#ফাবিয়াহ্_মমো .
সূর্যের আঁচটা প্রখর, তেমনি প্রখর হয়ে তাকিয়ে আছে একজোড়া চোখ। সাদা গদিতে আয়েশীভঙ্গিতে পায়ের উপর পা তুলে রেখেছে, পিঠটা ঠেকিয়ে রেখেছে সিটের সাথে। বদ্ধ জানালা ভেদ করে দূর-দূরান্তে দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছে, জানালার সাথে কনুই ঠেকিয়ে ঠোঁটে রেখেছে আঙ্গুল। ভাবুক স্টাইলে মৌন থাকতেই চোখদুটো অকস্মাৎ বন্ধ করলো, সুঠাম দেহের প্রশস্ত বুকটা ধীরে-ধীরে নিশ্বাসের জন্য ফুলে উঠলো, অনেকটা শব্দ করেই নিঃশ্বাস ছাড়তে লাগলো মাহতিম আনসারী। জানালার বাঁ-দিকটা এখন তার আয়ত্তে নিমগ্ন আছে, চলন্ত গাড়িটা জ্যাম কাটিয়ে হাইওয়ে ধরেছে মাত্র। পাঁকা রাস্তায় আশির উপরে স্পিড তুলেছে ড্রাইভার, খুবই চতুরতার সাথে টেক্কা দিচ্ছে সামনের গাড়িগুলো। হাতে পর্যাপ্ত পরিমাণে সময় নেই সেটা একটু আগেই ঘড়িতে দেখতে পেরেছে। হাতে আছে আর মাত্র সাতাশ মিনিট। তার মধ্যে চেকআপ করতেই লাগবে দশমিনিটের মতো, আবার বিমানবন্দরের কর্মকর্তার সাথে কিছু আলাপও করা লাগবে। যোগ্য, দক্ষ, শান্ত প্রকৃতির ড্রাইভার নিজের মস্তিষ্কের মধ্যেই বসের সম্পূর্ণ শ্যাডিউলটার ছক কষে রেখেছে, একটুও এদিক-ওদিক হওয়ার চান্স নেই সেটা সে জানে। চোখের সামনে এখন ট্রাক ছুটছে, ট্রাকটার মতিগতি বড্ড অসুবিধার ঠেকলেও প্যাডেলে চাপ দিয়ে গাড়িটার স্পিড বাড়ালো ড্রাইভার। পাকাপোক্ত ড্রাইভিং হুইলটা শক্ত করে দুহাতে ধরলো, প্যাডেলে চাপ প্রয়োগ করে বাতাসের সাথে ছুট লাগালো। নিমিষেই ট্রাকটাকে পিছু ফেলে দিলো ড্রাইভার নোমান। মনে-মনে বিশ্বজয়ীর হাসি দিয়ে গাড়ি চালাতেই লুকিং মিররে চোখ আঁটকে গেলো, সাথে-সাথে কিন্ঞ্চিৎ ভয়ের সাথে ঢোক গিললো নোমান। পেছনের সিট থেকে একজোড়া তীক্ষ্মদৃষ্টি নোমানের কার্যকলাপ নিরবে পর্যবেক্ষণ করছে, নোমান যে একটু আগে বিশ্ববিজয়ীর মতো হাসি দিলো সেটাও হয়তো তার চোখ এড়ায়নি। প্রায় চারটা বছর ধরে মাহতিম আনসারীকে চেনে নাজমুল নোমান। পেশাগত জীবনে মাহতিমই তাকে নিজের ব্যক্তিগত ড্রাইভার হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে। ব্যক্তিগত ছাড়া আরো কি কি কাজে নিয়োগ দিয়েছে সেটা ডিপার্টমেন্টের খুব উচ্চপদের লোকেরাও জানে না। পরিষ্কার করে কাউকে বলেও নি নোমৃনের বস। সামরিক বাহিনী থেকে ব্যক্তিগত মানুষ নিয়োগ দেওয়াটা সহজ কোনো ব্যাপার ছিলোনা। উক্ত পাওয়ারটা মূলত বিশেষ কিছু ব্যক্তিদের জন্য বরাদ্দ, তন্মধ্যে মাহতিম অন্যতম। সামরিক বাহিনীর নাম শুনলেই বুকের ভেতরটা কেমন অস্থির হয়ে উঠে সেটা সকলের কাছে অজানার বিষয় নয়। নোমান দ্রুত নিজের ভয়গুলোকে মনের ভেতর লুকিয়ে নিলো, নিজের দিকটা স্বচ্ছ রাখার জন্য লুকিং মিররে চোরাদৃষ্টিতে তাকালো। আবার বিষম খেলো নোমান, এখনো সেই দৃষ্টিদুটো স্থির ভাবে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। নোমান জোরে-জোরে দুটো ঢোক গিলে ড্রাইভিং হুইলটা শক্ত ভাবে ধরলো। গলাটা একটু পরিষ্কার করে প্রসন্ন সুরে বললো,
– স্যার কিছু বলবেন?
