#পর্বসংখ্যা_১৪.
#ফাবিয়াহ্_মমো .
বাঘের আস্তানায় গর্জন থামানোর জন্য পা বাড়ালো মেহনূর। ভয়ের তীব্রতায় মনের অবস্থা বড়োই নাজেহাল। প্রচণ্ড ভয়ের জন্য গায়ের পশম কাটা দিয়ে দাড়িয়ে গেছে, পা চালাতেও প্রচুর বেগ পেতে হচ্ছে। শুস্ক গলায় কয়েকবার ঢোক গিললো মেহনূর, বদ্ধ দরজায় ধাক্কা দেওয়ার আগে বুকে তিনবার ফুঁ দিলো। ঠান্ডা ও অসাড় হয়ে আসা শরীরটা দরজার একদম নিকটে নিয়ে দুহাত বাড়িয়ে ধাক্কা মারলো। ক্যাচ করে একটা শব্দ তুলে বদ্ধ দরজাটা খুলে গেলো। তখনই রুমের আবছা অন্ধকারে জানালার কাছে আবিস্কার করলো লম্বা দেহের মানুষটাকে। সেই মানুষটা জানালার দিকে মুখ দিয়ে কঠোরভাবে দাড়িয়ে আছে। তার পেশিবহুল হাতদুটো প্যান্টের দু’পকেটে গুঁজিয়ে রেখেছে। বাইরে থেকে আসা রাস্তার আলোতে এটুকু বুঝা যাচ্ছিলো, তার গায়ে কোনো টিশার্ট নেই। সেই উন্মুক্ত গায়ের উপর ঘামের আস্তরণ লেপ্টে কেমন যেনো চকচক করছিলো। মোটা-মোটা মাংসপেশীগুলো খাপে-খাপে ফুলা তার, চওড়া কাধের মানুষটার দেহ আসলেই আর্কষণীয়। জিমখানার সেই বডি-বিল্ডারদের মতো চোখ ধাঁধানো। দেখতে বিশাল দেহের মানুষ, সেই সঙ্গে উচ্চতাও যেনো অতুলনীয়। লোকটা যদি নিজের বউকে কখনো জড়িয়ে ধরে, তাহলে সেই মেয়ে কি আদৌ নিশ্বাস নিতে পারবে? দম আটকে মারা যাবেনা? সাথে সাথে ধিক্কার দিয়ে চোখ নামিয়ে ফেললো মেহনূর। অসভ্য-অভদ্র চিন্তা করার জন্য নিজেকে দু’স্তবক গালাগাল দিয়ে সেই রুমের ভেতর পা ফেলে ঢুকলো। মাহতিমের কানে স্পষ্টভাবে সেই পদজোড়ার শব্দ আসছে। পরিচিত সেই শব্দের জন্য কিছুটা বিভ্রান্ত হলেও তৎক্ষণাৎ নিজেকে শান্ত করে নিলো। পেছন থেকে আসা আগত বালিকার জন্য কাঠিন্য সুরে বললো,
– কি জন্য এখানে আসা হয়েছে?
