ফাবিয়াহ্_মমো .
দম ফুরিয়ে আসছে। বুকে প্রচণ্ড চাপ লাগছে। চোখের দৃষ্টিও ঘোলা-ঘোলা। কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না। শরীরের অঙ্গ-প্রতঙ্গ যেন ব্যথায় মশগুল। মেহনূর যাওয়ার পর স্বস্তি পাচ্ছে না। অব্যক্ত যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে মাহমুদা। চিৎকার করে কাউকে ডাকার অবস্থা শূন্য। সমস্ত শরীর ব্যথা, গলা রুক্ষ, কণ্ঠনালী শুষ্ক। ক্যান্সারের জীবানু দেহের সর্বত্র যেন ছড়িয়ে গেছে। এখন আগের মতো স্বাভাবিক নেই। টপটপ করে চোখের কোণ বেয়ে পানি ঝরছে। ঘনিয়ে আসছে সময়। নাস্তার ট্রে নিয়ে দরজা ঠেললো সাবা। হাসিমুখে ভেতরে ঢুকতেই থমকে গেলো সে। বিছানার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। হাতের ট্রেটা প্রচুর ঠকঠক করে কাঁপছে। এক চিৎকার দিয়ে সবাইকে ডাকতে নিলো, চিৎকারের জন্য মুখও খুললো, কিন্তু অবস্থা দেখে থেমে গেলো সাবা। দ্রুত ট্রেটা নিয়ে টেবিলে রাখলো সে। বিছানায় বসে ত্রস্তভঙ্গিতে মাথায় হাত ছুঁয়ে বললো,
– ছোটমা, ছোটমা খুব লাগছে? হঠাৎ কি হলো? ছোটমা চোখ খুলুন। বন্ধ করবেন না। আমি.. আমি এক্ষুণি আম্মাকে ডেকে আনছি। ছোটমা শুনতে পাচ্ছেন তো? ও ছোটমা দয়াকরে —
অবস্থা বেগতিক! সাবা কথা শেষ করলো না। যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব দ্রুতবেগে ঘর থেকে বেরুলো। এবার সত্যি-সত্যিই চিৎকার দিয়ে সবাইকে ডাকলো। অস্থির কন্ঠে গলার স্বর উঁচিয়ে সুজলাকে ডাকলো,
– আম্মা, তাড়াতাড়ি বের হও। ঘর থেকে বের হও!
সাবার উচ্চকন্ঠ শুনে সুজলা ভারী চমকে গেলেন। এমন করে তো সাবা কখনো ডাকে না। কোনোদিন গলা উঁচাতে দেখেনি। বিপদের আশঙ্কা বুঝে তাড়াতাড়ি চোখ থেকে রিডিং-গ্লাসটা খুললেন। দ্রুত মাথায় ঘোমটা টেনে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। ভ্রুঁ কুঁচকে সাবার দিকে তাকাতেই অশনি ভয়ে শুধালেন,
– কিছু হয়েছে? ওমন করে গলা ফাটাচ্ছিস কেন?