এখনো লুকিং মিররের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেছে মাহতিম। নোমানের ছোট্ট প্রশ্নটা শুনে এবার সামনের দিকে তাকালো, হাইওয়ের রাস্তাটা একপলক দেখে নিয়ে আবার লুকিং মিররে দৃষ্টি রাখলো। গলায় কপট ঝাঁঝ মিশিয়ে সর্তকতার সুরে বললো,
– আশির উপরে স্পিড তুলে নিজেকে শেয়ানা ভাবতে যেও না। প্রথমেই তুমি ট্রাফিক রুলস ব্রেক করে বসে আছো। এটা বাংলাদেশ দেখে বেঁচে গেলে, অন্য কান্ট্রি হলে —-
কথাটা শেষ করার সময় ও সুযোগ দুটোই পেলো না মাহতিম। চট করে সাদা প্যান্টের পকেটে ফোনের ভাইব্রেট অবস্থা টের পেতেই কথা থামিয়ে ফেললো। বসকে ফোনের জন্য ব্যস্ত হতে দেখে চোখ বন্ধ করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো নোমান। মাহতিমের কড়া কথাগুলো মাঝে-মাঝে হজম করা যায় না। যেই চোখ দিয়ে একবার তাকায় ওইখানেই যেনো গেঁড়ে ফেলে। নোমান ভেবেই পায়না কি করে তার বসের বউ কি করে তার বসকে ট্যাকেল করে। বসের বউ সম্ভবত খুব রাগী, যখন সে সালাম দিলো তখন ম্যাডাম একটুও কথা বলেনি। নোমান নিজের ভাবনা চিন্তায় মশগুল থাকলে ফোনের স্ক্রিনে চোখ রাখলো মাহতিম। কলার নামটা দেখে প্রথমে ইচ্ছা করছিলো কেটে দিতে, পরক্ষণে সেটা রিসিভ করে কানে ঠেকালো। জানালা থেকে সরে গিয়ে পিঠ সোজা করলো, বাঁহাতের ঘড়িতে সময় দেখত্রই ছোট্ট শব্দটা বলে উঠলো,
– হ্যালো,
কাঙ্ক্ষিত সাড়াটা পেয়ে গেলে কিছুক্ষণ চুপ রইলো সৌভিক। মাহতিম এই চুপটির অর্থটা ভালো করে জানে, ফোনের ওপাশে কথা গুছাতে ব্যস্ত সৌভিক, তাই সে চুপ করে আছে। মাহতিম তাকে সহজ করার জন্য নিজ থেকেই বলে উঠলো,
– কলটা তো এমনে এমনেই করিসনি। কি কারণে করেছিস সেটাই বল।
একটু স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করলো সৌভিক। গলাটা ভিজিয়ে নিয়ে স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,
– ভাবীর সাথে যোগাযোগ বন্ধ করিস না মাহতিম। আমি জানি তুই কি ধরনের চালাকি করার চিন্তায় আছিস। ওর সাথে আপাতত এসব কিছুই করিস না। মেয়েটা প্রচুর কষ্ট পাবে। তুই একটু কল করে যদি ভাবীকে —
সঙ্গে-সঙ্গে মুখের কথা কেড়ে কপট ভঙ্গিতে জবাব দিলো মাহতিম। অনেকটা ক্ষোভের সাথে, কিছুটা জোরালো ভঙ্গিতে বললো,
– ওর টপিক বাদ দিয়ে যদি কথা থাকে তাহলে সেটা বল। আমি এয়ারপোর্টের কাছাকাছি চলে এসেছি, যেকোনো সময় ফোন বন্ধ করতে হবে। যা বলার দ্রুত বল সৌভিক।
মুখ ফুলিয়ে সশব্দে নিশ্বাস ছাড়লো সৌভিক। চরম পরিমাণে হতাশা কাজ করছে এখন। ডানহাতের আঙ্গুল দিয়ে কপালটা টিপে চোখ বন্ধ করে বললো,
– ভাবীর হাতটা কেন কেটে দিলি দোস্ত?