পা থামিয়ে চমকে উঠলেও কোনো শব্দ উচ্চারণ করলোনা মেহনূর। কিছুক্ষণ বোকার মতো চুপ থেকে ধীরে-ধীরে গলা খুলে বললো,
– আপনার সাথে দুটো কথা ছিলো।
কথাটা শুনে কোনো হেলদোল হলো না মাহতিমের। যেভাবে দাড়িয়ে ছিলো, সেভাবেই দাড়িয়ে রইলো, কোনো উত্তর দিলোনা সে। চোখের দৃষ্টি আকাশের দিকে স্থির করে চুপ করে রইলো। ঠিক ওইসময় বাইরে একটা পিকআপ গাড়ি থামলে সেই গাড়ির আলোতে রুমের অন্ধকার যেনো একটুখানি কমলো। মেহনূর আবারও দৃষ্টি তুলে মাহতিমের দিকে তাকালো। কিন্তু সেই দৃষ্টি আর নিচে নামাতে পারলোনা মেহনূর, শত চেষ্টা করেও পারলোনা তখন। ভীতু চাহনির দৃষ্টিটা হঠাৎই যেনো শান্ত হয়ে গেলো ওর। শুধু মাহতিমের পিঠটার দিকে যেনো সম্মোহন দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো। হৃদযন্ত্রের বেসামাল ধুকপুকনি ধীরে-ধীরে যেনো কমতে লাগলো। সকল ভয় অকস্মাৎ উধাও হয়ে গেলো কেনো জানি। এতোদিন লোকটাকে টিশার্টের মধ্যেই দেখেছে, টিশার্টের ভেতরেই ভয়ংকর ফিটনেস বুঝা যেতো লোকটার। হাতের বাইসেপ্স মাশলের জন্য টিশার্টের শর্ট-সিল্ভও কুপোকাত হয়ে যেতো। এই লোকটা নিজেকে এতো বড়-বড় করে, তাহলে ইয়াংদের মতো কিভাবে বডি-ফিটনেস ধরে রেখেছে? বয়স কতো? ত্রিশের ওসপার? নাকি আরো বেশি? চিন্তার দুয়ারে কড়া নাড়তেই মাহতিমের গমগম সুর যেনো ওকে বাস্তবে টেনে আনল,
– এখানে দাড়িয়ে থেকে লাভ নেই। চলে যাও এখান থেকে।
মেহনূর এমন কিছুই শুনবে ভেবেছিলো, আর সেটাই কিনা কাটায়-কাটায় মিলে গেলো। কিন্তু এখনই হার মানলে চলবেনা। সৌভিক বলে দিয়েছে, এই লোকটা যেই পযর্ন্ত কমিটমেন্ট আকারে রাজি হবেনা, সেই পযর্ন্ত কোনোভাবেই আসন্ন বিপদ থেকে রক্ষা পাবেনা। এই মাহতিম আনসারী একবার যেটা বলে, সেটা আকাশ-পাতাল উলটে গেলেও গড়ায়-দণ্ডায় করে ছাড়ে। মেহনূর আরেকটু সাহস জুগিয়ে মাহতিমের দিকে এগিয়ে গেলো। মাহতিমের বাঁপাশে এসে জানালার কাছে দাড়াঁলো। নিচু করে রাখা চোখদুটো ডানে ফিরিয়ে মাহতিমের মুখের দিকে ধীরগতিতে তুলতে লাগলো। মাহতিমের মুখের বাঁপাশটা কেবল দেখা যাচ্ছিলো, আর তাতেই মেহনূরের গলা যেনো শুকিয়ে খসখস হয়ে গেছে। মাহতিমের মুখটার দিকে দৃষ্টি তুলে তাকালে কয়েক সেকেন্ডের জন্য বায়ে তাকালো মাহতিম। শান্ত অথচ কঠোর দৃষ্টি দিয়ে একপলক ভীতু প্রাণীটিকে দেখে আবার আকাশের দিকে তাকালো। মেহনূর কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে মিনমিন করে বললো,
– আপনি তরুণ ভাইয়ার জন্য বাড়িতে কোনো ঝামেলা করবেন না। আপনার একটা ঝামেলার জন্য আমি প্রচুর বিপদে পরবো। আমার দাদাভাইয়ের নাক কাটা যাবে। আমি আপনার কাছে অনুরোধ করছি, আপনি দয়া করে আজকের ঘটনাটা বাইরে ফাঁস করবেন না।
মেহনূর কথাটুকু শেষ করে আবার মাহতিমের মুখের দিকে তাকালো। উত্তরের জন্য যখন অনিমেষ নেত্রেই চেয়ে রইলো তখন ভীষণ অসহায় অনুভব করছিলো মেহনূর। মানুষ যে কতোটা খারাপভাবে বিশ্রী ঘটনা রটিয়ে দিবে সেটা চিন্তা করলেই কান্না পায়। তারা যদি তরুণের ঘটনা জানতে পারে তাহলে মোল্লাবাড়ি নিয়ে সাত গ্রাম পযর্ন্ত থু-থু করতে থাকবে। মেহনূর আসন্ন বিপদ নিয়ে চিন্তা করতে থাকলে পাশ থেকে মাহতিম শক্ত কন্ঠে বলে উঠে,
– তুমি কি আমাকে ভয় পাচ্ছো নাকি আমার তাণ্ডবলীলার জন্য টেনশন করছো?