সাবা অস্থির ভঙ্গিতে মায়ের দিকে তাকালো। ওর কপাল-মুখ ঘেমে একাকার। দু’দফা শঙ্কার ছাপ চোখের মনিতে স্পষ্ট। রান্নাঘর থেকে ছুটে এলো শেফালি। হাতদুটোতে মাছ কুটার এঁটো। সাবাকে অদ্ভুতভাবে কাঁদতে দেখে ব্যস্তভাবে জিজ্ঞেস করলো,
– ওই ছেড়ি চিল্লাস ক্যা? ভালা কইরা আসল কথা ক। কপালের ঘাম মুছি নে।
সাবা দ্রুত ঢোক গিললো। কপালটা ব্যতিব্যস্ত কায়দায় মুছতেই মাহতিম চলে এলো। সিঁড়ি দিয়ে দ্রুতবেগে নামতেই কৌতুহল চোখে তাকালো। সাবা ডানহাতের উলটোপিঠে চোখ ডলতেই ভীতকণ্ঠে বললো,
– ছোটমার অবস্থা ভালো না। শ্বাসকষ্ট..শ্বাসকষ্ট উঠেছে। হাত-পা দাপাচ্ছে। আমি খাবার দিতে গিয়ে —
কথাটা শেষ করতে পারলো না। পুরো কথা শেষ না করতেই মাহতিম ঝড়ের বেগে দৌঁড় দিয়েছে। ধাম্ করে দরজা খুলে ঘরের ভেতর ঢুকেছে। শেফালিও কোনোকিছু পরোয়া করলো না। মাছের এঁটো হাতেই ‘ হায় আল্লাহ্ ‘ বলে চিৎকার মেরে উঠলো। সাবার কথাগুলো কর্ণগোচর হতেই সুজলা বিস্ফোরণ চাহনিতে থম মেরে গেলেন। ডানহাতের মুঠো থেকে রিডিংগ্লাসটা থপ্ করে পরে গেলো। চর্তুদিকের সবকিছু বানোয়াট, মিথ্যা, ভেলকিবাজি মনে হলো। সত্য-মিথ্যার দোলাচলে তিনি যেন বোধশক্তি হারিয়ে ফেলছেন। যেই সংসারটা তিন বউ মিলে গড়লেন, তিন নারীর হাতে ঠুনকো সংসারের আনন্দলীলা ফুটলো, ত্রয়ীর পরিচালনায় সমস্ত দুঃখ-কষ্ট লাঘব হলো, আজ সেই ত্রয়ীতে বিচ্ছেদের গ্রাস হানলো। সুজলা ধীরে-ধীরে পা ফেলে কাঙ্ক্ষিত ঘরে গেলেন। কানে হৈচৈ-শোরগোলের মাতম চলছে। দরজার সীমানা ডিঙিয়ে প্রবেশ করলেন ঘরে। চোখ ফেললেন বিছানার দিকে। শেফালি সেখানে বিছানায় মুখ গুঁজে মেঝেতে বসে আছে। সাবার কোলে মাহমুদার রুগ্ন মাথা। মাহতিমের দু’হাতে রুগ্ন দুখানা হাত। সুজলা পা টিপে-টিপে খুব কাছে আসলেন। মাহতিম কিছুটা সরে বসতেই সুজলা শান্তভাবে বসলেন। মাহমুদা ফ্যাকাশে চোখে তাকিয়ে আছে। আদৌ স্পষ্টভাবে দেখছে কিনা কে জানে। সুজলা হাত বাড়িয়ে মাহমুদার চিবুক ছুঁয়ে বললেন,
– ডাক্তার এসে যাবে ছোটবউ। কোনো চিন্তা কোরো না। নাতী-নাতনীর ঘরটা দেখে যেতে হবে না? এভাবে চলে গেলে চলবে? এতোদিন ধৈর্য্য ধরেছো, আর কটা দিন সবুর করো। তোমার মেয়েকে আমার কাধে কেন ঝুলাচ্ছো? ঝুলিয়ে যেও না। আমি কি এতো শক্ত আছি? দেখোনা বয়স বেড়ে গেছে? আজ ছুঁড়ি থেকে বুড়ি হয়ে গেছি। তুমিও যদি আমার কাধে দায়িত্বের বোঝা চাপাও, আমি একা-একা আর কতো দেখবো?
