#ফাবিয়াহ্_মমো .
নিশ্বাসটা এখনো উত্থাল। স্বাভাবিক হয়নি একটুও। জোরে-জোরে নিশ্বাস নিতেই ঢোক গিললো মেহনূর। মাথা পিছু ঘুরালো সে, অটোর ছোট্ট চারকোণা হোল দিয়ে পেছনের অবস্থা দেখছে। না, মাহতিম আসেনি। ওর গাড়িও দেখা যাচ্ছে না। চলন্ত অটোর জন্য চোখে-মুখে বাতাস লাগছে। কপালের কাছে এলোপাথাড়ি চুল ছুটছে। শরীরের ভেতর চলছে তুমুল দাঙ্গা। শিরায়-শিরায় ছুটছে রক্তের স্রোত। মেহনূর শান্ত হতে পারছে না। একদম শান্ত পারছে না। চোখ বন্ধ করলেই একটু আগের ঘটনাটা মনে পরছে। বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে সত্যি-সত্যিই মাহতিম এসেছে! দুটো বছরের গণ্ডি পেরিয়ে হঠাৎ আগমনটা একেবারেই অপ্রত্যাশিত! কেনো এসেছে? আজ কেন আসলো? আজ কি কোনো বিশেষ দিন? এতোদিন কেন আসেনি? হাতদুটো কোলের উপর মুষ্টিবদ্ধ করলো। মাথাটা সামনে ঘুরিয়ে আরেকবার ঢোক গিললো সে। চোখ বন্ধ করে নিশ্বাস নিতেই হঠাৎ বিকট শব্দে হর্ণ বেজে উঠলো। শব্দের তীব্রতায় পলকের ভেতর চমকে উঠলো মেহনূর। দুচোখের পাতা খুলতেই লজ্জাবতী পাতার মতো তৎক্ষণাৎ মনটা কুঁকড়ে গেলো। বুকটা ঢিপঢিপ করে কাঁপছে। হৃৎযন্ত্রটা বেসামাল গতিতে ছুটছে। বুকে প্রচণ্ড ভয় নিয়ে আস্তে-আস্তে পিছু তাকালো মেহনূর, ঠিক একইভাবে ছোট্ট হোলের বাইরে দৃষ্টি ফেললো সে। মনে-মনে শুধু একটাই আকুতি জানালো, এটা মাহতিম না-হোক! অন্তত, সে না-হোক! পাক্কা কয়েক সেকেন্ড নিরব রইলো মেহনূর। ঢোক গিলতে-গিলতে ভয় মেশানো দৃষ্টিতে দেখলো, হর্ণটা বাজাচ্ছে বালুবাহী ট্রাক। বিশাল ট্রাকটা ফাঁক পাওয়ার জন্য হর্ণ বাজিয়ে যাচ্ছে। দৃশ্যটা দেখে মূহুর্তের ভেতর অদ্ভুত স্বস্তিতে চোখদুটো বন্ধ করলো মেহনূর। চাপা নিশ্বাসটা ছাড়তে-ছাড়তে মাথাটা সামনে ঘুরাতে লাগলো। নিজেকে স্থির করে অটোওয়ালাকে বললো,
– কাকা, পেছনে একটা ট্রাক আসছে। ওটাকে একটু যেতে দিন। আপনি একটু ডানে চাপুন। আগে ট্রাকটা চলে যাক।
– আইচ্ছা, খাড়াও দ্যাখতাছি।
সম্মতি জানালো অটোওয়ালা। হ্যাঁ সূচকে মাথা নাড়িয়ে বাঁদিকে জায়গা ছাড়লো সে। পেছনের ট্রাকটা সুযোগ পেয়ে সুন্দর মতো স্পিড বাড়িয়ে ছুটলো। বাঁ-পাশে যখন স্পিডের সাথে ট্রাকটা শাই-শাই করে এগুচ্ছিলো, তখন বাতাসের ঝাপটায় এলোমেলো চুলগুলো বড্ড বিব্রত করলো মেহনূরকে। মেহনূর ডানহাতে চুলগুলো ঠিক করতেই কি ভেবে বাঁয়ে তাকালো, তখনই সমস্ত শরীর কাঁটা দিয়ে উঠলো তার। শিরশির অনুভূতিটা আবার শিহরণ জাগিয়ে