#ফাবিয়াহ্_মমো.
রুমের লাইট নিভিয়ে হুঁশহীন মেহনূরের দিকে এগুতে লাগলো মাহতিম। রুমটা ঘুটঘুটে অন্ধকার হলেও জানালা থেকে আগত আলোয় মেহনূরের গৌরবর্ণের মুখটা যেনো দেখা যাচ্ছে। সেদিকেই মোহাবিষ্টের মতো দুচোখ আটকে আছে মাহতিমের। কি অদ্ভুত সৌন্দর্যের মাঝে দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়ে আছে, সেটি মাহতিম প্রকাশ করতে পারছেনা। অজান্তেই পা চালিয়ে বিছানার কাছে এসে বসলো মাহতিম। তাকিয়ে দেখলো ঠোঁট ভেদ করে মৃদ্যুভঙ্গিতে নিশ্বাস ছাড়ছে মেহনূর। গালদুটো রাঙা হয়ে আছে এখনো। জ্বরের প্রকোপে কান্নার হিড়িকের মতো অনেকটা বুক ফুলিয়ে নিশ্বাস ছাড়ছে সে। গলা পযর্ন্ত কাথা দিয়ে ঢেকে রেখেছে। দীর্ঘ চুলগুলো ছেড়ে রাখার কারনে বিছানার ডানপাশ ঘেঁষে ফ্লোরে পরে আছে। চেহারার গ্লানিটুকু জ্বরের হিংস্রতায় ম্লান হয়ে গেছে ওর। চোখ বন্ধ থাকার কারনে ঘনবেষ্টিত পাপড়িগুলো অদ্ভুত মায়া জড়িয়ে চুম্বকের মতো যেনো টানছিলো। ক্রমে বিহ্বল হয়ে পরছিলো মাহতিম। ধীরে-ধীরে মেহনূরের কাছে যেয়ে বসলো সে। দৃষ্টি বিচরণ করছিলো মেহনূরের চোখ-ঠোঁট-গলার উপর। বেহায়া যাচ্ছিলো গলার সেই কালো তিলের উপর। নিশ্বাসও যেনো ভারী হয়ে আসছে এখন, বেকাবু হয়ে আসছে শরীর-মন। এখুনি এই দৃশ্যের উপর চাদর টানা প্রয়োজন। ঠিক তখনই জানালাটা বন্ধ করার জন্য উদ্যত হলো সে, মেহনূরকে দেখে আর ক্ষরণ করতে চায়না হৃদয়ে। জানালা বন্ধ করতে গিয়ে হঠাৎ মনে পরলো, যদি জানালাটা সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেয় তাহলে একেবারেই আলোহীন অবস্থা হয়ে যাবে এখন। চট করে সিদ্ধান্ত বদলে শুধু জানালার পর্দাটা টেনে দিলো। সম্পূর্ণ অন্ধকার না হলেও রুমে আবছা অন্ধকার বিরাজ করলো। মনের সকল জড়তা যেনো স্বল্প অন্ধকার পেয়ে উধাও হয়ে গেলো, হাত এনে রাখলো মেহনূরের কপালের উপর। তপ্তময় কপালে হাত রাখতে যেয়ে ধ্বক করে উঠলো বুকটা! চমকে গিয়ে তৎক্ষণাৎ হাত সরিয়ে ফেললো মাহতিম। অতি মাত্রায় আশ্চর্য হয়ে নিজের হাতের দিকে তাকালো সে। জ্বরের তাপমাত্রা এতোটা প্রবল হয়ে আছে কি করে? অনেকটা উদভ্রান্তের মতো চারপাশে তাকাতে লাগলো মাহতিম! পানি কোথায়, পট্টি কোথায় কিছুই যেনো খুঁজে পাচ্ছিলো না তখন। তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে পাশের টেবিলে লক্ষ করতেই বাটি সমেত পট্টিটা দেখতে পেলো। দ্রুতগতিতে সেটা এনে পট্টি ভিজিয়ে কপালের উপর চেপে ধরলো। মিনিট দুয়েক ওভাবেই চেপে রাখলো ভেজা সুতির পট্টিটা। হালকা মতোন গরম হয়ে এলেই আবার ভিজিয়ে নেয় সেটা। পরপর অনেকবার ভেজা পট্টি কপালে চেপে ধরলো, তারপর আবার কপালে হাত রেখে তাপমাত্রা পরোখ করলো। কিছুটা কমলেও একশোর নিচে নামেনি শিওর। মাহতিম উপায়ন্তর না পেয়ে নিরব ভঙ্গিতে নিশ্বাস ছাড়লো। মাথা কিছুটা নুয়ে মেহনূরের মাথার দুইপাশে হাত রেখে ওর মুখের উপর ঝুঁকলো। আলো-আধারির অন্ধকারে ওটুকুনি মুখটা যেনো হৃদয়ের মধ্যে দহনস্পর্শ চালিয়ে যাচ্ছে। কাছে টানার-কাছে থাকার জন্য ব্যকুল হয়ে উঠছে। অস্থিরতার তীব্র ক্লেশ কাজ করছে মনে। ওকে চোখ সয়ে দেখতে পাচ্ছিলো মাহতিম, কিন্তু নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছিলো সে। কিছুক্ষণ ওই বদ্ধ চোখের পাণ্ডুর মুখটার দিকে নিরবে তাকিয়ে কোমলমিশ্রিত শীতল কন্ঠে বলে,
– আমার সামান্য উপস্থিতি পেয়ে এমন অবস্থা হবে ভাবতেও পারিনি পুচকি। এতোটা জ্বর বাধিয়ে অসুস্থ হয়ে পরবে ভাবতেও পারিনি। বয়স তো অল্প তোমার, তবুও কেনো বড়দের মতো চলাফেরা করো? নিজেকে কেনো এতো আলাদা মতো রাখো?
কথাটুকু শেষ করতেই চোখ থেকে দৃষ্টি সরালো মাহতিম। ওর উপর থেকে যেই উঠতে নেবে গোঙানি সুরে শব্দ করলো মেহনূর। চোখের পাতা স্বল্প আকারে খুললে মুখের উপর কাউকে যেনো টের পাচ্ছিলো। অন্ধকারে মুখ স্পষ্ট দেখা না গেলেও মনের ভ্রম ভেবে বিড়বিড় করে মেহনূর বললো,
– অসভ্য একটা লোকের সামনে পরে গেছি দাদাভাই। দাদাভাই ওই অসভ্য লোকটাকে তুমি তাড়িয়ে দাও।
চোখ বন্ধ করে অচেতন অবস্থায় ঘোরের মধ্যে বিড়বিড় করছিলো মেহনূর। ওর কথা শুনে কপালে ভাঁজ ফেলে আশ্চর্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মাহতিম। ক্ষোভে বুকটা দাউদাউ করছে ওর! মেহনূর কি ওকে ছ্যাঁচড়া ভাবলো? কথাগুলো যে জ্বরের ঘোরে বলছিলো সেটা বুঝে গিয়েছে সে, তাই চুপচাপ মেহনূরের প্রলাপ শুনছে। ওর উপর থেকে একটুও সরলো না মাহতিম, ওভাবেই ঝুঁকে মেহনূরের পানে তীব্রদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। মেহনূর তখন তোতলানো সুরে কিছু বলছিলো, কিন্তু সেটা অগ্রাহ্য করে মাহতিম শক্ত কন্ঠে প্রশ্ন করলো,
– সেই অসভ্য পুরুষ কি তোমায় ছুঁয়েছে?
মেহনূর প্রশ্ন শুনে শুষ্ক গলায় ঢোক গিললো। চোখের পাতা বন্ধ এবং ঘোরের মধ্যে দূর্বল কন্ঠে উত্তর দিয়ে বসলো,
– না,
চট করে জিজ্ঞাসু ভঙ্গিতে মাহতিম ফের প্রশ্ন ছুঁড়লো,
– তাহলে?
জীর্ণ গলায় কথা বলতে আড়ষ্ট হয়ে যাচ্ছে মেহনূর। কন্ঠ নামিয়ে নিচু সুরে বললো,
– সে আমার সবকিছু দেখে ফেলেছে।
গম্ভীর ভঙ্গিতে তাকিয়ে থাকা মাহতিম, হঠাৎ এমন ভঙ্গিমার জবাব শুনে ফিক করে হেসে দিলো। উত্তরের জন্য স্বহাস্য কন্ঠে বললো,
– তাই? সে তোমার কি কি দেখেছে বলোতো?
প্রশ্নটা করতেই মেহনূর আবার চোখ খুলার জন্য বৃথা চেষ্টা করলো। কিন্তু এবারও ব্যর্থ হয়ে চোখের পাতা মুদিয়ে রাখলো। জিহবা দিয়ে ফ্যাকাশে ঠোঁট ভিজিয়ে নিচু কন্ঠে বললো,
ো
– জানিনা, আমি কিছু জানিনা।
মাহতিম ঠোঁটদুটো চেপে হাসি আটকানোর তীব্র চেষ্টায় আছে। এমন নাদান মেয়ের কাছ থেকে আজগুবি সব উত্তর শুনে মারাত্মক হাসি পাচ্ছে। ইচ্ছে করছে দূরে গিয়ে হাসিটা ঠিকমতো বের করতে, পরক্ষনে নিজেকে সামলে নিয়ে আবার ওর কপালে হাত রাখে। তাপমাত্রা আগের মতোই আছে। কপাল থেকে হাতটা যেই সরাবে ওমনেই তপ্তকর নরম হাত এসে বাধা দিলো সেখানে। মাহতিম নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলে কপাল থেকে হাত সরিয়ে দিলো মেহনূর। নিজের উষ্ণ হাতদুটোর মধ্যে মাহতিমের হাতটা আবদ্ধ করে নিলো। আঙ্গুলের ফাঁকে আঙ্গুল গুঁজিয়ে শক্ত করে ধরার চেষ্টা করলো, কিন্তু দেহে সামান্যতম শক্তি না থাকায় শক্ত করে ধরতে পারছিলো না। আঙ্গুলগুলো শক্তিহীন হয়ে মাহতিমের হাতটা ছেড়ে দিতে বসলো। মাহতিম ড্যাবড্যাব দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে থাকতেই আকষ্মিকভাবে শক্ত করে ছেড়ে দেওয়া হাতটা খপ করে ধরলো। মেহনূরের উষ্ণ আঙ্গুলের ফাঁকে নিজের আঙ্গুল গুঁজিয়ে পূর্ণমায়ায় আকড়ে ধরলো। দূর্বল নরম হাতটা শক্ত হাতের অস্তিত্ব টের পেয়ে প্রশান্ত মনে আবারও আবছা দৃষ্টিতে তাকালো। কিছুই দেখতে পেলো না। পুনরায় চোখের পাতা বুজে হাতজোড়া নিজের দিকে টানতে লাগলো। মাহতিমের একহাত তখন মেহনূরের ডানহাত আকড়ে ছিলো, আরেকহাত ছিলো ওর কানের পাশে বালিশের উপর। মাহতিম নিজেকে চূড়ান্তরূপে সংযত করার চেষ্টায় ছিলো, মেহনূরের এতোটা কাছে যেয়ে নিজের মনকে আটকানো দুঃসাধ্য ছিলো। তবুও প্রাণপণ চেষ্টায় নিয়ন্ত্রণ থাকার প্রয়াস করছিলো মাহতিম। ওই মূহুর্ত্তেই সবচেয়ে ধারণাতীত কাজটি ঘটালো মেহনূর। মাহতিমের হাতের উল্টোপিঠে নিজের লালাভ উষ্ণ ঠোঁটজোড়া রাখলো। মেহনূরের দিকে দৃষ্টি ফেলে দাঁতে দাঁত চিবিয়ে ফেললো মাহতিম। মেহনূরের কানের পাশে যে হাতটা ভর রেখেছিলো, সেই হাতটা পাঁচ আঙ্গুলে বালিশ খামচে ধরলো। বুকের ভেতর হৃদযন্ত্রটা উচ্চমাত্রায় ধড়ফড় করতে লাগলো, সারাদেহে বেগতিক হারে রক্ত ছুটতেছিলো। আবারও সেই তুফান, আবারও সেই ঝড়, বারবার সেই আকস্মিক টাইফুনে মাহতিমের ভেতরটা লন্ডভন্ড হচ্ছিলো। মেহনূর তখন হাতের উল্টোপিঠের সমস্ত জায়গায় একটু-একটু করে স্পর্শ চালিয়ে যাচ্ছিলো। নিজের অজান্তে সেই হাতটাকে নিজের অধিকার হিসেবে ফলাও করছিলো। আর এক মিনিট এই কার্যক্রম চলতে থাকলে ‘ আউট-অফ-মাইন্ড ‘ হয়ে যাবে মাহতিম! সাক্ষাৎ আগুনের সামনে বসে আছে সে। আরেকটু বাড়াবাড়ি হলে নিজেকে সে পুরোপুরি হারিয়ে ফেলবে। এই দৃশ্য যদি রের্কড করে দেখানো যেতো, তাহলে এই মেয়ে বোধহয় গলায় ফাঁস দিয়ে দম ত্যাগ করতো। মাহতিম চটজলদি ওর হাত ছেড়ে দেয়, একপ্রকার ঝটকা মেরে হাত ছাড়িয়ে নেয়। পকেট থেকে তাড়াতাড়ি ফোন করতে যেয়ে ভুলবশত পকেট থেকে কিছু ফেলে দেয়। কিন্তু তীব্র উৎকন্ঠায় জর্জরিত হয়ে সেদিকে তাকানো ভুলেই যায়। কানে ফোন লাগিয়ে যতটা সম্ভব স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টায় নিজের সুরকে তর্জমা করে। ওপাশ থেকে ফোন রিসিভ হলে মেয়েলি সুরটা কৌতুহল কন্ঠে বলে উঠে,
– ভাইয়া তুমি লাইট নিভিয়েছো কেনো? ওর রুমে লাইট নিভিয়ে কি করছো? প্লিজ তাড়াতাড়ি জবাব দাও ভাই! আই নিড এ্যাকুরেট আন্সার!
মাহতিম এমন প্রশ্ন শুনে ক্ষেপাটে ভঙ্গিতে চিবিয়ে বললো,
– তোর গালে কাটায়-কাটায় চারটা থাপ্পর মারা দরকার! মারটা পরে দিচ্ছি। আগে দেখ বাইরে কেউ আছে কিনা, ভালোমতো দেখবি। একটা কাক-পক্ষিও যেনো বাইরে ঢু না মারে।
নীতি চটপট ডানে ও বামে মুখ দেখলো, একটু সামনে বারান্দার রেলিং ধরে নিচের দিকেও দেখলো, কোথাও কেউ নেই। এবার তাহলে শান্তি। ফোনের ওপাশে আশ্বস্ত সুরে জবাব পাঠালো,
– ডানে-বায়ে, উপর-নিচে কোথাও কেউ নেই ব্রো, তুমি জলদি রুম থেকে বেরিয়ে আসো।
কয়েক সেকেন্ডের ভেতর মাহতিম নিঃশব্দে দরজা খুলে বাইরে বের হলো। নিজেও একবার সর্তক দৃষ্টিতে আশেপাশে দেখে নিলো, তারপর নীতির দিকে ইশারা করে চুপচাপ সিড়ি ধরে নেমে গেলো। মাহতিম নিজের রুমের দিকে চলে গেলে তাড়াতাড়ি কৌতুহল কমানোর জন্য মেহনূরের রুমে লাইট জ্বালালো নীতি। সবকিছু স্বাভাবিক অবস্থায় দেখে চোখ বন্ধ করে লম্বা নিশ্বাস ছাড়লো। যেনো বুকের উপর থেকে এক টন বোঝা নেমে গেলো। স্বস্তির নিশ্বাসে দরজা চাপিয়ে মেহনূরের কাছে এসে জ্বর চেক করলো। জ্বর কিছুটা কম অনুভূত হলেও মাহতিম কেনো লাইট বন্ধ করলো, সেই উত্তর পেলোনা এখনো। তাহলে কি করলো এতোক্ষন?
.
দুপুরের তেজী সূর্যটা মধ্য গগনে অবস্থান করছে। মাঠ, উঠোন, আঙিনা গরমের দাপটে খাঁ খাঁ করে উঠছে। দূরের কোনো গাছে বসে ‘ বউ কথা কও ‘ পাখিটা ছন্দ কাটছে। মাঝে-মাঝে যেটুকু হাওয়া বাড়ির মধ্যে ঢুকছে সেটাও গরমের হলকা হয়ে তেজ বাড়িয়ে দিচ্ছে। মেহনূর স্ফীত ভঙ্গিতে চোখের পল্লব খুলতেই দুপুরের প্রহরটা অনুমান করলো। এতো বেলা পযর্ন্ত কতোদিন পর ঘুমালো জানা নেই ওর। মাথাটা দুহাতে চেপে শোয়া থেকে উঠে বসলো। কিছুসময় স্থির থেকে তারপর কাথা সরিয়ে ফ্লোরে পা রাখলো। এখনো শরীরে দূর্বলতা কাজ করছে। জ্বরের প্রকোপ এখনো অনুভব হচ্ছে, তবে সেটা পূর্বের তুলনায় অনেকটা কম। ফ্লোরে পাদুটো রেখে যেই উঠতে নিবে হঠাৎ একটা জিনিসের দিকে দৃষ্টি পরলো। কপাল কুঁচকে বস্তুআর দিকে তাকিয়ে থাকতেই পাশের টেবিলের ধরে নিচে ঝুঁকলো। হাতে সেটা তুলে দেখলো একটা ডিজিটাল সিস্টেমের ঘড়ি। মেহনূরে ধীরগতিতে উঠে দাড়ালো, ভ্রুঁদুটো এখনো আগের মতোই কুঁচকানো। ঘড়িটা কালো, স্ক্রিনটা বর্গাকার। দুইপাশে কোনো বাটন না পেয়ে স্ক্রিনের উপর আঙ্গুল ট্যাপ করলো। ওমনেই লাল বাতি জ্বলে প্রথমে সময় শো করলো। এরপর স্ক্রিনটা হবহু মোবাইলের মতো হয়ে গেলো। স্ক্রিনের ওয়ালপেপার দেখে বিষ্ময়ে হা হয়ে গেলো মেহনূর। ইংরেজিতে ইটালিক অক্ষরে লিখা ছিলো ‘ M Ansari ‘. নামটার সার্নেম দেখে বুঝে গেলো ঘড়িটার মালিক মাহতিম। কিন্তু এই বস্তু ঘরে কি করে এলো সেটা ভাবতেই মাথায় হাত দিয়ে বিমূঢ় হয়ে গেলো! তারমানে মাহতিম এখানে এসেছিলো? এই রুমে, এই জায়গায় ওই অসভ্য বেহায়া লোকটা আবার এসেছিলো? প্রচণ্ড রাগে ঠোঁট শক্ত করে ভেজানো দরজার দিকে ছুঁড়ে মারলো ঘড়িটা। কাঠের দরজায় বিকট শব্দ তুলে ফ্লোরে যেয়ে পরলো সেটা। মেহনূর ক্রুদ্ধ ভঙ্গিতে শরীরের সব দূর্বলতা ভুলে চুল পেঁচিয়ে খোপা করতে লাগলো। এক্ষুনি দাদাভাইকে ডেকে শায়েস্তা করা প্রয়োজন! বেহায়া লোক কোথাকার, লজ্জা নেই, শরম নেই, বিনা অনুমতিতে রুমে ঢুকে কাহিনী করছে! একে তো বাশঁ দিয়ে তক্তা বানানো উচিত! দানবের মতো বড় শরীর বানিয়েছে, পেশি বানিয়েছে শক্ত! ইনোসেন্ট একটা এটিটিউট দেখিয়ে সবখানে দাপট দেখাচ্ছে, অথচ লজ্জা নেই একটুও! ঠাস করে চড় মেরে ইজ্জতের ফালুদা করা উচিত এই লোকটার! অসভ্য, অভদ্র কোথাকার! কে বলবে ডিসেন্ট ফ্যামিলি থেকে বিলং করে? প্রচণ্ড ক্রুদ্ধ হয়ে নিজের চারপাশ ভুলে দরজার বাইরে পা রাখলো মেহনূর। এই সময়টায় সৌভিকরা গাছতলায় বসে আড্ডা মারে। নীতিরা সেখানে পেয়ারা খেতে থাকে। বুবুরা গোসলের জন্য লাইন ধরতে থাকে, আর মা, বড়মা, ছোটমা মিলে রান্নার কাজে থাকে। দাদাভাই নিশ্চয়ই এখন পড়ার কক্ষে বই নিয়ে বসে আছে। মারজাও এখন রুমের মধ্যে শুয়ে থাকবে। আর ওই অসভ্য বদপুরুষ ইতর লোকটা ফোনের ভেতর ঘুটুরঘুটুর করবে। সব তথ্যই মেহনূর মাহদির মাধ্যমে জেনে ফেলেছে। মেহনূর দাদাভাইয়ের কাছে বিচার দেওয়ার জন্য দুহাতে শাড়ি ধরে সিড়ি দিয়ে নামে এবং একদৌড় দিয়ে পড়ার কক্ষে ঢুকে পরে। বিশাল বড় চারকোণা কক্ষটা বইয়ের রাজ্য হিসেবে বানানো হয়েছে। হান্নান শেখের সব সাহিত্য রস এখন থেকেই আস্বাদিত হয়। কক্ষের ঠিক বাম পাশে চারটা বিশাল বড় শেল্ফ, ডানপাশে দুইটা কাঠের আলমারি রাখা। মাঝখানে একটা গোল টেবিল সাজানো, সেই সঙ্গে চারটা চেয়ার রাখা। বামপাশের শেল্ফের ওখান থেকে খুটখুট শব্দ হচ্ছিলো তখন। দাদাভাই সম্ভবত বই নামাচ্ছে পড়ার জন্য। মেহনূর সেখানে এগিয়ে গিয়ে একটার-পর-একটা শেল্ফ পেরুতেই রাগত সুরে বলছিলো,
– দাদাভাই, আমি লজ্জার মাথা খেয়ে আজ বাধ্য হয়ে কিছু বলতে এসেছি। আমি কখনো চাইনি তোমার কোনো অপমান হোক। কিন্তু তোমার যেই বন্ধুর মেয়ে এখানে এসেছে, তার বড় ছেলেটা খুবই জঘন্য কাজ করেছে। আমি এসব একদমই সহ্য করতে পারিনা দাদাভাই। ওই লোকটার নাম সম্ভবত মাহতিম! লোকটা যা কাজ করেছে আমি এগুলো নিতে পারিনা! তুমিতো জানো, আমি তোমার কাছে কিছুই লুকাইনি, আজও লুকাবো না। সেদিন সবাই লিয়াকত কাকার বাড়িতে যখন গেলো, তখন ওই লোক ইচ্ছে করে আমার রুমে এসেছিলো। আমি গোসল করে শাড়ি পরছিলাম আর ওই লোক তখন,
বিদ্যুপৃষ্ঠের মতো চমকে গিয়ে প্রথম শেল্ফের কাছে দৃষ্টি আটকে গেলো! মেহনূরের ঠোঁট ‘ তখন ‘ শব্দটা বলার জন্য খুলেছিলো, সেটা ওভাবেই অটল হয়ে গেলো, আর স্বাভাবিকভাবে বন্ধ হলোনা। চোখের সামনে এমন ব্যক্তিকে দেখে হতভম্ভ হয়ে বাকবিতণ্ডা হারিয়ে ফেললো, চোখের পলকও যেন পরলোনা। উজ্জ্বলবর্ণের গা-টা উপর ডার্ক ব্লু কালারের টিশার্টে ঢাকা, ট্রাউজারটা সাদাটে রঙের অনেকটা। টিশার্টের হাতা যেনো ফেটে যাচ্ছে বাইসেপ্স মাশলগুলোর জন্য। ওমন পেশিবহুল বাহু দেখে ভয় পেলো মেহনূর। বাঘের মতো এক থাবার হাত ওগুলো। ওই হাতে যদি একটা চটকানা কেউ খায়, নির্ঘাত ‘ ওমাগো ‘ বলে দুদিন অজ্ঞান থাকবে। বাঁ ভ্রুঁটা তীক্ষ্মভাবে উঁচু করে তোলা, যেনো দৃষ্টি দিয়ে গোগ্রাসে খেয়ে ফেলবে। ঠোঁটদুটো শক্ত করে রাখা, যেনো — বাকিটুকু আর ভাবতে চাইলো না মেহনূর। চিন্তার চাকা বন্ধ করে চুপচাপ পিছাতে লাগলো। অনবরত ঢোক গিলতে-গিলতে ধীরে-ধীরে পিছিয়ে যাচ্ছিলো। তার হাতে থাকা শার্লক হোমসের বইটা যেনো ধারালো যন্ত্রের মতো লাগছিলো। কিন্তু মেহনূর পিছনে না তাকিয়ে পিছিয়ে যাওয়ার জন্য একটুও বুঝতে পারেনি সে চার নাম্বার শেল্ফের সাথে ধাক্কা খাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। মাহতিম ওর ভীতু চেহারা দেখতেই হঠাৎ শেল্ফটার দিকে নজর পরলো। কিন্তু বাধা দেওয়ার আগেই যা হওয়ার সেটা ঘটে গেলো। সেই সঙ্গে বাড়তি কাহিনী সুক্ষ্ম ঘটনা হিসেবে যুক্ত হলো, যেটা মাহতিম খেয়াল করেনি! মেহনূর অস্ফুট শব্দে ব্যথার সুরে শিউরে উঠতেই তৎক্ষণাৎ চোখ কুঁচকে ঠোঁট কামড়ে ফেললো। মাথাও নুয়ে ফেললো সাথে-সাথে। মাহতিম ওর দিকে এগুলো ঠিকই, অথচ মেহনূর ওর আগমন দেখে আর পিছালো না। মাহতিম একদম ওর সামনে এসে দাড়ালো, শার্লক হোমসের বইটা মেহনূরের ঠিক মাথার উপরে থাকা তাক-টার ফাঁকে ঢুকিয়ে বললো,
– আমাকে দেখে ভয় পাওয়ার কিছুই ছিলো না। আমি তোমাকে কিছুই করিনি। অকারণে মনের মধ্যে ভয় ঢুকিয়ে রেখেছো। আমি অতোটা অসভ্য নই, যতোটা তুমি নানার কাছে বিচার দিতে এসেছো।
মাথা উঠিয়ে উপরের দিকে তাকালো মেহনূর। সামনে দাড়ানো দানবীয় মানুষটার মুখটার দিকে দৃষ্টিপাত করার চেষ্টা ছিলো। মাহতিম বইটা তাকের ভেতরে ঠেলে দিয়ে মেহনূরের দিকে তাকালো। আর তখনই আবিষ্কার করলো মেহনূরের গাল বেয়ে অসংখ্য অশ্রুফোটা দেদারসে গড়িয়ে পরছে। ঠোঁট কামড়ে কিছু হজম করার চেষ্টা চলছে। চেহারার উপর যন্ত্রণার ছাপ লেপ্টে গেছে, যেটা কয়েক সেকেন্ড আগেও ছিলো না। প্রচণ্ড অবাক হয়ে ওর দিকেপ্রশ্ন ছুড়লো মাহতিম,
– তুমি কাঁদছো কেনো? পিঠে কি বেশি ব্যথা পেয়েছো?
মেহনূর উত্তর না দিয়ে চোখ আরো তীব্র রূপে কুঁচকে ফেললো। শেল্ফের ধাক্কা খেয়ে পিঠ এতো ব্যথা হবার কথা না। ব্যাপারটা কেমন সোজা ঠেকলো না। মাহতিম ব্যাপারটা তলিয়ে দেখতেই আপাদমস্তক যেই তাকালো, সাথেসাথে বিস্ফোরণ চাহনিতে চেঁচিয়ে উঠলো,
– ওই রক্ত কিসের? ওখান থেকে হাত সরাও!
চেঁচানো কন্ঠ শুনে একদফা শিউরে উঠলো মেহনূর। চোখ খুলে মাহতিমের দিকে তাকালো। চোখাচোখি হতেই থরথর করে কাঁপতে থাকা হাতটা কোমরের ডানপাশ থেকে সরাতে লাগলো। কাঁচা হলুদ রঙের শাড়ি পড়ুয়া মেহনূর আচঁলের নিচ থেকে হাত বের করে সামনে ধরতেই মাহতিমের দৃষ্টি স্তব্ধ হয়ে গেলো! ওর হাত টেনে দেখতেই বাকরুদ্ধ ভঙ্গিতে মাহতিম সঙ্গে-সঙ্গে ওর কোমরে হাত রাখলো। জীবনে এই প্রথম দেহের উপর অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যক্তির স্পর্শ পেয়ে সমস্ত গা শুদ্ধো কেঁপে উঠলো মেহনূর। মাটির সুগভীর পথে নিজেকে কবর দিতে ইচ্ছে করছিলো ওর! তীব্র আক্ষেপে আক্রান্ত হয়ে চোখ বন্ধ করে কেদেঁ ফেললো। হাতে ভেজা-ভেজা সিক্ত অবস্থা অনুভব করতেই মাহতিমের দৃষ্টি স্থির হয়ে গেলো। গলগল করে রক্তের স্রোতে যেনো হাত লেপ্টে যাচ্ছিলো।
– ‘ চলবে ‘
#FABIYAH_MOMO
মন বাড়িয়ে ছুঁই গল্পের লিংক kobitor (all part)
( নোটবার্তা : প্রতিক্রিয়া(রিয়েক্ট) দিবেন, মন্তব্য(কমেন্ট) করবেন, তাহলে লেখার উৎসাহ্ ও মনোবল বাড়াতে পারবো। অবশ্যই আপনাদের ভালোবাসি আমি )