মায়ের কথা শুনে সাবা ঠোঁট কামড়ে কেঁদে ফেললো। শেফালি এখনো বিছানা থেকে মুখ গুঁজে আছে। ঘোমটা দেওয়া মাথাটা দমকে-দমকে কাঁপছে। হাতদুটো মেঝেতে ফেলে রেখেছে। মাছের আঁশটে গন্ধ নাকে লাগছে। খোলা জানালা দিয়ে হুরহুর করে এক পশলা বাতাস এলো। দূরের কোনো পুষ্পকুন্ঞ্জ থেকে মিষ্টিমধুর গন্ধ টেনে আনলো। মৃত্যুপুরীর চারিদিকে অবলীলায় ছড়ালো। মাহতিম শান্ত হয়ে আছে। হাতের মুঠোয় মাহমুদার কঙ্কালসার হাতদুটো স্নেহার্দ্রে বুলাচ্ছে। বিয়ের পর থেকে আজ অবধি শ্বাশুড়িকে রাগতে দেখেনি। মনেও পরে না কোনোদিন উচ্চস্বর শুনেছে। এতো আস্তে-আস্তে কথা বলতো যে, কোনো পাষাণও যদি তার কথা শুনতো, তবে পাষণ্ডের মনটাও বুঝি মোমের মতো গলে যেতো। চরিত্রের বিচারে কোনোদিন ঝগড়া করতে দেখেনি। রুক্ষ মেজাজে থাকেনি। কারোর প্রতি আক্ষেপ করেনি। এক টুকরো পবিত্র হাসি সবসময় ঠোঁটে থাকতো। যতবার মাহতিম কাছে আসতো, কথা বলতে এগিয়ে যেতো, মাহমুদা মিষ্টি হাসিতে কপালে-মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া করতো। যেদিন শুনতে পেলো মাহমুদা ভয়ানক অসুখে আক্রান্ত, সেদিনই চোখের পাতা ভারাক্রান্ত হয়ে বুজে এলো। এমন নরম মনের মানুষটার এই পরিণতি হবে, মাহতিম যেন মানতেই পারেনি। অনেকভাবে চেষ্টা করেছে মানুষটার আরোগ্য লাভের জন্য। নানাভাবে যোগাযোগ রক্ষা করে বিদেশি ডাক্তারদের খোঁজ নিয়েছে। কিন্তু, সবার মুখে সেই একটাই কথা, রোগী মিরাকেল ছাড়া বাঁচবে না। তবুও তো হার মানেনি। টাকা থেকে শুরু করে যা প্রয়োজন, সবই সাধ্যমতো দিয়েছে। আজ সবকিছুর পরিপন্থীতে এরকম অবস্থা দাঁড়াবে কে জানতো? মাহতিম নিরব চাহনিতে তাকালো। হাসি দিয়ে বললো,
– আপনি আমাকে ঠকিয়ে দিলেন। আমার সৌভাগ্যের খাতায় জামাই আদরটা জুটলো না। আপনার হাতে জামাই আদরটা দিলেন না মা। এ বাড়িতে তিনবার আসার সুযোগ হলো। প্রথমবার এসেছিলাম আপনার বাড়ির অতিথি হয়ে। দ্বিতীয়বার আসলাম জামাই হিসেবে। কিন্তু, এইবার যে আপনি ধোঁকা দিবেন, বুঝতে পারিনি। যদি জানতাম আপনার মনে-মনে এমন গুবলেট চলছে, তাহলে কাজ ফাঁকি দিয়ে চলেই আসতাম। কোনোভাবেই পাঁয়তারা করতে দিতাম না। এতোদিন বাইরের মানুষকে ট্যাকেল দিলাম। এখন ভেতরের মানুষই ধোঁকা দিয়ে বসলো।
মাহতিম দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চোখ নিচু করলো। পাশ থেকে সুজলা মৌন হয়ে আছেন। খোলা জানালার দিকে লালচক্ষুতে তাকিয়ে আছেন। এতোক্ষন যেটা টের পাননি, সেটা অনুমান করা মাত্র শান্ত গলায় বললেন,
– মেজোবউ,
সাড়া দিলো না শেফালি। বিছানায় এখনো মুখ ডুবিয়ে আছে। সাবা ভেজা চোখে নাক টেনে শেফালির দিকে তাকালো। আর্দ্র গলায় ডাকলো,
– মেজোমা? আম্মা ডাকে।
কোনো হেলদোল নেই শেফালির। যেমন ছিলো, তেমনই রইলো। সুজলা আবার গলা বাড়িয়ে বললো,
– কলপাড় থেকে হাত ধুয়ে এসো। মাছের এঁটো হাতে বসে থেকো না।
বেশ জোর দিয়ে বললেন সুজলা। সম্ভবত সেই প্রেক্ষিতে শেফালির হুঁশ ফিরে এলো। বিছানা থেকে মুখ তুলে দ্রুত বসা থেকে উঠলো। দরজার বাইরে যেতেই হঠাৎ মাথা ফিরিয়ে বললো,
– মেহনূর কই?