তুললো। দেহের প্রতিটি রন্ধ্রে-রন্ধ্রে ঠান্ডা হাওয়া বইতে লাগলো। চোখদুটো যেনো কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম! বড়-বড় চাহনিতে নিষ্পলক হলো মেহনূর। কোমল গোলাপী ঠোঁটদুটো অজান্তেই ফাঁক হতে লাগলো। শিরদাঁড়া বেয়ে ছুটে চললো অবাধ শীতল হাওয়া। বুক ফুলিয়ে অদম্য নিশ্বাসগুলো নিতেই বিবর্ণ হলো মুখ। ট্রাকটার পেছনে সুপরিচিত জীপটা দাপটের সাথে চলছে। স্টিয়ারিংয়ে শক্ত দুটো হাত দক্ষতার সাথে ঘুরছে। বুদ্ধিদীপ্ত চোখদুটো আজও ধারালো। চোখে কালো চশমা আঁটা। বাতাসের জন্য উড়ন্ত চুল কপাল ছুঁয়ে যাচ্ছে। সৌম্যভাবের সুদর্শন মুখটা ব্যক্তিত্বের সাথে ফুটে উঠেছে। অটোর স্পিডের সাথে সমানতালে চলার জন্য জীপটা যেনো হিংস্র। বাঁয়ে দৃষ্টি রেখে কাজল পূর্ণ চোখদুটো কেবল জীপের ব্যক্তিকে দেখছে। যাকে দেখলে মনের ভেতরটা টগবগ করে উঠে, উত্থাল-পাত্থাল ঝড়ের মতো অস্থির লাগে, অশান্ত অনুভূতিতে নিজেকে বেহায়ার মতো বোধহয়, সেই মুখটা এখন কাছাকাছি। যেনো হাত বাড়ালেই তাকে ছোঁয়া যাবে, ধরা যাবে, নাগাল পাওয়া সম্ভব। মনে-মনে প্রচণ্ড বিহ্বল হচ্ছে মেহনূর, ভেতরকার সুপ্ত অবস্থাটা উৎকন্ঠায় জীর্ণ। চলন্ত জীপের ব্যক্তিটা এবার ডানদিকে তাকালো, গম্ভীরতুল্য মুখটা মেহনূরের দিকে স্থির। স্টিয়ারিংয়ের হাতদুটো তখনো চলছে, বাতাসের শোঁ-শোঁ দমকা হাওয়া উচাটন হয়ে গেছে। কালো চশমার আড়ালে ব্যকুল চক্ষুদুটো মেহনূরের দিকে নিবদ্ধ। সে যে ড্রাইভে আছে, আপাতত সেদিকে হুঁশ-জ্ঞান ক্ষীণ। মেহনূর বাকশূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতেই নিচের ঠোঁটটা কামড়ালো। ওমন চাহনি দেখেই কিছুটা কুণ্ঠার সাথে চোখ নামাতে বাধ্য হলো। আঁচলের প্রান্তে অনবরত খুট পাঁকাতে থাকলো। অস্বস্তিকর অনুভূতিতে গুটিয়ে গেলো সে। আড়চোখে উপলব্ধি করলো, এখনো স্টিয়ারিং ধরে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কেনো তাকিয়ে আছে? সেদিনের কথা কি ভুলে গেছে? মাহদির মৃত্যু নিয়ে পরোক্ষ অপমান কি স্মরণে নেই? চলে আসার পর একদিনও খোঁজ নেয়নি। ভুল করেও ফোন দেয়নি, জিজ্ঞেস করেনি, ‘ মেহনূর, তুমি কেমন আছো? আমাকে একা ফেলে সুখে আছো? নিশ্চয়ই তুমি ভালো নেই? আমাকে কি মনে পড়ে না? ‘। কিচ্ছু বলেনি মাহতিম! না ফোন, না যোগাযোগ, না কল, না খোঁজ, কিচ্ছু নেয়নি সে। অটোতে যাত্রী ছিলো না। রিজার্ভ করা অটোর ভেতর একাকী মেহনূর দাঁত কিড়মিড় করছিলো। কোলের