সরুচোখে তাকালো মাহতিম, ভ্রুঁদুটো কুঁচকে নাকের কাছে অসংখ্য ভাঁজ ফেলে আশ্চর্য হয়ে গেলো। চরম আশ্চর্যের সাথে প্রশ্নাত্মক কন্ঠে বললো,
– কার হাত কেটেছে বললি?
সৌভিক তৎক্ষণাৎ চাপা ক্ষোভের সুরে গজগজ করে উঠলো,
– ভাবীর হাত তুই কাটিসনি? কতখানি মাংস তুলেছিস চিন্তা আছে? প্রীতি যেয়ে কতো কাহিনী করার পর স্যাভলন লাগাতে পেরেছে, ভাবী কাউকে হাত ধরতে দেয় না। আন্টি যদি জানতে পারে কি পরিমাণে ক্ষেপবে ভেবেছিস? তুই এমন কাজ করবি আমি ভাবতেও পারছিনা মাহতিম। তুই নিজেকে ডেম্পারেট প্রকাশ করতে যেয়ে ভাবীকে শেষমেষ ক্ষতি করবি এটা কল্পনার বাইরে ছিলো। এটা একদম ঠিক করিসনি!
মাহতিম কোনো কিছুই বুঝতে পারলো না। সৌভিকের কথা শুনে যতদূর বুঝতে পারলো, তাতে বুঝলো হয়তো মেহনূরের হাত ভুলবশত কেটেছে। সেটার অজুহাতে সৌভিক চটে আছে, এখন বেজায় রাগ দেখানোর জন্য কল করেছিলো ঠিকই, কিন্তু রাগটা পুরোপুরি ফলাতে পারেনি সে। মাহতিম জানালার বাইরে দৃষ্টি দিলো, এরপর চোখ ফেরালো সামনের দিকে। কিছুটা উদভ্রান্তের মতো বোধ হচ্ছিলো তখন, কিন্তু নোমানের দৃষ্টি থেকে নিজেকে আড়াল করার জন্য তেজালো সুরে বললো,
– আমি এখন বাড়িতে নেই সৌভিক। এই মূহুর্তে কোথায় যাচ্ছি সেটা তুই ভালো করে জানিস। ওর অবস্থা যদি বেশি খারাপ হয় দ্যান ডাক্তার ডেকে আন, মা’কে বিষয়টা জানিয়ে দে। ওর যদি ইচ্ছে হয় স্বামীর সাথে কথা বলার, সেটা ও নিজেই পারবে। ওকে ওর মতো ছেড়ে দে, নীতিদের ভালোভাবে পৌঁছে দিস। রাখি এখন। রাত দশটার আগে কল করবি না। করলেও বন্ধ পাবি।
মাহতিমের কথার বিপরীতে কথা বলার জন্য বাক্য সাজাচ্ছিলো সৌভিক। মাহতিম একটানে কথাগুলো শুনিয়ে দিতেই সৌভিক যেই মুখ খুলবে ওমনেই কানে কল কাটার টুট টুট আওয়াজটা শুনতে পেলো। দাঁতে-দাঁত পিষে কান থেকে ফোন সরিয়ে স্ক্রিনে তাকালো, ততক্ষণে মাহতিমের ফোন বন্ধ হয়ে গেছে, আর কল করেও মাহতিমকে পেলো না সৌভিক।
.