প্রশ্নটা ছুঁড়েই মাহতিম পকেটে হাত গুঁজানো অবস্থায় ওর দিকে ফিরলো, মুখোমুখি হয়ে ওর ভীত মুখটার দিকে দৃষ্টি ফেলে অটল হয়ে দাঁড়ালো। খসখসে গলায় ঢোক গিলে মেহনূর ওর দিকে ধীরগতিতে দৃষ্টি তুলতে লাগলো। আবারও তীব্র উত্তেজনায় বুকের ভেতর হাতুড়ি চালনা হচ্ছে, নিশ্বাস হয়ে আসছে দীর্ঘ-ঘণ-গভীর। মাহতিম আনসারীর মুখের দিকে তাকানোর সাহস হলো না তখন, বুক পযর্ন্ত দৃষ্টি তুলেই দাঁত শক্ত করে চোখ বন্ধ করে ফেললো মেহনূর। দুহাত মুষ্টিবদ্ধ করে কঠোরভাবে শক্ত হয়ে গেলো ও। শরীরের ভেতর যেনো অদ্ভুত শিরশিরে ভাব অনুভূত হচ্ছে, সেই শিরশির অনুভূতির জন্য শিরায়-উপশিরায় বিদ্যুতের মতো ঝিমঝিম করছে। মেহনূরকে ওমন অবস্থায় দেখে চোখ তীক্ষ্ম করে কৌতুহলমিশ্রিত চাহনিতে তাকালো মাহতিম। প্রশ্নাত্মক ভঙ্গিতে সে মেহনূরের দিকে এক-কদম এগিয়ে গেলো। মেহনূর রুমে ঢুকার পর যেই সুঘ্রাণযুক্ত গন্ধটা মৃদ্যু আঁচে টের পাচ্ছিলো, সেই গন্ধটা আকস্মিকভাবে তীব্র হয়ে ঠেকলো এখন। এটা কিসের ঘ্রাণ? এটা কি কোনোভাবে ক্লোরোফর্মের গন্ধ? ক্লোরোফর্মের গন্ধ কি এরকম হয়? ধুর, যদি হয়েও থাকে তাহলে এই ব্যাটা কি কারণে সেটা ইউজ করবে? মেহনূর চোখ না খুলেই যতসব হাবিজাবি চিন্তা করতে থাকলো, অথচ একজোড়া সুতীক্ষ্ম চোখ ওর মুখের দিকে গাঢ়দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। পলকে-পলকে অপলক চাহনিতে তাকিয়ে থাকতেই মাহতিম আনসারী বলে উঠে,
– আমার রুমে যেহেতু এসেছো, আমার দিকে তাকানোর সাহসটাও রাখা উচিত। চোখ খুলে আমার দিকে আই-টু-আই কন্টাক্ট করো।
মেহনূর এটুকু বুঝতে পারলো মাহতিম বর্তমানে ওর কাছে এসে দাড়িয়েছে। ওর মুখের দিকে ভয়ানক দৃষ্টি ফেলে তাকিয়ে আছে। এদিকে উপায়ন্তর খুঁজাও যখন বৃথা হয়ে দাঁড়ালো, তখন বাধ্য হয়ে মেহনূর নিজের চোখ খুলে মাহতিমের দিকে পিটপিট করে তাকালো। শান্ত-কঠোর-অক্ষুণ্ণ চাহনির মাঝে নিজের ভীত চাহনিটা সম্পূর্ণরূপে আটকা পরে গেলো মেহনূরের। চোখ সরানো তখন দূরের কথা, চোখের পলকও যেনো পরলো না। শুধু ওই সম্মোহন চাহনির মাঝে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে আস্তে-আস্তে ঢোক গিললো মেহনূর। মাহতিম কিছুক্ষণ চুপ থেকে তাচ্ছিল্যের সুরে কঠোর ভঙ্গিতে বললো,
– তোমার ওই ‘ তরুণ ভাই ‘ যদি ভুলেও আমার সামনে আসে, আমি কিন্তু ওর জন্য স্পেশাল গোরখোদক হবো।
গোরের কথা শুনে গা কাঁটা দিয়ে উঠলো মেহনূরের। ভয়ে চুপসে গেলেও নিজেকে বাইরে থেকে স্বাভাবিক দেখিয়ে ধাতস্থ সুরে বললো,
– কি দরকার এসব করার? যে যেভাবে আছে, সে সেভাবেই থাকুক, আপনার এখানে কিছুই করতে হবেনা। আপনি কেনো মাতামাতি করতে চাইছেন?