দিকে দৃষ্টি রেখে দু’পাটি দাঁত শক্ত করে ফেললো। যেটুকু মনোবল প্রাণপণে শিকড়ের মতো আঁটকে ছিলো, সেটুকু চেতনা কাঁচের মতো চুরচুরে হয়ে গুড়িয়ে গেলো। ছিটকে আসা কান্নায় কেঁদে ফেললো মেহনূর। দিনের-পর-দিন, মাসের-পর-মাস, বছরের-পর-বছর যেই জেদটুকু মনের কুঠিরে অর্পণ করেছিলো, সেটুকু জেদ অভিমান হয়ে দুচোখ বেয়ে পরলো। কোলের উপর হাতের চামড়ায় টপটপ করে ঝরলো। পরাস্ত সৈন্যের মতো সবটুকু শঠতা ভেঙে গেলো। ঠোঁট কামড়ে অবাধ আকণ্ঠ কান্নাটা নিজের মধ্যেই গুটাতে চাইলো। যেনো একটুখানি শব্দ বাইরে না যাক, কারো কানে না-পৌঁছাক। ব্যক্তিগত আঘাত, পুরোনো ক্ষতটা একান্তই নিজের কাছে থাকুক। দলা পাকিয়ে, গুটি পাকিয়ে চেপে নিজের মধ্যেই থাকুক। মেহনূর শুধু বুঝতে পারলো তার কোলের আঁচলটুকু ভিজে যাচ্ছে। কোনো অজানা ব্যথায় যন্ত্রণা হচ্ছে। অদ্ভুত জ্বালায় তার অব্যক্ত ক্ষুদ্র মনটা কষ্ট পাচ্ছে। মেহনূর কতক্ষণ ওভাবে ছিলো জানা নেই। যখন একটু শান ্ত হলো, চোখদুটো আঁচলে মুছলো, নিজেকে একটু ধাতস্থ করলো, তখন আবার বাঁয়ে তাকালো সে। ভেজা-ভেজা চোখ দিয়ে তাকাতেই বুকটা ধ্বক করে উঠলো! জীপটা আর পাশে নেই! কোথায় গেলো? মেহনূর পাগলের মতো ডানে-বামে তাকালো, পিছনে কিছুদূর দৃষ্টি বুলালো। কিন্তু না, গাড়িটা নেই! বাঁহাতে টলমলে চোখটা মুছতে ঠিকই, কিন্তু অশ্রুধারা বন্ধ হয়নি। মেহনূর বুঝতেও পারলো না, তাকে কাঁদতে দেখে স্টিয়ারিংয়ের হাতদুটো কবেই থমকে গেছে। সেই জীপ আর সামনে এগোয়নি।
.
বাড়ি ফিরতেই সবার আগে কলপাড়ে ঢুকলো মেহনূর। চাপকলে পানি চেপে মুখ-হাত ধুলো। উঠোনের তারে নেড়ে দেওয়া গামছা দিয়ে ডলে-ডলে মুখ মুছলো। কান্নার শেষ পানিটুকু লুকানোর অব্যর্থ চেষ্টা। বুকভর্তি তাজা নিশ্বাস টেনে বাড়ির দিকে এগুলো। চৌকাঠ পেরিয়ে ভেতরে ঢুকতেই মুখোমুখি হলো সুজলার। আঙিনায় বসে চোখে চশমা এঁটে হিসাব দেখছেন তিনি। মেহনূরের হঠাৎ আগমন দেখে কপালে ভাঁজ ফেলে তাকালেন। হিসাবের খাতাটা চৌকিতে রেখে প্রশ্ন করে বললেন,
– তুই? তোদের না চারটার দিকে অনুষ্ঠান শেষ? এখন কয়টা বাজে?
প্রশ্নটা ছুঁড়েই চশমার চোখদুটো দেয়ালে নিক্ষেপ করলেন। টিকটিক করে চলমান ঘড়িতে দুপুর দুটো বাজে। সময়ের নিকেশটা দেখে নিয়ে ফের প্রশ্ন ছুঁড়লেন,
– এ্যাই মেহনূর? কোনো ভণিতা না করে সোজাসুজি উত্তর দিবি। তুই ওদের ফেলে এখানে কেনো? কোনো গন্ডগোল হয়েছে? নাকি ওখানে কোনো সমস্যা? কি কারণে একা এলি?