সকালের নাস্তাটা খাপছাড়া ভাবে শেষ হলো। কেউ নাস্তা খেলো, কেউবা খেলো না। কেউ-কেউ আধা খেয়ে উঠে চলে গেলো, কেউ রুটি ছিড়তেই সময় পার করলো। মারজা না চাইতেও নাস্তা খেতে বাধ্য হলো, একান্ত ঔষুধের জন্যই যতটুকু খাওয়া-দাওয়া। মেহনূর আজ নাস্তার টেবিলে আসেনি, সকালে একপলকের জন্য বিমর্ষ মুখটা দেখেছিলো এরপর আর দেখেনি। মাথায় খয়েরী রঙের ওড়নাটা পরিপাটিভাবে টেনে সিড়ি দিয়ে উপরে উঠলো, পা টিপে-টিপে ছাদের ডানদিকের রুমটায় চলে এলো। দরজার হালকা নীলের পর্দা ঝুলছে, পর্দার শেষভাগটা সাদা রঙের। মারজা ডানহাতে পর্দা সরিয়ে রুমের ভেতরে পা রাখলো, শান্তমুখে ভেতরে ঢুকতেই চোখদুটো বিছানার দিকে স্থির হয়ে গেলো। হাঁটুদুটো বুকের কাছে তুলে মাথাটা হাঁটুতে ঠেকিয়ে রেখেছে মেহনূর, গোলাপী চাদরের পরিষ্কার বিছানায় গুটিশুটি হয়ে বসে আছে। মেহনূরকে ওভাবে মাথা ঠেকিয়ে বসতে দেখে মারজা তার পাশে গিয়ে বসলো। মেহনূরের পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে থাকলে পরমাহ্লাদের সুরে বললো,
– নাস্তা না করলে চলবে? মাহদিকে পাঠালাম, নীতিকে পাঠালাম, সবাইকে তুমি এক-এক করে ফিরিয়ে দিলে। না খেলে যে শরীর আরো রোগা করবে বুঝো না? মাহতিম এলে তো খুব বকবে মেহনূর। কাল কি বকার নমুনা দেখোনি?
নড়েচড়ে উঠলো মেহনূর, নাক টানার শব্দ করতেই হাঁটু থেকে মাথা তুলতে লাগলো। বন্ধ চোখদুটো অনেকক্ষণ পর খুলতে যেয়ে ঝাপসা দেখছে এখন। ফোলা-ফোলা আঁখিদুটো লাল হয়ে গেছে, নাকের মাথাটা যেনো রক্তজবার মতো লালচে হয়েছে, চোখের দুই কোল থেকে এখনো ঝরছে অশ্রুফোটা। হাঁটুটা নামিয়ে স্বাভাবিক করতেই শাড়ির আচঁল টেনে চোখ মুছলো মেহনূর, দুচোখের কোলদুটো অশ্রুমোচন করার চেষ্টা করলো। মারজা ব্যথার দৃষ্টিতে চুপচাপ তাকিয়ে থাকলে মেহনূরের হাতটা থামিয়ে দিলো, মেহনূর অবাক হয়ে চোখ মুছা বন্ধ করলে মারজা একটু এগিয়ে বসলো। বাহাত দিয়ে মেহনূরের সিক্ত গালটা ধরলো, অন্যহাতটা দিয়ে ওড়না নিয়ে গাল মুছে দিতে থাকলো মারজা। কান্নার জন্য ফুপানো ভঙ্গিতে ঠোঁট কাঁপছে, নাক বন্ধ হওয়ার কারণে ঠোঁট দিয়ে নিশ্বাস নিচ্ছে, শ্বাশুড়ির মুখপানে কান্নাবিজরিত চাহনিতে তাকিয়ে থাকলে হাসার চেষ্টা করলো মারজা,
– মা’রে, তোকে কি কাঁদার জন্য এ বাড়িতে নিয়ে এসেছি? আমার মতো বুড়িকে একটু দেখবি, সময় দিবি। তোর সংসারটা একটু-একটু করে বুঝে নিবি, আমার মাহতিমটাকে সামলাবি, এ সবই তো তোর মা।
