#ফাবিয়াহ্_মমো .
– মেহনূর প্লিজ রিসপন্স মি! মেহনূর কথা বলো, মেহনূর তুমি কি শুনতে পাচ্ছো? মেহনূর, মেহনূর কথা বলো।
একনাগাড়ে চেঁচাতে লাগলো মাহতিম। ভয়ে তার কলিজাটা কামড়ে আছে! নাজানি ওই দজ্জাল মহিলাটা খারাপ কিছু করলো নাকি! যদি কিছু করে ফেলে তাহলে এইবার একচুলও ছাড় দিবে না। মাহতিম ডেষ্কের সামনে বসে খুব দ্রুত কলটা ব্লুটুথে কানেক্ট করলো। ফোনটা মাউসের পাশে রাখতেই আরেকবার সাড়ার জন্য চেঁচিয়ে উঠলো সে, নির্যুত্তর অবস্থা দেখে যেই ইন্টারকমটা বাজাতে নিবে ওমনেই অস্ফুট ও রোগা কন্ঠ শুনতে পেলো,
– শান্ত হোন,
চূড়ান্ত মূহুর্তে থেমে গেলো মাহতিম। বুকটা এখনো ধুকপুক-ধুকপুক করছে, নিশ্বাসটা সেকেন্ডের ভেতর ভারী হয়ে গেছে। মেহনূর যে ইচ্ছে করে সাড়া দেয়নি সেটা ভেবে চরম রাগ উঠলো তার। ইন্টারকম টিপে আর নোমানকে ডাকতে হলো না। রাগে অপ্রত্যাশিত কথাটা ক্ষোভের সাথে বলতে গিয়ে তৎক্ষণাৎ চোখ বুজে ফেললো মাহতিম। রাগটা চেপে গিয়ে নিজেকে ঠান্ডা ভাবে বুঝাতে লাগলো, ‘ তোর বউ অসুস্থ, বিছানায় পরে আছে, ওর অবস্থা তোর চেয়েও খারাপ। একদম রাগ দেখাবি না, ঠান্ডা থাক। একদম ঠান্ডা থাক মাহতিম! ‘ একবুক গভীর নিশ্বাস নিয়ে রকিং চেয়ারের গায়ে পিঠ ঠেকিয়ে দিলো সে। শান্ত কন্ঠে গম্ভীর মেজাজে বললো,
– আমি যে গরুর মতো চেঁচালাম, জবাবটা দাওনি কেনো?
পুরোটা কথা শান্ত কন্ঠে বললেও তীব্র ক্ষোভটা ঠিকই প্রকাশ পেলো। মেহনূর একটু চুপ থেকে কাশতে-কাশতে বললো,
– গলাব্যথা হচ্ছে।
চোখ খুললো মাহতিম, ভ্রুঁ কুঁচকে উৎকন্ঠার সাথে জিজ্ঞেস করলো
– তোমার গলাব্যথা শুরু হয়েছে?
মেহনূর খুশখুশে গলায় বললো,
– জ্বী,
আশ্চর্য হয়ে বললো মাহতিম,
– কি আশ্চর্য! তুমিতো আমাকে এ ব্যাপারে কিছুই বলোনি।
মাহতিম অকপটে কথাটা বলে ফেললে মেহনূর একটু চুপ থাকলো। পরক্ষনে স্বর নামিয়ে মলিন কন্ঠে বললো,
– আপনি যে একবারও আমার খোঁজ নেননি। আমিতো আগের মতো হাত নাড়াতে পারিনা। এখন যে আপনার সাথে কথা বলছি, তাও বালিশের উপর লাউডে রেখে। গলাব্যথার ব্যাপার এখনো কেউ জানে না, কাউকে বলিনি।
আড়ষ্ট হয়ে গেলো মাহতিম। ইতস্তত ভঙ্গিতে নিচের ঠোঁটটায় জিভ বুলিয়ে নিলো, চোখদুটো বন্ধ করে শীতল কন্ঠে বললো,
– হাত কি খুব ব্যথা? কল কি কেটে দেবো?