সুজলার বাঁজখাই কন্ঠে রান্নাঘর থেকে ছুটে শেফালী এলো। দ্রুতপায়ে এগিয়ে আসতেই ‘ কি হইলো ভাবী? কার লগে কথা কন? ‘ বলেই চট করে থামলো। দুই চোখে প্রশ্ন ফুটিয়ে তাজ্জব গলায় বললো,
– ওই ছেড়ি? তুই এনে ক্যা? সাবা, সুরাইয়া কই?
দু’দফা প্রশ্নের মুখে ঢোক গিললো মেহনূর। কি উত্তর দিবে? কি বললে ঠিক হবে? সুজলা এখনো চড়া দৃষ্টিতে মেহনূরের দিকে তাকিয়ে আছে। এবার যেনো সুজলা কিছু একটা বুঝলো। আনমনে কিছু একটা আঁচ করতে পারলো। চশমার দুই ডাঁট ধরে চোখ থেকে চশমা খুলে ফেললেন। ডাঁটদুটো বন্ধ করতে-করতে বসা থেকে উঠলেন, নির্যুত্তর মেহনূরের দিকে ধীরপায়ে এগিয়ে মেহনূরকে আস্তে করে শুধালেন,
– তুই কি কেঁদেছিস?
চমক ভাঙ্গার মতো চোখ তুললো মেহনূর। বড়মার দিকে ভীতু চোখে তাকালো সে। বড়মা কিভাবে টের পেলো? চোখ কি এখনো ফোলা? ভীষণ ফুলে আছে? কান্নার কোনো ছাপ চেহারায় লেগে আছে? বড়মার চশমাহীন চাহনি দেখে অপ্রস্তুত হলো মেহনূর। কোনো যোগ্য জবাব খুঁজে না পেয়ে আমতা-আমতা করে বললো,
– বাইরে প্রচুর গরম বড়মা। এর মধ্যে অনুষ্ঠানের যেই হাউকাউ, আমি একদম সহ্য করতে পারিনি। একটুও ভালো লাগেনি। আমি বুবুদের রেখে একাই চলে এসেছি। ওখানে কিছু হয়নি বড়মা। আমি একটু ঘরে যাই? শাড়ি পালটাবো। খুব গরম লাগছে।
তড়িঘড়ি করে উত্তর ছুঁড়ে দোতলার দিকে ছুটলো। সিঁড়িতে ধপধপ পা ফেলে তাড়াতাড়ি উঠলো মেহনূর। আঙিনায় দাঁড়িয়ে থাকা নিরব সুজলা দোতলার দিকে তাকিয়ে থাকলে পাশ থেকে শেফালি বললো,
– ঠাডা মিছা কথা ভাবী। ওয় কান্দিছে। ওর চোখ লাল, কাজল লেপ্টি গেছে। কি নিয়া কান্দিলো ভাবী? সক্কাল-সক্কাল ভালা মাইয়াডা গেলো। আর অহন কান্দিয়া বাড়িত আসিলো?
দোতলা থেকে মুখ সরালেন সুজলা। শেফালির দিকে দৃষ্টি রেখে শান্তমুখে বললেন,
– ও কিসের জন্য কাঁদে জানো না? ভালো মানুষ যেহেতু কাঁদতে-কাঁদতে ঢুকেছে, তাহলে নিশ্চয়ই স্বাভাবিক কিছু হয়নি। চুলায় আধপোয়া পোলাও চাল চড়াও। টুনির মাকে বলো লাল মুরগীটা জবাই করে কুটতে। আমি একসের দুধ দুইয়ে আনি।
কথাগুলো বলার সময় তাড়া দেখালেন তিনি। সেকেন্ডের ভেতর কি হলো বুঝতে পারেনি শেফালি। হঠাৎ এতো তড়িঘড়ি কিসের? কিসের জন্য আয়োজন? একরাশ প্রশ্ন নিয়ে খচখচ করছে সে। সুজলা যখন তাড়াহুড়ো ভঙ্গিতে ঘড়ি দেখতে ব্যস্ত, তখন পেছন থেকে উজবুক গলায় শেফালী প্রশ্ন করলো,
– ও ভাবী? চাল চড়ামু ক্যা? বাড়িত কি কুটুম আসিবো?