মেহনূরকে শান্ত করার উদ্দেশ্যে মাথায় হাত বুলাচ্ছিলো মারজা। চোখের অবাধ্য জল যেনো মারজার ‘ তুই ‘ সম্বোধনে থেমে গেলো, এক টুকরো সুখ পাওয়ার মতো খুশী অনুভব করলো মেহনূর। শ্বাশুড়ির চাওয়া মতো চোখদুটো ভালো করে শেষবারের মতোন মুছলো। নিরবে সব কার্যকলাপ দেখে প্রাণভোলা হাসি দিলো মারজা, স্নেহের কোমল মায়ায় হাতদুটো বাড়িয়ে মেহনূরকে বুকে টেনে নিলো। মেহনূরের মাথাটা নিজের শূণ্য বুকটার কাছে চেপে মাথায় আদরের পরশ বসিয়ে দিলো। দুহাতে মাতৃভান্ডারের ভালোবাসা বিলিয়ে অনেকক্ষণ আগলে রাখলো। মায়ের মতোই নিখাদ স্নেহের অস্তিত্ব পেয়ে মারজাকেও হাত এগিয়ে জড়িয়ে ধরলো মেহনূর। ছোটবেলায় শেফালীর হাতে মার খেয়ে কাঁদতে-কাঁদতে মায়ের বুকটায় লুকাতো মেহনূর। মায়ের মাতৃগন্ধে গা মিলিয়ে একসময় ঘুমিয়ে পরতো। সেই মধুর দিনগুলো আর খুজেঁ পায় না মেহনূর। হাতড়ে-হাতড়ে অনেক খোঁজাখুজির পর বুঝতে পেরেছে, বয়স বাড়ার সাথে-সাথে মায়ের দেহে গা মিলানোর দিনগুলো হারিয়ে গেছে। মেহনূর যেনো ভুলেই গেলো সে এখন মারজার ছায়ায় ঢেকে আছে। মারজাকে মায়ের মতোই কাছে পেয়ে আনমনে বলতে লাগলো মেহনূর। কিছুটা ব্যথাতুর গলায় আর্দ্রমিশ্রিত কন্ঠে প্রশ্ন করলো,
– মা, আপনার সাথে যদি কম কথা বলি আপনি কি আমার উপর রাগ করবেন?
মাথায় থুতনি বসিয়ে চোখ বন্ধ করে ছিলো মারজা। ওই অবস্থায়ই শান্ত কন্ঠে উত্তর বলে দিলো,
– এখানে রাগের কি দেখলি? রাগ করবো কেন? বাবামশাই তো বলেই দিয়েছে তুই কম কথা বলিস।
শ্বাশুরির কথায় মনের সমস্ত জড়তা দূরীভূত হলো মেহনূরের। মনের মধ্যে জটপাকানো প্রশ্নটা এবার প্রস্তুত করে নিলো। মারজাকে ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে বসলো। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে প্রশ্ন করে উঠলো,
– উনি কিসে চাকরি করেন মা? আমাকে উনি আজ পযর্ন্ত উনার সম্পর্কে কিছু জানাননি। উনি আমায় বিশ্বাস করতে পারেন না। মাঝে মাঝে মনেহয় উনি আপনাকে খুশী করতে আমায় বিয়ে করেছেন। আমাকে মাফ করুন, আমি জানি এরকম কথা বলা ঠিক হচ্ছেনা, কিন্তু আমার উত্তরগুরো কেউ দেয় না মা। সবাই আমার থেকে মুখ ঘুরিয়ে রাখে। আমি কি গ্রামের মেয়ে বলে —
চট করে জিভ কামড়ে ছিঃ ছিঃ করে উঠলো মারজা। তড়িৎগতিতে মেহনূরের মুখটা হাত চাপ দিয়ে ‘ না ‘ সূচকে মাথা নাড়ালো। উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে চিন্তিত সুরে মেহনূরের উদ্দেশ্যে বললো,
– এখানে গ্রাম-ট্রাম বলে কিছু নেই। খবরদার ওসব আজেবাজে কথা মুখে আনবি না। মা’রে মাহতিম নিজেই তোকে পছন্দ করেছে। সেদিন তরুণ লম্পটের জন্য শেফালী ভাবী যখন তামাশা করলো, তখনই মাহতিম আমার কাছে এসে বিয়ের প্রস্তাব রাখতে বলেছে। ও চেয়েছিলো তুই ওর কাছেই থাক। তোর জন্য এই প্রথম ওকে ছুটির জন্য পাগলামি করতে দেখেছি। আমার কোলে মাথা রেখে কতবার যে কাকে-কাকে কল দিলো সেই হদিশ আমিও মিলাতে পারি না।