মাহতিম এবার চোখ সরু করে তাকালো কাধের নিচে পরে থাকা মেহনূরের দিকে মাথা নুইয়ে সুক্ষ্ম মেজাজ দেখিয়ে বললো,
– তোমার জায়গায় যদি নীতি,প্রীতি বা ফারিন হতো, তাহলে ওই তরুণের নামের আগে ‘ ম-রহুম ‘ শব্দ যুক্ত হতে বেশি সময় লাগতো না। কিন্তু তুমিতো আমার কিছুই হও না। ঠিকই বলেছো, আমারতো তোমার ম্যাটার নিয়ে মাতামাতি করার দরকার নেই। তোমার মতো বলদের জন্য নিজের হাত তো আমি নষ্ট করতে পারিনা। সো, গো-টু-হ্যা-ল! আমার সামনে থেকে নিজের ভীতু মুখখানি নিয়ে বিদায় হও। চেষ্টা করবে ভুলেও আমার সামনে যেনো না পরো। নইলে আমি রাগের মাথায় কেমন আচরণ করবো নিজেও জানিনা। চলে যাও এখান থেকে!
প্রচণ্ড রাগটা সামলে নিলেও শেষোক্ত কথাটা চড়া গলায় বললো মাহতিম। মেহনূরকে রুম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য আরেকবার হুঙ্কার দিয়ে উঠলো। মাহতিমের খোঁচা-অপমান-গন্ঞ্জনা শুনে মেহনূর নতমুখে ধীরে-ধীরে চলে যেতে থাকলো। মাহতিম তখন উত্তেজিত রাগটা সামলানোর জন্য জোরে-জোরে নিশ্বাস নিতে থাকলো। একপর্যায়ে পকেট থেকে ফোন বের করে সেটা আছাড় মারতে নিলো, কিন্তু পরক্ষণে শূন্যে উঠিয়েও আর ছুড়ে মারলো না মাহতিম। চূড়ান্ত রাগটা সামলে নিয়ে ঠোঁট গোল করে নিশ্বাস ছাড়তে লাগলো তখন। ফোনটা আবারও পকেটের ফাঁকে ফেলে মাথা ঘুরিয়ে দরজার দিকে তাকালো। ঘিয়ে রঙের শাড়িটা অন্ধকারেও উজ্জল হয়ে আছে, মাথার বেণীটা পিঠ থেকে হাটু পযর্ন্ত মায়াবী বালিকার চিত্র প্রদর্শন করছে। ছোট-ছোট পায়ে চলে যাওয়ার দৃশ্যটা দেখে চোখ বন্ধ করলো মাহতিম। জানালার দিকে পিঠ ঠেকিয়ে বন্ধচোখে ভাবতে লাগলো, ওই পাদুটো আটকানোর জন্য আসল যোগ্যতা কি ওর আছে? যদি কখনো যোগ্যতা এসে যায় ও কি গ্রহণ করবে? মাহতিম সবসময় চাইতো এমন কেউ আসুক, যে তার কাছে চেয়ে-চেয়ে ভালোবাসার আবদার করবে। ব্যস্ত মাহতিমের হাতদুটো টেনে কোমরে রেখে বলবে, উপরে তুলুন আপনার কোমল ওষ্ঠযুগলের স্পর্শ নিতে চাই। কাজের মাঝে ব্যাঘাত ঘটিয়ে বলুক, আপনার বাহুগুলোর মধ্যে গুটিশুটি পাকিয়ে ঘুমাতে চাই। এতো আবদারের জন্য যেই মানুষটা দরকার সেই মানুষটাও নেই। এসব চিন্তা করলে সবসময় আফসোসের শূণ্যতা ভর করে ওর। মাহতিম বুকভর্তি নিঃশ্বাস টেনে চোখ খুলে দেখলো, জীবনের মতোই রুমটা নিঃশব্দ-নিঃসঙ্গ-ঘুটঘুটে অন্ধকার। কোথাও কেউ নেই।
.