উত্তরের জন্য পিছু তাকালো মাহতিম। চোখ-মুখ ফোলা শেফালির দিকে শান্তভাবে বললো,
– বাড়িতে নেই। সুরাইয়ার সাথে কলেজে গিয়েছে। প্র্যাকটিক্যাল খাতা সাইনের জন্য ডেট ছিলো। সাইন করিয়ে এসে পরবে।
সবাই জানতো সময়টা চূড়ান্ত। যেকোনো মূহুর্তে কিছু একটা ঘটবে। এরপর সব ঠান্ডা-শূন্য-বিলীন। মাহতিম নিজেকে স্থির রেখে প্রতি মূহুর্তের জন্য সজাগ থাকলো। ডাক্তার এসে মাহমুদার পালস্ দেখে নিলো। চোখদুটোর অবস্থা অনেকক্ষণ ধরে পর্যবেক্ষণ করলো। এরপর শূন্যমুখে ঘর থেকে বেরিয়ে শেষ উত্তরটা জানিয়ে দিলো। নির্বাক রইলো সবাই। মুখে কোনো সাড়া নেই। সাবা ওজু করতে কলপাড়ে গেলো, শেফালি গেলো গোসল করতে, সুজলা গেলেন সুরাইয়াকে ফোন দিতে। পুরো ঘরের মধ্যে শুধু মাহতিম রইলো। মাহমুদার কাছে বসতেই বহুকষ্টে ঠোঁট নাড়ালো মাহমুদা। ক্ষীণ স্বরে বললো,
– বাবা…
মাহতিম চটপট ভঙ্গিতে এগিয়ে গেলো। ডানহাতটা খুব জোর দিয়ে দুহাতের মধ্যে নিলো। ফিসফিস কন্ঠটা স্পষ্ট শোনার জন্য মাথা ঝুঁকিয়ে বললো,
– আমি শুনতে পাচ্ছি মা।
চোখ বন্ধ করলো মাহমুদা। মুখ দিয়ে লম্বা নিশ্বাস ছাড়তেই রুগ্ন সুরে বললো,
– তোমাকে বিশ্বাস করি মাহতিম। জীবনে তুমি অনেক বড় হও। তোমার ঘরে যেন সব সুখ আসুক। মারজা ভাবীকে দেখে রাখিও। আমাকে মাফ করে দিও বাবা। তোমাকে ঠকাইনি। আমি রোগী মানুষ, আমিই আগাছার মতো অন্যের উপর চলি। তোমাকে আপ্যয়ন করতে পারলাম না।
মাহতিম মাথা নিচু করে ফেললো। নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরলো। মাহমুদার দিকে তাকানোর ক্ষমতা তার নেই। দুহাতের মুঠোয় থাকা হাতটা চোখের কাছে তুললো। মাহতিম বন্ধ চোখে ধাতস্থ হয়ে বললো,
– যেদিন আপনার অসুখের রিপোর্ট পড়লাম, আমি স্বাভাবিক থাকতে পারিনি। কি করলে আপনি সুস্থ হবেন শুধু সেটাই চিন্তা করেছি। আপনার মেডিকেল রিপোর্টের কপি পড়ার পর শুধু মেহনূরের মুখটা ভেসেছে। আমি চাইলে আপনার মেয়েকে এখান থেকে ফিরিয়ে নিতে পারতাম। কিন্তু আপনার জন্য আগাইনি। মেহনূর আপনার আশেপাশে থাকলে আমার চিন্তা কম হতো। অন্তত মনে-মনে এটুকু স্বস্তি থাকতো, আপনার মেয়ে নিজের সর্বোচ্চটা দিয়ে আপনার দেখাশোনা করছে। আপনার মতো মানুষকে আমি হারাতে চাই না।