মেহনূর কৌতুহল দৃষ্টিতে তাকালো এবার। ছটফট করে উঠলো মারজার মুখে পরবর্তী কথাটা শোনার জন্য। পরের কথা যে মাহতিমের পেশা সম্পর্কীয় সেটা কিন্ঞ্চিৎ হলেও ধরতে পেরেছে মেহনূর। শ্বাশুড়িকে তাড়া দিতে যেয়ে হঠাৎ অপ্রত্যাশিত ঘটনার মুখোমুখি হলো সে। কে যেনো দরজার কাছ থেকে অনমনীয় কন্ঠে ডেকে উঠে। চকিত হড়বড় করে দরজার দিকে তাকায় দুজন, মেহনূর মানুষটাকে চিনতে না পেরে তাকিয়ে থাকলে মারজা তখন সাদরে গ্রহণ করার জন্য বিছানা থেকে নেমে যায়। দরজায় দাঁড়িয়ে আছে খুবই শৌখিন পোশাকের মহিলা। চামড়ায় এমনভাবে কৃত্রিম রঙ মেখেছে গালদুটো গোলাপী-গোলাপী হয়ে আছে। ঠোঁটে লাল রঙের ম্যাট লিপস্টিক কড়া করে দিয়েছে, পড়নে আভিজাত্য ভঙ্গির শাড়ি পরা। রঙটা সোনালীর রঙের মধ্যে ঝিলমিল করে চোখ ধাঁধাচ্ছে। ব্লাউজটা খুবই দৃষ্টিকটু লাগছে, এটা মেহনূরের কাছে কেমন লজ্জাজনক বোধ হলো। বাদামী রঙের মখমল কাপড়ের ব্লাউজটা হাতাবিহীন, তার উপর গলাটাও বেশ হা করা। শাড়ির আচঁল যদি বেখাপ্পা ভাবে সেইফটিপিন মুক্ত হয়ে যায়, তাহলে লালসাজনিত যেকোনো পুরুষেরই চলে যাবে। বেজায় ঘেন্না কাজ করছিলো মহিলাটার প্রতি। অশালীন পোশাক-আশাক পরে এই মহিলা কিভাবে চলাফেরা করে? অস্বস্তিবোধ হয়না? পুরুষালী দৃষ্টি তো গিলে-গিলে খাওয়ার কথা। মেহনূর নিজেই আর মহিলার দিকে তাকাতে পারলো না। প্রচণ্ড লজ্জা কাজ করছে মহিলার অবস্থা দেখে, মাহতিম কি এই মহিলাকে দেখতে পারে? মাহতিম যদি এই মহিলাকে প্রশ্রয় দেয় তাহলে একটুও মাহতিমের সাথে যোগাযোগ করবে না মেহনূর। ওই অসভ্য লোককে একদম সহ্য করবে না সে। মনে-মনে উদ্ভট জেদে ভষ্মীভূত হতে থাকলে চিন্তার দুনিয়ায় ছেদ কলো মারজা। চোখ তুলে সামনে তাকাতেই দেখলো ওই বেলা’ল্লাপনা মহিলা ওর দিকে হ্যান্ডশেক করার জন্য হাত বাড়িয়েছে। বাড়িয়ে দেওয়া হাতটায় দামী একটা ব্রেসলেট দেখতে পেলো মেহনূর। হাতের পাঁচটি আঙ্গুলে সমান তালে হীরে বসানো আংটি পরা তার। মেহনূর ড্যাবড্যাব করে হাতের দিকে তাকিয়ে থাকলে মহিলা এবার বাঁ ভ্রুঁ উঁচু করলো। মেহনূরের দিকে আপাদমস্তক ঘৃণ্যভাবে তাকিয়ে দেখলো। মারজা এখনো পাশে দেখে দৃষ্টি পালটালো মহিলা, ঠোঁটে মিথ্যে হাসি ঝুলিয়ে সেই হাত বাড়িয়ে মেহনূরের থুতনি ধরলো। মেহনূর তখনও উজবুকের মতো তাকিয়ে থাকলে মহিলা নিজেই তখন বলে উঠলো,
– তুমিই তাহলে মেহনূর আফরিন? দেখে ভালো লাগলো প্রিটি লেডি। আমি হচ্ছি তোমার মামী শ্বাশুড়ি। মাহতিমের একমাত্র রজনী মামী। ছেলেটা আমার সাথে দেখা করে গেলো না। আমার লাকটা কি খারাপ!