এশারের একটু পরেই বাড়িতে ফিরলো মাহমুদা। এসেই দেখেন উঠানের বাতি আজ নিভানো। তিনি কিছুটা অবাক হলেও চুপচাপ বাড়িতে ঢুকে গেলেন। আঙিনার লাইট জ্বললেও সেখানে কেউ ছিলোনা। তার মানে সুজলা ভাবী, মারজা আপা এখনো আসেনি। মাহমুদা মাথার ঘোমটাটা কপাল পযর্ন্ত টেনে আনলেন। এরপর মেয়েকে একবার দেখার জন্য সবার আগে মেহনূরের রুমে গেলেন। দরজার সমুখে দাড়িঁয়ে পর্দা সরিয়ে দেখলেন বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে আছে মেহনূর। যখন সেদিকে ভালোমতো তাকালেন তখনই আশ্চর্য হয়ে বিছানার দিকে ছুটে গেলেন মাহমুদা। বিছানায় বসে মেয়েকে দ্রুত নিজের দিকে ঘুরাতেই নানা অস্থির বাক্যে বলতে লাগলেন,
– মা রে, তুই কাদছিস কেন? কেউ কি কিছু বলেছে? মেহনূর, তাকা মা। বাড়িতে কেউ কিছু বলেছে? শেফালী ভাবী কিছু —
কথার মাঝখানে আটকে গেলেন মাহমুদা দমে-দমে ফুলে উঠা পিঠটা নিয়ে বালিশ থেকে মুখ তুলে তাকালো মেহনূর। চোখদুটো অশ্রুসিক্ত হয়ে রক্তিম হয়ে আছে। এখনো গাল বেয়ে অশ্রুফোঁটা বর্ষণ হচ্ছে ওর। মাহমুদা তীব্র উৎকন্ঠায় আচঁল টেনে মেহনূরের গাল মুছে দিতে লাগলেন। বারবার জিজ্ঞেস করতে লাগলেন কেনো ও কাঁদছে, উনার অনুপস্থিতিতে কেউ কি কিছু বলেছে? নিঃশব্দে কান্নার আওয়াজ যেনো ফিসফিস করে শোনা যাচ্ছে ওর। মাহমুদা আর সহ্য করতে না পেরে এবার ক্রোধ দেখিয়ে জোর দিয়ে জানতে চাইলো। মেহনূর অশ্রুপূর্ণ চোখ তুলে মায়ের দিকে তাকালেও আবার দৃষ্টি নামিয়ে মৃদ্যু সুরে বললো,
– তুমি কারণ শুনে কি কিছু করতে পারবে? কখনো তুমি আমার পক্ষ নিয়ে কথা বলছো? মেজো মা, সুরাইয়া বুবু প্রতিদিন আমাকে কথা শোনায়, তোমাকে ইচ্ছেমতো খোটা দেয়, আব্বাকে নিয়েও যা-তা করে কথা বলে। এসব শুনেও তুমি কিছু করতে পেরেছো? আব্বা বিদেশে দিন-রাত এক করে খাটে, আর সেই খাটুনির টাকায় ওরা নাম ফুটায়। আম্মা ছোট থেকে বড় হলাম ঠিকই, কিন্তু অন্যের লাত্থি-উষ্ট্রা খেয়েই বড় হতে হয়েছে। দাদাভাই সারাদিন বাইরে চলে গেলে ওরা দুজন মিলে বাড়ি চষে খায়। এতোসব দেখেও তুমি কিছু করো না, ওদের কিছু বলো না। আমাকে তুমি ভালোবাসো না আম্মা। তুমি যদি আমাকে মূল্য করতে তাহলে এই বাড়িতে রাখতে না। ওরা কেউ ভালো না।
