#জাকিয়া_সুলতানা_ঝুমুর
শ্যামাকে সেখানে রেখেই ফিরোজ হনহন করে বাড়ির দিকে হাটে।বুকে কেমনতর ব্যাথায় চিরবিড়িয়ে উঠছে,এই ব্যাথার সাথে সে সম্পূর্ণ অপরিচিত।বাড়িতে গিয়ে সোজা বিছানায় চলে যায়।ফিরোজ চোখ বন্ধ করে সব ভুলতে চায় কিন্তু কিছুই ভুলতে পারে না তার মনে হয় শ্যামার নরম গায়ের আদুরে স্পর্শ এখনো তার বুকজুড়ে লেগে আছে।ফিরোজের এই প্রথম কেমন হাফসাফ লাগে,দম বন্ধ করা অসহ্যরকম অনুভূতি হয়।সে বিরবির করে বললো,
‘এই যন্ত্রণার একমাত্র কারণ শ্যামা।’
ফিরোজের মনে হচ্ছে শ্যামাকে থাপ্পড় দেয়া উচিত হয়নি।মেয়েটাকে কেমন অসুস্থ দেখাচ্ছিলো তার উপর সে মা,রলো।খারাপ লাগায় তার মন ছেয়ে গেলো।না মা,রলেও হতো একটু কড়া করে ধমক দিলেই পারতো।
শ্যামা চুপচাপ বাসায় আসে।তাদের কাঠের চারচালা ঘর।ঘরের সামনে লাগোয়া লম্বা বারান্দা।বারান্দায় দুইপাশে দুইটা রুম আছে যার একটা রুম শ্যামার জন্য বরাদ্দ।কেউ কিচ্ছু টের পাওয়ার আগে শ্যামা চুপচাপ তার রুমে ঢুকে যায়।তারপর বিছানায় শুয়ে হাউমাউ করে কেঁদে দেয়।আজকে ফিরোজের আঘাত তার শরীরে না মনে দাগ কেঁটে গেছে।চোখ বন্ধ করে নিজের বেহায়াপনা থামানোর প্রতিজ্ঞা করে।পরক্ষণেই মনটা চিৎকার করে ফিরোজকে চায়।শ্যামা বুঝতে পারেনা আশাপাশে এতো ছেলে থাকতে মনটা কেনো এমন পুরুষে আটকাবে যার কিনা পাথরের মন।এই মনকে আয়ত্বে আনবে কিভাবে?নিজের অনুভূতির খাতা এভাবে খুলে দেয়ার পরেও যে ছেলে বুঝেনা তাকে আর কিভাবে বুঝানো যায়?এতো বিতৃষ্ণা কেনো তার প্রতি?দু’হাত বুকে জড়িয়ে শ্যামা শ্বাস টেনে নেয় মনে হচ্ছে সে এখনো ফিরোজের গায়ের মিষ্টি ঘ্রাণটা পাচ্ছে।সারা গায়ে ফিরোজের গায়ের ছোঁয়া।শ্যামা তার হাত দু’টো চোখের সামনে আনে,এই হাত দিয়েই সে ফিরোজকে আঁকড়ে ধরেছিলো,তারপর পাগলের মতো হাতে চুমু খায়।বিরবির করে বললো,আপনি এতো কঠিন কেনো?আমার আকুল হৃদয়ের আবেদন কেনো বুঝেন না?আপনাকে যে এতো ভালোবাসি তা কি বুঝেন না?বোধহয় আমি মা,রা যাবো আপনাকে না পেলে আমার এই জীবন বৃথা।একটু জড়িয়েই তো ধরেছিলাম তাই বলে এভাবে আঘাত করবেন?একটুও মায়া লাগেনি?এতো নিষ্ঠুর কেনো আপনি? শ্যামার ভীষণ অভিমান হয়,এই পুরুষটার উপর তার সাত জনমের অভিমান ভর করে।সে নিজেও মানে যে আজকে জড়িয়ে ধরা উচিত হয়নি কিন্তু তখন নির্জন পুকুর পাড়ে প্রিয় পুরুষকে দেখে আর স্থির থাকতে পারেনি কিভাবে যেনো এক আকাশ সাহস তার বুকে জমা হয় আর সে ফিরোজকে আঁকড়ে ধরেছে।আর এমন কাজ করাতেই ফিরোজ রেগে তাকে থাপ্পড় দিয়েছে।সে কখনো ভাবেনি ফিরোজ এতো রাতে তার ডাকে সারা দিতে আসবে কিন্তু এসেছে আর সে কিনা পাগলের মতো কাজ করে ব্যাপারটা আরো ঘেটে দিলো?শ্যামা লজ্জায় বালিশে মুখ লুকোয়।
তারপর থেকে শ্যামা আর ফিরোজদের বাড়িতে যায় না।সোজা কলেজে যায় তারপর কলেজ থেকে বাড়ি ফিরে।দূর থেকে ফিরোজকে দেখলেও কাছে গিয়ে ভুলেও মুখ তুলে তাকায় না।সেদিন জড়িয়ে ধরার পর থেকে লজ্জায় সে তাকাতে পারে না।শুনেছে প্রিয় মানুষকে জড়িয়ে ধরলে আরো নিবিড় করে বুকে মিশিয়ে নেয় সেখানে তাকে থাপ্পড় দিয়েছে।এই লজ্জা,অপমানে শ্যামা চুপসে গেছে কিন্তু ফিরোজকে মন ভরে দেখার স্বাধ ছাড়তে পারেনি মোবাইলে ছবির সাথে সারাক্ষণ কথা বলেছে,মোবাইলের স্কিন গালের সাথে লাগিয়ে ঘুমিয়েছে।এই যে এখন ফারিয়া ফিরোজের বাইকে করে আসছে;তাকে বলেছে উপজেলার মোড়ে থাকতে।সে কথামতো সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে।ফিরোজ কাছে এসে বাইক থামায়,ফারিয়া কলম কিনতে পাশের দোকানে যায় শ্যামা তখনো মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
ফিরোজ গভীর চোখে শ্যামার দিকে তাকায়।বাহ!মেয়েটা তাকাচ্ছেনা তার দিকে ভুল করেও তাকাচ্ছেনা।বুকে আগুন লাগিয়ে এখন ভালোমানুষী সাজা হচ্ছে।ফিরোজ নিজেও জানেনা আজকাল হুট করেই শ্যামাকে কেনো তার মনে পড়ে,চোখ বন্ধ করলেই কেনো চোখের পর্দায় এই এলোমেলো মেয়েটা উপস্থিত হয়।সেদিন মেয়েটা তার কাছে অনুভূতির প্রকাশ করে ফেলেছিলো আর ফিরোজ সেই ডাকে সারা দেয়নি আসলে তার কেনো জানি এসব ভালো লাগে না।তাছাড়া শ্যামা কত্তো ছোট,তার ছোটবোনের বান্ধুবী হয়।এসব চিপ ব্যপার ভাবলেই খারাপ লাগে।সেদিনের পর থেকে সে শ্যামাকে সরি বলতে চাইছিলো,থাপ্পড় দেয়া উচিত হয়নি সেটা বলতে চেয়েছে কিন্তু শ্যামা তার সামনে আসেনি,কেমন লুকিয়ে চুড়িয়ে বেড়ায়।আজকে সুযোগ পাওয়াতে ফিরোজ বাইক থেকে নেমে এগিয়ে আসে।
“কি খবর শ্যামা?”
ফিরোজের মুখে কিছু শুনবে ভাবতে পারেনি।শ্যামা অবাক হয়ে তাকায়।আস্তে করে বললো,
“ভালো।”
ফিরোজ শ্যামাকে লক্ষ করে।
“আমাদের বাড়িতে যাও না কেনো?”
শ্যামা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,
“এমনি।”
“এমনি?নাকি পছন্দ পাল্টে গেছে।”
শ্যামা অবাক হয়ে বললো,
“পছন্দ পাল্টাবে কেনো?”
ফিরোজ আস্তে করে বললো,
“আর তাকাও না যে তাই বললাম।”
“আপনি পছন্দ করেন না বলেই তাকাই না।”
“আমার সব পছন্দ অপছন্দই মানো নাকি?”
শ্যামা বুঝতে পারে না ফিরোজ কি বলতে চায়।সে মাথা নেড়ে বললো,
“সেদিনের।জন্য সরি।এতোটা পাগলামি করা উচিত হয়নি।”
শ্যামার পাগলামিতে অভস্ত্য ফিরোজ এই গম্ভীরমুখের শ্যামাকে ভালো লাগে না।
“আচ্ছা।আগের মতো হাসিখুশি থাকো।এমন প্যাচার মুখে তোমাকে ভালো লাগে না।আর সেদিন তুমি এসব উল্টাপাল্টা কথা বলাতে রেগে গিয়েছিলাম সরি।হ্যাঁ।”
ততক্ষণে ফারিয়া চলে এসেছে।ফিরোজ আস্তে করে সরে যায়।বাকি রাস্তা শ্যামা ফারিয়ার সাথে থাকলেও মনটা ফিরোজের কাছেই পড়ে রইলো।লোকটা তাকে আশকাড়া দিচ্ছে?নাকি সেদিনের কাজে অনুতপ্ত তাই।হাজারো প্রশ্ন শ্যামাকে খুচিয়ে বেড়ায়।ফারিয়া হাসিমুখে বললো,
“আমার ভাইয়া ভালো না?”
ভাইয়ের কথা আসাতে শ্যামা মাথা নেড়ে বললো,
“তোর ভাই তুই ভালো চিনিস।”
ফারিয়া অবাক হয়ে বললো,
“তোরও তো ভাই।”
শ্যামা ঘোর প্রতিবাদ করে বললো,
“আমার ভাই না।”
ফারিয়া অবাক হয়ে বললো,
“তোর কি?”
শ্যামা মুখ সামলে নেয়।ঝটপট বললো,
“আপন ভাই নাকি?উনি তো আমার চাচাতো ভাই।”
ফারিয়া হেসে বললো,
“ওই একি হলো,ভাইয়ার বিয়েতে আমি আর তুই সেম ড্রেস পড়বো।”
শ্যামা মনে মনে বললো,
“যদি তোর ভাইয়ের বিয়েতে বউ হতে না পারি তোর ভাইকে কেটে গোমতী নদীতে ভাসিয়ে দেবো।হুহ”
ফারিয়া তার ভাইকে অনেক ভালোবাসে বান্ধুবীর মনের কথা জানতে পারলে তখনি কান্নাকাটি করে এলাকা ভরিয়ে ফেলতো।
শ্যামাদের বাড়ির পাশে মুনিয়াদের বাড়ি।মুনিয়া এবার মাস্টার্স করছে।সে তামিমের সমবয়সী সেই সূত্র ধরেই তামিমিদের বাড়িতে আসা যাওয়া।শ্যামা অনেকদিন ধরেই লক্ষ করছে মুনিয়া ফিরোজের আশেপাশে ঘুরে,দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করে কিন্তু ফিরোজ তাকেই পাত্তা দেয়না এই মুনিয়া টুনিয়াকে তো আরো আগেই দেবেনা।এই ব্যাপারটা নিয়ে সে আর মাথা ঘামায়নি।অনেকদিন পরে আজকে শ্যামা ফারিয়ার কাছে তার বাড়িতে যায়।বাহিরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে।ফারিয়ার মা রোজিনা বেগম জানায় সবাই ফিরোজের রুমে।গুটিগুটি পায়ে সেও ফিরোজের রুমের দিকে এগিয়ে যায় কিন্তু ভেতরের দৃশ্য দেখে সামনের সব দৃশ্য স্বপ্ন মনে হয়।ফিরোজ আর মুনিয়া একপাশে আর তামিম আর ফারিয়া একপাশে বসে লুডো খেলছে।ফিরোজের মুখের হাসি শ্যামার নজর এড়ায় না।তার উপস্থিতি টের পেয়ে সবাই তার দিকে তাকায়।ফারিয়া পাশে জায়গা করে বললো,
“এখানে বোস।”
শ্যামা তখনো ফিরোজের দিকে তাকিয়ে আছে।ফিরোজ শক্ত চোখে শ্যামাকে দেখছে।সে চুপচাপ গিয়ে শ্যামার কাছে বসে।কারণে অকারণে মুনিয়া ফিরোজকে ছুঁয়ে দিচ্ছে।শ্যামা অবাক হয়ে লক্ষ করলো ফিরোজ বাধা দিচ্ছে না অথচ সেদিন সে একটু জড়িয়ে ধরাতে কি রাগ!শ্যামা সটান উঠে দাঁড়ায়।প্রিয় পুরুষকে আরেক মেয়ের পাশে দেখতে ভালো লাগছেনা,নিজের বুকের জ্বালাপোড়া লুকিয়ে ফারিয়াকে বলে বাড়ি চলে আসে।ফিরোজের উপর রাগ হচ্ছে ভিষণ।তাকে অসভ্য বলা?এবার দেখবে শ্যামা কি।
শ্যামা চলে যাওয়ার পরে ফিরোজ মুনিয়াকে বললো,
“গায়ে হাত দিওনা মুনিয়া।দূরে থাকো।”
সরাসরি এভাবে বলাতে মুনিয়া লজ্জিত হয়।ফিরোজ তখনো জানালা দিয়ে ছুটে চলা রমনীর পদগমন দেখছে।ফারিয়ার জোড়াজুড়িতে লুডো খেলতে রাজী হয়েছিলো শর্ত হলো তার রুমেই খেলতে হবে কিন্তু সাথে যে মুনিয়া থাকবে এই কথা ভাবেনি।শ্যামা আসার পর থেকে মুনিয়ার গায়ে হাত দেয়ার ব্যাপারটা ফিরোজ খুব ইনজয় করেছে,বালিকার রাগে নাক ফুলানো,আড়চোখে তার দিকে তাকানো অবশেষে রাগ সামলাতে না পেরে বাড়ির দিকে ছুটে চলা সবই তার দৃষ্টিগোচর হয়েছে।আজকাল শ্যামার পাগলামি ভালোই লাগে।
তখন রাত।নিঝুম অন্ধকারে ঝি ঝি পোকা ডাকছে অবিরত।ফিরোজ মোবাইল হাতে নিয়ে শ্যামাকে ম্যাসেজ করে,
“কি ব্যাপার তখন চলে গেলে যে।”
সাথে সাথেই ম্যাসেজ সিন হয়।
“আপনার ছোঁয়াছুঁয়ি শেষ আই মিন লুডো খেলা শেষ?”
ফিরোজ মুচকি হাসে।
“হ্যাঁ।”
শ্যামা রাগ সামলে ছোট করে বললো,
“ভালো।”
ফিরোজ মেয়েটার রাগের উত্তাপ টের পায়।
“তুমিও কি ছোঁয়াছুঁয়ি করতে চাও?”
“না।”
“তোমার বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে মশাদের ছোঁয়া নিচ্ছি।তুমি ছুঁতে চাইলেও আসতে পারো,মশাদের থেকে তোমাকে একটু ভাগ দিতেই পারি।”
শ্যামা বিছানা থেকে সটান দাঁড়িয়ে যায়।ফিরোজ এসেছে আর সে যাবেনা তা কি করে হয়?এতোটা ভালো মেয়ে সে না।আস্তে করে দরজা খুলে বেরিয়ে আসে।বাড়ির সীমানা পেরিয়ে দেখে অন্ধকারে একটা লাল বিন্দু ক্রমাগত উঠানামা করছে।বুঝতে পারে ফিরোজ সিগারেট খাচ্ছে।দুরুদুরু বুকে এগিয়ে যায়।শ্যামাকে দেখে ফিরোজ শান্ত গলায় বললো,
“বাব্বাহ ছোঁয়ার তো অনেক শখ।রাতের অন্ধকার মাথায় নিতে চলে এসেছো,ভয় লাগছেনা?”
আজকের ফিরোজের কথার ধরন সম্পূর্ণ ভিন্ন।শ্যামা ভেবে বললো,
“আমি ছুঁতে আসিনি।”
“কি করতে এসেছো?”
“দেখতে।”
মেয়েটার লজ্জা একটু কমই,আর কারো সাথে কেমন জানা নেই কিন্তু ফিরোজের সাথে লাগামহীন ।ফিরোজ মাথা নেড়ে অন্যদিকে তাকায়।
“আমি কি মধু যে মৌমাছির মতো আগে পিছে ঘুরে ঘুরে দেখতে হবে।”
শ্যামা ফিকফিক করে হাসে।
“এটা আপনি?আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।”
ফিরোজ কোনো কথা বলেনা।অন্ধকারে শ্যামার মুখ দেখা যাচ্ছে না। ফিরোজ কিছু বলছেনা দেখে শ্যামা ভিষণ নিলজ্জ হয়।আসলে সে নিজেকে গুটিয়ে গর্তে চলে যেতে চেয়েছিলো কিন্তু স্বয়ং ফিরোজই তাকে খুচিয়ে বের করেছে।সে ফিরোজের সামনে এমনিতেই লাগামছাড়া হয় আজকে ফিরোজের কথায় যেনো আশকাড়া পেলো।গভীর গলায় বললো,
“আপনি মধু না আপনি হলেন মধুররাজা।”
ফিরোজ থমথমে গলায় বললো,
“পাগল।”
শ্যামা এসব কথার তোয়াক্কা করে না।
“আমাকে মধুমাসে নিয়ে যাবেন?”
“মধুমাস সম্পর্কে ধারনা আছে?”
শ্যামা অকপটে বললো,
“আপনি ধারনা দিবেন।”
তখন দূর থেকে রিপনের বাইক ছুটে আসতে দেখা যায়।ভাই যে আজকে এখনো বাড়িতে আসেনি শ্যামা জানে না।প্রচন্ড রাগী ভাই এই রাতে তাকে এখানে দেখলে নির্ঘাত মে,রে ফেলবে।ফিরোজ সেদিকে তাকিয়ে বললো,
“মধুমাসে যাবে?রিপনকে বলি?”
চলবে……
(আপনারা লাইক কমেন্ট আর শেয়ার করলে আমি খুশী হই।