে প্রস্তাব নিয়ে যাবেন।”
মোহাম্মদ আলী চেচিয়ে উঠে।হুংকার দিয়ে বললো,
“অসম্ভব।”
ফিরোজ নরম স্বরে বললো,
“জীবনে তো কোনো কিছু চাইনি আব্বা,এবার চাইলাম ফিরিয়ে দেবেন?”
মোহাম্মদ আলী ছেলের মুখের দিকে তাকায়।
“এতো পছন্দ?”
“জ্বি।”
“শ্যামার চেয়ে মুনিয়া ভালো ছিলো না?রাজ্যের সাথে রাজকন্যা!”
ফিরোজ উঠে দাঁড়ায়।
“আমার রাজ্য চাইনা আব্বা;রাজকন্যা হলেই হবে।”
মোহাম্মদ আলী হঠাৎ চুপ হয়ে যায়।কিছুক্ষণ পরে গম্ভীর গলায় বললো,
“তাহলে তুই আমার মান রাখবিনা।”
“মান রাখবো বলেই তো অনুমতি নিতে আসলাম,না হলে বিয়ের পরে এসে বলতাম।”
মোহাম্মদ আলী মাথা নাড়ে।
“আমি প্রস্তাব দেয়ার পরে যদি উনারা একবারো না করে আমি কিন্তু আর কখনো ওই বাড়িমুখো হবো না।”
ফিরোজ আত্মবিশ্বাসের সাথে বললো,
“না করবে না।”
“আচ্ছা।”
ফিরোজ খুব খুশী হয় কয়েক কদম এগিয়ে তার আব্বাকে জড়িয়ে ধরে।উনি যে এতো সহযে রাজী হয়ে যাবে তা ফিরোজের বিশ্বাস হচ্ছে না কিন্তু এমন পরিস্থিতিতে অবিশ্বাসও করতে পারছেনা।সে আস্তে করে বললো,
“আব্বা শ্যামাকে এনে দিলে আমার সারাজীবনের সব কষ্ট দূর হয়ে যাবে,মেয়েটা আমার সেরা উপহার।”
মোহাম্মদ আলী পাথরের মতো দাঁড়িয়ে থাকে।
সারাদিন শ্যামার সাথে বাড়ির কেউ কথা বলনি।এতো আদরের কন্যার সাথে কেউ কথা বলেনি এটা আসলেই অবিশ্বাস্য।শ্যামার খুব একা লাগছিলো, সে কয়েকবার মায়ের সাথে কথা বলার চেষ্টা করেছে কিন্তু ফাতেমা বেগম শ্যামাকে পুরোদস্তুর এড়িয়ে গেছেন।শ্যামা ব্যাকুল হয়,বাবা মায়ের এই এড়িয়ে চলা তার সহ্য হয় না।ফিরোজ ফোন দিলে সব বলে।ফিরোজ তাকে বলে,
“আব্বা আজকে সন্ধায় তোমাদের বাড়িতে যাবে।আশা করি কথা পাকা হবে।আমার আব্বা আমার কথা শুনবে দেখো।”
শ্যামা বিরবির করে বললো,
“ভালো হলেই ভালো।আমার এতো অশান্তি হচ্ছে।”
“সব ঠিক হয়ে যাবে।”
শ্যামার ভয় হয়।তার কেনো যানি মনে হচ্ছে কিছুই ভালো হবেনা।
সন্ধায় মোহাম্মদ আলী স্বপন ইসলাম কে উনার হোটেলে ডেকে নেয়।দুজনের মাঝে বেশ কিছুক্ষণ কথা হয়।গম্ভীরমুখে স্বপন ইসলাম বেড়িয়ে আসে।দ্রুত পায়ে বাড়ির দিকে হাটে।চোখে মুখের ভাষা ঠিক বোধগম্য হয় না।বাড়ির বারান্দায় সবাই বসে আছে।মোহাম্মদ আলী উঠোনের কাছের লাউয়ের ঝাড় থেকে একটা বাশের কঞ্চি হাতে নেয়।সবাই বারান্দায় বসে থাকলেও শ্যামা অনুপস্থিত।উনি কারো সাথে কোনো কথা না বলে শ্যামার রুমে গিয়ে সশব্দে দরজা আটকে দেয়।
চলবে…….
আমাদের বাড়িতে ইদের আমেজ এতোদিনে এলো।বাড়ি ভর্তি মেহমান,সারাদিন ফাঁকে ফাঁকে এইটুকু লিখলাম।