মাহমুদা এমন কঠিন কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেলেন। বাকশক্তি হারানোর মতো চুপ করে রইলেন। এদিকে মেহনূর চোখ মুছে ঢোক গিলে আবার কান্নাসুরে বলে উঠলো,
– মেজো মা যদি প্রতিবাদ না করে তাহলে কেউ আমার পক্ষ নিয়ে কথা বলেনা। আমি ঝগড়া করতে পারিনা দেখে সবাই ইচ্ছেমতো আমাকে কথা শুনিয়ে যায়। যখন মন চায় আমাকে মারে, চুল ধরে ব্যথা দেয়, এটা-ওটা কাজ করতে দেয়, যা খুশী সবকিছু আমাকে দিয়ে করায়। আমি কোনোদিন অবাধ্য হইনি, কাউকে কিছু বলিনি। কিন্তু সবাই আমাকে কষ্ট দিয়ে যায়। জানো আম্মা, দুনিয়ায় সরল-সহজ মানুষদের জায়গা নেই।
মূঢ় অবস্থায় স্থির হয়ে আছে মাহমুদা। চোখের সামনে মেয়ের ফুপাঁনো কান্না দেখে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেছেন। কি করবেন, কি বলবেন, কি বুঝাবেন কিছুই উনার মাথায় ঢুকলোনা। মাহমুদা সবসময়ের মতোই শান্ত-চুপচাপ-সহজ মনের মহিলা। আজও এমন বৈরি অবস্থা দেখে তিনি কিছুই বললেন না। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে অশ্রুসিক্ত চোখ মুছিয়ে কাছে টেনে নিলেন। ছোট্ট মেহনূর যে বড় হওয়ার পরও ছোটদের মতোই অশ্রু ঝরাচ্ছে সেটা দেখে তিনি মৃদ্যু হাসলেন। মেয়ের কপালে স্নেহমায়ায় গাঢ় চুমু খেয়ে বুকে মাথা টেনে আগলে ধরলেন। মাথায় আদরের হাত বুলিয়ে দিতেই কান্না কমে এলো ওর। স্বল্প সময়ের মধ্যে কান্না থেমে চোখ বন্ধ করে ফেললো। মায়ের পরিচিত উষ্ণতায় গা মিশিয়ে ঘুমিয়ে পরলো মেহনূর। আজকের বীভৎস ঘটনার উপর চাঁদর টেনে দিয়ে ক্লান্ত মনে ঘুমিয়ে গেলো।
বাড়ির সদস্য এক-এক করে ফিরে এলে সবাই একসঙ্গে খাবার খেয়ে নিলো। নীতি, সৌভিকরা আনমনে খাবার খেয়ে উঠলো। মাহমুদা নিজের উদাস মুখটা যথাসম্ভব আড়াল করার চেষ্টা করলো। এদিকে মাহতিম কোনোরকমে দু-লোকমা গিলে নিজের রুমে ফিরে এলো। ওর পিছু-পিছু কয়েক মিনিটের মধ্যে নীতিরা এসে উপস্থিত। মাহতিম বিছানার হেডবোর্ডে পিঠ লাগিয়ে আধশোয়া স্টাইলে ফোন টিপছিলো। মাহতিমের মুডের অবস্থা দেখে কারোর কথা বলার সাহস হচ্ছেনা। এদিকে নিজেদের মধ্যে ইশারায় কথা চললে শেষে নীতি বলে উঠলো,
– ভাইয়া তুমি কি ঠিক আছো?