ওপাশ থেকে মৃদ্যু হাসি দিয়ে বললো মেহনূর,
– হাতের অজুহাত দিয়ে পালাতে চাচ্ছেন?
ফিক করে হেসে ফেললো মাহতিম। রকিং চেয়ার থেকে উঠে রুমের লাইট নিভিয়ে দিলো। বিছানার দিকে আসতে-আসতে বললো,
– কোথায় পালিয়ে যাবো? যাওয়ার জন্য শুধু তিনটা জায়গা বেঁচে আছে। এক. যেখানে আছি সেখানে, দুই. তোমার কাছে, তিন. মাটির নিচে। আমার তো পালানোর জায়গা নেই।
দীর্ঘশ্বাস ফেললো মেহনূর, খুব সাবধানে হালকা একটা ঢোক ঠেলে আলতো গলায় বললো,
– মাঝে-মাঝে এমন কথা বলেন লজ্জায় ম-রে যাই। আর এখন কিসব বাজে কথা বলছেন। এগুলো না বললে চলে না?
বিছানায় সটান হয়ে শুয়ে পরলো মাহতিম, খোলা জানালার পর্দাগুলো টেনে দিয়ে রুম অন্ধকার করে দিলো। বালিশে মাথা ফেলে কাথা টেনে শান্ত গলায় বললো,
– ম্যাডাম,
একটুও দেরি না করে উত্তর দিলো মেহনূর,
– বলুন,
উত্তর শুনে একটু হেসে স্বাভাবিক গলায় বললো মাহতিম,
– এই জান্তব নি’ষ্ঠুরটাকে আপনার ছোট্ট বুকটায় লুকাতে দিবেন?
সাথে সাথে চোখ বন্ধ করলো মেহনূর। গ্রীষ্মের খরতপ্ত মাটির বুকে এক পশলা বৃষ্টির মতো আনন্দ অনুভব হলো। শোকাহত, রুগ্ন মন অদ্ভুত শীতলতায় আচ্ছন্ন হলো। নিগূঢ় উচ্ছ্বাসটা ব্যক্ত করে বললো,
– আসুন, আমি দুহাতের ভেতর আপনাকে লুকিয়ে-জড়িয়ে রাখবো।
এক চিলতে সুখকর হাসি ফুটলো মাহতিমের, আজ তৃপ্ত ঠোঁটে বাঁকা হাসির বদলে প্রগাঢ় হাসিটা জড়িয়ে রইলো। মেহনূরের মধ্যে আর জড়তার ছোঁয়া নেই, যতটুকু ছিটেফোঁটা অবশিষ্ট ছিলো তাও ধূলো হয়ে ঝরে গেছে। অন্ধকার রুমে অদৃশ্য ভাবে অনুভব করলো মেহনূর যেনো কাছেই আছে, যেনো দুহাতে মাহতিমের গাল ধরে সমস্ত মুখে ওষ্ঠযুগলের গাঢ়তা বসিয়ে দিচ্ছে। ফোনের দুপ্রান্তে থাকা দুটো আত্মা, দুটো মন, দুটো বিহ্বল হৃদয় নিরবতার ভেতর নিজেদের আলাপন সারছে, জানান দিচ্ছে মনের অব্যক্ত-অপ্রকাশ্য কথাগুলো। বহুক্ষণ নিরব থাকার পর মেহনূর ক্ষীণ গলায় বললো,
– আমি গ্রামে যেতে চাই না। জানি, একসময় ওটা আমার বাড়ি ছিলো। কিন্তু, আজ আমি ও বাড়ির মেহমান ছাড়া কিচ্ছু নই। ওখানে আমার সব থাকলেও আপনি নেই, মা নেই, কেউ নেই। আমি কি করে ওখানে থাকবো?
মাহতিম বিচক্ষণতার সুরে বললো,
– তুমি কি আমার কথা অমান্য করতে চাচ্ছো?