মেহনূরের থুতনি ছেড়ে এবার মারজার দিকে তাকালো রজনী ইবনাত। মেহনূর মনে-মনে তীব্রমাত্রায় রাগ অনুভব করছে, কেনো করছে তা সে নিজেও জানেনা। এদিকে সবার দৃষ্টি বাঁচিয়ে একজোড়া চোখ তখন সিসিক্যামেরার মতো কাজ করছে, অবশ্য সেটা কারো নজরে পরেনি। জানালা দিয়ে গোয়েন্দা স্টাইলে দৃষ্টি রেখে আছে মাহদি। আজ ছোট বলে নীচ থেকে সবাই আপাতত ওকেই পাঠিয়ে দিয়েছে। চোরা দৃষ্টি রাখার জন্য মাহদি চরম লেভেলের এক্সপার্ট, এ বিষয়ে মাহতিমও বলতে বাধ্য। রজনী খুব কায়দা করে মারজাকে রুম থেকে নিচে পাঠিয়ে দিলো, মা’কে বেরুতে দেখে সর্তক হলো মাহদি। নিজেকে চতুরতার সাথে আড়াল করার জন্য ছাদে থাকা চটের বস্তাটা গায়ে টেনে বসলো। মায়ের পদধ্বনি ক্রমশ কমে গেলে গা থেকে বস্তা সরালো মাহদি, মায়ের যাওয়ার দিকে হাসি দিয়ে নিজের কলারটা দাম্ভিকতার স্টাইলে দুবার টান মারলো। হাত ঝারা দিয়ে উঠে দাড়াতেই জানালা দিয়ে পুনরায় দৃষ্টি দিলো। তৎক্ষণাৎ ভেতরের দৃশ্য দেখে চিৎকার দিতে নিচ্ছিলো মাহদি! আৎকে উঠতেই মুখে দুহাত চাপা সাথে-সাথে নিচে বসে পরলো। মূহুর্ত্তের মধ্যে অস্থির হয়ে উঠলো মাহদি। দ্বিতীয়দফায় সাহস করে পাদুটো উঁচু করে জানালা দিয়ে ফের তাকালো, পূর্বের তুলনায় দ্বিগুণ মাত্রায় শিউরে উঠে ছাদের ফ্লোরেই বসে পরলো মাহদি। মাথা কাজ করছেনা ওর! ভয়ার্ত বুকটা চিপসে আসছে, কি করবে ভাবতে পারলো না। তড়িঘড়ি করে ট্রাউজারের পকেট থেকে মায়ের চুরি করা ফোনটা বের করলো, নিশ্বাসের প্রখরে হাপাতে-হাপাতে ভয়েস রের্কডই সঠিক মনে হলো। তাড়াতাড়ি হোয়াটসঅ্যাপে ঢুকে অডিও অপশনে বৃদ্ধাঙ্গুল চেপে গড়গড় করে বলতে লাগলো মাহদি,
– ভা-ভা-ভাই-য়া, আ-আ-আপু, রর-জনী মামী ব্য-থা দিচ্ছে। ররররর-ক্ত পপ-রছে। আ-মার বব-উকে ব্য-থা দি-চ্ছে, ব্য-থা দিচ্ছে….
এটুকু বলতেই কপাল-গলা ঘেমে একাকার মাহদির। এখনো অবিরামভাবে হাপাচ্ছে সে। বুকের ধড়ফড় করা জায়গায় হাত রেখে ঢোক গিলে যাচ্ছে। কোনোমতে বৃদ্ধাঙ্গুলটা অডিও অপশন থেকে সরিয়ে সেন্ড মারলো। বাচ্চাদের মতো হামাগুরি দিতে রিষ্কজোনটা কভার করতেই একদৌড়ে নিজের রুমে ঢুকলো মাহদি, দরজা আটকে বিছানায় ধপাস করে শুয়ে পরলো। বালিশে মুখ ডুবিয়ে হাপিয়ে যাচ্ছে, নিশ্বাস ওর শান্ত হচ্ছে না। এদিকে সেন্ড অপশনের জায়গায় ভুলবশত অন্যখানে ফরওয়ার্ড হয়েছে অডিওটা। যদি ফরোয়ার্ড মেসেজটা ওই ব্যক্তি সিন করে তাহলে কেমন তাণ্ডবলীলা হবে, কেউ জানে না।
– চলবে
#FABIYAH_MOMO .
মন বাড়িয়ে ছুঁই গল্পের লিংক kobitor (all part)
( # নোটবার্তা : এবার শুরু হবে । )