মাহতিম একপলক দৃষ্টি তুলে নীতির দিকে তাকালো, পরক্ষণে ফোনের দিকে দৃষ্টি নামিয়ে শান্ত সুরে বললো,
– আমার কি কিছু হওয়ার কথা ছিলো?
নীতি সাথে-সাথে মাথাটা ‘ না ‘ বোধকে নাড়িয়ে অস্থির কন্ঠে বললো,
– না না, সেটা হবে কেনো? তোমার মুড যে এমন খারাপ হয়ে আছে, সেটাই জিজ্ঞেস করতে চাচ্ছি আরকি।
মাহতিম কয়েক সেকেন্ড চুপ করে আবার বলে উঠলো,
– ওই রামবলদকে তোরাই রুমে পাঠিয়েছিলি ঠিকনা?
এমন সম্বোধন শুনে নীতি ফিক করে হেসে দিতেও সামলে নিলো। পেছন থেকে তৌফ বলে উঠলো,
– রামবলদ না পল্ট্রি মুরগি সেটা সময় আসলেই বুঝবি। যাইহোক, মেহনূর যখন রুম থেকে বের হলো, তখন তুই উদাম গায়ে কি করতাছিলি?
মাহতিম তৎক্ষণাৎ এমন কথা শুনে তৌফের দিকে তাকালো। ভ্রুঁ উঁচু প্রশ্ন ছুঁড়ে বললো,
– মানুষ উদাম গায়ে কি করে?
তৌফের পাশ থেকে সিয়াম একগাল হাসি দিয়ে মেয়েদের মতো লজ্জামাখা ভঙ্গিতে বললো,
– যাহ্ দুষ্টু, খালি দুষ্টু দুষ্টু কথা বলে।
সিয়ামের মেয়েলি ঢঙ দেখে ফিসফিস করে হেসে দিলো সবাই। এদিকে সিয়ামের ঘটনার সূত্র ধরে তৌফ অনুযোগের সুরে বললো,
– সত্যটা কও তো মামা, তুমি টিশার্ট খুইলা কি আকামটা করতে চাইছিলা। অন্ধকার তো ভালোই ছিলো, তার উপর সুন্দরী নিজেই তোমার রুমে পদধূলি দিতে আসছিলো। তুমি কি আবার চান্স মারলা নাকি বন্ধু?
মাহতিম টু শব্দ পযর্ন্ত না করে ডানহাতের তর্জনী তুলে জানালার দিকে ইশারা করলো। সবাই ইশারা অনুযায়ী সেদিকে তাকালে দেখতে পেলো, একটা মোটা-লম্বা শক্ত মতোন পাথর জানালার নিচে রাখা। সেই পাথরটা যে রাগ কমানোর জন্য ব্যায়ামের কাজে ডাম্বেলের মতো লেগেছে, সেটা বুঝা শেষ সবার। তরুণ এখনো বাড়িতে ফিরেনি, আর ফিরলেও সম্ভবত মাহতিম কিছু করবেনা। কিন্তু মেহনূরের সাথে কি কথা হয়েছে সেটাও ওরা জানেনা। মাহতিমের রুম থেকে মলিন মুখ নিয়েই বেরিয়েছে মেহনূর, সেখানে মাহতিম ওকে কিছুই বলেনি। ওরা সবাই দূর থেকে এক্সপেক্ট করছিলো হয়তো মাহতিম যখন মেহনূরকে দেখবে তাদের মধ্যে কিছু-না-কিছু ঠিকই কানেক্ট হয়ে যাবে। কিন্তু সেটা হওয়া তো দূরের ব্যাপার, উলটো মাহতিমের চড়ানো আওয়াজের ধমক শুনে সবাই স্থির হয়ে যায়।