মেহনূর চট করে উত্তর দিলো,
– কোনোদিন অমান্য করেছি? করিনি। আজও করবো না। কিন্তু, এখানে সব ফেলে ওখানে কেনো যাবো বলুন?
মাহতিম আবারও কাটকাট সুরে বললো,
– তোমাকে ফেলে যেতে বলিনি। এক লাইন বেশি বুঝতে যাও কেনো? শুধু বলেছি ওখানে গিয়ে থাকো।
মেহনূর কপট বিশ্ময়ে বললো,
– থাকবো মানে?
নাছোড়বান্দার মতো প্রশ্ন শুনে কিছুটা হাপিয়ে গেলো মাহতিম। সব প্রশ্নের ‘ কিন্তু ‘ বলার সময় যে এখনো আসেনি সেটা এই বোকার মাথায় কে ঢুকাবে? মাহতিম শান্ত, স্বাভাবিক ভঙ্গিতে ব্যাপারটা সামলে নিলো। মিটিমিটি হাসি দিয়ে বললো,
– গ্রামে রোমান্সের ভাইবটা ফিউফিল পাওয়া যায় এজন্যে।
মেহনূর কথার প্যাঁচ বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করে বসলো,
– আপনি কি বলতে চাচ্ছেন ঝেড়ে বলুন তো?
মাহতিম এবার দুষ্টু-দুষ্টু হাসি দিয়ে বললো,
– বুঝো না কি বুঝাচ্ছি?
মেহনূর বুঝার জন্য কিছুক্ষণ চুপ থাকলো, একটু ভাবতেই হঠাৎ চোখের কোটর বিশাল বড়-বড় করে চেঁচিয়ে বললো,
– কেমন অসভ্য! ছিঃ মুখে আপনার একটুও লাগাম —
ওপাশ থেকে বলে চললো মেহনূর। ব্লুটুথে মেহনূরের কথাগুলো শুনতে একটুও আপত্তি লাগছে না। এভাবে মন ঝেড়ে কথা বলার মানুষটাই এতোদিন দেখতে চেয়েছিলো, লুকানো-ছুপানো মেহনূর পুরোপুরি যেনো মাহতিমের কাছে ধরা দিয়ে বসুক। গ্রামে যাওয়ার বিষয়টা নিয়ে আপাতত আর চিন্তা নেই, মেহনূর এবার নিশ্চিন্ত মনে গ্রামের ভিটায় ফিরে যাবে। অন্তত রজনীর কাছ থেকে দূরে থাকবে এটাই সবচেয়ে বড় স্বস্তির বিষয়। বিরাট পরিকল্পনার একাংশ শুধু মেহনূরকে নিয়ে চিন্তিত ছিলো, অথচ মেহনূরের জায়গায় মহড়া হলো মাহদি। এদিকেই ঠান্ডা মাথায় সুক্ষ্ম চালাকিটা সেরেছে রজনী। মাহদির মৃত্যু যে একটা দূর্ঘটনা নয়, একটা পরিকল্পিত হ’ত্যা সেটার শক্ত আলামত এখনো হাতের নাগালে পায়নি মাহতিম। তার অভিজ্ঞ মস্তিষ্ক ইতিমধ্যে ধরে ফেলেছে রজনী পেশাদার কাউকে দিয়ে কাজটা করিয়েছে। কাজটা সমুদ্রপথে এতো এতো পর্যটক এবং সাক্ষাৎ মাহতিমের নাকের নিচ দিয়ে করাটা চাট্টিখানি ব্যাপার ছিলো না। পুরো পরিকল্পনা সাজানো হয়েছে এক ভয়াবহ মস্তিষ্ক থেকে, যেটা অবশ্য রজনীর মাথা থেকে আসার সম্ভাবনা ১০০%। মাহদির প্রতি যেই মহিলা নির্ম’মতার পরিচয় দিয়ে ফেলেছে, সেখানে মেহনূরকে নাগালে রাখাটা বোকামি হবে। প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলের কাউন্সিলর পদ থেকে এখন মেয়র পদে উত্তীর্ণ হবার জন্য তোড়জোড় চালাচ্ছেন রজনী। সোজা কথা নয়, একদম সোজা কথা নয়। এই পেশাদার লোককে খুঁজে, তারপর তাকে কাজ বুঝিয়ে হায়ার করার পেছনে আরো একজনের হাত আছে। এই ‘ আরো একজন ‘ লোকটা ঠিক কে হতে পারে এটাই ধরতে পারছেনা মাহতিম। প্রথম-প্রথম সে ধরেই নিয়েছিলো রজনীকে সাহায্য করার মূলহোতা তার মিনিস্টার পদপ্রাপ্ত ভাই। লোকটা যদিও কর্কশ মেজাজের, খুবই গম্ভীর এবং স্বল্পভাষী স্বভাবের, তবুও তার বিরুদ্ধে অসংগত আচরণের তথ্য পায়নি মাহতিম। লোকেরা তার রুক্ষ মেজাজের জন্যই তাকে ভয় পায়। তার স্পষ্ট মনে আছে, অনামিকার ঘটনা তার কান পযর্ন্ত যাওয়ার পর নিজেই সব ফেলে মাহতিমের কাছে ছুটে আসেন। মাহতিমের হাত ধরে করমর্দন করে সব ঝামেলা মিটিয়ে নেন। মেয়েলী ঝামেলার জন্য মাহতিমও এসব ব্যাপারে মাটি দিয়ে ফেলে। অর্থাৎ, রজনী ইবনাতের ভাইসাব একজন সৎ লোক, সে এসবে জড়িত হবে না।
রজনীর দ্বিতীয় টার্গেট যে মেহনূর, সেটা সুস্পষ্ট। এর জন্য যত দ্রুত সম্ভব মেহনূরকে এখান থেকে বিদায় করতে হবে, পাঠাতে হবে পুরোনো ভিটেমাটির দিকে। হান্নান শেখ তার পরোক্ষ শ’ত্রু, এই শ’ত্রুতা কেবল দেশের জন্য। এতে রজনীর মতো পারিবারিক শ’ত্রুতার জের নেই। রজনীকে রাস্তা থেকে সরানোর আগে রজনীর মূল শিকড়টাকে চিনতে হবে, শিকড় না কেটে কখনোই গাছের আগা ছাঁটা যাবে না। মেহনূর এখন পুরোপুরি দেহমন এবং নিবিষ্ট অন্তঃস্থল থেকে মাহতিমের প্রতি ঝুঁকে গেছে। যেই ফাঁকটা দুজনের ভেতর জড়তা তৈরি করতো, এখন তার বিন্দুমাত্র অবশিষ্ট নেই। হান্নান শেখের কাছে পাঠানো নিয়ে একটুও বিচলিত না মাহতিম। মেহনূর এখন তার প্রতি কঠিনভাবে দূর্বল হয়ে পরেছে, এই দূর্বল দিকটা হান্নান শেখ কোনোভাবেই টলাতে পারবেনা। যদি বিড়ালের কাছে আগেভাগেই ইঁদুর পৌঁছে যায়, সেক্ষেত্রে বিড়াল কিন্তু সাথে-সাথে ঝাঁপিয়ে পরেনা, কিছুটা সময় নিয়ে কৌশলের সাথে এগোয়। মেহনূরকে হান্নান শেখের কাছে পৌঁছে দিলে সাথে-সাথে এ্যাকশনে নামবেন না হান্নান। তিনি পরিকল্পনাটা শানিয়ে নেওয়ার জন্য সময় নিবেন, এই সময়ের ভেতরই যা করার সব করে ফেলবে মাহতিম। তবে সময়টা খুবই কম পাবে মাহতিম।
হান্নান শেখ যতই পা’ষাণ-চতু’র-ভয়ঙ্ক’র লোক হোকনা কেনো, মেহনূরকে সে কিছুই করবে না। উলটো মেহনূরের গায়ে যেনো আঘা’তের আঁচ’ড় না লাগে তার জন্য মাহতিমকেই কু’পোকা’ত করতে প্রস্তুত। পারলে তিনি মাহতিমের কাছ থেকেই মেহনূরকে দূরে সরিয়ে রাখবেন। অন্ততপক্ষে রজনীর অদৃশ্য ব্যক্তির ছোবল থেকে মেহনূরকে দূরে রাখাই শ্রেয়।
চিন্তার গভীর সুড়ঙ্গ থেকে বাস্তবে ফিরলো মাহতিম। মেহনূর এখনো ফোনের ওপাশে হালকা গলায় কথা বলে যাচ্ছে। বাঁ পাশ ফিরে শুলো মাহতিম। কাথাটা বুক পযর্ন্ত ঢেকে নিয়ে ঘুম ঘুম কন্ঠে বললো,
– মেহনূর,
মেহনূর একটু থামলো। সাড়া দিয়ে বললো,
– জ্বী,
ঘুমে চোখের পাতা আপনাআপনি বুজে এলো। মাহতিম একটুও চোখ খৌলতে পারছেনা। টানা কয়েক দিনের ক্লান্ত দেহটা তন্দ্রায় ডুবো-ডুবো অবস্থা। ঘুম জড়ানো কন্ঠে সে বললো,
– সকালে ডিউটি আছে মেহনূর, কলটা রাখলে রাগ করবে?
মেহনূর হেসে দিয়ে বললো,
– করবো না।
.
শোকের ছায়াটা চোখের নিচে কালসিটে করে দিয়েছে। গালের চামড়া ভেতরে ঢুকে মুখটা এখন এইটুকুনি দেখা যায়। চোখের পানি শুকিয়ে এলেও বুকের শূন্যতা পূরণ হয়নি। এখনো শূন্য প্রান্তরটা চৌচির হয়ে খাঁ খাঁ করে। স্বামীর শেষ চিহ্ন হিসেবে ছোট সন্তানকে বুকে পিঠে মানুষ করেছেন মারজা। নিজের নির্ঘুম বহু অগণ্য রাত বিসর্জন দিয়েছেন ছেলের পেছনে। বড় ছেলের পর ছোটটার প্রতি আদরের কমতি ছিলো না, বাবার আদরটা না পেলেও বড় ভাই-ই সেটা পূরণ করে দিতো। আজ যে বাড়িটা খালি হয়ে গেছে, এই খালি ভাবটা কিভাবে কাটবে? কিভাবে বুঝ দিবে তার চন্ঞ্চল ছেলেটা আর নেই? মন তো মানে না, বেহায়া মন বারবার শুধিয়ে দেয় মাহদি কোথাও যায়নি। অথচ, পাগলের মতো দুচোখ দিয়ে খুঁজতে গেলে ঠান্ডা-নিথর-নিষ্প্রাণ চিত্রটা ভেসে উঠে। বুকটার ভেতর ঝড় উঠে যায়, সবকিছু তীব্র জলোচ্ছাসের মতো ভেঙ্গেচুড়ে শেষ হয়। চারিদিক যেনো মাহদির হাসি-হাসি কলরব মিশে আছে, আঙ্গুল ধরে-ধরে সদ্য হাঁটার স্মৃতিগুলো আজও সজীব। এইতো সেদিনই টুল ধরে-ধরে দাঁড়াতে শিখলো, এরপর হাঁটি-হাঁটি করে হাঁটতে শিখলো, এরপর ঝড়ের বেগে হুড়মুড় করে দৌঁড়াতে শিখলো। সেসব স্মৃতিরা আজ কোথায়? সাদা রঙের ওড়না টেনে চোখের উপর চেপে ধরলেন, শুকনো সুতির ওড়নাটা চোখের নোনাজল শুষে ভিজে উঠলো। কিছুক্ষণ চেপে রেখে জোরে ঘষা দিয়ে চোখটা শুকনো করতে গেলেন, কিন্ঞ্চিৎ ব্যথায় ‘ উহ্ ‘ করে ওড়নাটা চট করে সরিয়ে ফেললেন মারজা। চোখ মুছতে-মুছতে এখন চোখের আশপাশের জায়গাগুলো খসখসে হয়ে গেছে, মুছতে গেলেই এখন জ্বলে। হঠাৎ এমন সময় বিকট রিংটোনে ফোন বাজতে লাগলো, ফোন ধরার ইচ্ছাটা নিবৃত্ত করতে চাইলেও স্ক্রিনের উপর ‘ Babamoshai ‘ লেখা দেখে ধরতে গেলেন। নাক টেনে কল রিসিভ করতেই সালাম দিলেন মারজা,
– আসসালামুয়ালাইকুম বাবামশাই, কি অবস্থা? কেমন আছেন?
হান্নান শেখ কন্ঠটা মলিন করে বললেন,
– মা-রে, তোর অবস্থার কথা শুনে ভালো থাকা যায়? কি একটা খবর শোনালি। মনটাকে বিশ্বাসই করাতে পারছিনা।
মারজা এমন কথা শুনে ডুকরে কেঁদে উঠলেন। বাধ ভাঙ্গা কান্নায় নিশ্চুপ হয়ে গেলেন তিনি। হান্নান শেখ মোদ্দাকথাটা বলার সুযোগ পাচ্ছেন না। দ্রুত কথাগুলো জেনে নিলে তার জন্য সুবিধে হতো। মারজা যখন কাশির জন্য কান্না থামালন, তখন হান্নান শেখ ফাঁক মতো কথাটা বসিয়ে দিলেন,
– ও মা, কাঁদিস না। তুই কাঁদলে কি তোর ছেলেবউ ভালো থাকবে? ওকেও তো দেখতে হবে। চুপ কর, চুপ কর। চোখ মুছে ফ্যাল।
মেহনূরের প্রসঙ্গ শুনে চোখ মুছে শান্ত হলেন মারজা। ছেলের দূর্বোধ্য সিদ্ধান্তে এখনো তিনি নারাজ, নিজের মতের কথা জানান দিয়ে বিষণ্ণ-করুণ-সিক্ত কন্ঠে বললেন,
– আমি কোনো কূলকিনারা খুঁজে পাইনা বাবামশাই। আমার ছেলে যে এমন নির্দয়ের মতো কাজ করে ফেলবে কল্পনাও করতে পারিনি। এক শো’ক না কাটাতেই আরেক আঘা’ত দিয়ে গেছে। আমাকে মাফ করুন বাবামশাই, আমার ছেলের জন্য কোন্ মুখে মেহনূরের সাথে কথা বলবো খুঁজেই পাচ্ছি না।
প্রত্যাশী কথাটা শুনতে পেয়ে মনে মনে আওড়ালো হান্নান, ‘ তোর আর মুখ দেখানো লাগবে না। ওই মুখ তোর কাছেই রাখ্। ‘ রাগটা ভেতরে ঠেলে মিথ্যা কষ্টের অভিনয় ধরলেন তিনি, অসহন কন্ঠে বললেন,
– হায় রে জীবন, আমার নাতনীটার কপালে সুখী হওয়ার কপাল নেই। সবই ভাগ্য। কি ভাগ্য নিয়ে আমার নাতনীটা আসছিলো।
অসহায়ের মতো কথাটা শেষ করলেন হান্নান, যেনো ওপাশের ব্যক্তি কষ্টে বিষিয়ে উঠে। একটু থেমে এবার আসল কথায় ভিড়লেন,
– মেহনূরকে কখন পাঠাচ্ছিস মা? আমি কি আসবো?
মারজা তাড়াতাড়ি বাধা দিয়ে বললেন,
– ছিঃ ছিঃ, আমাকে মেয়ে ডেকে এখন নিজেই এতোদূর পাড়ি দিতে আসবেন? বাবামশাই, আপনার আসতে হবে না। আমি আপনার নাতনীকে সুস্থ ভাবে পাঠিয়ে দেবো। আমার ঘরের লক্ষ্মীকে অসুস্থ শরীরে পাঠাবো না।
টনটন করে কথাটা রাগের সাইরেন বাজিয়ে তুললো। হান্নান শেখের ইচ্ছা করলো ফোনের মধ্যেই একখাদা বিশ্রী কথা শোনাতে। সহ্য আর ধৈর্য্য, দুটোই যে কতকাল যাবৎ ধারণ করে আছে সেটা কে বুঝবে? এসব নাটকীয় তামাশা দেখলে তার রীতিমতো বিরক্ত লাগে। হান্নান শেখ কথা বাড়ালেন না, বাকি কথাটুকু সেরে টূপ করে কল কেটে দিলেন। এমন সাধুগিরি করে থাকাটা একটা অদ্ভুত ও দূর্লভ শিল্প, যেটা সব মানুষ সহজে পারেনা। মুখে খিলি পান পুড়ে চিবোতে লাগলেন তিনি, বিছানার তোশক আলগি দিয়ে গুপ্ত ফোনটা গুরুত্বপূর্ণ কলের জন্য বের করলেন। এবার এটাকে কাজে লাগাতে হবে। দুবার টোন যেতেই রিসিভ হলো কলটা, সতর্ক কন্ঠে একটা মেয়েলী সুর সালাম দিতেই হান্নান শেখ জবাব দিলেন,
– তোর ফোন ধরতে এতো টাইম লাগলো কেন?তোর রান্নার ঘরের গু’ষ্ঠি **। ঠিক আছে, ঠিক আছে চাপা দূরে গিয়ে মা’রবি। বাড়ির খবর দে। মাঝরাইতে মানে? মাঝরাইতে প্যাচাল পারছে? সব শুনছোস? কতক্ষণ? জানো’য়ারের বা’চ্চা কি কথা বলছে শুনোস নাই? তোরে প্রেম পিরিতির খবর দিতে বলিনাই। মেহনূর কোনখানে থাকার কথা বলছে? গ্রামে? ঠিক আছে। আচ্ছা রাখ্, ব্যাংকে সময়মতো টাকা পাবি। নাম্বার ভুল দিস না।
.
হান্নান শেখ সকাল-সকাল নাস্তা সেরেই মারজাকে কল করলেন। তখন কেবল হাত-মুখ ধোয়া মেহনূর নিস্তেজ শরীরে বিছানায় হেড সাইডে পিঠ লাগিয়ে বসে আছে, হাতের কাছে ফোন বাজতে থাকলে নার্স মহিলাটা রিসিভ করে ইয়ারফোনের ব্যবস্থা করে দিলেন। গতরাতের মতো রুম থেকে চলে যেতেই কথা শুরু করলো মেহনূর। এক কথা, দুই কথা বলতে-বলতে হঠাৎ আকস্মিকভাবে মারজা ছুটে আসলো। দরজায় নক না করে ভেতরে ঢুকলেন তিনি, তখনই দেখতে পেলেন তার বউ ইতিমধ্যে ইয়ারফোনে কথা বলছে। তাকে দেখে অবশ্য চুপ করে তাকিয়ে আছে। অপর পাশে মেহনূরের চুপটি পেয়ে মাহতিম অস্থির হয়ে উঠলে মেহনূর জানায় মা এসেছে, দাদাভাই তার সঙ্গে কথা বলতে চায়। মাহতিমও জানিয়ে দেয় সে এখন নাস্তা করছে, এই নাস্তার কথা টাইমটুকুই কথা বলার জধ্য বরাদ্দ। এরপর সে কথা বলতে পাবেনা। এদিকে মারজা হান্নান শেখের সাথে কথা চালাতে গিয়ে শেষমেশ নিরুপায় হয়ে ফিসফিসিয়ে বললো,
– ওটা রাখ মেহনূর, দ্যাখ বাবামশাই তোর সাথে কথা বলার জন্য চাপাচাপি করছে। বেশিক্ষণ বলবেনা, এই তো দুই মিনিট।
মেহনূর কি করবে বুঝতে পারলো না। মেহনূর এদিকে দুই তরীর মধ্যে পা ডূবানোর মতো ঝামেলায় পরলো। মারজা ব্যাপারটা সহজ করে দিলেন। হান্নান শেখের কলটা লাউডে দিয়ে মেহনূরকে কথা বলতে বললেন। ততক্ষণে কান থেকে ইয়ারফোন খুলে দিলো মারজা। মাহতিমের কলটাও লাউডে ফেলে দুটো ফোনই একসাথে মেহনূরের কোলে রেখে দিলেন। রুম থেকে বেরুনোর পূর্বে তিনিও মাহতিমকে কলের ভেতর ফিসফিসিয়ে দুই মিনিটের জন্য কল কাটতে বললেন। কিন্তু মাহতিম কি ভেবে যেনো কলটা কাটলো না। চুপ করে হান্নান শেখের কথাটা শুনতে লাগলো সে।
– আমি ভালো আছি দাদাভাই। র’ক্ত দেওয়ার পর এখন একটু ভালো লাগছে।
– আমার কাছে যতদিন ছিলে এমন অসুখে পরোনি। ওই ঠান্ডা থেকে হালকা-হুলকা নিউমোনিয়া হতো, হোমিওপ্যাথি ঔষধ খাওয়ালে নাই হয়ে যেতো।
– এখন তো সুস্থ আছি দাদাভাই, এখন তো কোনো সমস্যা নেই।
– অসুস্থ হলে রাত জেগো না দাদু। গলাব্যথা নিয়ে কিভাবে যে কথা বলছো। হাত মুখ ধুয়েছো? মুখে কিছু দিয়েছো?
– হাত মূখ ধুয়েছি। এখনো নাস্তা —
হঠাৎ মাহতিমের খাওয়া থেমে গেলো। মুখের খাবারটা তাড়াতাড়ি গিলে সে কলটা কেটে দিলো। যত দ্রুততার সাথে সম্ভব, সঙ্গে-সঙ্গে সৌভিককে কল লাগিয়ে বললো,
– হ্যালো সৌভিক! সৌভিক তুই আমার কথা মন দিয়ে শোন। তুই আজই, মানে আজ বিকেলের মধ্যেই মেহনূরকে নিয়ে গ্রামে যাবি। প্লিজ ‘ কেনো, কিন্তু ‘ এই মূহুর্তে জিজ্ঞেস করিস না।
সৌভিক অফিসের গাড়িতে ড্রাইভটা সাইডে পার্ক করে বললো,
– তোর কি একটু পরপর মাথা খারাপ হয়ে যায়? আজ কি করে সম্ভব? ডাক্তারই তো ওকে জার্নি করার পারমিশন দিবে না।
মাহতিম অস্থির হলেও ঠান্ডা মাথায় বললো,
– বাড়িতে গুপ্তচর ঢুকেছে সৌভিক! প্লিজ ব্যাপারটা বুঝার ট্রায় কর। কোনো অঘটন ঘটার আগেই ওকে সরিয়ে ফ্যাল।
সৌভিক এবার ভীতশঙ্কিত অবস্থায় বললো,
– তুই আনসারী নিবাসের কথা বলছিস? কিভাবে সম্ভব মাহতিম! বাড়িতে তো নীতিরা আছে শুধু! তুই কি করে বুঝলি ওখানে গুপ্তচর ঢুকেছে?
চলমান .
#FABIYAH_MOMO
মন বাড়িয়ে ছুঁই গল্পের লিংক kobitor (all part)