শেফালির প্রশ্ন শুনে মুখ ঘুরালেন সুজলা। একপ্রস্থ হাসি দিয়ে দোতলার দিকে মুখ ফেরালেন। শূন্য বারান্দার দিকে একপলক দৃষ্টি দিয়ে নির্যুত্তর মুখে কাজে গেলেন। কিছু জিনিস পরিস্থিতির উপর ছেড়ে দিলেন তিনি। শেফালি যেনো নিজ থেকেই বুঝুক! বুঝে-শুনে কাজটা করুক। শেফালি অবুঝ ব্যক্তির মতো একবার সুজলার যাওয়া দেখলো, আরেকবার চোখ ঘুরিয়ে দোতলার দিকে তাকালো। মেহনূরের রুমটা দরজাবদ্ধ। সেই বদ্ধ দরজার পানে দৃষ্টি দিতেই নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। মুরগি জবর করার হেতু খুঁজে পাচ্ছে না শেফালি। বাড়িতে মেহমান বা আত্মীয় না এলে রান্নার ধুম উঠে না। দুধ দুয়ানোর কর্ম অবেলায় খাটে না। তাছাড়া, ভাবী দোতলায় তাকালো কেন? চিন্তার সূত্রটা বাড়াতে-বাড়াতে থমকে গেলো শেফালি! অকস্মাৎ দোতলার দিকে তাকালো! বিস্ময় দৃষ্টিতে তাকাতেই বিড়বিড় করে বললো, ‘ ও আল্লাহ্! কতো কাম বাকি! তাত্তাড়ি করোন লাগবো। ও টুনির মা? কোনহানে আছো? ‘
.
ভারী বাতাস। আকাশের অবস্থা করুণ। প্রকৃতির চেহারা এক লহমায় বদলে গেছে। মধ্যগগণের সূর্যটা মেঘের আড়ালে গ্রাস হয়েছে। চিলতে ফোঁটা আলো নেই। সূর্যের দেখা নেই। চর্তুদিকে অন্ধকার। আকাশটা কালো মেঘে সওয়ার। বাতাসের চোটপাট তীব্র। গাছের ডালপালাগুলো ভীষণভাবে নড়ছে। একটা ভূতুড়ে শব্দ প্রকৃতির বাজে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে যাচ্ছে। মেঘে-মেঘে স্ফুলিঙ্গ হয়ে গর্জন সুরে ডাকছে। গুড়ুম-গুড়ুম আওয়াজে প্রকৃতির অবস্থা চন্ঞ্চল। মেদিনীর বুকের ঠান্ডা হাওয়ার ঢল নেমেছে। এইতো বুঝি বৃষ্টি নামার সংকেত বেজেছে। বাতাসটা শীতল, কেমন যেনো ভিজভিজে। গায়ে লাগলে পশম দাঁড়িয়ে যায়। শীত-শীত অনুভূতি হয়। জানালার কপাটদুটো ঠাস-ঠাস করে শব্দ করছে। চোখে-মুখে ঠান্ডা বাতাস লেগে চোখ খুললো মেহনূর। কানে শুনতে পেলো জানালার শব্দধ্বনি। তন্দ্রার রেশটা কাটিয়ে উঠতেই তাড়াতাড়ি শোয়া থেকে উঠলো। ঝিরিঝিরি বৃষ্টিটা জানালা দিয়ে ঢুকছে। দুহাত বাড়িয়ে কাঠের কপাটদুটো আঁটকে দিলো সে। সবটুকু আলো জানালার জন্য হারিয়ে গেলো। রুমটা এখন অন্ধকার। দরজাটাও বুঝি বন্ধ। ঘুম-ঘুম চোখদুটো তখনও নিভু-নিভু করছে। আরেকটু ঘুমানোর জন্য উষ্ণতাটুকু খুঁজছে। ছোট্ট একটা হাই তুলে ভালো করে তাকালো। বিছানা থেকে নেমেই সুইচ টিপে দিলো। ফ্যানের দিকে তাকাতেই বুঝলো কারেন্ট নেই। রেডিয়াম ডায়ালের ঘড়িতে বিকেল পাঁচটা বাজছে। টেবিলের ড্রয়ার টেনে মোমবাতি জ্বালালো মেহনূর। সেটা টেবিলের উপর রাখতেই নিজের দিকে দৃষ্টি গেলো। শাড়িটা এখনো খুলেনি সে। ক্লান্ত হয়ে ফিরার পর ওভাবেই ঘুমিয়ে পরেছে। নিজের বেশভূষা পালটে সালোয়ার-কামিজ পরলো। সেই ভূষণেই দরজা খুলে বাইরে পা দিলো। বারান্দা পেরিয়ে যেতেই সাবার রুম থেকে পড়ার শব্দ, এরপর সুরাইয়ার রুম থেকে বেসুরো গানের আবৃত্তি শুনতে পেলো। পরপর দুটো রুম নিঃশব্দে পেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামলো। নিচে সবসময়ের মতো কাউকে না দেখে স্বস্তি পেলো মেহনূর। তারমানে, ওই ব্যক্তি বাড়ি আসেনি। একবুক নিশ্বাস ছেড়ে চায়ের জন্য রান্নাঘরে গেলো। একটা হারিকেন ধরিয়ে চায়ের পানি বসালো। তাক থেকে চাপাতা কৌটা খুঁজতেই হঠাৎ হারিকেনের আলোটা তিরতির করে কমতে লাগলো। দুহাত উঁচিয়ে কৌটা পাড়তেই থেমে গেলো মেহনূর। ব্যাপারটা লক্ষ্য করতেই কপাল কুঁচকে অবাক হলো। কি ব্যাপার? হারিকেনের তেল ফুরালো নাকি? আলো কমে যাচ্ছে কেন? কৌটা পাড়া বাদ দিয়ে হাত নামালো মেহনূর, সম্পূর্ণ পিছু ঘুরে তাকাতেই শিউরে যেন নিশ্বাস আঁটকে এলো! দমবন্ধ করা অবস্থার মতো বিস্মিত হলো মেহনূর! চুলার কাছে দাঁড়িয়ে আছে মাহতিম। দু’আঙ্গুলে ধরে আছে হারিকেনের স্ক্রুটা। আরেক প্যাঁচ ঘুরালেই পলতেটা নিভে যাবে। রান্নাঘরটা অন্ধকারে ডুবতে দেরি নেই। কেনো ভয় পাচ্ছে? এতোদিনের শক্ত মূর্তিটা কোথায় গেলো? কেনো এই মানুষটা সামনে আসলে বুক শুকিয়ে যায়? প্রচণ্ড অস্থির লাগে। মাথা ঝিমঝিম করে। কানদুটো আগুনের মতো উত্তপ্ত হয় কেন? হারিকেনের স্ক্রু ধরে গম্ভীর মুখটা কাট-কাট গলায় বললো,
– আমাকে দেখে পালাচ্ছো কেন?
গভীর করে ঢোক গিললো মেহনূর। ভয়টুকু ভেতরে পুড়ে ঠেলেঠুলে বললো,
– আমি পালাইনি।
উত্তরটা ছোঁড়ার পর পিনপতন নিরবতা। ফুটন্ত পানির টগবগ আওয়াজ ছাড়া দ্বিতীয় শব্দ নেই। ক্ষুরধার দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মাহতিম। ওই চোখ, ওই চাহনি, ওই দৃষ্টির মাঝে অদ্ভুত কিছু লুকিয়ে আছে। মেহনূর ওই নয়নজোড়ায় চক্ষু স্থির রেখে হালকা গলায় বললো। কিছুটা নরম, কিছুটা ক্ষুণ্ণ হয়ে শুধালো,
– কেনো এলেন? আজ এতোদিন পর কেনো? এই এতিমের মুখ দেখতে কেনো এলেন? আমিতো কোনোদিন আপনার দয়া ভিক্ষা চাইনি। বলিনি আমার খোঁজ করুন। ভুলেই তো গিয়েছিলেন। তবে আজ স্মরণ কেনো? আজীবন ভুলেই থাকতেন। কারো তো ক্ষতি হতো না।
চলমান .
#FABIYAH_MOMO .
মন বাড়িয়ে ছুঁই গল্পের লিংক kobitor (all part)
#নোটবার্তা : প্রায় রাইটিং ব্লকে চলে যাচ্ছিলাম। মন মেজাজ বড্ড খারাপ ছিলো। গোছানো জিনিসটা এলোমেলো লাগলে আমি দুঃখিত। দফায়-দফায় আমার অভ্যন্তরীণ অসুস্থতা নাজুক করে ছেড়েছে। কার্ডিয়াক অসুস্থতায় ভুগছিলাম। এখন তুলনামূলক সুস্থ।