মাহমুদা পাণ্ডুর মুখে হাসলো। জলপূর্ণ চোখে হাসি এঁটে তাকালো। একটা অদ্ভুত শান্তির ছায়া সারা মুখে ছড়িয়ে আছে। চেহারায় যেনো অব্যক্ত জৌলুসের দীপ্তি। মাহতিম তাকিয়ে থাকতে-থাকতে ভাষা হারিয়ে ফেললো। রোগাক্রান্ত শেষযাত্রার মানুষটার মুখে অদ্ভুত তৃপ্তি। মাহমুদা বেশ তাগদের সাথে মাহতিমের হাতে চাপ দিলো। ছোট্ট স্বরে বললো,
– গর্ভে মেয়ে ধরেছিলাম। সেই মেয়েকে দিয়ে ছেলে পেয়েছি। ভালো থেকো বাবা। তোমাকে সবসময় বিশ্বাস করি।
প্রদীপের শেষ তেলটুকু যেন নিঃশেষ হয়ে এলো। খুবই ধীরগতিতে চোখের পল্লব নামালো। শরীরের সমস্ত বন্ধন আস্তে-আস্তে আলগা করলো। মাহতিম মূঢ়ভঙ্গিতে ওই মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। তার চোখের পাতা একমূহুর্ত্তের জন্যও নড়লো না। দুহাতের ভেতর যে জীর্ণ হাতটা একটু আগে চাপ দিয়েছিলো, সেটা সন্তর্পণে চাপহীন হচ্ছে। খসখসে ঠোঁটদুটো নিঃশব্দে কিছু আওড়ালো, শেষবাক্য উচ্চারণ হতেই থেমে গেলো নড়াচড়া। আজীবনের জন্য সবকিছু থেমে গেলো।
.
দুপুরের শেষ ভাগ। উদীয়মান সূর্যটা মধ্যগগণ ছেড়েছে। কিছুটা পশ্চিমাকাশে হেলে গিয়েছে। কড়া রোদের তাপটা কম এখন। সুরাইয়া ও মেহনূর কলেজ থেকে ফিরলো। রসায়ন দ্বিতীয় পত্র খাতাটা সাইন করাতে বেশ জক্কি পোহাতে হয়েছে। ম্যাডামকে খুঁজে-খুঁজে ক্লাস শেষ হবার জন্য অপেক্ষা করেছে। ওরা ক্লাসের বাইরে যখন সাইনের জন্য অপেক্ষা করছিলো, তখন সুরাইয়ার বাটন ফোনে কল এসেছিলো। সুরাইয়া অবশ্য স্বাভাবিকভাবে কলটা ধরলেও সুজলার কন্ঠে তেমন কিছুই বুঝতে পারেনি। নেটওয়ার্কের ঘ্যাড়ঘ্যাড় শব্দের জন্য সব অস্পষ্ট বলা চলে। কেবল ‘ তাড়াতাড়ি আয় ‘ কথাটা শুনতে পেয়েছিলো। সেটা নিয়ে তত চিন্তা হয়নি ওর। বাড়িতে ফেরার পর দুজন অবাক হলো। সুরাইয়া ভাড়া চুকিয়ে মেহনূরের দিকে তাকালো, আরেকবার তাকালো মানুষভর্তি বাড়ির দিকে। মেহনূরও সন্দিগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে। সুরাইয়া খুচরা টাকাটা ব্যাগে পুরতেই তাজ্জব গলায় বললো,
– কেমন-কেমন যেন লাগছে না? ফাঁকা বাড়িতে এতো মানুষ কেন? কিরে মেহনূর, কিছু কি জানোস?
মেহনূর বাড়ির দিকে দৃষ্টি রেখে ‘ না ‘ সূচকে মাথা দোলালো। স্পষ্ট করে জানালো সে কিছুই জানে না। অসংখ্য প্রশ্নের ঝুলি নিয়ে বাড়িমুখো হলো। মেহনূর হাতের প্র্যাকটিক্যাল খাতাগুলো সুরাইয়ার হাতে দিলো। মুখে বললো,
– খাতাগুলো ধরো বুবু।
সুরাইয়া চকিতে মেহনূরের দিকে তাকালো। ওর কন্ঠ মলিন কেন? কি হলো এখন? খাতাগুলো নিতেই মেহনূর যন্ত্র-মানবের মতো আঙিনায় এলো। চোখের সামনে ফুপিয়ে-ফুপিয়ে শেফালি কাঁদছে। মেহনূর নির্বোধের মতো তাকিয়ে থাকতেই আশেপাশের মানুষজন দুপাশে চেপে মাঝ বরাবর রাস্তা দিলো। মেহনূর ডানে-বামে মানুষের উপস্থিতি দেখতেই পা চালিয়ে এগুলো। শেফালির অবস্থা দেখে আসল রহস্য তিরোধান করতেই বুকটা কামড়ে এলো মেহনূরের। বৈদ্যুতিক শক লাগার মতো কয়েক পা পিছিয়ে গেল মেহনূর। পেছন থেকে দ্রুত ধরে ফেললো সুরাইয়া। সেও বড়-বড় চক্ষুতে মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে। শেফালি মেঝেতে বসে কপাশ চাপড়াচ্ছে। সুরাইয়া খুব শক্ত করে মেহনূরের বাহুদুটো ধরলো। ঢোক গিলে পেছন থেকেই বললো,
– চ-চ-চল মেহনূর।
সুরাইয়া ঠোঁট ভিজিয়ে মেহনূরের হাত ধরলো। সরু কবজিটা পাঁচ আঙ্গুল ধরতেই কাঙ্ক্ষিত রুমটার দিকে চললো। সেখানে আরো ভীড়। প্রচুর মানুষে গিজগিজ। সুরাইয়া ভেতরে ঢুকতেই দাঁড়িয়ে পরলো। পেছন-পেছন টেনে আনা মেহনূরের হাতটা ছেড়ে দিলো। সুরাইয়ার পেছন থেকে বেরিয়ে এলো মেহনূর। বিছানার দিকে তাকাতেই জমাটবদ্ধ অশ্রুটা গাল বেয়ে ঝরলো। সটান হয়ে শুয়ে থাকা দেহটা চাদরে ঢাকা। মুখটাও চাদর টেনে ঢেকে দিয়েছে। পাশেই সুজলার শক্তমূর্তি ভেঙেচুড়ে ধ্বংস। অবুঝ শিশুর মতো হাউমাউ করে কাঁদছেন। এরকম কান্না এতো বছরের মধ্যে দেখেনি মেহনূর। সাবাকেও ওরকম শোকের কান্নায় দেখেনি। মাহতিম ঘরে নেই। লোকজন নিয়ে দাফনকার্য দেখতে বেরিয়েছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দাফন করতে হবে। মেহনূর অশ্রুপূর্ণ চোখে বিছানার দিকে এগিয়ে গেলো। একজন প্রতিবেশী মহিলা সরে গেলে সেদিকে উঠে বসলো। চাদরের ফাঁক গলে পরিচিত হাতটা বিছানায় পরে আছে। মেহনূর টলমল চোখে সেই হাত ছুঁতেই দাঁত শক্ত করলো। কি ঠান্ডা হাত! এতো ঠান্ডা কোনো মানুষের হাত হয়? বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে আছে। সকালেই এই হাতটা ছুঁয়ে-ছুঁয়ে কতো যত্ন করলো। সেই হাত এতো ঠান্ডা? মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠলো। তৎক্ষণাৎ চোখ খিঁচালো মেহনূর। মাথা ঘুরছে। কি যেন আপনা-আপনি বন্ধ হয়ে আসছে। চোখ খুলতে চাইলো, কিন্তু পারলো না। শ্রবণেন্দ্রিয় যেন সুরাইয়ার ‘ মেহনূর ‘ ডাকটা শুনতে পেলো। চোখের পাতা টেনেটুনে খুললো মেহনূর। ঝাপসা দৃষ্টিতে দেখতে-দেখতেই চোখের সামনে আঁধার ঘনিয়ে এলো। মনেহচ্ছে সে পরে যাচ্ছে। ধপ্ করে একটা শব্দ বুঝতে পারলো। এরপর কোনো জ্ঞান নেই। কেউ যেন ইচ্ছে করে চোখের পর্দাদুটো টেনে দিলো। বুঝতে পারলো না সৎবিৎ নেই।
.
আধঘন্টার ভেতর সব বন্দোবস্ত করলো মাহতিম। জানাজার নামাজে জমায়েত হলো বহু পুরুষ। এক ডাকে মোল্লাবাড়ির ছোটবউয়ের জন্য অসংখ্য মানুষ হাজির। পুরো দাফনকার্যের জন্য একটুও দেরি হয়নি। গ্রামের বুজুর্গ লোকগুলো বেশ অমায়িক আচরণ করলো। গ্রাম্য মহিলাদের মুখে-মুখে শোনা গেলো মৃতব্যক্তির সুনাম। সবার তনুমনে শোকের ছায়াটা আলোড়িত হয়েছে। চোখ ভিজেছে মাহমুদার জন্য। মানুষের কুড়ানো সম্মান বুঝি চলে যাওয়ার পর মুখরিত হয়। প্রতিটি স্তরে-স্তরে তার সুলভ আচরণ নিয়ে মানুষ দুঃখ করে। মাহমুদার গমনে সবচেয়ে ভেঙ্গে পরেছে সুজলা। কেউ উনার কান্নাকাটি থামাতে পারেনি। খবর শুনে চলে আসছে শানাজ। কিন্তু ফোনের মধ্যেই কেঁদে দিয়েছে সে। লাশ বেশিক্ষণ রাখার উপায় ছিলো না। ধর্মীয় মোতাবেক দ্রুত দাফনের জন্য ব্যস্ত ছিলো মাহতিম। যেই মহিলাটা তারই কাছে জীবনের শেষ মূহুর্ত কাটিয়েছে, তাকে কষ্ট দেওয়াটা কঠিন। মেহনূর এখনো সংজ্ঞাহীন। ডাক্তার এসে দেখে গেলেও ঘুমের সূঁচ দিয়েছে। শোকের ধাক্কাটা নিতে পারবে না সে। ইতিমধ্যে মোল্লাবাড়ির উদ্দেশ্য রওনা দিয়েছে সবাই। তৌফ থেকে শুরু করে সবাই ছুটে আসছে। শুধু বাদ যাচ্ছে প্রীতি ও মারজা। মারজাকে এখনো জানানো হয়নি। তাকে দেখাশোনার জন্য প্রীতি থেকে যাচ্ছে। সূর্য যখন ডুবে গেছে, তখন বাড়ি ফিরলো মাহতিম। মাথার টুপিটা পকেটে ঢুকিয়ে ঘরমুখো হলো। সাদা পান্ঞ্জাবীর স্লিভদুটো গুটিয়ে মেহনূরের খোঁজ নিলো। জানতে পারলো মেহনূর জেগেছে। কিন্তু কথা বলেনি কোনো। মাহতিম মেহনূরের কাছে গেলো। সাবা শিউরের কাছে বসে-বসে পানিপট্টি করছে। মাহতিম দরজা থেকেই জিজ্ঞেস করলো,
– ওর কি জ্বর?
সাবা নাক টেনে কান্না চোখে তাকালো। মুখে কিছু না বলে মাথা নাড়িয়ে দিলো। মাহতিম ‘ হ্যাঁ ‘ সূচকের জবাব পেয়ে মেহনূরের কাছে এসে বসলো। মেহনূর চোখ বন্ধ করে আছে। পেটের উপর দুহাত রাখা। বুক পযর্ন্ত কাঁথা টেনে রেখেছে।এখনো হালকা নীল শাড়িটা পরে আছে। সারাদিনে কাপড় বদলায়নি। মাহতিম ওর দুহাতের উপর হাত ছুঁয়ে দেখলো। কি সাংঘাতিক! জ্বরের মাত্রা খুব বেশি লাগছে। এতো তাপমাত্রা নিয়েও চুপ করে আছে? মাহতিম বেশ চিন্তায় পরে গেলো। লক্ষণ ভালো না। ধাক্কাটা বেশ ঠান্ডা ভাবে নিয়েছে। এরকম হয়ে থাকলে মেহনূর তো স্বাভাবিক হতে পারবে না। বেশ উদ্বেগের সাথে জিজ্ঞেস করলো মাহতিম,
– জ্বরটা চেক করেছো?
সাবা একটু সামলে নিয়ে বললো,
– না, ভাইয়া। ঘরে থার্মোমিটার নেই। যেটা ছিলো ওটা ভেঙ্গে গেছে।
মাহতিম আবার প্রশ্ন করলো,
– তোমার কি মনেহয় জ্বরটা স্বাভাবিক?
সাবা ‘ না ‘ ভঙ্গিতে মাথা নাড়িয়ে বললো,
– খুব বেশি। কি করবো ভাইয়া? বাড়ির মধ্যে সব তছনছ। আম্মাই নিচে বিলাপ করে কাঁদছে। ছোটমার যাওয়াতে এতো কষ্ট পাবো ভাবতে পারিনি ভাইয়া। এতোদিন ছোটমা যেমনই ছিলো, আমাদের সাথেই ছিলো। কিন্তু আজ থেকে কি করে নিজের মনটাকে বুঝ্ দিবো? ওই বিছানাটা খালি পরে আছে। কেউ নেই। প্রতিদিন সকাল-বিকাল আমরা সবাই ও-ঘরে ঢুঁ মারতাম। ছোটমার কিছু লাগবে কিনা জিজ্ঞেস করতাম। আজ থেকে কাকে এসব বলবো? বিছানার দিকে তাকালেই কান্না পায়। কেউ নেই।
মাহতিম কথার বদলে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। ডান পকেটে হাত ঢুকিয়ে সাবার উদ্দেশ্যে বললো,
– দুটো কাজ দিবো, করবে?
পকেট থেকে ফোন বের করলো মাহতিম। নিজের জিমেইল একাউন্টটায় ঢুকতে-ঢুকতে প্রসন্ন কন্ঠে বললো,
– বড়মাকে উপরে আসতে বলো। যদি না-আসে; বলবে, আমি ডেকেছি।
সাবা ডানহাতের উলটোপিঠে চোখ মুছে তাকালো। বসা থেকে উঠে দাঁড়াতেই মাহতিম দ্বিতীয় কাজটা বললো,
– গা মুছিয়ে ওর শাড়িটা বদলে দাও। এই মূহুর্তে কোনো প্রশ্ন কোরো না। কাজদুটো এক্ষুণি কমপ্লিট করবে। আমি আশেপাশে আছি। কোনো সমস্যায় পরলে আমাকে ডাক দিবে। কথা বুঝেছো?
মাহতিম ফোনের কিবোর্ডে আঙ্গুল চালাতে থাকলো। কথামতো সাবা কোনো প্রশ্ন করলো না। চুপচাপ নিচে চলে গেলো। মেহনূরকে এভাবে রাখা যাবে না। যার জন্য এতোদিন এ বাড়িতে রেখেছে, আজ সে নেই। আর মোল্লাবাড়িতে রাখা চলবে না। সময় ঘনিয়ে এসেছে। মাহতিম দ্রুত একটা এ্যাপ্লিকেশন লিখে মেইল পাঠিয়ে দিলো। সেন্ড বাটনে ক্লিক করতেই এক কপি নোমানকেও পাঠালো। নোটিফিকেশনে M.A.B. দেখেই হোক, বা ভক্তির চোটে, নোমান সাথে-সাথে চেক দিলো। চা খেতে-খেতে মেইল পড়তে লাগলো। বেশ ফুরফুরে মেজাজে পরতেই বড় চুমুক দিলো সে। যেই চতুর্থ লাইনটা পড়লো, ফস করে সমস্ত মুখভর্তি চা ঝর্নার মতো ছেড়ে দিলো। কি ছিলো ওটা? চতুর্থ লাইনটা আবার পড়লো নোমান। আশ্চর্যে স্তব্ধ হয়ে গেলো।
Hello, just to inform you that I’m applying immediately for the private cottage offered by you. May my application be accepted as soon as possible. All formalities should be mailed from Head Office. I’m canceling my leave for two days. In that compulsion, let my request be speedily approved without any fuss. I’m returning to the field. Hopefully, my personal facilities will be very good. I want to tighten my personal security.
M. Ansari .
চলমান .
#FABIYAH_MOMO
মন বাড়িয়ে ছুঁই গল্পের লিংক kobitor (all part)