রাত তখন দুটো বাজে। পাড়া-পড়শি-সহ বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে গেছে। চাঁদের স্নিগ্ধ কিরণে আলোকিত হয়ে আছে চারপাশ। কিন্তু প্রকৃতির নিরবতা যতো নিস্তব্ধ আকারে নিঃশব্দ হচ্ছে, ততই যেনো একজনের বুকে ভয়ের গোলাটা দারুণভাবে ভীত করে তুলছে। নাকের নিচে মলম লাগানো, হাতের কনুইয়ে ওয়ান-টাইম ব্যান্ডেজ দেখা যাচ্ছে। মানুষটা যে বিকেলের দিকে জঘন্য একটা ঘটনা করে বেরিয়েছে সেটা বাড়ির বয়োজোষ্ঠরা জানেনা। যারা জানে তারা কেউ জেগে নেই এখন। তরুণ চুপচাপ অন্ধকার উঠান পেরিয়ে বাড়ির সদর দরজায় কড়া নাড়লো। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার কড়া নাড়তেই দেখলো দরজাটা খোলা। প্রচণ্ড আশ্চর্য হলেও মনে-মনে খুশী হলো তরুণ। যাক বাবা, দরজা যে ভুলবশত না লাগিয়ে সবাই ঘুমিয়ে পরেছে, এতে ওর জন্য ভালোই হয়েছে। তরুণ হাসিখুশি মনে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে গেলো। দরজা আটঁকে আঙিনার দিকে তাকালো। অন্ধকারে কিচ্ছু দেখা যাচ্ছেনা, তাই চোখ সয়ে চলার জন্য একটু অপেক্ষা করলো তরুণ। চোখ যখন অন্ধকারে সয়ে এলো তখন দর্প ভঙ্গিতে পা বারিয়ে নিজের রুমে চলে আসলো তরুণ। দরজাটায় ছিটকিনি দিয়ে বিছানায় এসে বসলো। জোরে একটা শ্বাস ছেড়ে আবার উঠে আয়নার সামনে গেলো। আয়নার পাশেই সুইচবোর্ড দেওয়া, তাই লাইটের জন্য সুইচ টিপতে লাগলো। কিন্তু দ্বিতীয় দফায় আশ্চর্য হয়ে দেখলো লাইটও আজ কাজ করছেনা। বাধ্য হয়ে মোমবাতি জ্বালিয়ে কাঠের টেবিলে সেটা রাখলো। দেয়ালে ঝুলানো বর্গাকার আয়নায় মুখটা দেখতে গেলো। নাকের নিচটা অনেকখানি কেটে গেছে। তর্জনী আঙ্গুলটা দিয়ে কাটা জায়গায় আলতো ভাবে স্পর্শ করতেই হঠাৎ আয়নার দিকে চোখ পরলো ওর। আয়নার ভেতর যেই প্রতিবিম্ব দেখতে পেলো, সেটা দেখে অস্ফুট সুরে শিউরে উঠরো তরুণ! চোখদুটো গোল গোল করে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। মনের ভ্রম নাকি সত্য, সেটা বুঝার জন্য তাড়াতাড়ি দুহাতে চোখ কচলাতে লাগলো, কিন্তু না, মনের ভ্রম না। আয়নায় যেই পুরুষমূর্তি দেখা যাচ্ছে, সেটা মিথ্যা না। সত্যি-সত্যিই তরুণের পিছনে সেই পুরুষমূর্তি দাড়িয়ে আছে, ভয়াবহ দৃষ্টি দিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। বুকের বক্ষস্থল থেকে গলা পযর্ন্ত শুকিয়ে এলো তরুণের, কথা বলতেও যেনো জিহবা ভার লাগছে।
#চলবে
#FABIYAH_MOMO
মন বাড়িয়ে ছুঁই গল্পের লিংক kobitor (all part)
(#নোটবার্তা : নোটপ্যাডে আশি শতাংশ টাইপ ছিলো, সকাল থেকে বাকিটুকু কমপ্লিট করে দিয়ে দিলাম। জানি বেখাপ্পা-খাপছাড়া হয়েছে। অসুস্থ মস্তিষ্কে শব্দ-বুননটা একটু জটিল। জ্বর এই আসে, এই নেই। তাই এখনো দূর্বলতা কাটিয়ে উঠতে পারিনি। ভুলের জন্য আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত )